অক্ষর
ইংরেজি :
Syllable।
সাধারণ অর্থে বাংলাতে 'অক্ষর' শব্দটির বর্ণের
(letter)
সমার্থক শব্দ হিসাবে বিবেচিত হয়। সত্যিকার অর্থে আটপৌরে বাক্যালাপে 'অক্ষর' শব্দটাই
বেশি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ধ্বনি তত্ত্বে 'অক্ষর' পৃথক একটি অর্থ বহন করে। কথা বলার
সময় বড় ধরনের বিরাম পাওয়া যায় দাঁড়ির পরে। অল্প বিরামের জন্য ব্যবহার করা হয় কমা,
সেমিকোলন। কিন্তু একটি পুরো বাক্যের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, বাক্যের অন্তর্গত
শব্দগুলোর ভিতরেও কমা, সেমিকোলন ইত্যাদির বিচারে প্রাপ্ত বিরাম ছাড়া আরও বিরাম আছে।
কথা বলা বা শোনার সময় প্রতিটি শব্দকেই নিরেট মনে হয়। অর্থাৎ শব্দের ভিতরে ধ্বনিগত
কোনো ফাঁক-ফোকর খুঁজে পাওয়া যায় না। ধ্বনিবিজ্ঞানীরা শব্দের ব্যাপারে এইভাবে
সন্তুষ্ট হতে পারেন না। শব্দকে খুব ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে, তাঁরা ফাঁক-ফোকর বেশ
ভালোভাবেই শনাক্ত করতে পারেন। যেমন- 'হাল্কা'। সাদামাটাভাবে শুনলে মনে হবে এর ভিতরে
কোনো ফাঁক নেই। কিন্তু ভালোভাবে বিচার করলে দেখা যাবে- 'হাল্কা' শব্দটি উচ্চারণে
বক্তা উচ্চারণ করেন—
হাল্+ কা হিসাবে। অর্থাৎ 'হাল্; বলার পর ধ্বনি থেমে যায় এবং এর পরে 'কা' উচ্চারিত
হয়। কিন্তু 'হাল্কা' শব্দটি এত চর্চিত অভ্যাসে এত দ্রুত উচ্চারণ করা হয় যে, এর
ভিতরের বিচ্ছিন্নভাবটা আছে বলে মনে হয় না।
ইংরেজি ভাষা অক্ষরের প্রতিশব্দ syllable। প্রাচীন গ্রীক συλλαβή শব্দ থেকে ইংরেজি সিলেবল শব্দ গৃহীত হয়েছে। যাঁরা বাংলা কাব্যের ছন্দের বিচার করেন, তাঁরা অক্ষরকে ভিন্ন ভিন্ন নামে চিহ্নিত করেছেন। যেমন— অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেন 'অক্ষর' –কে 'দল' নামে অভিহিত করেছেন। আবার কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এর নামকরণ করেছিলেন 'শব্দপাপড়ি'। মূলত শব্দের ক্ষুদ্রতম ধ্বনি একক, যা একটি শ্বাসাঘাতে সৃষ্টি হয়। এর ধরন অনেকটা রূপমূলের (morpheme) মত। উভয়ই একটি শ্বাসাঘাতে উচ্চারণযোগ্য, কিন্তু রূপমূলের অর্থ আছে। পক্ষান্তরে অক্ষরের অর্থ থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে।
