আলী আকবর খান, ওস্তাদ
১৯২২-২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ
প্রখ্যাত সরোদ বাদক।

১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীত সাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান এবং মায়ের নাম মদিনা বেগম। তাঁর জন্মের পর ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সপরিবারে তাঁর কর্মস্থল মাইহরে (ভারতের মধ্যপ্রদেশের প্রিন্স শাসিত রাজ্য) চলে আসেন। উল্লেখ্য ইনি এখান রাজদরবারের সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন।

মাইহরে পিতার কাছেই তিন-চার বছর বয়স থেকে তাঁর সঙ্গীত-শিক্ষার হাতে খড়ি হয়। শুরুতে তিনি পিতার কাছে কণ্ঠ সঙ্গীতে তালিম নেন। পরে তবলা শেখা শুরু করেন তাঁর চাচা ফকির আফতাবউদ্দিনের কাছে। এরপর পিতার ইচ্ছায় সরোদ শেখা শুরু করেন। প্রায় ২০ বছর যাবৎ তিনি তাঁর পিতার কাছে সরোদ শেখেন। এই সময় তিনি প্রতিদিন প্রায় ১৮ ঘণ্টা করে রেওয়াজ করতেন। এই সময় তাঁর সতীর্থ ছিলেন পণ্ডিত রবি শঙ্কর ও কন্যা বিদুষী অন্নপূর্ণা

১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে এলাহাবাদে সঙ্গীত সম্মেলনে সম্মেলনে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে পণ্ডিত রবি শঙ্কর (সেতারশিল্পী) সাথে প্রথম দ্বৈতবাদন পরিবেশন করেন। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে অল ইন্ডিয়া রেডিও-এর সাথে সরোদ পরিবেশন করেন। এই সময় তাঁর সাথে তবলার সঙ্গত করেছিলেন ওস্তাদ আল্লারাখা খাঁ।

১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এবং পণ্ডিত রবি শঙ্কর মাইহর ত্যাগ করেন। তিনি লাখনৌতে কিছুদিন অল ইন্ডিয়া রেডিও-এর সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি যোধপুরের মহারাজার (হনবন্ত সিং) দরবারে সভা-শিল্পী হিসেবে নিয়োগ পান। যোধপুরের মহারাজ তাঁর সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে ওস্তাদ উপাধি দেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে বিমান দুর্ঘটনায় মহারাজ হনবন্ত সিং নিহত হলে, তিনি লোখ্‌নৌ ত্যাগ করে বোম্বে আসেন। এই সময় তিনি মুম্বাইতে তিনি কয়েকটি সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের সত্যজিৎ রায়ের 'দেবি' ও তপন সিনহার 'ক্ষুদিত পাষাণ'-এর মতো বিখ্যাত চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন।

১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এইচএমভির সাথে সিরিজ রেকর্ডে কাজ করেন। এই সময়ে ৭৮ আরপিএমএ-এর রেকর্ডে মাত্র তিন মিনিটের একটি সরোদবাদন রেকর্ড করা হয়েছিল। এটি ছিল মূলত একটি মিশ্র রাগের সমন্বিত রূপ। এর তিনি নাম দিয়েছিলেন, রাগ চন্দ্রানন্দন। এই রাগটি মূলত মালকোষ, চন্দ্রকোষ, নন্দকোষ এবং কৌষিকা নাড়ার সমন্বয়ে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। এই রেকর্ডী সে সময়ে ভারতবর্ষে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। পরে তিনি এই রাগটি ২২ মিনিট দীর্ঘ একটি রূপ বাজান এবং তা ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে রেকর্ড হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'সীমা' নামক চলচ্চিত্রে সরোদ বাজান। এই বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনগণের কাছে ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের সৌন্দর্য্য তুলে ধরার জন্য নিউইয়র্কে একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন ইহুদি মেনহুইন করেন। এই অনুষ্ঠানে সেতার পরিবেশনের জন্য তিনি পণ্ডিত রবি শঙ্করকে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু পণ্ডিত রবি শঙ্করকে বৈবাহিক ঝামেলার জন্য এই অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারেন নি, কিন্তু তিনি এই অনুষ্ঠানে বাজানোর জন্য ওস্তাদ আলী আকবর খানের নাম প্রস্তাব করেন। নিউইয়র্কের
Museum of Modern Art -এ ওস্তাদ আলী আকবর খান সরোদ পরিবেশন করে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। তাঁর সাথে তবলায় সঙ্গত করেছিলেন চতুর লাল। এই সূত্রে ওস্তাদ আলী আকবর খানের সরোদ মার্কিন টেলিভশনে প্রচারিত হয়। এটাই ছিল মার্কিন টেলিভিশনে কোনো ভারতীয় শিল্পীর প্রথম রাগ পরিবেশন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ারে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ রবি শঙ্কর (সেতার), আল্লা রাখা খাঁ (তবলা) ও আলী আকবর খান (সরোদ), তানুপরায় কমলা চক্রবর্তী

