জর্জ হ্যারিসন ও পণ্ডিত রবি শঙ্কর

জর্জ হ্যারিসন
ইংরেজি : George Harrison
পাশ্চাত্য প্রখ্যাত পপ সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার, বেজ গিটার বাদক।

জর্জ হ্যারিসন ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৫  ফেব্রুয়ারি, ইংল্যান্ডের ল্যাংশায়েরর লিভারপুলে জন্মগ্রহণ করেন। এঁর পিতার নাম হ্যারোল্ড হার্গ্রিভিস হ্যারিসন (
Harold Hargreaves Harrison) এবং মায়ের নাম লুইসে (Louise)। ইনি ছিলেন পিতামাতার চার সন্তানের ভিতর চতুর্থ। অপর ভাইবোনরা ছিলেন একামাত্র বোন : লুইসে (জন্ম ১৬ আগষ্ট ১৯৩১)। দুই ভাই যথাক্রমে হ্যারি (জন্ম ১৯৩৪), পিটার (২০ জুলাই ১৯৪০)। এঁর পিতা ছিলেন হোয়াইট স্টার লাইনের বাস কন্ডাক্টর। মা ছিলেন আইরিশ বংশোদ্ভুত এবং লিভারপুলের একটি দোকানের সহাকারিণী।

হ্যারিসনের শৈশব কেটেছে লিভারপুলে। ছয় বৎসর পর্যন্ত তিনি তাঁর পিতমাতার সাথে লিভারপুলের ১২ আর্নল্ড গ্রোভ, ওয়েভারট্রি -(12 Arnold Grove, Wavertree) তে। এই সময় এঁরা একটি শ্রমজীবী মানুষের জন্য নির্মিত সাধারণ বাড়িতে। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে এঁরা একটু ভালো বাড়িতে থাকার সুযোগ পান।

হ্যারিসনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পেনি লেনের নিকবর্তী ডাভডেল প্রাইমারি স্কুলে (Dovedale Primary School)। এখান থেকে তিনি ১১-প্লাস (11-plus) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে Liverpool Institute for Boys-এ ভর্তি হন। এই ইন্সটিটিউট- তিনি লেখাপড়া করেন। উল্লেখ্য এই ইনস্টিটিউটি বর্তমানে Liverpool Institute for Performing Arts নামে পরিচিত। এই প্রতিষ্ঠানে তিনি ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এই বিদ্যালয়ে গিটার শিখতেন। কিন্তু তাঁর পিতামাতার আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, হ্যারিসনের জন্য প্রথম দিকে গিটার কিনে দিতে পারেন নি। পরে তাঁর মা তাঁকে একটি গিটার কিনে দেন। সে সময়ে এর দাম ছিল ৩.১০ পাউন্ড।

এই প্রতিষ্ঠানে থাকাকালীন সময়ে স্কিফ (skiffle) নামক একটি গানের দল তৈরি করেন। এই দলের সাথে ছিলেন তাঁর বড় ভাই পিটার এবং তাঁর বন্ধু আর্থার কেলি। স্কুল বাসে তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে তাঁর আট মাসের বড় পল ম্যাককার্টেনি (Paul McCartney)-এর সাথে। এই পল ম্যাককার্টেনি এবং জন লেনোন (John Lennon) মিলে তৈরি করেছিলেন 'দ্যা কোয়ারিমেন্' (the Quarrymen) নামক একটি ব্যান্ড তৈরি করেছিল।

১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে গানের জন্য রোরি স্ট্রোমস-এর Morgue Skiffle Club -এ গানের পরীক্ষা দেন। পরীক্ষায় হ্যারিসন সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হলেও, প্রাথমিকভাবে অল্প বয়স (১৪ বৎসর) বলে, জন লেনোন তাঁকেএই দলে না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরে তিনি একটি বাসের উপর তলায় ম্যাককার্টেনি এবং জন লেনোনন-কে একটি গান শোনান। এই সময় হ্যারিসন এতটাই বিশুদ্ধ গিটার বাজান যে, জন লেনোন তাঁকে তাঁদের 'দ্যা কোয়ারিমেন্' ব্যান্ডে অন্তর্ভুক্ত করেন।