একটি শ্বাসাঘাতে উচ্চারণযোগ্য ক্ষুদ্রতম ধ্বনি একক যদি অক্ষর হয়, তাহলে প্রশ্ন হলো- এই এককের সীমারেখা কিভাবে নির্ণয় করা হবে। প্রকৃতপক্ষে উচ্চারণযোগ্য ধ্বনিগুলোর মূল একক হল— বর্ণ। এর ভিতরে স্বরধ্বনিগুলো স্বাধীনভাবে উচ্চারণ করা যায়। কিন্তু স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়া ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণ করা অসম্ভব। অবশ্য একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনি দিয়ে যে যুক্তধ্বনি তৈরি হয়, সেখান আদ্য ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ পাওয়া গেলেও শেষ পর্যন্ত স্বরধ্বনির দ্বারাই তার মুক্তি ঘটে। যেমন- ক্ল। এখানে ‘ক’-এর ধ্বনি রূপ স্বরধ্বনি ছাড়াই পাওয়া যায় বটে, কিন্তু ক্+ল্ উচ্চারণের সাথে স্বরধ্বনি যুক্ত না করলে কোন ধ্বনিরই মুক্তি ঘটবে না।
স্বরধ্বনি স্বাধীনভাবে উচ্চারিত হয় এবং ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে স্বরধ্বনি প্রাণ-ধ্বনি হিসাবে কাজ করে। এই ধারণা থেকে যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যায়, তা হলো— অক্ষরের জন্য স্বরধ্বনি কেন্দ্রীয় ধ্বনি হিসাবে কাজ করে। ধ্বনিবিজ্ঞানে একে বলা হয়, অক্ষরকেন্দ্র (syllable nucleus)। অক্ষরের ধ্বনির গুণগত মান বিচার করলে দেখা যায়, ব্যঞ্জনধ্বনির চেয়ে স্বরধ্বনি অনুরণন অপেক্ষাকৃত বেশী। এই কারণে অক্ষরে স্বরধ্বনিকে কখনো কখনো অক্ষর শীর্ষ (peak) এবং ব্যঞ্জনধ্বনিকে অক্ষর পাদদেশ (valley) বলা হয়।
স্বরধ্বনি এককভাবে একটি অক্ষর তৈরি করতে পারে। কিন্তু ব্যঞ্জনধ্বনির সাহায্যে অক্ষর তৈরি হলে তার আগে বা পরে স্বরধ্বনি যুক্ত হবে। যদি ব্যঞ্জনধ্বনিটি অক্ষরের শুরুতে থাকে, তবে তাকে বলা হবে অক্ষরাম্ভ (onset), আর ব্যঞ্জনধ্বনিটি পরে থাকলে তাকে বলা হয় অক্ষারান্ত (coda)। ব্যঞ্জনধ্বনিযুক্ত অক্ষরে একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত হয়ে ব্যঞ্জনগুচ্ছ তৈরি করতে পারে। তবে এর সাথে অবশ্যই স্বরধ্বনি থাকবে। এই সকল বিচারে বাংলাভাষার অক্ষরকে প্রাথমিকভাবে চারটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
১. অক্ষরকেন্দ্র
(syllable nucleus)
: এক্ষেত্রে শুধু মাত্র স্বরধ্বনি দিয়ে একটি অক্ষর তৈরি হয়।
যেমন—
অ, আ, ও ইত্যাদি।
২. অক্ষারম্ভ ব্যঞ্জন (onset):
এক্ষেত্রে ব্যঞ্জনধ্বনির পরে স্বরধ্বনি যুক্ত থাকবে।
যেমন—
মা =ম্ +আ।
৩. অক্ষরান্ত ব্যঞ্জন (coda)
: এক্ষেত্রে ব্যঞ্জনধ্বনির আগে স্বরধ্বনি যুক্ত থাকবে।
যেমন—
আম =আ +ম্।
৪. অক্ষারম্ভ-অক্ষরান্ত (onset-
