বিনোদবিহারী চৌধুরী
ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ১৯৩০-এ সূর্যসেন-এর সহযোদ্ধা।


১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী থানার উত্তর ভূর্ষি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কামিনি কুমার চৌধুরী ছিলেন আইনজীবী। তাঁর মায়ের নাম রমা রানী চৌধুরী। তিনি ছিলেন পিতামাতার পঞ্চম সন্তান।

 

১৯২১-২২ খ্রিষ্টাব্দে ভারতব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে, তাঁর পিতা এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এই সময় তিনি তাঁর পিতার সাথে একরকম না বুঝেই সঙ্গী হিসেবে ছিলেন।

চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার রাঙ্গামাটিয়া বোর্ড স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। সেখান থেকে তিনি ফটিকছড়ি করোনেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। স্কুলে পড়ার সময় ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে, বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের অনুপ্রেরণায় তিনি তৎকালীন বিপ্লবী দল 'যুগান্তর'-এ যোগ দেন। পরে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে বোয়ালখালীর সারোয়াতলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। এসময় তিনি রায় বাহাদুর বৃত্তি পান। কলেজে পড়ার সময়, বিপ্লবী দলের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হন। এই সময় তাঁর সাথে সূর্যসেনের যোগাযোগ ঘটে। এ প্রসঙ্গে- দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার (১৮ জানুয়ারি ২০১০) সংখ্যার এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান -'আমি যখন বিপ্লবী দলে আসি তখন মাস্টারদা জেলে। ১৯২৪ সালে 'রাউলাট এ্যাক্ট' অনুযায়ী চট্টগ্রামসহ বাংলা এবং ভারতের অন্য প্রদেশ, বিশেষত পাঞ্জাব ও মুম্বাইয়ে অনেক লোক বিনা বিচারে আটক হয়। মাস্টারদা খবর পেয়ে আত্মগোপন করেন। আসাম, যুক্তপ্রদেশ প্রভৃতি জায়গায় গোপনে সফর করে তিনি সাংগঠনিক কর্মকা- চালান। দুই বছর আত্মগোপনে থাকার পর ১৯২৬ সালে 'ভারত রৰা আইন'-এ তিনি কলকাতা থেকে গ্রেফতার হন। '২৮ সালের শেষের দিকে তিনি জেল থেকে বের হন। চট্টগ্রাম ফিরে তিনি আবার সংগঠনকে গোছাতে থাকেন। রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, তারকেশ্বর দস্তিদার এঁদের কাছে তিনি আমার কথা শোনেন। ১৯২৯ সালের জুলাইতে আমি যখন চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হই, তখন তিনি আমার কাছে খবর পাঠান আমি যেন চট্টগ্রাম কলেজেই পড়ি এবং তাঁর সঙ্গে দেখা না হওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রাম ছেড়ে কোথাও না যাই। আমি চট্টগ্রাম কলেজের হিন্দু হোস্টেলে থাকতাম।

 

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিলে, মাষ্টার দা সূর্যসেন মোট ৬৫ জন যোদ্ধা নিয়ে প্রায় রাত দশটার দিকে আক্রমণ করে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে অবস্থিত অস্ত্রাগার দখল করেন। সূর্যসেন  বিপ্লবীদেরকে চারটি 'অ্যাকশন গ্রুপে' ভাগ করেছিলেন। প্রথম দলের দায়িত্বে ছিল ফৌজি অস্ত্রাগার আক্রমণ, দ্বিতীয় দলে ছিল পুলিশ অস্ত্রাগার দখল, তৃতীয় দলের ছিল টেলিগ্রাফ ভবন দখল, চতুর্থ দলের ছিল রেললাইন উৎপাটন। বিনোদবিহারী চৌধুরী ছিলেন পুলিশ অস্ত্রাগার দখল করার গ্রুপে। উল্লেখ্য এই আক্রমণে বিপ্লবীরা সামরিক পোশাকে সজ্জিত ছিলেন।  বিনোদবিহারী চৌধুরী'র দলের সদস্যরা শাবল চালিয়ে আলমারি ভেঙে অস্ত্র লুণ্ঠন করেন এবং অবশিষ্ট অস্ত্র ধ্বংস করে দেন।
 

