স্তন্যগ্রন্থি (মানবদেহ)/স্তন
ক্যানসার
Mammary
gland
মানবদেহে অবস্থিত এক প্রকার
জটিল থলিকার বহিঃক্ষরা
গ্রন্থি।
মানুষসহ সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীদের শরীরে স্তন্যগ্রন্থি থাকে। মানুষের স্ত্রী এবং
পুরুষ উভয়লিঙ্গেই স্তন থাকলেও একমাত্র নারীস্তনই দুগ্ধ উৎপাদনে সক্ষম।
মানষের বয়ঃসন্ধিকালে অর্থাৎ যৌবনাগমনে নারীদেহে স্তন বিকশিত হতে আরম্ভ করে।
ইস্ট্রোজেন নামক হরমোনের সহায়তায় স্তন ক্রমে ক্রমে আকারে বৃদ্ধি পায় ও স্থুলতা
লাভ করে। সাধারণত ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যেই স্তনের বিকাশ সম্পূর্ণতা লাভ করে।
সন্তান ধারণের পর নারীদেহর স্তন আরও স্ফীত হয়। নারীদেহের যৌবন প্রাপ্তির চিহ্ন
হিসাবে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়। নারীর যৌন-উত্তেজনা বৃদ্ধিতে পুরুষকে আকৃষ্ট করার
ক্ষেত্রে স্তন বিশেষ ভূমিকা রাখে।
স্তন এক প্রকার পরিবর্তিত স্বেদ গ্রন্থি। বাইরে থেকে এর শীর্ষদেশে একটি কালো স্ফীত অংশ দেখা যায়। একে বলা হয় স্তন্তবৃন্ত বা দুধের বোঁটা। এই বোঁটাকে ঘিরে কালচে বা গোলাপী যে বলয় দেখা যায় একে বলা হয় স্তনবৃত্ত।
নারীস্তনে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুগ্ধগ্রন্থি থাকে। দুগ্ধগ্রন্থিগুলোতে দুগ্ধ উৎপাদনকারী এ্যালভিওলাই থাকে। এই দুগ্ধগ্রন্থিগুলো একত্রিত হয়ে একটি বড় একক সৃষ্টি করে। একে বলা হয় লোবিউল। দুগ্ধগ্রন্থিগুলোর সাথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নালি থাকে। এই সকল নালি একত্রিত হয়ে একটি বড় নালি তৈরি করে। এই নালি পথে দুগ্ধ প্রবাহিত হয়ে ক্ষুদ্রাকার স্ফীত অংশে জমা হয়। এই স্ফীত অংশকে বলা হয় সাইনাস। এরূপ প্রতিটি সাইনাস নালি থেকে দুগ্ধ প্রবাহিত হয়ে স্তনবৃন্তে জমা হয়। শিশু তার মুখের সামান্য চাপেই এই দুগ্ধ মুখগহ্বরে টেনে নিতে পারে। অনেক সময় অতিরিক্ত দুগ্ধ জমা হওয়ার কারণে, স্তনবৃন্ত দিয়ে দুধ ঝরে পড়ে।
স্বাভাবিক অবস্থায় স্তন নরম ও দলাহীন হয়। তবে রজঃশ্রাব-এর পূর্বের দিনগুলিতে স্তন কিছুটা সংবেদনশীল অনুভূত হয় অর্থাৎ টনটনে ভাব বা শক্ত ভাব অথবা ফোলা ফোলা ভাব পায়। এছাড়া যৌন উত্তেজনায় স্তনের নরমভাব লোপ পায়।
স্তন ক্যান্সার
নারীদেহের নানা রকম
ক্যান্সার মধ্যে এটি
একটি মারাত্মক ক্যান্সার। স্তন ক্যান্সারই হচ্ছে সারা বিশ্বে মহিলাদের মৃত্যুর
দ্বিতীয় অন্যতম কারণ।
স্তনের ভিতরে এই ক্যান্সারের সূচনা ঘটে। স্তনের ভিতরে কোষের অস্বাভাবিক সংখ্যাধিক্যকের কারণ টিউমার বা ক্যান্সার হয়ে থাকে। কোষ বৃদ্ধির কারণে একটা নির্দিষ্ট স্ফীত বা শক্ত দলা সৃষ্টি হলে এবং তা একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকলে একে টিউমার বলা হয়। কিন্তু এই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত কোষ যদি অন্যান্য কোষগুলোকে বিকৃত করে এবং তা ক্রমান্বয়ে স্তনের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে, স্তনের মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ করে তোলে, তখন তা ক্যান্সারে রূপ লাভ করে। ভেদন ক্ষমতাযুক্ত টিউমার বা ম্যালিগ্ন্যান্ট টিউমার ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে মৃত্য ঘটায়।
একবার
স্তন ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লে, তা
থেকে রক্ষা পাওয়া দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তবে প্রাথমিকভাবে এই রোগ ধরা পড়লে
নিরাময় সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে নারীদের নিজেদের পর্যাপ্ত সচেতনতা দরকার।
নিজেদের প্রাথমিক পরীক্ষা
১. গোসলের সময় স্তনের ভিজা
চামড়ার উপর দিয়ে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দেখতে হবে, কোথায় দলার মতো মনে হয়ে কিনা।
এক্ষেত্রে আঙ্গুল পাশের চিত্রের মত চেপ্টা করে স্তনের উপর দিয়ে এদিকে ওদিকে
চালনা করতে হবে। এক্ষেত্রে বাম দিকের স্তন পরীক্ষা করার জন্য ডান হাত এবং ডান
দিকের স্তন পরীক্ষা করার জন্য বাম হাত ব্যবহার করতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে
দেখতে হবে কোনো দলা অথবা শক্ত গিট্টুর মত কিছু ধরা পড়ে কিনা।
২. আয়নার সামনে দঁড়িয়ে
নিজের স্তনকে গভীরভাবে লক্ষ্য করতে হবে। দেখতে হবে স্তনের গঠনে কোনো
অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ে কিনা। এরপর প্রথমে দুই হাত দু’পাশে রেখে, তারপর ধীরে
ধীরে হাত দু’টো সোজা করে মাথার উপরে তুলতে হবে। এবার সতর্কভাবে লক্ষ্য করতে
হবে, স্তনের আকারে কোন অস্বাভাবিক পরিবর্তন চোখে পড়ে কিনা। দেখতে হবে স্তনবৃত্ত
বা অন্য কোন অংশ ফুলে গেছে কিনা কিংবা কোন অংশে লালচে ভাব বা টোল পড়া আছে কিনা।
এরপর মাটির উপর সোজা হয়ে দাড়িয়ে, কোমরে দুই হাত রেখে চাপ দিতে হবে। এখন উভয়
স্তনকে ভাল করে দেখতে হবে যে, উভয় স্তনের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থা বজায় থাকছে
কিন। যদিও খুব কম মহিলারাই দুটি স্তন দেখতে একই রকম হয়, তবুও প্রতিনিয়ত এই
পরীক্ষার সাধ্যমে প্রতিটি নারী বুঝে যাবেন তার জন্য কোনটা স্বাভাবিক বা
অস্বাভাবিক।
৩. মাটিতে চিৎ হযে শুয়ে
স্তন পরীক্ষা করতে হবে। প্রথমে ডান স্তন পরীক্ষা করার জন্য ডান দিকে ঘাঁড়ের
নিচে একটা বালিশ অথবা ভাঁজ করা কাপড় রাখতে হবে। এরপর ডান হাত মাথার পিছনে রাখতে
হবে। এই অবস্থায় বাম হাতের আঙ্গুলগুলি চেপ্টা করে ডান স্তনের উপর রেখে―
ঘরির কাঁটার গতি অনুসরণ করে হাত ঘুরাতে হবে। সবচেয়ে উপরের জায়গাটাকে ১২টা বৃত্ত
করে পরীক্ষা করতে হবে। উল্লেখ্য স্তনের নিচের অংশ কিছুটা শক্ত মনে হতে পারে,
কিন্তু এটা স্বাভাবিক। সম্পূর্ণ ঘুরে আসার পর স্তন বৃন্তপরীক্ষা করে, একইভাবে
পুনরায় স্তনকে পরীক্ষা করতে হবে। এর বিপরীত পদ্ধতিতে বাম স্তন পরীক্ষা করতে
হবে।
সবশেষে স্তন বৃন্তকে উপরের
চিত্রের মত করে বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনী আঙ্গুলের মধ্যে ধরে চাপ দিতে হবে। লক্ষ্য
করতে হবে কোন রকমের রস নিঃসরণ হচ্ছে কিনা, সেটা রক্ত জাতীয় বা স্বচ্ছ যেমনই
রকমই হোক।
এইভাবে পরীক্ষার পর যদি কোনো
অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে, তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রতিবার রজঃশ্রাব শেষ হবার ২/৩ দিন পর নিজেকে নিজে পরীক্ষা করতে হবে। যাদের রজঃশ্রাব বন্ধ হয়ে গেছে তারা মাসের যে কোন একটা নির্দিষ্ট দিন বেছে নিয়ে প্রতি মাসে নিজেকে নিজে পরীক্ষা করবেন।
সবারই যে স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভবনা সমান তা নয়। যাদের এই ক্যান্সারের ঝুকিঁ বেশী, তারা হলেন:
যাদের বয়স ৪০ এর উর্ধ্বে।
যাদের রজঃক্ষান্তি (Menopause) হতে দেরি হচ্ছে।
যারা নিঃসন্তান।
যাদের ইতোমধ্যে স্তনে দলা আছে।
যারা এষ্ট্রোজেন জাতীয় হরমোন ব্যবহার করেন। এখানে বলতে হয় যে, কোনো কোনো জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়িতে এই হরমোন আছে। সেজন্য বড়ি কেনার সময় প্যাকেটের উপরে এই হরমোন আছে কিনা তা দেখে কিনতে হবে। পারত পক্ষে এই জাতীয় জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি পরিহার করতে হবে।
যাদের স্তনের ও বুকের অনেক এক্সরে করা হয়েছে।
যাদের পরিবারের মধ্যে কোন নিকট আত্মীয় যেমন-মা, বোন, এদের কারো স্তন ক্যান্সার হয়েছে; তা’হলে তাদের এই ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। যদিও তার শতকরা হার নগণ্য।
যারা সন্তান প্রসব করার পর বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ান নি। প্রকৃতপক্ষে স্তন ক্যান্সার কেন হয় তা সঠিক কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। তবে পরিসংখ্যানে দেখা গেছে নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়ালে স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
স্তন ক্যান্সারেরই পূর্ব লক্ষণ,
স্তনের কোন অংশে কোন দলা বা চাকা অনুভূত হওয়া। তা ব্যাথাহীনও হতে পারে।
স্তনে ব্যথা বা ভারী বোধ হওয়া অথবা ফুলে যাওয়া। উল্লেখ্য, রজঃশ্রাবের পূর্বের দিনগুলিতে সাধারণতঃ স্তন কিছুটা সংবেদনশীল থাকে ও দলাদলা অনুভূত হয়। তাই এই উপর্গগুলো ক্যান্সার-এর উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করা হবে না।
স্তন বৃন্ত থেকে কোন রস বের হওয়া।
এখানে নির্দিষ্টকৃত লক্ষণগুলো ছাড়াো পূর্বে আলোচিত কোন পরিবর্তন চোখে পড়লে দেরি না করে ডাক্তার দেখাতে হবে। যদি ক্যান্সারের কোন সম্ভাবনা থেকে থাকে তা যত তাড়াতাড়ি সনাক্ত হয় তার চিকিৎসা তত সহজতর।
সূত্র :
ইন্টারনেট ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও
পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত গ্রন্থাসমূহ।
http://www.naripokkho.org.bd/nari-index.html#