nucleus- coda) : এক্ষেত্রে স্বরধ্বনির
উভয় পার্শ্বে ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত থাকতে পারে।
যেমন—
গান= গ্+আ+ন্।
ধ্বনিবিজ্ঞানীরা অক্ষরের এই বিন্যাসকে সঙ্কেত দিয়ে প্রকাশ করে থাকেন। এই সঙ্কেত হল-
স্বরধ্বনি
(Vowel) =V
ব্যঞ্জনধ্বনি
(Consonant) =C
এই বিচারে উপরের চারটি সূত্রের উদাহরণগুলোকে যেভাবে প্রকাশ করা হবে, তা হল-
১. অ = V
২. মা (ম্ +আ)=
C V
৩. আম (আ +ম্) =
VC
৪. গান (গ্ +আ +ন্)
= CVC
উপরের এই বিভাজনটি করা হয়েছে মূলত স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির সরল বিন্যাস অনুসারে।
এই বিন্যাসে জটিলতার ছায়া পড়ে, ভিন্নতর পথ ধরে। যেমন—
যাওয়া, যাওয়াই। এক্ষেত্রে জটিলতা হলো—
একাধিক স্বরবর্ণের। পক্ষান্তরে ক্লান্ত, প্রাণ ইত্যাদি শব্দের জটিলতা হলো—
একাধিক ব্যঞ্জনবর্ণের।
পাশাপাশি একাধিক
ব্যঞ্জনবর্ণযুক্ত অক্ষর
বাংলা কোনো কোনো অক্ষরে পাশাপাশি একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
যেমন—
প্রাণ = প্+র্+আ +ণ্=
CCVC
এইভাবে পাশাপাশি একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনির সম্মিলনকে বলা হয়—
ব্যঞ্জনগুচ্ছ (consonant cluster)।
এই ব্যঞ্জনগুচ্ছ শব্দের আরম্ভে বা শেষে হতে পারে। তবে বাঙলাতে অক্ষারম্ভ
ব্যঞ্জনগুচ্ছ (onset consonant
cluster) বেশি দেখা যায়। শব্দের শেষে
ব্যঞ্জনগুচ্ছের সংখ্যা খুবই কম। যেমন—
'কৃচ্ছ্র' শব্দের শেষ অক্ষরটি 'ছ্র' এবং তা গঠিত হয়েছে =ছ্+র্ ব্যঞ্জনধ্বনি নিয়ে ।
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত ব্যঞ্জনগুচ্ছ হতে পারে দুই বা তিনটি ব্যঞ্জনধ্বনির বিচারে। এর
ভিতরে দ্বি-ব্যঞ্জন গুচ্ছের সংখ্যা সর্বাধিক। ত্রি-ব্যঞ্জনগুচ্ছ পাওয়া যায় বাংলায়
ব্যবহৃত বিদেশী শব্দে। 'র-ফলা'-যুক্ত অক্ষর এবং ঋ-কার-যুক্ত অক্ষরের উচ্চারণ
প্রকৃতি কাছাকাছি। ঋ-কার-যুক্ত অক্ষরের শেষে 'ই' ধ্বনির আগম হয়, কিন্তু 'র'
ব্যঞ্জনধ্বনি হিসাবে স্বীকৃতি পায়। নিচের সারণীতে ব্যঞ্জনগুচ্ছের তালিকা তুলে ধরা
হল।
মূল ধ্বনিসমূহ |
যুক্তধ্বনি |
দ্বি-ব্যঞ্জনগুচ্ছ |
ত্রি-ব্যঞ্জনগুচ্ছ |
উদাহরণ |
ক্ +ঋ |
কৃ |
CCV |
|
কৃত |
ক্ +র |
ক্র |
CC |
|
ক্রম |
ক্+ল |
ক্ল |
CC |
|
ক্লান্ত |
খ্ +ঋ |
খৃ |
CCV |
|
খৃষ্ট |
খ্ +র |
খ্র |
CC |
|
খ্রিষ্টাব্দ |
গ্ +ঋ |
গৃ |
CCV |
|
গৃহ |
গ্ +র |
গ্র |
CC |
|
গ্রহ |
গ্+ল |
গ্ল |
