আসগর খান, এয়ার মার্শাল (অব)
(১৯২১-২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ)
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও লেখক।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি আফ্রিদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরে তাঁর পিতামাতা জম্মু-কাশ্মীরে বাস করা শুরু করেন। তিনি লাহোরের আইচিসন কলেজ থেকে পাশ করার পর, ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে দেরদুন রাজকীয় ভারতীয় সামরিক একাডেমীতে ভর্তি হন। কিন্তু বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানে চাকরিতে তাঁর বেশি আগ্রহ ছিল। কিন্তু এই সময় বিমান বাহিনীতে নতুন সৈন্য যুক্ত করার প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে- ব্রিটিশ সরকার রাজাকীয় ভারতীয় বিমান বাহিনীতে লোক নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সুযোগে তিনি ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে পদাতিক বাহিনী থেকে বিমান বাহিনীতে যাওয়ার জন্য আবেদন করেন। মাত্র নয় মাসে তিনি তার মৌলিক বিমান বিষয়ক উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ শেষে  ডিসেম্বর মাসে কমিশন  লাভ করেন এবং নম্বর ৯ স্কোয়াড্রন-এ বৈমানিক হিসেবে যোগ দেন। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি নম্বর ১১ স্কোয়াড্রনে বদলী হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা অভিযানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্কোয়াড্রন লিডার পদ লাভ করেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন। পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে উপযুক্ত অফিসারের ঘাটতি ছিল। তাই তিনি দ্রুত উইং কমান্ডার পদ লাভ করেন। এরপর তিনি গ্রুপ ক্যাপ্টেন এবং এয়ার কমোডোর পদ লাভ করেন।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ। আসগর খান ও মোহম্মদ আলী জিন্নাহ [সূত্র ডন: ১৮ মার্চ ২০২১]

চাকরীতে থাকাকালে তাঁর সাথে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ইস্কান্দার মীর্জা এবং সেনাপ্রধান (পরে রাষ্ট্রপতি) জেনারেল আইয়ুব খানের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। এসকল কারণে পদোন্নতি হয়েছিল বেশ দ্রুত।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এয়ার ভাইস মার্শাল হিসেবে পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রধান পদে আসীন হন। আইয়ুব রাষ্ট্রপতি হলে তিনি এয়ার মার্শাল হন।

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের পাক-ভারত যুদ্ধের জন্য, পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বহরে তখনকার দূর্ধ্বর্ষ লড়াকু বিমান এফ-৮৬ নিয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। এই যুদ্ধের শেষে ২২শে জুলাই আসগর বিমান থেকে অবসর নেন।

এপর তিনি পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পাকিস্তান এয়ারলাইন থেকে অবসর গ্রহণের পর, তিনি রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। মূলত পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের শাসন-ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনার মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনীতির শুরু হয়েছিল। পরে তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টো'র সমর্থন করা শুরু করেছিলেন।

আয়ুব বিরোধী আন্দোলন ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বিরোধী দলগুলোর সাথে রাজনৈতিক আলোচনার জন্য রাওয়ালপিণ্ডিতে আয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো এই বৈঠক বয়কট করেন। কিন্তু  বঙ্গবন্ধু গোলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা ও ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। আয়ুব খান শেষ পর্যন্ত এই দাবী অগ্রাহ্য করলে ১৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু গোলটেবিল বৈঠক ত্যাগ করেন এবং ১৪ মার্চ ঢাকায় ফিরে আসেন। এরপর আয়ুব খান সকল দলের সমন্বয়ে একটি একক দলের একটি সূত্র দেন। এই সভায় আসগর খান যোগদান করেন। সভা শেষে আসগর খান আয়ুব খানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এই সময় তিনি নতুন একটি দল গড়ার ঘোষণা দেন। দলটির নাম দিয়েছিলেন- জাস্টিস পার্টি। এর কিছুদিন পর তাঁর এই দলটি নওয়াবজাদা নাসিরুল্লাহ খানের 'পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট'-এর সাথে একীভূত হয়ে যায়। এই সময় তিনি রাজনীতি পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে এই সিদ্ধান্ত ত্যাগ করে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নতুন একটি দল তৈরি করেন। এই দলের নাম রাখেন তেহরিক-ই-ইস্‌তাকবাল'। এই দল থেকে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে এই দলের প্রধান হিসেবে তিনি 'বঙ্গবন্ধু'র সমর্থন করেছিলেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ১ লা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান,  ৩ মার্চ ঢাকায় আহুত জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন। এই সময় ইয়াহিয়া খানের, এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। ৪ মার্চ করাচি প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে, দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। ৫ই মার্চ বিকেলে তিনি করাচি থেকে ঢাকায় পৌঁছোন এবং সে রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। তিনি চলমান পরিস্থিতির জন্য ইয়াহিয়া খানকে, দায়ী করেন।

৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই তিনি সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে অনতিবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করেন। একই সাথে তিনি জানান যে, ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের জন্য আওয়ামী লীগ যে শর্ত দিয়েছেন তা ন্যায়সঙ্গত, উপযুক্ত, সুষ্ঠ ও বৈধ।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব-পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের শেষে  জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হন। নানা বিষয়ে  ভুট্টোর সাথে মতবিরোধ থাকলেও, তাঁর সহযোগিতা করেছেন। এই সকল বিরোধিতার কারণে তিনি কিছুদিন কারাভোগও করেছেন।

১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে তিনি নয়-দলের সাথে যুক্ত হন। এই দলের নাম ছিল- পাকিস্তান ন্যাশনাল এলায়েন্স (পিএনএ)। এই ভোটযুদ্ধে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জুলাই জিয়াউল হক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন। প্রথম দিকে আসগর খান দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জিয়াউল হকের অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেন। কিন্তু জিয়াউল হক সাধারণ নির্বাচন দিতে গড়িমসি করা শুরু করলে, আসগর খান তাঁর বিরুদ্ধে চলে যান।

১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে জিয়াউল হকের সামারিক শাসনের বিরুদ্ধে বামপন্থী দলগুলো মিলে একটি সম্মিলিত দল তৈরি হয়। এর নাম ছিল-
Movement for the Restoration of Democracy (MRD)। এই দলে আসগর খান তাঁর 'তারিক-ই-ইস্‌তিকবাল' নিয়ে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই দলের সাথে জিয়াউল হক বিরোধী আন্দোলনে সামিল হন। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন।

এরপর তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে রাজনীতি থেকে গুটিয়ে নেন। তাঁর দলের ভার গ্রহণ করেন, তাঁর ছেলে ওমর আসগর খান।

১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে জেনারেল পারভেজ মুশারফ ক্ষমতা দখল করলে, আসগর খান তাঁর কোনো প্রতিবাদ করেন নি। বরং মুশারফের মন্ত্রীসভায় যোগদানের জন্য তাঁর ছেলেকে উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি তাঁর দলের নাম পাল্টিয়ে নতুন নাম রাখেন ন্যাশনাল জামহুরি পার্টি। ইতিমধ্যে তাঁর ছেলে রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করলে, তিনি নিজেকে গৃহবন্দী করে প্রায় নির্বাসিত জীবন বেছে নেন।

২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারি রাওয়ালপিণ্ডি সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান বিমান বাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর, আসগর খান লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা


সূত্র: