ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং ইসলাম ধর্মমতে পয়গম্বর।
বাইবেল ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থাদি অনুসরণে, ধারণা করা হয়
আনুমানিক ১০৪০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দাউদ (আঃ) বেথেলহামে জন্মগ্রহণ করেন ছিলেন। বাইবেলের
স্যামুয়েল প্রথম গ্রন্থ মতে- এঁর পিতার নাম জেসি। মায়ের নাম নিটজেট। লূকলিখিত সুসমাচার মতে যীশুর পুর্বপুরুষ ইয়াকুবের পুত্র, ইয়াহুদার অধস্তন বংশধর।
তিনি ছিলেন ছিলেন পিতামাতার আট পুত্রের মধ্যে কনিষ্ঠ।
শৈশবে তিনি ছিলেন পিতার মেষপালের পালক। তিনি নিজের চেষ্টায় সঙ্গীতবিদ্যা আয়ত্ব করেছিলেন এবং
বীণাবাদক হিসেবে বেথেলহাম এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে সুখ্যাতি অর্জন
করেছিলেন। এই সূত্রে ইস্রায়েলের তৎকালীন ইস্রায়েলের রাজা সৌলের প্রিয়পাত্র হয়ে
উঠেছিলেন। একসময় সৌল ফিলিস্তানি রাজা স্যামুয়েলের শাসনের বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
স্যামুয়েল এই বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে পরাজিত হন। কিন্তু সীমালঙ্ঘনের জন্য ঈশ্বরের
প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করায়, ঈশ্বর সৌল এবং তাঁর পুত্র যোনাথন ঈশ্বরের বিরাগভাজন
হন। এদের দমন করার জন্য ঈশ্বর দাউদ (আঃ)-কে মনোনীত করেন।
ঈশ্বরের নির্দেশে
স্যামুয়েল বেথেলহামে এসে দাউদ (আঃ)-কে তেল শিঙা দিয়ে অভিষিক্ত করেছিলেন। একই সময় দাউদ
(আঃ) ঈশ্বরের দ্বারাও নবী হিসেবে মনোনীত হন। পরে তিনি রাজা সৌলের কাছে এসে
অস্ত্রবাহকের চাকরি নেন। এরপর ইস্রায়েল এবং সৌলের সৈন্যরা এলা উপত্যাকায়
ফিলিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তাবু ফেলেন। যুদ্ধ শুরুর সময়, দাউদ (আঃ) বাড়িতে ছিলেন।
এই যুদ্ধে দাউদের বড় ভাই এলিয়াব, আবিনাদাব এবং শাম্মা অংশগ্রহণ করেছিলেন। দাউদ (আঃ)
তাঁর পিতাজোসের নির্দেশে ভাইদের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে খাবার পৌঁছে দিতেন। যুদ্ধের
ময়দানে ফিলিস্তানীদের
পক্ষের বীর বীর যোদ্ধা ছিলেন গলিয়াথ। তিনি সৌলের বাহিনীর বীরের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রস্তাব দেন।
দাউদ (আঃ) এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে গলিয়াথের মুখোমুখী হন এবং তাঁকে হত্যা করেন।
ফিলিস্তিনিদের গলিয়াথের মৃত্যর পর, তাঁদের সকল সৈন্য পালিয়ে যায়। এরপর দাউদ (আঃ) ভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে জয়লাভ করেন।
এই সময় সৌলের পুত্র যোনাথনের সাথে তাঁর গভীর
বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
বীর হিসেবে দাউদ (আঃ)-এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকলে, সৌল ঈর্ষান্বিত হয়ে দাউদকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু দাউদ
(আঃ)-এর স্ত্রী
মিখাল বিষয়টি জানতে পেরে তাঁকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। দাউদ (আঃ) এরপর সামুয়েলের কাছে আশ্রয় নেন। দাউদ