CC |
|
গ্লানি |
ঘ্ +ঋ |
ঘৃ |
CCV |
|
ঘৃত |
ঘ্ +র্ |
ঘ্র |
CC |
|
ঘ্রাণ |
ছ+র্ |
ছ্র |
CC |
|
কৃচ্ছ্র |
জ্+ঋ |
জৃ |
CCV |
|
জৃম্ভণ |
ট্ +র |
ট্র |
CC |
|
ট্রাম |
ড +র |
ড্র |
CC |
|
ড্রয়ার |
ত্ +ঋ |
তৃ |
CCV |
|
তৃপ্ত |
ত্ +র |
ত্র |
CC |
|
ত্রাণ |
দ্ +ঋ |
দৃ |
CCV |
|
দৃপ্ত |
দ্ +র্ |
দ্র |
CC |
|
দ্রব্য |
ধ্ +ঋ |
ধৃ |
CCV |
|
ধৃত |
ধ্ +র |
ধ্র |
CC |
|
ধ্রুব |
ন্ +ঋ |
নৃ |
CCV |
|
নৃত্য |
প্+ঋ |
পৃ |
CCV |
|
পৃথিবী |
প্+র |
প্র |
CC |
|
প্রথম |
প্+ল |
প্ল |
CC |
|
প্লাবন |
ফ্ +র |
ফ্র |
CC |
|
ফ্রক |
ফ্+ল |
ফ্ল |
CC |
|
ফ্লানেল |
ব্ +ঋ |
বৃ |
CCV |
|
বৃত্তি |
ব্+র |
ব্র |
CC |
|
ব্রত |
ব্ +ল |
ব্ল |
CC |
|
ব্লক |
ভ্+ঋ |
ভৃ |
CCV |
|
ভৃত্য |
ভ্ +র |
ভ্র |
CC |
|
ভ্রাতা |
ভ্ +ল |
ভ্ল |
CC |
|
ভ্লাদিমির |
ম্ +ঋ |
মৃ |
CCV |
|
মৃত |
ম্+র |
ম্র |
CC |
|
ম্রিয়মান |
ম্+ল |
ম্ল |
CC |
|
ম্লান |
শ্ +ঋ |
শৃ |
CCV |
|
শৃগাল |
শ্+র |
শ্র |
CC |
|
শ্রাবণ |
শ্ +ল |
শ্ল |
CC |
|
শ্লথ |
ষ্ +ট |
ষ্ট |
CC |
|
ষ্টোর |
স্ +ঋ |
সৃ |
CCV |
|
সৃষ্টি |
স্ +ক |
স্ক |
CC |
|
স্কন্ধ |
স্ +ক্ +র |
স্ক্র |
|
CCC |
স্ক্রুপ |
স্ +খ |
স্খ |
CC |
|
স্খলন |
স্ +ট |
স্ট |
CC |
|
স্টক |
স্ +ট্ +র |
স্ট্র |
|
CCC |
স্ট্র-বেরি |
স্ +ত |
স্ত |
CC |
|
স্তূপ |
স্ +ত্ +র |
স্ত্র |
|
CCC |
স্ত্রী |
স্ +থ |
স্থ |
CC |
|
স্থান |
স্ +ন |
স্ন |
CC |
|
স্নান |
স্ +প |
স্প |
CC |
|
স্পর্শ |
স্ +প্ +ঋ |
স্পৃ |
|
CCCV |
স্পৃহা |
স্ +প্ +র |
স্প্র |
|
CCC |
স্প্রিং |
স্ +ফ্ |
স্ফ |
CC |
|
স্ফোটন |
স্ +ম্ +ঋ |
স্মৃ |
CCV |
|
স্মৃতি |
স্ +র |
স্র |
CC |
|
স্রাব |
স্ +ল |
স্ল |
CC |
|
স্লোগান |
হ্ +ঋ |
হৃ |
CC |
|
হৃদয় |
হ্ +র |
হ্র |
CC |
|
হ্রদ |
হ্ +ল |
হ্ল |
CC |
|
হ্লাদিনী |
যৌগিক স্বরধ্বনি-তে অক্ষর নিরূপণ:
একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনি নিশ্বাসের একটি ধাক্কায় উচ্চারিত হয়ে যেমন ব্যঞ্জনগুচ্ছ
তৈরি করে, তেমনি ভাবে একাধিক স্বরধ্বনির উচ্চারণের প্রক্রিয়াকে বলা হয়
যৌগিকস্বর ধ্বনি। স্বরধ্বনির সংখ্যার বিচারে যেভাবে ধ্বনিমান বিবেচনা করা হয়ে
থাকে, তা হলো—
একক স্বরধ্বনি
(Monophthong): যে সকল
ধ্বনি একটি মাত্র স্বরধ্বনি নিয়ে গঠিত হয়ে থাকে। যেমন—
এ
=V
দ্বি-যৌগিক স্বরধ্বনি
