বু বকর সিদ্দীক (রাঃ), হযরত

(
৫৭৩-৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দ)। ইসলাম ধর্মের প্রথম খলিফা, হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর শ্বশু মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশে ৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাল্য নাম ছিল আবদুল্লাহ্, আবু বকর ছিল তার ডাক নাম।  

ইসলাম গ্রহণ করিবার পর তিনি সিদ্দীক (সত্যবাদী) এবং আতিক (দানশীল) খেতাব লাভ করেছিলেন। আবু বকরের পিতার নাম ছিল ওসমান, কিন্তু ইতিহাসে তিনি আবু কুহাফা নামেই সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর মাতার নাম উম্মুল খায়ের সালমা। আবু বকরের মাতাপিতা উভয়েই বিখ্যাত কুরাইশ বংশের তায়িম গোত্রের লোক ছিলেন। তার মা প্রথমদিকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং পিতা হিজরীর অষ্টম বৎসরে ইসলামে দীক্ষিত হন।

আবু বকর (রাঃ) আরবের একজন কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন। এই ব্যবসায়ে তার প্রচুর অর্থ উপার্জন হয়। কথিত আছে, তিনি কুরাইশ ব্যবসায়ীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ধনী ছিলেন। নবুয়ত লাভের পর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন মানুষকে ইসলাম গ্রহণের জন্য দাওয়াত দিলেন তখন তিনি বিনা দ্বিধায় ইসলাম গ্রহণ করেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি হযরত আবু বকরের এত গভীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ ছিল যে, বিবি খাদিজার মৃত্যুতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) দিশাহারা হয়ে পড়লে তিনি তার মানসিক চিন্তা দূর করার জন্য নিজ কন্যা বিবি আয়শা (রাঃ)-কে নবীর সাথে বিবাহ দেন। ি হিজরত-এর সময় হজরত মুহম্মদ (সাঃ)- এর সাথে ছিলেন।

বদর, ওহদ ও খন্দকের যুদ্ধগুলি ছাড়াও হুদায়বিয়ার সন্ধি স্বাক্ষরের সময় ও মক্কা বিজয়ের সময় তিনি মহানবীর পাশেই ছিলেন। হজরত মুহম্মদ (সাঃ)- এর মৃত্যুতে ইসলামী দুনিয়ায় এক ভয়াবহ ও সংশয়পূর্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। নবীর কোন জীবিত পুত্র সন্তান ছিল না এবং নিজে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন বলে ওফাতের সময় তিনি উত্তরাধিকারীও মনোনয়ন কর যান নাই বা উত্তরাধিকারী সংক্রান্ত কোন আইন বা নির্দেশ প্রদান করেন নাই। তার জীবদ্দশায় অসুস্থতা বা অনুপস্থিতির জন্য হযরত আবু বকর (রাঃ) কয়েক বার নামাজে ইমামতি করেছিলেন। এতকিছুর পরেও খলিফা নির্বাচনের প্রশ্নে চারটি দলের উদ্ভব হয়েছিল। এই দল চারটি হলো- আনসার, মোহাজের, কুরাইশ ও হযরত আলীর সমর্থকবৃন্দ। আনসারগণ দাবী করলেন যে, শত বিপদ আপদ উপেক্ষা করে তাঁরা ইসলাম ধর্ম, মহানবী ও তার অনুসারীদিগকে রক্ষা করেছেন এবং মদীনায় আশ্রয় দিয়েছেন। অতএব তাঁদের দল থেকেই খলিফা নির্বাচিত হওয়া উচি। এরূপ মোহাজেররা ইসলামের প্রথম বিশ্বাসী হিসাবে নিজেদের গোত্র থেকে খলিফা নির্বাচনের প্রস্তাব করেন। এছাড়া তাঁরা আরও দাবী করেন যে, তারা মহানবীর সগোত্রের লোক। কুরাইশরা ছিল আরবদের অভিজাত বংশ। মহানবী এই কুরাইশ বংশের লোক ছিলেন। অতএব তাঁরা দাবি করলেন যে, তাদের দলের লোককেই খলিফা নিযুক্ত করা উচিৎ