(আঃ) এবং সামুয়েল নায়োতে এলে, সৌল তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য একদল সৈন্য পাঠান। সৈন্যরা নায়োতে এলে- ঈশ্বর তাদের মনে
ভাবান্তর ঘটালেন। ফলে সৈন্যরা দাউদ (আঃ)-কে গ্রেফতার করলেন না। এরপর সৌল আরও দুই বার
সৈন্য পাঠালেন এবং প্রতিবারই ঈশ্বর তাঁদের ভাবান্তর ঘটালেন। সবশেষে সৌল নিজেই এলেন
এবং ঈশ্বর তাঁকেও ভাবান্তর করে দিলেন। এই সময় দাউদ (আঃ) নায়োতে থেকে পালিয়ে সৌলের পুত্র
যোনাথনের সাথে দেখা করে যোনাথনে সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এরপর দাউদ (আঃ) নোব্-নগরের আহিমেলখের
কাছে যান। এখান থেকে তিনি অস্ত্র সংগ্রহ করে ফিলিস্তিনি অঞ্চলে ফিরে যান এবং রাজা
আখীসের রাজদরবারে উপস্থিত হন। কিন্তু রাজা আখীস তাঁকে পাগল নামে আখ্যায়িত করে
ক্ষতি করার চেষ্টা করেন। ফলে দাউদ পলাতক হয়ে আদুল্লাম গুহা, মিপ্পে ঘুরে হেরেতের
বনাঞ্চলে আসেন। সৌল বিষয়টি জানার পর, দাউদ (আঃ)-এর আশ্রয়দাতের শাস্তি দিলেন
এবং একই সাথে ধর্মযাজক-সহ বহু সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেন। এই সময় ফিলস্তিনিরা কেয়ীলা
নগরে হানা দিয়ে লুটপাট করা শুরু করলে, দাউদ (আঃ) ঈশ্বরের অনুমতি নিয়ে কেয়ীলা অঞ্চল থেকে
ফিলিস্তানীদের বিতারিত করেন। সৌল কেয়ীলা নগর থেকে দাউদ (আঃ)-কে গ্রেফতার করার চেষ্টা করলে
তিনি মরু প্রান্তের জীফ্-অঞ্চলে পালিয়ে যান। সৌল এই সংবাদ পেয়ে সৌল জীফ-অঞ্চলে অভিযান
চালান। কিন্তু এবারেও তাঁর পুত্র যোনাথন দাউদ (আঃ)-এর পক্ষালম্বন করেন।
স্থানীয় লোকদের সহায়তায় দাউদ (আঃ) নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হন। শেষ পর্যন্ত সৌল একটি
গুহায় দাউদ (আঃ)-এর সাথে দেখা হয়। তিনি সৌলকে আক্রমণ করে হত্যা করতে পারতেন। কিন্তু তা না
করে সৌলের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করেন। কারণ সৌল ঈশ্বরের আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। সৌলও অনুতপ্ত হয়ে তাঁর উপর থেকে সকল
সাময়িকভাবে ক্রোধ তুলে
নিলেন।
সৌলের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠার পর, দাউদ (আঃ) বেথেলহামে ফিরে আসেন। এর কিছুদিন পর সামুয়েল
মৃত্যুবরণ করলে, দাউদ (আঃ) পারান মরুপ্রান্তরে আসেন। সেখানে নাবাল নামক এক ধনী ব্যক্তি
এসে ভেড়া চুরি এবং জোর করে ভেড়ার লোম কাটা শুরু করলে, তিনি এর জন্য ক্ষতিপূরণ প্রার্থনা করেন।
কিন্তু নাবাল এই দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। দাউদ (আঃ)-এর তাঁর অনুগত সৈন্যদের নিয়ে নাবালের বাড়ি গিয়ে তাঁর
ধর্মপ্রাণা স্ত্রী অবিগাইলের কাছে গিয়ে বিষয়টি জানান। সব শুনে অবিগাইল দাউদ (আঃ)-এর
কাছে সকলের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেন। এই সংবাদ পেয়ে নাবাল মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং শেষ
পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু হয়। নাবালের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর দাউদ (আঃ) অবিগাইলের কাছে বিবাহের
প্রস্তাব পাঠান। অবিগাইল এই প্রস্তাবে রাজি হলে, তিনি তাঁকে বিবাহ করেন। অবশ্য ইতিমধ্যে
দাউদ (আঃ) জেস্রয়েল নগরের অহিনোয়াম নামক একটি মেয়েকে বিবাহ করেছিলেন। এছাড়া সৌলের কন্যা
মিখলকেও তিনি বিবাহ করেছিলেন।
সৌল পুনরায় দাউদ (আঃ)-এর বিরুদ্ধাচারণ শুরু করেন। তিনি হাখীলা-পাহাড়ে থাকার সময়,
সৌল তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য তিন হাজার সৈন্য প্রেরণ করেন। এই সংবাদ পাওয়ার পর,
দাউদ (আঃ) রাত্রে সৌলের তাবুতে হানা দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁকে বন্দী করেন। সৌল ঈশ্বরের
আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন বলে, তিনি এবারেও তাঁকে হত্যা না করে ক্ষমা করে দেন। সৌল এবারও অপরাধ
স্বীকার করে এবারেও দাউদ (আঃ)-এর হাত থেকে রক্ষা পান। কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সুযোগ পেলেই
সৌল তাঁকে হত্যা করবেন। তাই তিনি সৌলের কাছে অনুমতি নিয়ে ফিলিস্তিনি অঞ্চলে বসবাস
শুরু করেন। এখানে তিনি রাজা আখীশের কাছে আশ্রয় নেন। পরে আখীশ তাঁকে সিক্লাগ
নগর দান করেন। এখানে তিনি তাঁর দুই স্ত্রী আহিনোয়ম এবং অবিগাইলকে নিয়ে বসবাস শুরু
করেন।
দাউদ (আঃ) সিক্লাগ নগরে স্থিতি হয়ে বসার পর, একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। এই
বাহিনী আশপাশের অঞ্চলে হানা দিয়ে নির্বিচারে সবাইকে হত্যা এবং গবাদী পশু-সহ
সেখানকার সকল সম্পদ লুট করা শুরু করে। এই সময় ফিলিস্তানিরা প্যালেস্টাইনের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ করা প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিল। এই অবস্থায় দাউদ রাজা আশীখের প্রধান দেহ
রক্ষীর দায়িত্ব পান। ফলে এঁদের একটি যৌথ বাহিনী গড়ে উঠে। ফিলিস্তিনি বাহিনী শুনম
নামক স্থানে তাবু ফেলে। অন্যদিকে ইস্রায়েল বাহিনী সৌলের নেতৃত্বে গিলবোয়ায় তাবু ফেলে।
কিন্তু বিশাল ফিলিস্তিনি সেনাবাঈনী দেখে সৌল ভয় পেয়ে যান। তিনি একজন নারী গণনাকারীর শরণাপন্ন
হয়ে ভবিষ্যৎ গণনা করার জন্য মৃত সামুয়েলের প্রতাত্মাকে ডাকেন। এই সূত্রে তিনি
দাউদের প্রতি ঈশ্বরের বিশেষ আনুকুল্যের বিষয় জানতে পেরে হতাশ হয়ে পড়েন।
ইতিমধ্যে ফিলিস্তনি বাহিনী নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য দাউদ (আঃ)-কে, তাঁদের
সেনাবাহিনীকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এরপর রাজা আখীশের সিদ্ধান্ত অনুসারে
দাউদ (আঃ) দলবল নিয়ে সিক্লাগে চলে যান। ইতিমধ্যে আমালেকীয়রা এই নগরী আক্রমণ করে
ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এরা এই নগরীর সকল অধিবাসীকে বন্দী করে নিয়েছিল। এই কারণে
সৈন্যরা দাউদ (আঃ)-এর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। পরে ঈশ্বরের নির্দেশে তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে
আমালেকীয়দের বিরুদ্ধে অভিযানে অগ্রসর হন। তিনি আমালেকীয় বাহিনীর উপর ক্রমাগত আক্রমণ
চালিয়ে সকলকে হত্যা করে পরিবার পরিজনকে উদ্ধার করেন এবং সকল সম্পদ হস্তগত করেন।
তিনি সিক্লাগে ফিরে এলে সৈন্যরা তাদের পরিবার এবং সম্পদ ফিরে পায়।
অন্যদিকে ফিলিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে, ইস্রায়েল বাহিনী পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে সৌল ও
তার তিন পুত্রকে গিল্বোয়া পর্বতে হত্যা করা হয়েছিল। সৌল এবং তাঁর পুত্রদের মৃত্যু
সংবাদ তিনি পেয়েছিলেন সিক্লাগে ফিরে আসার পর। এই সংবাদ পাওয়ার পর, দাউদ (আঃ) শোকে ভেঙে পড়েন।
এরপর ঈশ্বরের আদেশে তিনি হেব্রোন নগরে চলে আসেন এবং এখানে তিনি নতুন রাজত্ব শুরু
করেন। এই সময় সৌলের সেনাপ্রধান আব্নে সৌলের পুত্র ঈশ্বোশেৎকে উদ্ধার করতে সক্ষম
হয়েছিলেন। পরে ঈশ্বোশেৎকে ইস্রায়েলের রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল। ঈশ্বোশেৎ
মাহাইনামে নতুন রাজত্ব শুরু করেছিল। এর কিছুদিন পর ইস্রায়েল বাহিনী গিবেয়োনের দিকে
অভিযান চালান। এই সময় তাঁর বাহিনী গিবেয়োনের বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে,
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করে। এই যুদ্ধে দাউদ (আঃ)-এর বাহিনীর কাছে ইস্রায়েলের বাহিনী
পরাজিত হয়। এরপর সৌল বংশের সাথে দাউদ বংশের দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলছিল।
হেব্রোনে আসার পর দাউদ (আঃ)-এর ছয় জন স্ত্রীর গর্ভে ছয়টি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণে তথ্য পাওয়া
যায়, বাইবেলের সামুয়েল দ্বিতীয় ভাগ থেকে। এর হলেন-
- প্রথম পুত্র: মাতা আহিনোয়াম
- দ্বিতীয় পুত্র: মাতা আবিগাইল
- তৃতীয় পুত্র: মাতা মায়াকা
- চতুর্থ পুত্র: মাতা হাগগীত
- পঞ্চম পুত্র: মাতা শেফাতিয়া
- ষষ্ঠ পুত্র: মাতা এগ্ল
এরপর ঈশ্বোশেতর সাথে আব্নেরের
যুদ্ধ, যোয়াবের হাতে আব্নের মৃত্যু, ঈশ্বোশেতরের হত্যা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে
ইস্রায়েল নেতৃত্ব শূন্য অবস্থায় দাঁড়ায়। পরে ইস্রায়েলের জনগণের অনুরোধে
দাউদ (আঃ)
ত্রিশ বৎসর বয়সে (১০১০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ইস্রায়েলের রাজা হন। এরপর তিনি জেরুজালেম অভিযানে বের হন। কয়েক দিন
অবরুদ্ধ করে রাখার পর, তিনি জেরুজালেম নগরী দখল করেন এবং এখানে তিনি স্থায়ীভাবে রাজত্ব
শুরু করেন। জেরুজালেমে থাকার সময় তিনি কয়েকটি উপপত্নী গ্রহণ করেছিলেন। এঁদের নাম
ছিল- শাম্মুয়া, শোবাব, নাথান, সলোমন, ইভার, এলিশূয়া, নেফেগ, যাফিয়া, এলিশামা,
এলিয়াদা ও এলিফেলেৎ।
জেরুজালেমে রাজপদ অধিকার পর, ফিলিস্তানি বাহিনী জেরুজালেম দখলের জন্য যুদ্ধযাত্রা
করে। এই যুদ্ধের দাউদ সকল যুদ্ধক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের পরাজিত করেন। এরপর তিনি
বায়াল-যুদা থেকে 'ঈশ্বরের আজ্ঞাপত্র' অধিকার করেন। এরপর তিনি সৌ্লবংশের
উত্তরাধিকার খোঁজার উদ্যোগ নেন। অচিরেই তিনি তাঁর বন্ধু যোনাথনের পুত্র
মেফিবোশেৎ-এর সন্ধান পান। তিনি এঁদের পরিবার পরিজনের সুরক্ষার ব্যবস্থা নেন এবং
মেফিবোশেৎ-কে তিনি নিয়মিত তাঁর আহারের সঙ্গী করে নেন।
এর কিছুদিন পর আম্মেবীয়রা দাউদের দূতকে অপমান করায়, তিনি আম্মোনীয়দের বিরুদ্ধে
অভিযান চালান। এই যুদ্ধ আম্মোনীয়রা পরাজিত হয়ে, দ্বিতীয় বার যুদ্ধাভিযানে নামে।
এই অভিযানেও
দাউদ (আঃ)-এর হাতে আম্মোনীয়রা পরাজিত হয়।
এরপর
দাউদ (আঃ) তাঁর কামনার বশবর্তী হয়ে কিছু মারাত্মক অপরাধ করেন। প্রথমে তিনি
তাঁর অনুগত সেনাপতি উরীয়ের স্ত্রী সুন্দরী স্ত্রী বাৎশেবাকে কৌশলে ঘরে এনে ভোগ
করেন। এর ফলে বাৎশেবা গর্ভবতী হয়ে পড়েন। এই ঘটনা উরীয় জানার আগে,
দাউদ (আঃ) কৌশলে তাঁকে
যুদ্ধক্ষেত্রের দুর্বল জায়গায় পাঠান। পরে তাঁর নির্দেশে যুদ্ধক্ষেত্রে উরীয়কে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে
সৈন্যরা পিছিয়ে আসে। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে উরীয় প্রাণ হারান। এই ঘটনার পর ঈশ্বর
নাথান নামক প্রবক্তাকে পাঠিয়ে
দাউদ (আঃ)-কে তিরস্কার করেন। যথাসময়ে বাৎশেবা একটি
পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু সাত দিন অসুস্থ থাকার পর শিশুটির মৃত্যু হয়। এই
সাত দিন তিনি উপবাস থেকে এবং আত্মধিক্কারের মাধ্যমে প্রায়শ্চিত্ত করেন। শিশুটির মৃত্যুর পর,
দাউদ বাৎশেবাকে বিবাহ করেন। এই স্ত্রীর গর্ভে সলোমন নামক একটি পুত্র সন্তান
জন্মগ্রহণ করেছিল।
এরপর
দাউদ (আঃ) আম্মোনীয়দের রাজধানী রাব্বা নগরী অধিকারের জন্য যোয়াব নামক সেনাপতির অধীনে
একটি বিশাল বাহিনী প্রেরণ করে। যোয়াব নগরী অবরুদ্ধ করে
দাউদ (আঃ)-কে খবর পাঠান। পরে
তিনি
এই নগরী দখল করে আম্মোনীয় রাজার মুকুট অধিকার করেন।
দাউদ (আঃ)-এর জ্যৈষ্ঠপুত্র আম্মোন, তাঁর সৎবোন তোমরকে ধর্ষণ করেছিলেন। বিষয়টি
তিনি জানার
পর ক্ষুব্ধ হন কিন্তু জ্যৈষ্ঠপুত্র হিসেবে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু তোমরের ভাই আব্শালেম
এই ঘটনাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেন নি। তিনি এক ভোজসভায় আম্মোনকে হত্যা করে পালিয়ে
গিয়েছিলেন। অনেক পরে অবশ্য দাউদ আব্শালেমকে ক্ষমা করেছিলেন। আব্শালেম গভীর
চক্রান্ত করে রাজপদ অধিকারের চেষ্টা করেন। তিনি একটি ঘোড়ায় চড়ে রাজধানীর বাইরে থেকে
লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে তাঁর স্বপক্ষে সাধারণ মানুষকে আনার উদ্যোগ নেন। পুরো
চারবছর গোপনে এই কাজটি করে নিজের অনুগত একটি বাহিনী তৈরি করে ফেলেন। এরপর
দাউদ (আঃ)-এর
অনুমতি নিয়ে তিনি মানতের অজুহাতে হেব্রোনে যান। ধীরে ধীরে তিনি তাঁর অনুগত সৈন্যদের
নিয়ে হেব্রোনের রাজশক্তি অধিকার করেন।
দাউদ (আঃ) যখন
বিষয়টি জানতে পারলেন, তখন পুত্রের সাথে দ্বন্দ্বে না
গিয়ে, জেরুজালেম ত্যাগ করেন। এই সময় তিনি তাঁর ১০জন স্ত্রীর উপর নগর রক্ষার ভার
অর্পণ করে গিয়েছিলেন। পালিয়ে যাওয়ার সময় অনেকে
দাউদ (আঃ)-কে যেমন সাহায্য করেছিলেন, আবার
