ফ্রান্সিস রডন-হেস্টিংস, প্রথম মার্কুইস অব হেস্টিংস
Francis Rawdon-Hastings, 1st Marquess of Hastings
(১৭৫-১৮২৬)

ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনধীন ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল। ১৭৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর  এপ্রিল আয়রল্যান্ডের মৈরা কাউন্টি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম জন রাউটন এবং এলিজাবেথ হেস্টিং। ১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি ডাবলিনের অডেওন চার্চে বাপ্তাইজ করা হয়। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছিল নৈরা এবং ডাবলিনে। তিনি লণ্ডনের হিব্রু স্কুলের পাঠ শেষ করে অক্সফোর্টের ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হন এবং এখান থেকে ম্যাট্রিকুলেশান পাশ করেন। পরে লেখাপড়া ত্যাগ করে, ১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই অাগস্ট তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২০ অক্টোবর তিনি লেফট্যান্ট পদে উন্নীত হন। এরপর তিনি ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মে আমেরিকাতে যান।

আমেরিকাতে তিনি সেখানকার বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তিনি লেক্সিংটোন, কনকর্ড এবং বাঙ্কার হিলের যুদ্ধে গ্রেনেড নিক্ষেপক সৈনিক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিড হিলের যুদ্ধে তাঁর কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন হ্যারিস আহত হলে, তিনি কোম্পানি চালানোর দায়িত্ব লাভ করেন। এই যুদ্ধে তিনি আহত হন। কিন্তু যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্বের জন্য, ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত করা হয়। ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত তিনি এক টানা যুদ্ধক্ষেত্রে কাটিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে ইংল্যান্ডের পথে রওনা দেন। কিন্তু জল পথে ফরাসি নৌবাহিনীর হাতে বন্দী হন। পরে বন্দী বিনিময়ের মাধ্যমে মুক্তি পান।

ইংল্যান্ডে ফেরার পর রাজা চতুর্থ জর্জ তাঁকে বিশেষভাবে সম্বর্ধিত করেন। ১৭৮১ থেকে ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি আইরিশ কমন্স সভায় সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্যারেন হিসেবে স্বীকৃতি পান। এই বছরেই প্রিন্স অব ওয়েলসের বিশেষ বন্ধু হয়ে ওঠেন।

১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিইটিশ-ফ্রান্স যুদ্ধে মেজর জেনারেল হিসবে নিয়োগ পান। ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি মৈরার প্রধান মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। ১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পূর্ণ জেনারেল পদ লাভ করেন এবং স্কটল্যান্ডের কমান্ডার-ইন-চিফ পদ লাভ করেন।

১৮১২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ নভেম্বর তিনি ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি মাদ্রাজে পৌঁছান। অক্টোবর মাসে তিনি কলকাতায় এসে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

গুর্খা-ইংরেজ যুদ্ধ (১৮১৫-১৮১৮)
ভারতে আসার পর হেস্টিংসকে বেশ কয়েকটি যুদ্ধের মোকাবেলা করতে হয়। এর শুরু হয়েছিল গুর্খা মাধ্যমে। নেপালে গুর্খারা ১৭৯২ থেকে ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে ভুটানের সীমান্ত থেকে শতদ্রু নদী পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেছিল। এই সময় গুর্খারাজ্যের সাথে ইংরেজ শাসিত ভারতের সীমানা নির্দিষ্ট ছিল না। ফলে উভয় রাজশক্তির মধ্যে মাঝে মাঝেই সীমান্ত-সংঘর্ষ চলতো। গুর্খারা ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে কয়েকটি ইংরেজ শাসিত অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। ইংরেজদের অনুরোধ সত্ত্বেই গুর্খারা অধিকৃত অঞ্চল প্রত্যাপর্ণে অস্বীকার করায়, ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে হেস্টিংস নেপালের বিরুদ্ধে একসাথে চারটি অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু ইংরেজদের প্রতিটি অভিযান ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে অক্টারলোনি নেতৃত্বে ইংরেজ সৈন্য পুনারায় আক্রমণ করে কাটমুণ্ড অবরোধ করে। পরে গুর্খারা ইংরেজদের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হয়। এই সন্ধির মাধ্যমে ইংরেজরা ভারতের উত্তর প্রদেশের সিমলা, মুসৌরী, আলমোড়া শাসনের অধিকার লাভ করে। একই সাথে সিকিম থেকে গুর্খা সৈন্যদের অপসারণ করে। ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে সিকিমের সাথে ইংরেজেদের মিত্রতামূলক-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই সময় কাটমাণ্ডুতে একজন ইংরেজ প্রতিনিধি রাখতে সম্মত হয়।  