আনসারগণ খাযরাজ গোত্রের নেতা সাদ বিন অবু ওবায়দাকে খলিফা পদের জন্য মনোনীত করলেন। ইসলামের সেই সংকটপূর্ণ সময়ে হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর শান্তভাবে বলিলেন যে, ইসলামের খেদমতের দিক দিয় আনসারদের কোন তুলনা নাই, কিন্তু আরবের জনগণ কুরাইশ বংশ হতে তাঁদের খলিফা নির্বাচনে পক্ষপাতী। পরিস্থিতি যখন আরও জটিল হয়ে উঠল, যখন আবু বকর ওমর অথবা আবু ওবায়দাকে খলিফা হিসাবে মনোনীত কর কথা উত্থাপন করলেন। কিন্তু তাঁরা উভয়েই এই প্রস্তাব আবু বকরের অনুকূলে প্রত্যাখ্যান করলেন। এরপর ওমর আবু বকরের হাত ধরে তারা আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করলেন। ওমর ও আবু ওবায়দার আনুগত্যের পর আনসারগণ দলে দলে এগিয়ে এসে আবু বকরের নেতৃত্ব স্বীকার করলেন। এবং তিনি খলিফা নির্বাচিত হলেন।

খলিফা হওয়ার পর আবু বকর (রাঃ) -কে বহুবিধ সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছিল। এই সমস্যাগুলিকে কয়েকটি ভগে ভাগ করা যায়। যেমন- 
১। ভণ্ড নবীদের উদ্ভব
, ২। আভ্যন্তরীণ বিরোধী শক্তির উত্থান, ৩। ধর্মত্যাগী বা রিদ্দা আন্দোল, ৪। পারস্য সম্রাটের শত্রুতা এবং ৫। সম্রাটের বিরোধিতা।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যুর পূর্বে ওসামার নেতৃত্বে সিরিয়ার সমান্তে একটি অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল মুতার যুদ্ধে নিহত তাঁহার অনুচর ও পোষ্যপুত্র যায়েদ বিন হারিসের মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণ করা। ছাড়া উত্তরাঞ্চলের বিদ্রোহ দমন করাও বিশেষ প্রয়োজন হয়ে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তিনি হঠা অসুস্থ হইয়া পড়িলে, এই অভিযান স্থগিত রাখা হয়। পরে আবু বকর (রাঃ) খিলাফতের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করে যায়েদের পুত্র ওসমানের নেতৃত্বে একদল সৈন্য সিরিয়ায় অভিযানে পাঠান।

ওসামা প্রথমেই ভূমধ্যসাগরের নিকট আসফালন ও জাফ্ফার মধ্যবর্তী শহর উবানা আক্রমণ করে সেখানকার কোজা গোত্রের লোকজনকে পরাজিত করেন। এরপর ওসামা প্রায় চল্লিশ দিন পর বিজয়ী বেশে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। এই অভিযান শেষে ইনি মদিনা রক্ষার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং তালহাকে মদিনা রক্ষাকারী বহিনী অন্যান্য প্রহরী দলের নেতৃত্ব প্রদান করেন। মদীনার উত্তর দিকে আরব বেদুইনদের বানু আবস্ ও বানু ধুবিয়ান গোত্রদ্বয় বাস করত। তারা ভণ্ডনবী তুলায়হা কর্তৃক প্ররোচিত হয়ে যাকাত প্রদান মউকুফ করার জন্য খলিফার নিকট একটি প্রতিনিধি দল পাঠান। কিন্তু খলিফা বিদ্রোহীদের দাবী পূরণ না করলে, তারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কর। তাই ওসামার সৈন্যবাহিনী সিরিয়া রওনা হবার পর তারা মদিনা আক্রমণ করেছিল। আবু বকর র জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তিনি তত্ক্ষণা সৈন্যবাহিনী নিয়ে ধূলাকাশাতে উপস্থিত হয়। মুসলমানেরা এই যুদ্ধে জয়লাভ করেন। ওসামার সৈন্যবাহিনী বিজয়ীর বেশে মদিনায় ফিরে এলে সৈন্যদের কয়েক দিন বিশ্রাম দেওয়ার পর খলিফা ওসামানকে মদিনা রক্ষার্থে রেখে বেদুঈন গোত্রের বিরুদ্ধে নিজেই সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করেন। এবং তিনি তাদেরকে রাবাধা যুদ্ধে পরাজিত করে মদিনাকে আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করেন।

হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর শেষ জীবনে এবং পরবর্তী সময় বেশকিছু ভণ্ড নবীর আবির্ভাব ঘটে। এদের মধ্যে আসাদ আনসী, মুসায়লামা, তুলায়হা, সাজহ্ ইত্যাদি। এদের মধ্যে আসাদ আনসী হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর সময় আততায়ীর হাতে নিহত হন। বাকীদের আর সকলকেই হযরত আবুবকর (রাঃ)- দমন করেন।   দেখুন : আসাদ আনসী (ভণ্ড পয়গম্বর)

হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর শানকালের (৬৩২-৩৪ খ্রিষ্টাব্দ) অধিকাংশ সময় রিদ্দা যুদ্ধে অতিবাহিত হয়। রাদ্দা আরবী শব্দ। র অর্থ হল প্রত্যাবর্তনকরণ। নও-মুসলমানরা যাতে তাদের পূর্ব-ধর্মে প্রত্যাবর্তন না করে, তার জন্য এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। আরবের বিভিন্ন গোত্রের বিদ্রোহ এবং ভণ্ড নবীদের উস্কানিমুলক কর্যকলাপ ইসলামকে এক বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। ধর্মত্যাগী মুসলমান ও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করার জন্য, আবু বকর ওসামার সৈন্যবহিনী ও অন্যান্য মুসলমানদের ধুলকাশাতে সমবেত হতে আহবান জানান। তিনি সৈন্যদলকে এগারটি ভাগে ভাগ করে- প্রতেকটি সৈন্যদলের নেতৃত্বে একজন অভিজ্ঞ সেনাপতিকে নিয়োগ করেন। খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে প্রথমে তুলায়হা এবং পরে মালিক বিন ননুবায়রার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। অবু জাহেলের পুত্র ইকরামকে মুসায়লামার বিরুদ্ধে পাঠান। ইকরামাকে সাহায্য করার জন্য শুরাহ্বিলকে অতিরিক্ত সেন্যসহ প্রেরণ করেন। মুহাজীর বিন আবি উমাইয়াকে ইয়েমেন ও হাযরামাউথ আক্রমণ করতে পাঠান হয়। সিরিয়ার সীমান্ত পাহারা দেওয়ার জন্য এক দল সৈন্য এবং আম্মান ও মাহরাতে বিদ্রোহ দমনের জন্য অপর দুই দল সেন্য প্রেরণ করেন। বুজাহ্ গোত্রের শক্তি খর্ব করার জন্য এক দল এবং বানু সালমা ও হাওয়াজিন গোত্রকে দমন করার জন্য অপর এক দল সৈন্য দল পাঠান। আবু বকর স্বয়ং প্রধান সেনাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মদিনা তার সৈন্য দলের ঘাঁটি ছিল। এখান থেকে তিনি সৈন্যবহিনীর গতিবিধি পরিচালনা করতেন। অভিযান প্রেরণের পূর্বে তিনি সেনাপতিদের উপদেশ দিলেন যে, তারা যেন প্রথমে বিদ্রোহী গোত্রগুলিকে ইসলাম গ্রহণে আমন্ত্রণ জানায়। যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে তখন যেন তাদেরকে আক্রমণ করা হয়। কতকগুলি গোত্র বিনাযুদ্ধে ইসলামের নিকট আত্মসমর্পন করল, কিন্তু অনেকেই পূর্ব মতে দৃঢ় রইল। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হল।

খালিদ বিন ওয়ালিদ নাজদের ভণ্ড নবী তুলায়হার বিরুদ্ধে প্রথমে অগ্রসর হন। তিনি 'বুচাকার যুদ্ধে তুলায়হাকে পরাজিত করলে, তুলায়হা পরাজিত হয়ে সিরিয়ায় পলায়ন করে। তার গোত্র বানুআসাদকে ক্ষমা করলে তুলায়হা মদীনায় ফিরে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। দেখুন : তুলায়হা (ভণ্ড পয়গম্বর)

তুলয়হাকে দমন করার পর খালিদ বিন ওয়ালিদ তামিম গোত্রের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন। নবী করীম (সাঃ) এর মৃত্যুর পর বানু তামিম ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে। এবং এই গোত্রের সাজাহ্ নিজেকে নবী হিসাবে দাবী করে। এই সময়ে তামিম গোত্রের উপগোত্রসমুহ খালিদের আনুগত্য স্বীকার করে। কিন্তু ইয়ারবু গোত্রের নেতা মালিক বিন নুবায়ারা আনুগত্য অস্বীকার করে। খালিদ তাকে যুদ্ধে পরাজিত করে। ৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে খালিদ অপর ভণ্ড নবী মুসায়লামাকে ইয়ামামার যুদ্ধে পরাজিত করেন।
                                                                               দেখুন : মুসায়লামা (ভণ্ড পয়গ
ম্বর)

কুরআন শরীফ যাঁদের কণ্ঠস্থ ছিল তাদেরকে হাফিজ বলা হত। ইয়ামামার যুদ্ধে প্রায় তিনশত হাফিজ মারা যায়। এত অধিক সংখ্যক হাফিজের মৃত্যু এবং ভবিষ্যতে বিভিন্ন যুদ্ধে আরও হাফিজের নিহত হতে পারে চিন্তা করে হযরত ওমর কুরআনের অস্তিত্ব রক্ষার ব্যাপারে আতঙ্কিত হয়ে উঠেন। এই কারণে খলিফা যায়েদ বিন সাবিতকে কুরানের সুরাগুলি সংগ্রহ ও সংকলনের কাজে নিয়োগ করেন। তাঁর সময়ই কুরআনের প্রথম সংকলন তৈরি হয়

হজরত মুহম্মদ (সাঃ) এর মৃত
্যুর অল্পকাল পরে বাহরাইনের মুসলিম শাসনকর্তা মুনজিরের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুতে উক্ত প্রদেশে বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়। বানু আবুল কায়েস নামে একটি গোত্র ইসলামের প্রতি অনুগত ছিল, কিন্তু বানু বকর গোত্র ইসলাম ত্যাগ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ফলে এই দুই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বানু বকর পারস্যের সাহায্য কামনা করে। পরে বানু বকর ও  পারস্যে সম্মিলিত বাহিনী মুসলমানদের নিকট পরাজিত হয়। খলিফার অন্যান্য সেনাবাহিনী পূর্ব-প্রদেশের উমান ও মাহরার স্বধর্ম ত্যাগ আন্দোলন দমন করে।