অনেকে তাঁকে তিরস্কারও করেছিলেন।
|
আবশোলোমের স্তম্ভ
|
দাউদ (আঃ) পালিয়ে যাওয়ার পর আব্শালেম তাঁর দুই উপদেষ্টাকে নিয়ে জেরুজালেম পৌঁছান। তিনি
আহিথোফেল নামক জনৈক উপদেষ্টার পরামর্শে রাজ্য শাসন শুরু করেন। এরপর তিনি নিজের নামে
একটি স্তম্ভ তৈরি করেন। এই স্তম্ভটিকে এখনো আবশোলোমের স্তম্ভ বলা হয়।
পলাতক
দাউদ (আঃ)-কে সন্ধান করতে গিয়ে আব্শালেম জানতে পারলেন যে-দাউদ
(আঃ) জর্ডন নদীর ওপারে
পালিয়ে গেছেন। তিনি তাঁর সেনাবাহিনী জর্ডন নদী পার হয়ে
দাউদ (আঃ)-এর সন্ধান করতে গিয়ে
জানতে পারলেন যে, তিনি মাহানাইমে পালিয়ে গেছেন। এরপর
দাউদ (আঃ) সৈন্য সংগ্রহ করে,
আব্শালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। তবে তিনি তাঁর সৈন্যদের বলে দিয়েছিলেন যে আব্শালেমকে
যেন হত্যা না করা হয়। এই যুদ্ধে তিনি তাঁর সৈন্যদলকে নানা ভাগে করে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আব্শালেম
সেনাবাহিনী থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে খচ্চরের পিঠে চড়ে
দাউদ (আঃ) সন্ধান করার
সময়, একটা তার্পিন গাছের ডালের ফাঁকে তাঁর মাথা আটকে যায়। এই অবস্থায় খচ্চরটি তাঁর
নিচ থেকে সরে গেলে,
আব্শালেম তার্পিন গাছের সাথে ঝুলতে থাকে।
দাউদ (আঃ)-এর ভ্রাম্যমাণ সৈন্যদের একটি দলের
সেটা নজরে এলে, দলের অধিপতি যোয়াব ঝুলন্ত আব্শালেমকে বর্শার আঘতে হত্যা করে। এই
সংবাদ পাওয়ার পর,
দাউদ (আঃ) পুত্রশোকে গভীর ভাবে বিলাপ করতে থাকেন।
এরপর
দাউদ (আঃ) জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
কিন্তু বেঞ্জামিন গোষ্ঠীর শেবা তাঁর
আনুগত্য অস্বীকার করেন এবং নিজেদের দলবল নিয়ে তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেন।
দাউদ (আঃ)
জেরুজালেমে পৌঁছে শেবা'র বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য প্রথমে আমিশাকে দায়িত্ব দেন।
কিন্তু আমিশা শেবার পক্ষে চলে যান। পরে আবিশাকে এই দায়িত্ব দেন। এরপর
দাউদ (আঃ)-এর
সৈন্যরা প্রথমে আমিশাকে হত্যা করে এবং শেবাকে অনুসরণ করা শুরু করে। শেবা তার দলবল
নিয়ে বেরীয় অঞ্চলে প্রবেশ করে। এরা আবেল-বেথ-মায়াকা নগরে আশ্রয় নেয়। পরে একজন
বুদ্ধিমতী নারীর সহায়তায় এই নগরীটি রক্ষা পায় এবং নগরবাসী শেবার মাথা কেটে দাউদ-বাহিনীর প্রধান যোবায়ের হাতে সমর্পণ করে।
সৌল বংশধরদের দ্বারা গিবনীয়দের উপর অত্যাচারের জন্য ঈশ্বর দেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি
করেন। এই দুর্ভিক্ষ চলেছিল প্রায় তিন বছর। পরে ঈশ্বরের কাছ থেকে এই বিষয় জানতে পেরে,
দাউদ গিবনীয়দের ক্ষতিপূরণ ও রক্ষার অঙ্গীকার করেন। গিবনরা সৌল বংশের সাতজন পুরুষকে
দাবি করেন, যাদের এরা গিবোয়ায় নিয়ে গিয়ে শূলে চড়াবেন। তবে তাঁরা এই তালিকায় যোনাথনের
পুত্র মেফিবোশেৎকে বাদ দেন। পরে
দাউদ (আঃ) এদের হাতে সৌল বংশের সাতজন পুরুষকে তুলে দেন।
এই সাতজনকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করে।