১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে স্কুল ত্যাগ করার পর, তিনি কয়েক মাস জীবিকা হিসাবে ব্ল্যাকারস নামক একটি স্থানীয় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে নবীশ ইলেক্ট্রশিয়ান হিসাবে কাজ করেন। এই সময়ে তিনি রনি স্টর্ম-এর টর্নাডোতে যোগাদনের জন্য আবেদন করেন। অল্প বয়স বলে তিনি এখানে তাঁকে নেওয়া হয় নি। এরপর তিনি যোগদান করেন
Les Stewart নামক একটি কোয়ার্টেট (Quartet -চারজনের দ্বারা সৃষ্ট সঙ্গীত দল)-এ। এই দলে অপর তিনজন ছিলেন ছিলেন লেস স্টুয়ার্ট, কেন ব্রাউন এবং জিওফ স্কিনার।

১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগষ্ট মোনা বেস্ট (Mona Best) লিভারপুলে ক্যাসবাহ কফি ক্লাব (Casbah Coffee Club) উদ্বোধন করার উদ্যোগ নেন। কেন্ ব্রাউন এই ক্লাবে হ্যারিসানদের কোয়ার্টেট সঙ্গীত পরিবেশনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ব্রাউন মহড়াতে অনুপস্থিত থাকার কারণে, দলের অন্যতম সদস্য লেস স্টুয়ার্ট এই অনুষ্ঠানে বাজাতে অস্বীকার করেন। পরে হ্যারিসন এবং ব্রাউন এই অনুষ্ঠানে বাজানোর জন্য ম্যাককার্টেনি এবং লেনোনকে আমন্ত্রণ জানান। এঁরা এই অনুষ্ঠান শেষ পর্যন্ত ভালোভাবেই শেষ করতে পেরেছিলেন।

১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি হয় বিটল (The Beatles) নামক রক সঙ্গীত দল। এই বৎসরে জার্মানির হামবুর্গে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য আমন্ত্রণ পায়। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ অক্টোবরে বিটল হামবুর্গের কাইসেরকেল্লার (Kaiserkeller) নৈশক্লাবের উদ্বোধনের দিনে সঙ্গীত পরিবেশন করেন।

১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বরে বিটলের ম্যানেজার হন ব্রায়ান এপস্টেইন। তিনি বিটল সদস্যদের পোশাকে পরিবর্তন আনেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে ৫ অক্টোবর বিটলের প্রথম Love Me Do এবং P.S. I Love You গান নিয়ে একটি রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এই গানের সাথে হ্যারিসন Gibson J-160E (গিবসন কোম্পানির প্রথম এ্যাকুস্টিক-বৈদ্যুতিক গিটার) বাজিয়েছেন। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে Please Please Me এ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এরপর বিটলের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বিটল নিউইয়র্কে সঙ্গীত পরিবেশন করে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই বৎসরে বিটলের উপর সাদা-কালো রঙ্গ ছবি A Hard Day's Night তৈরি হয়। এই সময় হ্যারিসনের ভবিষ্যৎ স্ত্রী  Pattie Boyd-এর সাথে পরিচয় হয়। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটেনের রানীর জন্মদিনের সম্মানে এই চার বিটল -এর Order of the British Empire সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ষষ্ঠ স্টুডিও এ্যালবাম Rubber Soul প্রকাশিত হয়।

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রাবার সোল নামক এ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এই এ্যালবামের ভিতর দিয়ে হ্যারিসন সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। এক্ষেত্রে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন বব ডিলন নামক অপর একজন স্বনাম-খ্যাত সঙ্গীত-শিল্পী।

১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে লণ্ডনে ভারতীয় সেতারবাদক হ্যারিসনের সাথে পণ্ডিত রবি শঙ্কর-এর পরিচয় ঘটে। এর কিছুদিন পর, হ্যারিসন ভারতে আসেন এবং শ্রীনগরে রবি শঙ্করের কাছে ছয় সপ্তাহ সেতারের তালিম নেন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে হ্যারিসন বিটলের বাইরে অন্যান্য ব্যান্ড ও সঙ্গীত শিল্পীদের সাথে কাজ করা শুরু করেন। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে বিটলের 'হোয়াইট এ্যালব্যাম' প্রকাশিত হয়। এই সময় তাঁদের ড্রামার Ringo Starr কিছুদিনের জন্য হ্যারিসনের সঙ্গ ত্যাগ করেন। ফলে তাঁর এবং বিটলের জন্য সাময়িক অসুবিধার সৃষ্টি হয়। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রেকর্ড করেন Here Comes the Sun" এবং "Something" রেকর্ড করেন।