ভণ্ড পয়গম্বর আসাদ আনসির মৃত্যুর পর তার অনুচরদের দমনের জন্য খলিফা এই সমস্ত বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনী চালনা করার জন্য মুহাজীর বিন আবি উমাইয়াকে নিয়োগ করেন। মুহাজীর দক্ষিণ আরবের দিকে রওনা হলে পথে অনেক বিশ্বস্ত গোত্র তার দলে যোগদান করে। বিদ্রোহী নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক ঝগড়া থাকায় মুহাজীরের কাজ সহজ হয়। তিনি ইয়েমেনে শান্তি স্থাপন করে হাযরামাউথ প্রদেশকে খলিফার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্দা গোত্রের নেতারা এই রাজ্য শাসন করত। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবিতকালে কিন্দার নেতা আল-আসাদ বিন কায়েস ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু নবী মৃত্যুর পর সে ইসলাম ধর্মত্যাগ করে। হাযরামাউথের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের প্রদেশগুলি করায়ত্ত করে ইকরামা পূর্ব এবং মুহাজীর পশ্চিম দিক থেকে অগ্রসর হয়ে আল-আসাদকে আক্রমণ করেন। আল-আসাদ পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয় এবং দুর্গে আশ্রয় নেয়। পরে সে মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়ে মদীনায় প্রেরিত হয়। খলিফা তখন তাকে ক্ষমা করে দিলে, সে ইসলাম কবুল করে।

বাহরায়েনের বিদ্রোহের সময় পারস্যবাসীরা বিদ্রোহীদেরকে সাহায্য করেছিল। এর প্রতিশোধের জন্য খলিফা ১৩ হিজরীতে (৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে) সিপাহসালার মুসান্নার নেতৃত্বে ৮,০০০ সৈন্যের এক বাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু এই ব্যবস্থা নিরাপদ মনে না হওয়ায় তিনি অবিলম্বে বিখ্যাত সেনানায়ক খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে ১০,০০০ সৈন্যের আর একটি বাহিনীকে উবাল্লায় মুসান্নর সাথে মিলিত হতে আদেশ দিলেন। এরপর উবাল্লার ৫০ মাইল দক্ষিণে হাফির নামক প্রান্তরে উভয় পক্ষের সৈন্যরা মিলিত হয়। সেই সময় বীরশ্রেষ্ঠ খালিদ পারস্য সেনাপতি হরমুজকে সতর্কবাণী পাঠান। এই যুদ্ধে পারসিক সৈন্যরা পরষ্পরকে শিকলে বেঁধে যুদ্ধ করায় এই যুদ্ধ শৃংঙ্খল-যুদ্ধ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। হাফির নামক স্থানে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বলে একে হাফিরের যুদ্ধও বলা হয়। এর পর হরমুজ ও খালিদের মধ্যে মল্লযুদ্ধ সংঘটিত হলে হরমুজ খালিদের হাতে প্রাণ হারায়। এরপর আরও কয়েকটি ছোটখাট সংঘর্ষ হয়। অবশেষে পারসিক বাহিনী ইউফ্রেতিস নদীর পূর্বতীরে মেসোপটেমিয়ার দিকে বিতাড়িত হয়। এই সময় মুসলিম বাহিনী জনৈক পারসিক রাজকুমারী কর্তৃক রক্ষিত একটি দুর্গ জয় করে। এরপর হীরা অবরোধ করলে হইলে সেখানকার শানকর্তা আত্মসমর্পন করেন এবং খলিফাকে নিদিষ্ট কর দিতে রাজী হয়ে এক সন্ধিপত্র সম্পাদন করেন। হীরার নাসারারদের কাছ থেকে প্রাপ্তরাজস্বকে জিজিয়া নামে অভিহিত করা হয়।

হীরা বিজয়ের পর খালিদ উত্তর দিকে অগ্রসর হইয়া ফোরাত নদীর তীরবর্তী আন্বার ও আইনুততামুর নামক স্থান দু'টি দখল করেন। নবীর জীবদ্দশায় রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস তার প্রেরিত মুসলিম দূতকে সসম্মানে গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি মুসলমানদের দুশমনে পরিণত হন। প্রথমে খলিফা যখন দেখলেন যে, রোমসম্রাট সিরিয়া সীমান্তে বেদুঈনদের সাথে মুসলিম হুকুমের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তখন তিনি রোমান হামলা থেকে সীমান্ত রক্ষার বন্দোবস্ত করলেন। এ ছাড়া নাসারা শাসনকর্তা শুরাহ্বিল আন্তর্জাতিক চুক্তির খেলাপ করে। বসরার শাসনকর্তার নিকট প্রেরিত মহানবীর দূতকে মুতা নামক স্থানে হত্যা করেন। মুসলিম দূত হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সিরিয়ায় অভিযান প্রেরিত করেন।