এর কিছুদিন পর ফিলিস্তিনি ও ইস্রাইলের মধ্যে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথমে এই যুদ্ধ
শুরু হয়েছিল গোব অঞ্চলে। পরে এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল গাৎ নগরে। শেষ পর্যন্ত উভয়
পক্ষের বহু ক্ষয়ক্ষতির পর, যুদ্ধের অবসান ঘটেছিল।
দাউদ (আঃ) তাঁর রাজ্যে জনগণনা করেছিলেন। পরে এই কাজটি তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে
করেছেন, এমন ভাবনায় কাতর হয়ে পড়েন। এজন্য তিনি ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
এরপর ঈশ্বরের প্রবক্তা গাদ এসে তাঁকে এর প্রতিকারের জন্য তিনটি ইচ্ছার একটি বেছে
নিতে বলেন। এই ইচ্ছা তিনটি হলো-
- সাত বছর ধরে
দুর্ভিক্ষ হবে
- তিন মাস ধরে শত্রুরা
তাড়া করে বেড়াবে
- তিন দিন ধরে রাজ্যে
মহামারী হবে।
দাউদ (আঃ) মহামারীকে বেছে নেন।
এরপর সারা রাজ্যে দলে দলে লোক মহামারীতে মৃত্যুবরণ করতে থাকে। তবে ঈশ্বর এই মহামারী
থেকে জেরুজালেম পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। দাউদ (আঃ)
এই অবস্থায় ঈশ্বরকে জানান যে, পাপ তো করেছে
সে, অপরাধ তো তারই। এরজন্য সাধারণ মানুষের মৃত্যু হবে কেন? এরপর গাদের পরামর্শে
দাউদ জেবুসীয় আরাউনের খামারে একটি যজ্ঞবেদী প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে কয়েকটি পশু
বলি দেন। এরপর মহামারী বন্ধ হয়েছিল।
দাউদ (আঃ) আনুমানিক ৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেমে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর
রাজত্ব লাভ করেছিলেন তাঁর পুত্র সলোমন।
|
লেনিনগ্রাড কডেক্স, ১০০৮ খ্রিষ্টাব্দ |
দাউদের
তারা
দাউদ (আঃ)-এর ইংরেজি বানান (David),
হিব্রু ভাষায় রচিত বাইবেলে এই নামটির বানান লিখা হয়-
D- W-D
হিসাবে। গ্রিক ভাষায়
D বর্ণটিকে বলা হয় ডেল্টা, এর প্রতীক
Δ। দুটি ডেলটা চিহ্ন কোণাকুণিভাবে পরস্পরের উপর স্থাপন করে হেক্সাগ্রাম তৈরি সূচিত
হয়েছিল পাশ্চাত্য জগতে।
সঙ্গীতস্রষ্টা দাউদ আঃ
ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্মের আদি সঙ্গীত
সামগানের আদি রচয়িতা ছিলেন হজরত দাউদ (আঃ)।
সুগায়ক হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি ছিল। তিনি কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার
করেছিলেন। কথিত আছে, এই সামগানের মাধ্যমে ইহুদি সমাজে তিনি আধ্যাত্মিক
সঙ্গীতকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
দাউদ (আঃ) -এর রচিত এরূপ বহুগান হিব্রু বাইবেলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সংকলিত এই গ্রন্থের হিব্রু নাম ছিল সেফের তেহিল্লিম (sefer tehillim)। এর অর্থ ছিল প্রশস্তি-গ্রন্থ। ধারণা করা হয় এই সঙ্গীত-সংকলনটি খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর আগেই রচিত হয়েছিল। এতে ছিল
দাউদ (আঃ) -এর ৭৩টি গান,
দাউদ আঃ -এর গায়ক দলের প্রধান আসাফের ১২টি গান এবং
লেবীয়-এর কোরাহ-বংশীয় বাদক দলের ১১টি গান।
উল্লেখ্য কোরাহ ছিলেন মূলত যন্ত্রবাদক এবং মন্দিরের
গায়ক।