মহাকাশে
ভয়েজার-১ |
ভয়েজার -১ (নভোখেয়া)
ইংরেজি :
Voyager-1।
মহাকাশ পর্যবেক্ষণ এবং এর রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাসা নামক সংস্থা কর্তৃক প্রেরিত নভোখেয়া ভয়েজার-এর প্রথম মহাকাশ যান। এর দ্বিতীয় নভোখেয়ার নাম ভয়েজার-২। সৌরজগতের গ্রহগুলোকে অতিক্রম করে দূর আকাশে চলে যাওয়া নভোখেয়াসমূহের ভিতরে এই নভোখেয়াটিকে তৃতীয় স্থান দেওয়া হয়। উল্লেখ্য এর আগের দুটি নভোখেয়া ছিল পায়োনিয়ার সিরিজের ১০ এবং ১১ ।
১৯৬২-৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বুধ, শুক্র এবং মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণের জন্য মেরিনা প্রকল্প (Mariner program) গ্রহণ করেছিল। এর ভিতরে মেরিনা ১১ নামক নভোখেয়াকে ভয়েজার ১ এ উন্নীত করা হয়।
নাসা'র
নকশানুসারে এই নভোখেয়াটি তৈরি করেছিল
Jet
Propulsion Laboratory। পুরো
নভোখেয়াটির ওজন ৭২১.৯ কিলোগ্রাম। এতে ব্যবহার করা হয়েছে
Titan IIIE
নামক রকেট ইঞ্জিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল এলসি-৪১ (Cape
Canaveral LC-41) নামক বিমান বাহিনীর
ঘাঁটি থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। এরপর আশানুরূপ গতিতে এটি মহাকাশের দিকে ছুটে যায়।
ভয়েজার-১ এর সরল রৈখিক পথ। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে এর অবস্থান।
ভয়েজার-১ এর যাত্রাপথের বিবরণ
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ ৫ সেপ্টেম্বর (12:56:00 UTC.) : উৎক্ষেপণ করা হয়।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ ১০ ডিসেম্বর : গ্রহাণুপুঞ্জ-বলয় (asteroid belt) -এ প্রবেশ করে।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ ১৯ ডিসেম্বর : ভয়েজার-২-কে অতিক্রম করে।
১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দ ৮ সেপ্টেম্বর : গ্রহাণুপুঞ্জ-বলয় অতিক্রম করে বৃহস্পতির দিকে অগ্রসর হয়।
১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দ ৫ মার্চ : বৃহস্পতি গ্রহের আওতায় চলে আসে।
ভয়েজার-১ এর প্রকৃত গতিপথ
৬টা ৫৪ মিনিট: বৃহস্পতির তৃতীয় নিকটতম উপগ্রহ এ্যামালথিয়াকে অতিক্রম করে। অতিক্রমকালে এ্যামালথিয়ার সাথে ভয়েজার-১ এর দূরত্ব ছিল ৪,২০,২০০ কিলোমিটার।
১২টা ৫ মিনিট ২৬ সেকেন্ড : বৃহস্পতির কেন্দ্র থেকে ৩৪৮,৮৯০ কিলোমিটার দূরে পোঁছায়।
১৫ টা ১৪ মিনিট: বৃহস্পতির সর্ব নিকটতম উপগ্রহ আইও-কে অতিক্রম করে। ভয়েজার-১ থেকে এর দূরত্ব ছিল ২০,৫৭০ কিলোমিটার।
১৮টা ১৯ মিনিট: বৃহস্পতির ষষ্ঠ নিকটতম উপগ্রহ ইউরোপাকে অতিক্রম করে। ভয়েজার-১ থেকে এর দূরত্ব ছিল ৭৩৩,৭৬০ কিলোমিটার।
১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ৬ মার্চ :