হযরত আবু বকর মুসলিম সেনাদলকে তিনটি ভাগে ভাগ করে একটি সুপরিকল্পিত উপায়ে সিরিয়া অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। প্রত্যেক দলে তিন হাজার সৈন্য ছিল। আমর ইবনে আস, ইয়াযিদ ইবনে আবু সুফিয়ান এবং পরবর্তী সময়ে আবু সুফিয়ান সিরিয়ার পথে যাত্রা করেন। প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয় মরুসাগর ও আকাজ উপসাগরের নিকটবর্তী উপত্যকায়। এই যুদ্ধে ইয়াযিদের বাহিনী প্যালেস্টাইনের শাসনকর্তা সারগিয়াস বাহিনীকে পরাজিত করে। তখন বাইজান্টাইন দল ঘাজজার দিকে পলায়ন করিয়া প্রাণ বাঁচায়। সারগিয়াসের পরাজয়ের সংবাদ পাওয়া মাত্র সম্রাট হিরাক্লিয়াস তার ভ্রাতা থিয়োডোরাসের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। এই সংবাদে খলিফা আবু বকর বীরশ্রেষ্ঠ খালিদকে হীরা থেকে সিরিয়ায় গিয়ে বাইজান্টাইন বাহিনীর মোকাবিলা করার নির্দেশ দেন। মার্জরাহিত নামক স্থানে উভয় পক্ষ মিলিত হয়। খালিদ ঘাসানীয় সৈন্যদের সম্পূর্ণ পরাস্ত কর বসরার দিকে অগ্রসর হলেন। সেখানকার শাসনকর্তা জাবালা মুসলিম সেনাপতির ব্যশতা স্বীকার করলেন। এরপর খালিদ, আবু উবাইদা, ইয়াযিদ ও শোরাইবিলের সঙ্গে মিলিত হয়ে হিরাক্লিয়াসের ২,৪০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীর মোকাবিলা করেন। খালিদের সৈন্য ছিল মাত্র চল্লিশ হাজার। ৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে জুলাই আজনাদান নামক স্থানে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুসলিম সেনাবাহিনী অসুবিধা সত্ত্বেও যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়। হিরাক্লিয়াস এন্টিয়কে পলায়ন করলে বিজয়ী মুসলিম সিপাহসালার দামেসক অবরোধ করেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) যখন মৃত্যুশয্যা, তখন আজনাদানের বিজয় সংবাদ তার কাছে পৌছায়। এই সময় তার পীড়া গুরুতর ও আশঙ্কাজনক হয়ে উঠে। তিনি খলিফা মনোনয়নের ব্যাপারে পরামর্শের জন্য বিশিষ্ট মুসলমানগনকে আহবান জানান। হযরত ওমরের প্রতি সকলের দৃষ্টি নিবন্ধ হয়। হযরত আবু বকর প্রথমে আবদুর রহমান বিন আউফের সাথে পরামর্শ করেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেন আমি যেহেতু কোমল প্রকৃতির, সেইজন্যই তিনি অধিক কঠোরতা অবলম্বন করে থাকেন। এরপর তিনি হযরত ওসমান ও অন্যান্য বিশিষ্ট মুসলমানদের অভিমত গ্রহণ করলেন। অনেকে হযরত ওমরের কঠোরতার বিয় উল্লেখ করলেও শেষপর্যন্ত খলিফা পদের জন্য তার মনোনয়ন সমর্থন করলেন। প্রায় এক পক্ষকাল রোগ ভোগের পর ২৩ হিজরীর ২২ জামাদি-উস-সানি (৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে আগষ্ট) হযরত আবু বকর সিদ্দীক(রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন।