উইলিয়ম
কেরি (William Carey)
(১৭৬১-১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দ)
ভাষাতাত্ত্বিক, খ্রিষ্টান মিশনারি।
১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই আগষ্ট উত্তর ইংল্যাণ্ডের নর্থহ্যাম্পটনডায়ার-এর একটি দরিদ্র
তাঁতী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম এডমুন্ড কেরি এবং মায়ের নাম
এলিজাবেথ।
১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হ্যাকেল্টন-এ ক্লার্ক নিকোলাস নামক এক মুচির অধীনে
কাজ শেখা শুরু করেন। এখানে থাকাবস্থায় তিনি চার্চ অফ ইংল্যান্ড ত্যাগ করে
হ্যাকেল্টনের নিকটবর্তী
Congregational church
চার্চের সাথে যুক্ত হন।
১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ক্লার্ক নিকোলাস-এর মৃত্যুর পর তিনি স্থানীয় জুতা প্রস্তুতকারক
থমাস ওল্ড-এর অধীনে চাকরি নেন। ১৭৮১ থমাস ওল্ড-এর শালী ডরোথি প্যাকেট-কে বিবাহ
করেন। তাঁদের বিবাহ হয়েছিল চার্চ অফ সেন্ট জন ব্যাপটিষ্ট গির্জায়। ডরোথি লেখাপড়া
জানতেন না, তাই বিবাহের স্বাক্ষরের স্থানে ক্রস চিহ্ন দিয়েছিলেন। এঁদের মোট ৫টি
পুত্র ও ২টি কন্যা সন্তান জন্মেছিলে। এঁদের দুটি কন্যাই শৈশবে মৃত্যুবরণ করে। আর
পিটার নামক পুত্রটি মারা যায় ৫ বৎসর বয়সে। এর কিছুদিনের ভিতরে থমাস ওল্ড মৃত্যুবরণ
করলে, কেরী তাঁর ব্যবসার সকল দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, থমাস ওল্ড
হিব্রুভাষা-সহ ইউরোপের অনেকগুলো ভাষা জানতেন। জুতা তৈরি ফাঁকে ফাঁকে তিনি কেরীকে
শিখিয়েছিলেন হিব্রু, ইতালিয়ান, ডাচ এবং ফরাসি ভাষা।
এইভাবে স্বশিক্ষিত হয়ে উঠার কারণে স্থানীয় মিশনারীদের সাথে সখ্য গড়ে উঠে। মাঝে
তাঁকে স্থানীয় গির্জায় ভাষণ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানোও হতো। ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে
মৌল্টন স্কুলে শিক্ষতার চাকরি পান। এই চাকরির পাশাপাশি তিনি প্যাস্টর হিসেবে
গির্জায় ভাষণও দিতেন। এই সময় তিনি গির্জা ও স্কুলের সূত্রে নানা ধরনের বই পড়ার
সুযোগ পান।
১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
Harvey Lane Baptist Church in Leicester-এ
পূর্ণকালীন প্যাস্টর পদ পান। এই সময় তিনি জুতো তৈরির কাজ ছেড়ে দিয়ে
পূর্ণদমে মিশনারির কাজ শুরু করেন। ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে এই বৎসরে প্রকাশিত হয়−
পাঁচখণ্ডের গ্রন্থ
,
An Enquiry into the Obligations
of Christians to use Means for the Conversion of the Heathens।
এই বৎসরের অক্টোবর মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়
the Particular Baptist
Society for the Propagation of the Gospel Amongst the Heathen।
এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ভারতে ধর্ম প্রচারের জন্য তাঁকে নির্বাচন করা হয়। ১৭৯৩
খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে জাহাজযোগে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এই যাত্রায় তাঁর
সঙ্গী হয়েছিলেন, তাঁর ফেলিক্স এবং টমাস ও তাঁর স্ত্রী-কন্যা। তাঁর নিজের স্ত্রী
ডরোথি তখন সন্তানসম্ভবা থাকায়, তিনি তাঁর বোনের তত্ত্বাবধানে স্ত্রীকে রেখে যাত্রা
করেন।
১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের
নভেম্বর মাসে তিনি কলকাতায় আসেন।
এই সময় দুটি নীলকুঠির মালিক ছিলেন টমাসের এক বন্ধু। এই
কুঠির ম্যানেজার হিসেবে তিনি চাকরি নেন এবং পুত্র ও পুত্রবধূদের নিয়ে মেদেনীপুরে
চলে আসেন। এই সময় টমাসের অনুরোধে তিনি
রামরাম বসুকে
তাঁর মুন্সি হিসেবে নিয়োগ দেন। পরবর্তী ছয় বৎসর এই কুঠিতে কাজ করেন।
১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ৫ বৎসরের পুত্র পিটার এই সময় আমাশয়
রোগে তাঁর পুত্র পিটার মারা যান। এই কারণে তাঁর স্ত্রীর স্নায়ুবৈকল্য হয় এবং শেষ
পর্যন্ত এই রোগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে।
উল্লেখ্য, ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দ (১২০৩ বঙ্গাব্দ) পর্যন্ত রামরাম বসু কেরির অধীনে কাজ করেন। এই সময়
এক বিধবার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখার অভিযোগে কেরি তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন।
সম্ভবত কেরি রামারাম বসুর কাছে বাংলা ভাষা শেখেন। তাঁর সামান্য জ্ঞান দিয়ে কেরি
বাইবেলের বাংলা অনুবাদ করা শুরু করেন
ইতিমধ্যে মূল মিশনারি কমিটি ভারতে আরও মিশানারি পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই
সূত্রে জন ফাউন্টেইন নামক একজন নতুন মিশানরি হিসেবে আসেন এবং মেদেনীপুরে স্কুল চালু
করেন। এরপর ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে আসেন উইলিয়াম ওয়ার্ড, ডেভিড ব্রুনস্ডন,
জশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়াম গ্র্যান্ড। এই সময়
ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি খ্রিষ্টধর্ম
প্রচারে বাধা দিত। তাই মার্শম্যান এবং ওয়ার্ড কোম্পানিকে ফাঁকি দিয়ে একটি
মার্কিন জাহাজে এসেছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাঁদের আসল উদ্দেশ্যের খবর পেয়ে তাঁদের
গ্রেপ্তার করতে যায়। সেজন্যে তাঁরা কলকাতার অদূরে ডেনিশ মিশন শ্রীরামপুরে আশ্রয়
নিতে বাধ্য হন।
১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি কেরি এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। এঁদের প্রচেষ্টায়
শ্রীরামপুরে একটি মিশন গড়ে উঠে। ধর্মপ্রচার ও শিক্ষা প্রসারের তাঁর একটি ছাপাখানা
স্থাপন করেন। এই প্রেস থেকে কেরির অনূদিত বাইবেলের ছাপা শুরু হয়। এই বছরেই
ফাউন্টেইন মারা যান এবং তাঁরা প্রথম কৃষ্ণ পালকে খ্রিষ্টান বানাতে সক্ষম হন।
১৮০১
খ্রিষ্টাব্দে ডেভিড ব্রুনস্ডন এবং টমাস মৃত্যুবরণ করেন। এই বছরে কোম্পানির
গভর্নর-জেনারেল ওয়েলেসলি ইংল্যান্ড থেকে আগত কোম্পানির তরুণ সিভিলিয়ানদের দেশীয়
ভাষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভূগোল ইত্যাদি শেখানোর উদ্দেশে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম
কলেজ স্থাপন করেন। কিন্তু তখন কলকাতায় বাংলা ভাষার একমাত্র সাহেব-পণ্ডিত-হেনরি
পিটস ফরস্টার তাঁকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করতেন বলে বাংলা বিভাগ খুলতে পারেন
নি। কেরিকে বাংলা বিভাগের উপযুক্ত শিক্ষক বিবেচনা করে ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ বাংলা বিভাগ চালু হয়। সেই সাথে কেরির অধীনে কয়েকজন বাঙালি
পণ্ডিত এবং মুনশিও নিযুক্ত হন। দেশীয় পণ্ডিতদের নিয়ে কেরি শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার
করার মতো কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেন। রামরাম বসু এবং মৃত্যুঞ্জয়
বিদ্যালঙ্কার প্রথম দু বছরে তিনটি গ্রন্থ এবং কেরি একটি বাংলা ব্যাকরণ ও আদর্শ
সংলাপের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন।
১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিজের মত করে একটি মিশানারি স্থাপন করেন।
১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মারাঠী ব্যাকরণ (Marathi grammar)
প্রকাশিত হয়।
১৮০৭
খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এই বৎসরে তিনি বেঙ্গালি এশিয়াটিক
সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করেন।
১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ড্যানিশ মেয়ে
Charlotte Rhumohr-কে
বিবাহ করেন। এই বৎসরে তাঁর সংস্কৃতিতে অনূদিত নতুন নিয়ম প্রকাশিত হয়।
১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাতে সম্পূর্ণ বাইবেলের অনুবাদ সম্পন্ন হয়।
১৮১১ খ্রিষ্টাব্দে মারাঠি ভাষায় নতুন নিয়ম প্রকাশিত হয়।
১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে পাঞ্জাবি ভাষায় নতুন নিয়ম প্রকাশিত হয়।
১৮১৮
খ্রিষ্টাব্দে সংস্কৃত ভাষায় পুরাতন নিয়ম অনূদিত হয়।
১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা সেপ্টেম্বর এ্যাগ্রিকলাচার এবং হর্টিকালচার সোসাইটি স্থাপন
করেন। এই বৎসরে তিনি মারাঠি ভাষায় পুরাতন নিয়ম প্রকাশ করেন।
১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীরামপুর স্কুলকে কলেজে উন্নীত করেন। এই বছরে তাঁর দ্বিতীয়
স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন।
১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি গ্রেস হগসকে বিবাহ করেন।
১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি বাংলা-ইংরেজি অভিধান প্রণয়ন করেন।
১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।