ইলাহি সন
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা   {| বৎসর | পর্যায় কাল |মৌলিক পরিমাপ | পরিমা | বিমূর্তন | বিমূর্ত সত্ত | সত্তা |}
সমার্থক নাম : এলাহি সন, ইলাহী সন।


মোগল সম্রাট আকবর কর্তৃক নির্দেশিত একটি অব্দ গণন পদ্ধতি বিশেষ।
 
মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে একটি সমন্বিত নতুন ধর্ম প্রচারের উদ্যোগ নেন। এই ধর্মের নাম দেওয়া হয়েছিল দীন-ই-ইলাহি বা তৌহিদ-ই-ইলাহি। এই ধর্মের আদর্শে তিনি মুদ্রা থেকে কালিমা তুলে দেন। মুদ্রা ও শিলালিপি থেকে আরবি ভাষা তুলে দিয়ে ফারসি ভাষার প্রবর্তন করেন। একই সাথে তিনি আরব দেশীয় চান্দ্র মাসের পরিবর্তে পারস্যের সৌর বৎসরে প্রচলন করেন। প্রাথমিকভাবে এই বৎসর-গণন পদ্ধতির নাম দেন তারিখ-ই-ইলাহি বা সন ইলাহি। এই ইলাহি সনকে ভারতবর্ষের আদর্শে নতুন করে সাজানোর জন্য আকবর ৯৯২ হিজরি সনে, তাঁর রাজসভার রাজ জ্যোতিষী আমির ফতেউল্লাহ শিরাজীর উপর দায়িত্ব অর্পণ করেন। আকবর ৯৬৩ হিজরি সনের রবিউল আখির মাসের ২ তারিখে [১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ] সিংহাসনে আরোহণ করেন। হিজরি সনের মর্যাদা দেখিয়ে, ৯৬৩ সংখ্যাকে ইলাহি সনের প্রথম বৎসরের মর্যাদা দেন। এর পরবর্তী বৎসর থেকে সৌরবৎসর হিসাবে গণনা শুরু করেন। এই সূত্রে হিজরি চান্দ্র-মাস তুলে দিয়ে সৌরমাস গণনা শুরু করেন। আকবর এই নতুন বর্ষ-গণন পদ্ধতি প্রচলনের আদেশ জারি করেন ৯৯২ সালের ৮ই রবিউল তারিখ। খ্রিষ্টাব্দের বিচারে এই তারিখ ছিল ১০ মার্চ ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দ। যদিও আকবরের সিংহাসন আরোহণের দিন থেকে ইলাহি বর্ষের শুরু হওয়ার আদেশ জারি হয়েছিল, কিন্তু কার্যত দেখা গেল, পারস্যের পঞ্জিকা অনুসারে বৎসর শেষ হতে ২৫ দিন বাকি রয়ে যায়। তাই ইলাহি সন চালু হলো
আকবরের সিংহাসন আরোহণের ২৫ দিন পর। এই নির্দেশানুসরে বিষয়টি কার্যকরী হয় ২৮ রবিউল আখের ৯৬৩ হিজরী, ১১ মার্চ, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ।

ইলাহি সনের প্রথম দিনটিকে প্রাচীন পারস্যের রীতি অনুসারে নওরোজ (নতুন দিন) হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। এছাড়া ইলাহি সনের মাসগুলোর নাম গ্রহণ করা হয়েছিল প্রাচীন পারস্যের পঞ্জিকায় প্রাপ্ত নামগুলো থেকে। পারস্যের এই মাসগুলোর নাম ছিল- ফারওয়ারদীন (فروردین), আর্দিবিহশ্‌ত (اردیبهشت), খুরদাদ (خرداد), তীর (تیر), মুরদাদ (مرداد), শাহরীয়ার (شهریور), মেহ্‌র (مهر), আবান (آبان), আজার (آذر), দে (دی), বাহমান (بهمن) এবং ইসপন্দর (اسفند)।


ফসলি সন

সম্রাট আকবর পারস্যের সৌরবৎসরের অনুকরণে যে ইলাহি সন প্রবর্তন করেছিলেন, তা ছিল সর্বভারতীয় রাষ্ট্রীয় সন। কিন্তু এই সন ধরে একই সময়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজস্ব আদায় করাটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ রাজস্ব আদায়ের জন্য, সম্রাটকে কৃষকের ফসল ঘরে উঠার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। ভারতবর্ষের মতো বিশাল দেশে একই সময় সকল স্থানের কৃষকরা ফসল কাটতো না। সেই কারণে ফসল কাটার সময়কে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে পৃথক পৃথক সনের প্রচলন করা হয়েছিল। এই বিচারে ফসলী সন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ফসল-নির্ভর আঞ্চলিক বর্ষ গণন পদ্ধতি। এই কারণে তৎকালীন বঙ্গদেশে ফসলি সনের শুরু হতে অগ্রহায়ণ মাস থেকে। পক্ষান্তরে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে ফসলি সন শুরু হতো আষাঢ় মাস থেকে। তবে এই সকল ফসলি সনগুলো ছিল সৌর-বৎসর ভিত্তিক ইলাহী সন।



সূত্র : প্রাচীন ভারতীয় লিপিমালা/রায়বাহাদুর পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর হীরাচাঁদ ওঝা। অনুবাদ অধ্যাপক শ্রীমণীন্দ্র নাথ সমাজদার। বাংলা একাডেমী ঢাকা। আষাঢ় ১৩৯৬, জুন ১৯৮৯।