২টা ১৫ মিনিট : বৃহস্পতির সপ্তম নিকটতম উপগ্রহ গ্যানিমিডেকে অতিক্রম করে। ভয়েজার-১ থেকে এর দূরত্ব ছিল ১১৪,৭১০ কিলোমিটার।
১৭টা ৮ মিনিট : বৃহস্পতির চতুর্থ নিকটতম উপগ্রহ গ্যানিমিডেকে অতিক্রম করে। ভয়েজার-১ থেকে এর দূরত্ব ছিল ১২৬,৪০০ কিলোমিটার।
১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ এপ্রিলে ভয়েজার-১ বৃহস্পতির এলাকা ছেড়ে শনি গ্রহের দিকে রওনা দেয়।
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ নভেম্বর ভয়েজার-১ শনির এলাকায় প্রবেশ করে।
২টা ১৫ মিনিট : শনির ষষ্ঠ নিকটতম উপগ্রহ টাইটানকে অতিক্রম করে। ভয়েজার-১ থেকে এর দূরত্ব ছিল ৬,৪৯০ কিলোমিটার।
২২টা ১৬ মিনিট ৩২ সেকেন্ড : শনির তৃতীয় নিকটতম উপগ্রহ টেথিসকে অতিক্রম করে। ভয়েজার-১ থেকে এর দূরত্ব ছিল ৪,১৫,৬৭০ কিলোমিটার।
২৩টা ৪৬ মিনিট ৩০ সেকেন্ড : শনির কেন্দ্র থেকে ১,৮৪,৩০০ কিলোমিটার দূরে ভয়েজার-১ পৌঁছায়।
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ নভেম্বর ভয়েজার-১ শনির এলাকায় প্রবেশ করে।
১টা ৪৩ মিনিট ১২ সেকেন্ড: শনির সর্ব নিকটতম উপগ্রহ মিমাসকে অতিক্রম করে। ভয়েজার-১ থেকে এর দূরত্ব ছিল ৮৮,৪৪০ কিলোমিটার।
১টা ৫১ মিনিট ১৬ সেকেন্ড: শনির দ্বিতীয় নিকটতম উপগ্রহ এনসেলাডাসকে অতিক্রম করে। ভয়েজার-১ থেকে এর দূরত্ব ছিল ২,০২,০৪০ কিলোমিটার।
৬টা ২১ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড: শনির পঞ্চম নিকটতম উপগ্রহ রিয়াকে অতিক্রম করে। ভয়েজার-১ থেকে এর দূরত্ব ছিল ৭৩,৯৮০ কিলোমিটার।
১৬টা ৪৪ মিনিট ৪১ সেকেন্ড: শনির সপ্তম নিকটতম উপগ্রহ হাইপেরিয়ানকে অতিক্রম করে। ভয়েজার-১ থেকে এর দূরত্ব ছিল ৮,৮০,৪৪০ কিলোমিটার।
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর ভয়েজার-১ শনির এলাকা ছেড়ে দূর আকাশের দিকে যাত্রা করে।
১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারিতে পায়োনিয়ার ১০-কে অতিক্রম করে। এই সময় সূর্য থেকে এর দূরত্ব ছিল ৬৯.৪১৯ জ্যোতির্বিদ্যা একক। এই সময় এর গতি ছিল ১৭ কিমি/সেকেন্ড।
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারিতে ভয়েজার-১ টারমিনেশান শক এলাকা অতিক্রম করে। এই সময় সূর্য থেকে এর দূরত্ব ছিল ৯৪ জ্যোতির্বিদ্যা একক।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জুন হেলিওপজ এলাকায় প্রবেশ করে।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ অগাষ্ট হেলিওপজ এলাকা অতিক্রম করে এবং ইন্টারস্টেলার সিস্টেমে প্রবেশ করে।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর এটি পৃথিবী থেকে ১২১.৮৩৬ জ্যোতির্বিদ্যা একক দূরত্বে পোঁছায় (১.৮২২৬৪ ×১০১০ কিলোমিটার)।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর নাসার বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দেন যে, এই নভোখেয়াটি সৌর এলাকা ত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছে। এটি পৃথিবী থেকে ১২১.৮৩৬ জ্যোতির্বিদ্যা একক দূরত্বে পোঁছায় (১.৮২২৬৪ ×১০১০ কিলোমিটার)। এই সময় পৃথিবী এই নভোখেয়া থেকে তথ্য সঙ্কেত পৃথিবীতে পৌঁছাতে প্রায় ১৭ ঘণ্টা সময় লাগছে।