(Diphthong)
: দুটি স্বরধ্বনি এক নিশ্বাসের ঝোঁকে
উচ্চারিত হয়। যেমন—
ওই=
VV
।
ত্রি-যৌগিক স্বরধ্বনি
(Triphthongs)
: তিনটি স্বরধ্বনির সমন্বয়ে তৈরি কৃত অক্ষর। যেমন—
ছাওয়া =ছ্ +আ +ও +য়া= C + (VVV)।
চতুঃ-যৌগিক স্বরধ্বনি
(Tetraphthongs)
: চারটি স্বরধ্বনির সমন্বয়ে তৈরি কৃত
অক্ষর। যেমন—
হওয়াই = হ্ +অ +ও+আ+ই =
C + (VVVV)।
পঞ্চ-যৌগিক স্বরধ্বনি
(Pentaphthongs) :
পাঁচটি স্বরধ্বনির সমন্বয়ে তৈরি কৃত অক্ষর। যেমন-
খাওয়াইও =খ্+আ+ও+আ+ই+ও =
C + (VVVVV)।
একাধিক স্বরধ্বনি পাশাপাশি উচ্চারণ করতে গিয়ে, বাগ্-প্রত্যঙ্গে সামান্য
অস্বস্তি সৃষ্টি হয়। এই অস্বস্তি দূর হয় স্বতস্ফূর্তভাবে দুটি স্বরধ্বনির
মাঝখানে কিছু অস্পষ্ট ধ্বনি উচ্চারিত হয়। এই ধ্বনিগুলো শ্রোতার বা বক্তার
কাছে অস্পষ্ট থেকে যায়। এই অস্পষ্ট ধ্বনিগুলো পরবর্তী স্বরবর্ণের সাথে যুক্ত
হয়ে প্রকাশিত হয়। এই ধ্বনিগুলো প্রকৃত অর্থেই যৌগিক স্বরধ্বনির মধ্যবর্তী
পিছলিয়ে যাওয়া (Gliding)
স্বরধ্বনি। সে কারণে এদেরকে অর্ধ-স্বরধ্বনিও বলা হয়। সুতরাং একটি যৌগিক
স্বরধ্বনি সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে সূত্রটি কাজ করে তা হলো—
যৌগিক স্বরধ্বনি = |
আদি-স্বরধ্বনি অর্ধ-স্বরধ্বনি অন্ত্য-স্বরধ্বনি। |
এই
স্বরধ্বনিটি পরবর্তী ধ্বনির উপর ক্রিয়াশীল হয়, সে কারণে শেষ ধ্বনিটি
অর্ধ-স্বরধ্বনিতে পরিণত হয়। যেমন- 'এই' যৌগিক স্বরধ্বনি ধ্বনির কথাই ধরা যাক।
এখানে 'এ' উচ্চারিত হওয়ার পর জিহ্বা স্থান পরিবর্তন করে 'ই' উচ্চারণীয় স্থানে
চলে আসে। এক নিশ্বাসের ধাক্কায় যখন এই কাজটি ঘটে- তখন মীড়ের
(Gliding)
মাধ্যমে 'ই' অর্ধ-উচ্চারণ মানে পৌঁছায়। এই কারণে এখানে 'ই' হবে অর্ধস্বরধ্বনি।
উপরের তালিকায় যে যৌগিক স্বরের প্রকরণগুলো দেখানো হয়েছে, তার বিচারে অক্ষর
নির্ধারণ করতে গেলে অনেক সময় হোচট খেতে হয়। কারণ যখন প্রশ্ন উঠে—
'খাওয়াইয়া' {খ্ +আ +ও +আ+ই +আ}-এর মতো এত বড় শব্দকে একটি অক্ষর না একাধিক
অক্ষরের বিচার করার সমস্যা উপস্থিত হয়। অক্ষরের সংজ্ঞায় বলা হয়—
নিশ্বাসের এক ধাক্কায় উচ্চারিত ধ্বনি মান হলো অক্ষর। কিন্তু 'খাওয়াইয়া' শব্দটি
নিশ্বাসের ধাক্কাকে অনেকক্ষণ ধরে রাখার দরকার পরে। এক্ষেত্রে এই শব্দটিকে যদি
ছোটো থেকে বড় করার প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হওয়া যায় তাহলে, কি দাঁড়ায়?
