নিকোল রেকর্ড
Nicole Record
নিকোল ফ্রেরেস
(Nicol Freres)
) কোম্পানির বাজারজাতকৃত রেকর্ড।
১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে নিকোল ফ্রেরেস কোম্পানি স্থাপিত হয়েছিল সুইজারল্যান্ডের জেনেভা
নগরে। এরা শুরুর দিকে স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিক বাদ্যযন্ত্র
(musical Box)
তৈরি করতো। পাশাপাশি নানা কোম্পানির তৈরিকৃত
বাদ্যযন্ত্রের ডিলারও ছিল। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে লণ্ডনে এদের একটি শাখা অফিস চালু হয়।
ধীরে ধীরে লণ্ডনের এই অফিস প্রধান অফিসে পরিণত হয়। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে এটি লিমিটেড
কোম্পানিতে পরিণত হয়। তখন এর নামকরণ করা হয় নিকোল ফ্রেস লিমিটেড
Nicol
Freres Ltd
।
রেকর্ডের বাজার সম্প্রসারিত হওয়ায়, এরা প্রথম শব্দধারণ করার কার্যক্রম
হাতে নেয়। একই সাথে এরা এডিশন ফনোগ্রাফ্স্, গ্রামোফোন এবং জেনোফোন টকিং মেশিন এবং সকল ধরনের
রেকর্ড বিক্রয় করা শুরু করে। এরপর এরা নিজেদের কারখানায় রেকর্ড তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে নিকোল ফ্রেরেস
লিমিটেড প্রথম নিজেদের তৈরি করার উদ্যোগ নেয় এই সূত্রে এরা ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা জুলাই
প্রতিষ্ঠা করে 'The Nicol Record Co. Ltd.
।
এদের নতুন প্রতিষ্ঠানের অফিস স্থাপিত হয় লণ্ডনের ১৪৭-১৫০ গ্রেট স্যাফ্ফ্রোন
স্ট্রিট-এ। এদের প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৩
খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে।
১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসের ভিতরে নিকোল ফ্রেরেস
লিমিটেডের মাধ্যমে এরা প্রায় ১৫০টি এক-পার্শ্বীয়
ডিস্ক রেকর্ড বাজারে ছাড়ে। এই রেকর্ডগুলো তৈরি হয়েছিল লালাভ বাদামি ল্যাকুয়ার্ড
কার্ডবোর্ডর দিয়ে। এর উদ্ভাবন করেছিলেন কোম্পানির দুই ডিরেক্টর - জর্জ হেনরি বার্ট এবং
কার্ল ক্রইগর। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে এই কোম্পানির
পরিচালকের হিসেবে যোগদান
করেছিলেন জন ওয়াটসন হড। উল্লেখ্য, গ্রামোফোন এ্যান্ড টাইপরাইটার
লিমিটেড কলকাতায় শাখা অফিসের প্রথম ম্যানেজার ছিলেন জন ওয়াটসন হড। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে
তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যান এবং উক্ত কোম্পানি থেকে পদত্যাগ করেন। এর কয়েক মাস পরে
তিনি নিকোল রেকর্ড কোম্পানির পরিচালকের পদ গ্রহণ করেন। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ
মাসে হড নিকোল রেকর্ড কোম্পানির পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে
তিনি ভারতে রেকর্ড ব্যবসার বাজার
যাচাইয়ের জন্য জন ওয়াটসন হড ভারতে আসেন। সাথে ছিলেন নিকোল রেকর্ড বিশেষজ্ঞ আমেরিকান
গায়ক স্টেফেন কার্ল পোর্টার (১৮৬৪-১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দ)। উল্লেখ্য, স্টেফেন কার্ল
রেকর্ডিং অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন নিউইয়র্কের
কলাম্বিয়া
রেকর্ড
কোম্পানিতে। এছাড়া
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানিতে রেকর্ডিং-এর সাথে তিনি বিভিন্ন
সময়ে যুক্ত ছিলেন।
এই সময় তিনি রেকর্ডে কিছু গানও গেয়েছিলেন। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লণ্ডনে এসেছিলেন
রেকর্ডিং সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। লণ্ডনে তিনি প্রথম রেকর্ডিং-এর কাজ করেন