হরিগোপাল বল (টেগরা) ও মতি কানুনগো

প্রাথমিকভাবে বিজয় লাভের পর, সূর্যসেন বিপ্লবীদের নিয়ে সুলুক পাহাড়ে আশ্রয় নেন। ১৯শে এপ্রিল সারাদিন এই পাহাড়ে কাটিয়ে পরে ফতেয়াবাদে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে  সূর্যসেন সবাইকে নিয়ে জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন। ২২শে ‌এপ্রিল বিকালে ট্রেনযোগে আগত বৃটিশ বাহিনীর জালালাবাদ পাহাড়ে অভিযান শুরু করে। জালাবাদ যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন ১৪ বৎসর বয়সী হরিগোপাল বল (টেগরা)। এরপর আগে পরে একে একে বিপ্লবীরা যুদ্ধে প্রাণ হারাতে থাকেন। জালালাবাদের যুদ্ধে শহীদ হন মোট ১১জন বিপ্লবী। এঁরা হলেন।  টেগরা বল, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেন, বিধু ভট্টাচার্য, মতি কানুনগো, প্রভাশ বল, শশাঙ্ক দত্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাস, মধু দত্ত জো পুলিন ঘোষ। এই যুদ্ধে কণ্ঠে গুলিবিদ্ধ হন বিনোদবিহারী। এই দিনের যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী জালালাবাদ পাহাড় দখল করতে পারে নি। তবে অবশিষ্ট বিপ্লবীদের নিয়ে সূর্যসেন রাতের অন্ধকারে জালালাবাদ পাহাড় ত্যাগ করেন। এই সময় বিনোদবিহারী চৌধুরী ছাড়াও বিনোদ দত্ত নামক অপর একজন বিপ্লবী আহত হয়েছিলেন। চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে ঐতিহাসিক সম্মুখযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বিনোদ বিহারী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, 'হঠাৎ একটা গুলি আমার গলার বাঁ দিকে ঢুকে ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। ঘণ্টা খানেক অচেতন ছিলাম। লোকনাথ দা, শান্তি নাগ, বনহরি দত্তের ডাকে সংবিৎ ফিরে পেলাম। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম সৈন্যসামন্ত নেই। গলায় তখন অসহ্য যন্ত্রণা। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে। বিপ্লবীরা লেঙ্গুট ছিঁড়ে আমার গলায় ব্যান্ডেজ করে দিলেন। আমাদের এক ক্লাসফ্রেন্ড রজত সেন। সে বলল, 'তোর কষ্ট হচ্ছে খুব, না? তোকে তাহলে গুলি করে মেরে দিই?' তখন শুনছি রজতকে উদ্দেশ করে লোকদা (বিপ্লবী লোকনাথ বল) বলছেন- না, ও বাঁচবে। ওকে গুলি করতে হবে না। ওকে আমরা নিয়ে যাব'। এভাবে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে বহুবার প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি।

বেশ কিছুদিন গোপনে চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি আত্মগোপন করেছিলেন। আর তখন তাঁকে মৃত কিংবা জীবিত ধরিয়ে দিতে ব্রিটিশ সরকার ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি সূর্যসেনকে চট্টগ্রাম কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠী। এ সময় সূর্যসেনের ঘনিষ্ঠ সহচর বিনোদ বিহারী সূর্যসেনের মৃত্যুতে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েন।


১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের রাজপুতনা দেউলি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী অবস্থাতেই পরীক্ষা দিয়ে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বিভাগে পাশ করেন। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ওই ক্যাম্পে বন্দী থাকাকালে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজিতে এমএ ও বিএল (আইনে স্নাতক) পাশ করেন ইংরেজ সরকার কতৃক গৃহবন্দী অবস্থায়।

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে বিনোদ বিহারী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন এবং চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সহ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে বিনোদ বিহারী চট্টগ্রাম কোর্টের আইন ব্যবসা শুরু করেন। এই সময় আইনজীবী কিরন দাশের মেয়ে বিভা দাশকে (বেলা চৌধুরী, ২০০৯ সালে ২৯ ডিসেম্বর তিনি মারা যান।) বিয়ে করেন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবার গ্রেপ্তার হয়। কারাগারে থাকা অবস্থায় বিনোদবিহারী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মনোনীত হন। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি।

 

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান আইন পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কংগ্রেস নেতা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে ধর্মভিত্তিক পৃথক নির্বাচনের বদলে যুক্ত নির্বাচনের আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান দেশের সব রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করলে সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিনোদবিহারী অবসরে যান।

 

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে ভারতের চর হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছিল। যুদ্ধের শেষে তিনি মুক্তিলাভ করেন।

 

১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর দুই ছেলে সুবীর চৌধুরী, বিবেকানন্দ চৌধুরীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা কলকাতায় স্থায়ী হন। কিন্তু সস্ত্রীক বাংলাদেশে থেকে যান।
 

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে স্বৈরশাসনবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে তিনি অংশ নেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতে আশ্রয় নেন এবং  কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। এই সময় থেকে তিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন শিক্ষকতাকে।

২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে ২৯ ডিসেম্বর তাঁর সহধর্মিণী বিভা দাশ মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে মোমিন সড়কের বাসাতেই।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল মৃত্যবরণ করেন।

সম্মাননা
১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ভোরের কাগজ সম্মাননা, শহীদ নতুনচন্দ্র স্মৃতিপদক।
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক জনকণ্ঠ গুণীজন সম্মাননা।

২০০০ খ্রিষ্টাব্দে বিনোদবিহারী স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন।
 

সম্মাননার সঙ্গে যে আর্থিক সম্মানী দেয়া হয়েছিল তাঁর কিছুই নিজের জন্য রাখেন নি তিনি। চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়াতে মাষ্টার দার যে বাস্তুভিটা রয়েছে তা দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করে সেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছেন। সেখানে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় নির্মাণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যান।



সূত্র :