পিণ্ডারী দমন (১৯১৭)
দাক্ষিণ্যাতে মোগল শাসনামলে পিণ্ডারী দস্যুদের আমির খাঁ, চিত্ন, ওয়াসিল মোহম্মদ এবং করিম খাঁ'র নেতৃত্বে মালব, নর্মদা উপত্যাকা, গুজরাট, গঞ্জাম প্রভৃতি স্থানে হানা দিয়ে লুটতরাজ করতে থাকে। ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে দক্ষিণ ভারতে এরা ভয়ঙ্কর কিছু আক্রমণ করে। ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে নিজামের রাজ্য আক্রমণ করে ব্যাপক লুটতরাজ করে। এই সময় পিণ্ডারীদের দমন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই সময় কূটনৈতিক তৎপরতায় মারাঠা অধিপতি সিন্ধিয়কে স্বপক্ষে আনেন। পরে ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে ইংরেজ সৈন্য পিণ্ডারদের প্রধান আমির খাঁর বাহিনীকে আক্রমণ করে পরাজিত করে। আমির খাঁ ইংরেজদের সাথে সন্ধি করে টংক নামক স্থানে জায়গীর লাভ করে। এরপর করিম খাঁ আত্ম-সমর্পণ করে এবং ওয়াসিল খাঁ আত্মহত্যা করে। চিতু জঙ্গলে পলায়ন করার পর বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায়।

ইঙ্গ-মারাঠী যুদ্ধ (১৮১৭-১৮১৯)
পিণ্ডারীদের দমন করার পর হেস্টিংস মারাঠা-রাজ্য অধিকারের উদ্যোগ নেন। ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে  হেস্টিংস-এর আদেশে এল্‌ফিনস্টোন মারাঠা অধিপতি পেশোয়াকে পুন্যর সন্ধিতে বাধ্য করে। এই সন্ধি অনুসারে পেশোয়া রাজ্যের একটি অংশ ইরেজদের হাতে সমপর্ণ করে। প্রায় একই সময় গাইকোয়াড় সন্ধি হয়। এই সন্ধি অনুসারে রাজ্যে একদল ইংরেজ সৈন্য থাকবে এবং তাদের ব্যয় নির্বাহ করবে গাইকোয়াড়। এক্ষেত্রে সৈন্যদের ব্যয় নির্বাহের জন্য রাজ্যের কিছু অংশ ইংরেজদের কাছে সমর্পণ করবে। এই সকল চুক্তির দ্বারা পেশোয়া ক্রমে ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তিনি ইংরেজদের আক্রমণ করে। কিরকীতে মারাঠা বাহিনী পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। এই সময় নাগপুরে ভোঁসলে আপ্পা সাহেব ও হোলকার ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। আপ্পা সাহেব পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন। হোলকারে বাহিনী পরাজিত হয়। এরপর পেশোয়ার সেনাপতি গোখেলকে শেষবারের মতো যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে পরাজিত ও নিহত হন। ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে পেশোয়া অশতি ও কোরগাঁও-এর যুদ্ধে পরাজিত হন এবং আত্মসমর্পণ করেন। এর মধ্য দিয়ে পেশোয়ার সমগ্র রাজ্য ইংরেজদের অধিকারে চলে আসে।

মধ্যভারত ও রাজপুতনা কোম্পানির অধিকারভুক্ত  (১৮১৮)
১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে ভুপালের নবাব ভুপাল,মালব, ধর ও বুন্দেল খণ্ডের স্থানীয় রাজন্যবর্গ কোম্পানির সাথে অধীনতামূলক-মিত্রতায় আবদ্ধ হন। উল্লেখ্য লর্ড ওয়েলস্লে (১৭৯৮-১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দ) আমলে মেবারের রাজা মিত্রতা স্থাপনে আগ্রহী হলে, ওয়েলস্লে তাতে সাড়া দেয় নি। তবে সে সময়ে যোধপুর ও জয়পুরের সাথে মিত্রতা হয়েছিল। এরপর
জর্জ বারলো (১৮০৫-১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দ) জয়পুরের সাথে মিত্রতা নাকচ করে দিয়েছিল। মিন্টো, প্রথম, লর্ড (১৮০৭-১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দ)আমলে যোধপুর ও জয়পুর রাজ্যের ভিতর সংঘর্ষ উপস্থিত হলে- দৌলত রাও সিন্ধিয়া এবং আমীর খাঁ রাজপুতনার কিছু অংশ দখল করে নেয়। হেস্টিংস কোম্পানির স্বার্থে উদয়পুর ও যোধপুরের সাথে সন্ধি সম্পন্ন করে। এই সন্ধির মাধ্যমে রাজপুতনার রাজ্যগুলো কোম্পানির করদ রাজ্যে পরিণত হয়।

১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে  হেস্টিংস পদত্যাগ করেন। তবে তিনি ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতেই কাটান। ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে অস্থায়ীভাবে গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন জন এডাম।

১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে হেস্টিংস মাল্টার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি মাল্টার উদ্দেশ্যে সমুদ্রপথে যাত্রা করেন ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে জাহাজে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।