সর্বশেষ দূরত্ব জানতে হলে দেখুন : http://voyager.jpl.nasa.gov/
ভয়েজার-১ রক্ষিত সোনালি রেকর্ড
মহাকাশ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মহাকাশের কোথাও হয়তো মানুষের মতো বা মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী রয়েছে। ভয়েজার-১ যদি এদের নজরে আসে, তাহলে তাদের কাছে পৃথিবীর মানুষ সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য কিছু সাঙ্কেতিক তথ্য দেওয়া হয়েছে। এই সাঙ্কেতিক তথ্য দেওয়া হয়েছে একটি ফোনোগ্রাম রেকর্ডে। এই রেকর্ডটি তামার তৈরি। তবে এর উপর স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। সাধারণভাবে একে সোনালী রেকর্ড (Golden Record) নামে অভিহিত করা হয়। রেকর্ডির ব্যাস ১২ ইঞ্চি। এই রেকর্ডে রয়েছে পৃথিবীর জীবজগৎ এবং মানুষের সংস্কৃতির পরিচয় প্রদায়ক নির্বাচিত শব্দ, ছবি ও উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম।
এই রেকর্ডের বিষয়াবলী নির্বাচন করেছেন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ল স্যাগান। এই রেকর্ডের জন্য স্যাগান তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ১১৫টি ছবি নির্বাচন করে নাসাকে প্রদান করেছিলেন। একই সাথে তিনি নানা ধরনের প্রাকৃতিক শব্দ নির্বাচন করে দিয়েছিলেন এই রেকর্ডের জন্য। এর ভিতরে রয়েছে বাতাসের শব্দ, বজ্রপাতের শব্দ, পাখির ডাক, তিমির শব্দময় সঙ্কেত এবং অন্যান্য প্রাণীর ডাক। এছাড়া তিনি বিভিন্ন জাতির নানা ধরনের সঙ্গীতের নমুনা, ৫৫টি ভাষার কথ্য নমুনা নির্বাচন করে দেন। মুদ্রিত পাঠ হিসেবে এই রেকর্ডে রয়েছে মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান কার্টার এবং জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল ওয়াল্ডহেইমের বক্তৃতা। এই রেকর্ডটি একটি এ্যালুমুনিয়াম-এর মোড়কে আবৃত করে নভোখেয়ার ভিতরে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে রাখা হয়েছে। এছড়া এতে প্রাচীন কথ্য নমুনা হিসেবে প্রায় ৬০০০ বৎসর আগের আক্কাদিয়ান ভাষার কথন-রূপের শব্দ। কালানুক্রমে উল্লেখযোগ্য ভাষার নমুনা রয়েছে অল্পবিস্তর। তবে আধুনিক চীনা কথ্যরূপের Wu দিয়ে ভাষা নমুনা দিয়ে শেষ করা হয়েছে। কি করে এই রেকর্ডটি চালিয়ে তথ্যগুলো অনুধাবন করা যাবে তার এর সাথে কিছু তথ্য দেওয়া হয়েছে সাঙ্কেতিক ভাষায়। উল্লেখ্য এই রেকর্ডির ঘূর্ণ গতি ১৬-২/৩- প্রতি মিনিট।
সোনালি রেকর্ডের সঙ্কেত
এই রেকর্ডের বাম দিকের উপরে রয়েছে এই রেকর্ডের ঘূর্ণ গতি সম্পর্কিত চক্রাকার
সঙ্কেত। এই চক্রের উপরে রয়েছে দ্বি-আঙ্কিক পদ্ধতির I
=১ এবং
―
=
0
অনুসারে গতি দেখানো হয়েছে। এর নিচে রয়েছে রেকর্ডির
বাদনকাল সম্পর্কিত তথ্য। এই সঙ্কেতের দ্বারা বুঝানো হয়েছে, রেকর্ডের প্রতিটি ১
ঘণ্টার বাদন উপকরণ করেছে। এর নিচে রয়েছে সূর্য পরিচিতি। ডানদিকের উপর ও মধ্যাংশ
সচলচিত্রের সঙ্কেত এবং সর্ব নিম্নে রয়েছে হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেক্ট্রন ও
প্রোটনের নকশা।
ভয়েজার-১ যোগাযোগ উপকরণ
পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য এর সাথে আছে ৩.৭ মিটার ব্যাসের এ্যান্টিনা। এই এ্যান্টিনার দ্বারা নভোখেয়াটি পৃথিবীর তিনটি 'ডিপ স্পেস নেটওয়ার্ক' স্টেশনের সাথে যোগাযোগ করে চলেছে। পৃথিবী থেকে ভয়েজার-১ এ তথ্য প্রেরণ হয় 2114.676697 MHz -এ। পক্ষান্তরে ভয়েজার -১ থেকে তথ্য আসে 2296.481481 MHz এবং 8420.432097 MHz। কোনো কারণে ভয়েজার-১ যদি সরাসরি পৃথিবীতে কোনো তথ্য পাঠাতে না পারে, তবে প্রথমে এই অপ্রেরিত তথ্য একটি ডিজিটাল টেপে ধারণ করে রাখা হয় এবং পরে তা উপযুক্ত সময়ে প্রেরণ করা হয়। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের অগাষ্ট মাসে ভয়েজার -১ যে দূরত্বে পৌঁছেছিল, সেখান থেকে পৃথিবীতে তথ্য আসতে সময় লেগেছিল ১৭ ঘণ্টা।
ভয়েজার-১ এর গবেষণা উপকরণ
ভয়েজার-১ এর আকাশ পর্যবেক্ষণ উপকরণের ভিতরে রয়েছে ২টি সরু কৌণিক/বিস্তৃত কৌণিক
ক্যামেরা। বিশেষ নিয়ন্ত্রাধীন এই ক্যামেরা চালিত হয়
Imaging Science System নামক একটি
ব্যবস্থাপনায়। এখন পর্যন্ত ভয়েজার এই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বৃহস্পতি ও শনি গ্রহ এবং
এদের উপগ্রহের নানা রকম ছবি পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। গবেষণার জন্য ব্যবহৃত এর
Radio Science System
দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে বৃহস্পতি ও শনি গ্রহ
এবং উপগ্রহের আবহাওয়া, মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র, ঘনত্ব ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে―
অবলোহিত রশ্মি মাপক, অতিবেগুনি রশ্মি মাপক, প্লাজমা বিশ্লেষক, প্লাজমা তরঙ্গ মাপক,
কসমিক রশ্মি বিষয়ক যন্ত্রপাতি রয়েছে।
ভয়েজার-১ এর চালিকা শক্তি
ভয়েজার-১ -এ রয়েছে তিনটি
radioisotope thermoelectric generators (RTGs)।
এই জেনারেটে ব্যবহৃত হয় প্লুটোনিয়াম-২৩৮। ভয়েজার উৎক্ষেপণ কালে এই জেনারেটর থেকে
৪৭০ ওয়াট বিদ্যুৎ প্রাদন করছিল। ২০২৫-৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এর বিদ্যুৎ উৎপাদন
ক্ষমতা বন্ধ হয়ে যাবে। এরপর থেকে ভয়েজার-১ চিরতরে হারিয়ে যাবে।
সূত্র :
http://www.nasa.gov/