১.
খা (খ্ +আ) = CV
২. খাও (খ্ +আ +ও)
= CVV
৩. খাওয়া (খ্ +আ +ও +আ) = CVVV
৪. খাওয়াই (খ্ +আ +ও +আ+ই) =
CVVVV
৫. খাওয়াইয়া (খ্ +আ +ও +আ+ই +আ)
= CVVVVV
উপরের উদাহরণ অনুসারে অক্ষর বিশ্লেষণ করলে পাই-
ক. 'খা' এবং 'খাও' নিশ্বাসের একটি ধাক্কায় সচল থাকে। সুতরাং এ দুটি শব্দ
একাক্ষর।
খ. 'খাওয়া; শব্দে 'খাও' নিশ্বাসের একটি ধাক্কায় সচল থাকে কিন্তু একটি রুদ্ধভাব
চলে আসে, সেই কারণে য়া (আ)
ধ্বনিটিকে অপর ধাক্কায় উচ্চারণ করতে হয়। ফলে এর রূপ দাঁড়ায়- খাও +য়া। একত্রে
উচ্চারণের সময় যে য়া (আ) অর্ধস্বরের কাছাকাছি রূপ পেলেও 'খাও' রুদ্ধধর্মী হওয়ায়
য়া ধ্বনিটি অক্ষরমানের কাছাকাছি পৌঁছায়। সব মিলিয়ে 'খাওয়া' দুই-অক্ষরের মর্যাদা
দেওয়া যেতে পারে।
গ. 'খাওয়াই' শব্দে 'খাও'+ 'আই' দুটি অক্ষরের মর্যাদা পায়।
ঘ. 'খাওয়াই' শব্দে 'খাও'+ 'আই' +'আ' তিনটি অক্ষরের মর্যাদা পায়।
বাংলা স্বরবৃত্ত ছন্দ অক্ষরভিত্তিক। অর্থাৎ অক্ষর অনুসারে এর মাত্রা নির্ধারিত হয়। এই ছন্দরীতিতে মাত্রা বিভাজনও উপরের সূত্রকে অনুসরণ করে যেমন—
। | । | । | । | । | । | । | । | । | । | । | ||||
তো | মা | র | না | মে | নো | য়া ই | মা | থা | ও | গো |
এখানে 'নোয়াই' শব্দটির বর্ণ বিন্যাস ন্+ও +আ +ই =
C +(VVV) । অক্ষর অনুসারে দাঁড়িয়েছে
নো +আই। কারণ, নো ধ্বনিটি এখানে থেমে যায়। ফলে 'নো' অক্ষর। কিন্তু এর সাথে
যুক্ত 'ও' ধ্বনিটি 'আই' ধ্বনির সাথে যুক্ত হয়ে যৌগিক স্বর তৈরি করে বটে, কিন্তু
অক্ষর হিসাবে তার একক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পায় না। মূলত অক্ষরের মান নির্ধারণে
রুদ্ধ ও মুক্ত ধ্বনির একটি বিশেষ ভূমিকা আছে।
দেখুন :
মুক্ত ও রুদ্ধ অক্ষর ।
যৌগিক স্বরধ্বনিগুলোকে বানানের বিচারে আমরা যেভাবে পাওয়া যায়, উচ্চারণের বিচারে সেভাবে পাওয়া যায় না। যেমন— বানানের বিচারে 'কই' হলো- ক্ +অ+ই। কিন্তু উচ্চারণের বিচারে তা হলো- 'কোই'। এই কারণে বলা হয়, 'যৌগিক ধ্বনির প্রকৃতি বানান রীতির পরিবর্তে উচ্চারণ রীতিকে অনুসরণ করে'।