ওয়াটারফিল্ড, ক্লিফফ্ফোর্ড এন্ড কোম্পানি লিমিটেড-এ। স্টেফেন কার্ল পোর্টার নিকোল
কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়ে কলকাতায় এসেছিলেন আরও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য।
পোর্টার এবং হড কলকাতার ৩-৪ কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটে একটি বাসা ভাড়া করেন এবং এখানেই
অস্থায়ী অফিস খুলে বসেন। এঁরা প্রথম দিকে নিকোল কোপম্পানির রেকর্ড এবং ' নিকলোফোন'
মেশিন বিক্রয় শুরু করেন। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে মানিকলাল সাহা নিকোল ফ্রেরেস লিমিটেডের
প্রথম এজেন্ট হন।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে হড লণ্ডনে ফিরে যান। এই সময় পোর্টার তাঁর
রেকর্ডিং-এর কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। পুরো বছর ধরে তিনি ভারতীয় ভাষার বিভিন্ন কথন
শৈলী ও গানের প্রায় ৭ শত রেকর্ড করেন।
ভারতীয় সঙ্গীতের তালিকায় ছিল বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, তামিল,
তেলেগু ভাষার গান। এরপর তিনি তিনি বার্মাতে রেকর্ডিং-এর কাজ
করেন। এরপর তিনি লণ্ডন হয়ে আমেরিকা চলে যান। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের
ভিতরে নিকোল রেকর্ড একটি বিশেষ অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।
কলকাতায় এই রেকর্ড কোম্পানি নিকোল ফ্রেরেস (ইন্ডিয়া) লিমিটেড
[Nicol Freres (India) Ltd]
নামে প্রতিষ্ঠিত
হয়েছিল। এই কোম্পানির রেকর্ড আত্মপ্রকাশ করেছিল ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে
সেপ্টেম্বর। ভারতীয় এই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার এ্যাডলফ মুহলবার্গ কলকাতায় আসেন এবং
কলকাতার ২/১-২-৩ কর্পোরেশন স্ট্রিট একটি অফিস খোলেন। কিন্তু কোম্পানির
অন্তর্দ্বন্দ্বে এই প্রচেষ্টা ততটা ফলপ্রসু হয় নি। ইতিমধ্যে এই কোম্পানির প্রধান
অংশীদার এই কোম্পানি অধিগ্রহণ করেন এবং উত্তর ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টারের
নিকটবর্তী স্টকপোর্টে কার্যক্রম স্থানান্তরিত করেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের
৩রা মার্চ তাঁর এই কোম্পানি
Watson Hawd and Co
নামে
আত্মপ্রকাশ করে। এই প্রতিষ্ঠান
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে জুন থেকে, নিকোল ফ্রেরেসের সাথে তাঁদের কারখানায় রেকর্ড
তৈরি শুরু করে। এই সময় এরা নিয়মিতভাবে ভারতের নিকোল রেকর্ডকে রেকর্ড সরবরাহ করতে
থাকে। এই বৎসরে তারা দ্বিপার্শীয় নিকোল রেকর্ড প্রকাশিত হতে থাকে।
ভারতে নিকোল রেকর্ড কোম্পানি ভালোভাবে চললেও, লণ্ডনস্থ নিকোল ফ্রেরেসের লিমিটেডের
অফিসে প্রশাসনিক ও আর্থিক সমস্যা দেখা দেয়। ফলে ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে
কোম্পানিটি বন্ধ করে দেয়। এই সময় ভারতে নিকোল রেকর্ড
কোম্পানি ভালোভাবে চললেও, লণ্ডনস্থ নিকোল ফ্রেরেসের লিমিটেডের অফিসে প্রশাসনিক ও
আর্থিক সমস্যা দেখা দেয়। ফলে কোম্পানিটি বন্ধ করে দেওয়া।
এই সময় জন ওয়াটসন হড
নেকোল রেকরড কোম্পানির বেশরিভাগ স্বত্ব কিনে নেন। এই সূত্রে তিনি রেকর্ড উৎপাদক
কারখানা এবং রেকর্ড ব্যবসা অধিকার করেন। এরপর তিনি তাঁর নতুন ব্যবসার অফিস উত্তর
ইংল্যান্ডের ম্যান্চেস্টারের নিকটবর্তী স্টকপোরর্টে স্থানান্তর করেন।
৩রা মার্চ তাঁর নিকোল ফ্রেরেস (ইন্ডিয়া) লিমিটেডের
মান্যেজার এ্যাডলফ মুহলবার্গ এবং ওয়াটসন হড