১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় তিনি 'আলী আকবর কলেজ অব মিউজিক' প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরোদ শেখানো শুরু করেন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলিতে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত 'আলী আকবর কলেজ অব মিউজিক' -এর আদলে আরেকটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে এই কলেজটি  সান রাফায়েলে স্থানান্তরিত হয়।
 
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শঙ্কর ঘোষের সাথে বোষ্টনে কনসার্ট করেন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনযুদ্ধের স্বপক্ষে পণ্ডিত রবি শঙ্কর ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের জন্য তিনি  জর্জ হ্যারিসনকে উৎসাহী করে তোলেন। এই আয়োজনে তিনি ভারতবর্ষ এবং পাশ্চাত্য অন্যান্য আরও বহু বিখ্যাত শিল্পীদের একত্রিত করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব ছিলেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, জোয়ান বায়েজ ও ওস্তাদ আলী আকবর খান। এই অনুষ্ঠানের জন্য তিনি   'বাংলাদেশ ধুন' নামক একটি নতুন সুরবিন্যাস করনে। 'বাংলাদেশ ধুন' যুগলবন্দি বাদনে তাঁর সহশিল্পী ছিলেন পণ্ডিত রবি শঙ্কর। উল্লেখ্য ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১ আগষ্ট, নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ারে 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' নামে উপস্থাপিত হয়। এই কনসার্টের ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এর রেকর্ড বিক্রয়শীর্ষ স্থান লাভ করে। এই কারণে পরবর্তী সময়ে তিনি গ্র্যামি এওয়ার্ড লাভ করেন। উল্লেখ্য এই অনুষ্ঠান থেকে উপার্জিত সকল অর্থ মুক্তিযুদ্ধের জন্য দান করেন।

২০০০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিউইয়র্কে কনসার্টে ওস্তাদ আলী আকবর খান


১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা ও ক্যালিফোর্নিয়ায়  প্রতিষ্ঠিত 'আলী আকবর কলেজ অব মিউজিক' -এর একটি শাখা খোলেন সুজারল্যান্ডের ব্যাসেল-এ।

জীবনের শেষ দিকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়েছেন। স্বাস্থ্যগত কারণে শেষ জীবনে কনসার্ট কমিয়ে দিয়েছিলেন। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে মৃত্যবরণ করেন। তিনি একাধিক সঙ্গীত শিল্পীর সাথে যুগলবন্দী করেছেন। এর ভিতরে পণ্ডিত রবি শঙ্কর সাথে তাঁর সবচেয়ে যুগলবন্দী সম্পাদন করেছেন। এছাড়া তিনি বাজিয়েছেন পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় (সেতার), এল সুব্রামনিয়াম (বেহালা), বিলায়েত খান (সেতার)।

দ্বিতীয় স্ত্রী রাজদুলারী

পরিবার-পরিজন
তিনি মোট তিনটি বিবাহ করেছিলেন।

সম্মাননা