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জানুয়ারি বিটলের সাথে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে। অবশ্য এই সময়ের ভিতর হ্যারিসনের
Wonderwall Music এবং  Electronic Sound. নামক দুটি একক এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছিল। এর ভিতরে Wonderwall Music এ্যালবামে, পণ্ডিত রবি শঙ্কর-এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সাথে ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের মিশ্রণ ঘটান। বিটলের বাইরে এসে তাঁর তিনটি এ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এই এ্যালবামের গানগুলোকে তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজের নিদর্শন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই এ্যালবামগুলোর ভিতরে "My Sweet Lord", "What Is Life", "Wall of Sound" অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে।

হ্যারিসনের এই ভ্রমণের সময় 'রাগ' নামে রবিশঙ্করের উপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন Howard Worth এবং এই তথ্যচিত্রটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে। হ্যারিসনের সাথে এই বন্ধুত্বের সূত্র রবি শঙ্কর পাশ্চাত্য শ্রোতাদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পণ্ডিত রবি শঙ্কর বাংলাদেশের স্বাধীনযুদ্ধের স্বপক্ষে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের জন্য তিনি  জর্জ হ্যারিসনকে উৎসাহী করে তোলেন। এই আয়োজনে তিনি ভারতবর্ষ এবং পাশ্চাত্য অন্যান্য আরও বহু বিখ্যাত শিল্পীদের একত্রিত করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব ছিলেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, জোয়ান বায়েজ ও ওস্তাদ আলী আকবর খান

এই সূত্রে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১ আগষ্ট, বন্ধু জর্জ হ্যারিসনকে সঙ্গে নিয়ে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন (New York's Madison Square Garden)-এ  ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ (Concert for Bangladesh)’ নামে ঐতিহাসিক কনসার্টের আয়োজন করেন। প্রথম অনুষ্ঠানটি শ্রোতারা উচ্ছ্বসিত আগ্রহ দেখান। পরে এঁরা আরও একটি অনুষ্ঠান করেন। এই দুটি অনুষ্ঠানে প্রায় ৪০,০০০ দর্শক কনসার্টটি উপভোগ করেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে হ্যারিসন হ্যারি নেলসনের সাথে "You're Breakin' My Heart"-এ্যালবামের জন্য কাজ করেন। একই ভাবে তিনি বিল প্রেস্টোন-এর সাথে গান ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে করেছিলেন "That's the Way God Planned It" এবং ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে করেছিলেন "It's My Pleasure"। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর অপর একটি কাজ ছিল Cheech & Chong-এর সাথে "Basketball Jones"। 

১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে নিটলের পুরানো বন্ধু আততায়ীর হাতে জন লেনোন নিহত হন। এই মৃত্যু তাঁকে মানসিকভাবে আহত করে। লেনোনের উদ্দেশ্যে তিনি গান করেন "All Those Years Ago"

১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
Channel 4 live concert TV special করেন। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে  Birmingham Children's Hospital -এর জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য কনসার্ট করেন। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ক্লাউড নাইন এ্যালবাম প্রকাশ করেন। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কল্যাপ্টনের সাথে জাপান সফর করেন। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ এপ্রিল, তিনি Natural Law Party -এর জন্য লণ্ডনের Royal Albert Hal-এ কনসার্ট করেন। এই বৎসরের অক্টোবর মাসে নিউইয়র্কে বব ডিলনের সাথে কনসার্ট করেন। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে তাঁর The 30th Anniversary Concert Celebration এ্যালবাম প্রকাশিত হয়। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে অতিথি শিল্পী হিসাবে the Electric Light Orchestra album Zoom-এ কাজ করেন।

২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ নভেম্বর হলিউড হিলস ম্যনসনে মৃত্যুবরণ করেন।


সূত্র :
http://en.wikipedia.org/