কোম্পানি Watson Hawd and Co
নামে নামে নতুন কোম্পানি চালু করেণ। ১৯শে
জুন থেকে এই প্রতিষ্ঠান নিকোল ফ্রেরেসের সাথে তাঁদের
কারখানায় রেকর্ড তৈরি শুরু করে।
এই নতুন কোম্পানির ঠিকানা ছিল- ওয়েলিংটন মিলস, ওয়েলিংটন রোড, স্টোকপোর্ট। এই
কোম্পানি ভারতে
কোম্পানি নিকোল ফ্রেরেস (ইন্ডিয়া)-এর
কাছে রেকর্ড সরবরাহ করা শুরু করে।
|
|
গোড়ার দিকে এরা একপার্শ্বিক রেকর্ড
প্রকাশ করতো। রেকর্ডের উপরে রুপালি রঙের কালিতে সরাসরি রেকর্ডের পরিচয় মুদ্রিত হতো।
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এরা দ্বিপার্শ্বিক রেকর্ড প্রকাশ শুরু করে। এই রেকর্ডের
লালা কাগজের উপর কালো কালিতে ছাপানো লেবেল লাগানো হতো।
ইংল্যান্ডে
নিকোল ফ্রেরেস (ইন্ডিয়া) লিমিটেড
এবং নিকোল রেকর্ড কোম্পানি পুরোপুরি ধ্বসে পড়লেও ভারতের নিকোল ফ্রেরেস (ইন্ডিয়া)
রেকর্ডের ব্যবসায় সাফল্য লাভ করেছিল। এই সাফল্যের পিছনে বিশেষ অবদান ছিল কলকাতার
রেকর্ড ব্যবসায়ী মানিক লাল সাহা। উল্লেখ্য, ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে মানিকলাল সাহা
নিকোল ফ্রেরেস লিমিটেডের প্রথম এজেন্ট হয়েছিলন।
তাঁর অফিস ছিল কলকাতার ২৩/৫ ধর্মতলার স্ট্রিটে। তিনি পূর্ব-ভারতের রেকর্ডের অন্যতম
পাইকারি ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি নিকোল রেকর্ডের ব্যবসা
চালিয়ে গিয়েছিলেন।
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ ভারতে নিকোল রেকর্ডের সোল এজেন্ট হয় এম.তারা
এন্ড কোং। এদের অফিস ছিল মাদ্রাজের ৫ ব্রডওয়ে এবং ১৮৬ এসপ্লানেড। পশ্চিম ভারতের
নিকোল রেকর্ড একটি শাখা অফিস খোলে বোম্বাইয়ের ৩৭ পারসি বাজার স্ট্রিটে। তখন বার্মার
রেকর্ড বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ হতো কলকাতা থেকে।
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে এই
কোম্পানি ভারতে প্রায় ৬০০ রেকর্ড বাজারে ছাড়তে সক্ষম হয়েছিল। এই রেকর্ডের ভিতরে ছিল
বাংলা, হিন্দি, তামিল, তেলেগু গুজরাটি ভাষার গান এবং যন্ত্রসঙ্গীত। এছাড়া কোরান
তেলাওয়াত ও সংস্কৃত মন্ত্র রেকর্ড প্রকাশ করেছিল।
জন ওয়াটসন হড
ধীরে ধীরে তাঁর কোম্পানির মাধ্যমে বিভিন্ন ছোট ছোট রেকর্ড কোম্পানির রেকর্ড
প্রকাশের সাথে যুক্ত হয়ে যান। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত দ্যা ব্রিটিশ সোনোগ্রাম
কোম্পানি লিমিটেড এবং হডের কোম্পানি একীভূত হয় এবং ডিস্ক রেকর্ড কোম্পানির রেকর্ড
তৈরিতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। ব্রিটিশ সোনোগ্রাম কোম্পানির
'THE
SOVEREIGN RECORD' নিজেদের
উদ্যোগে তৈরি হওয়া শুরু করে লণ্ডনে। নিকল রেকর্ড নামে এরা প্রায় এক শত দ্বিপার্শীয়
রেকর্ড বাজারজাত করে। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দর ভারতীয় নিকল কোম্পানির কলকাতা অফিস বন্ধ
হয়ে যায়। এই সময় থেকে এদের ব্যবাসয়িক কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে বোম্বে থেকে।
১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগে এদের কার্যক্রম বেশ কমে যায়। এই সময় এরা নতুন রেকর্ড
প্রকাশের পরিবর্তে পুরানো রেকর্ড বিক্রয়ের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এই সময় এই
কোম্পানি মূলত চলতো কর্মচারীদের দ্বারা। আর এরা এই ব্যবসা করতো
McClean Atmaran
and Co.
-এর মাধ্যমে। এরপর ধীরে
ধীরে নিকল রেকর্ড এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যায়।
সূত্র: