অন্নপূর্ণা (রওশনারা খান)
(১৯২৭-২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ)
প্রখ্যাত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিদুষী সাধিকা।

ওস্তাদ আলাউদ্দীন খানের কনিষ্ঠ কন্যা,
ওস্তাদ আলী আকবর খানের ছোটো বোন, এবং পণ্ডিত রবি শঙ্করের স্ত্রী। মায়ের নাম মদিনা বেগম। তাঁর অপর দুই বোনের নাম শারিজা ও জেহেনারা।

১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ এপ্রিল চৈতি পূর্ণিমায় মাইহারে (মধ্যপ্রেদেশ, ভারত) জন্মগ্রহণ করেন। এই তাঁর পিতা ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান মাইহার দরবারের সভা-শিল্পী ছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল রওশনারা খান। ডাক নাম অন্নপূর্ণা। প্রকৃত নামের পরিবর্তে অন্নপূর্ণা নামেই প্রসিদ্ধা। শিষ্যদের কাছে তিনি মাইজী।

পিতা ওস্তাদ আলাউদ্দীন খানের কাছে শিক্ষারতা অন্নপূর্ণা। দূরে তাঁর মা মদিনা বেগম।

শৈশব থেকে অন্নপূর্ণাকে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান সঙ্গীতে তালিম দেন নি। এর পিছনে একটি দুঃখজনক ঘটনা আছে। ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান তাঁর মধ্যম কন্যা জেহানারাকে অত্যন্ত যত্নের সাথে কণ্ঠসঙ্গীতে তালিম দিয়েছিলেন। বিবাহের পর জেহেনারার শাশুড়ি তাঁর সঙ্গীত চর্চা বন্ধ করে দেয়। শাশুড়ির এই নিষেধ অগ্রাহ্য করে জেহেনারা সঙ্গীত চর্চা করতে থাকলে, শাশুড়ি জেহেনারার তানপুরা পুড়িয়ে দেয়। পরে তাঁর সঙ্গীত সাধনা আর অগ্রসর হয় নি।
এই ঘটনার পর থেকে তিনি তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা অন্নপূর্ণাকে সঙ্গীতে তালিম না দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। কিন্তু বাড়ির সঙ্গীতময় পরিবেশে কোনো তালিম ছাড়াই, শুনে শুনে সঙ্গীতে পারদর্শী হয়ে উঠেন। পরে তাঁর সঙ্গীত প্রতিভার বিষয়
ঘটনাক্রমে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান জানতে পারেন। এরপর থেকে তিনি কন্যাকে তালিম দেওয়া শুরু করেন। এ বিষয়ে ওস্তাদ আলী আকবর খান লিখেছেন-

‘অন্নপূর্ণার গানবাজনা শেখার সঙ্গে আমার অপদার্থতার সম্পর্ক আছে। একদিন সকালে একটা জিনিস বারবার চেষ্টা করেও যন্ত্রে আনতে পারছিলাম না। বাবা রেগেমেগে থলি হাতে বাজারে চলে গেলেন। ঠিক তখনই অন্নপূর্ণা সেই ঘরে এসে আমার ভুলে যাওয়া ওই ফ্রেজটা গেয়ে গেয়ে বলল, ‘এভাবে বাজাও, দাদা’। আমি তো অবাক, বুঝলাম বাবা যখন আমাকে শেখান, কাছাকাছি থাকলে শুনে শুনেই ও সেসব গলায় তুলে নেয়। আমি ওর গাওয়া শুনে পিসটা যন্ত্রে তুলে নিচ্ছি, এমন সময় আবার বাবার প্রবেশ; থলে নিয়ে বেরিয়েছিলেন কিন্তু রাগের ঝোঁকে টাকা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলেন। অন্নপূর্ণার এই আশ্চর্য ক্ষমতা দেখে সেদিন সন্ধে থেকেই অন্নপূর্ণাকে তানপুরা ধরিয়ে সরগম শেখাতে শুরু করেন বাবা। গানের সঙ্গে সঙ্গেই ছোট সেতার কিনে সেটাও শেখাতে শুরু করেন। বারো-তেরো বছর বয়সে শেখাতে শুরু করেন সুরবাহার। আশ্চর্য ক্ষমতা তো ছিলই, সেই সঙ্গে অন্নপূর্ণার নিষ্ঠার জবাব নেই। অন্নপূর্ণা আলাপটাকে একটা অসাধারণ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। সে বাবার মতোই বাজনায় শুদ্ধতার ব্যাপারে কোনো কমেপ্রামাইজ করত না। আলাপের পনেরোটা অঙ্গ নিখুঁতভাবে বাজাত। গভীর রাগই বেশি বাজাত অন্নপূর্ণা। আমরা যেমন  ভৈরবীতে সব পর্দা লাগিয়ে দিই, ও বাজাত ‘শুদ্ধ  ভৈরবী’। ওর বাজনার গভীরতা সমঝদারের অন্তরে গিয়ে ঘা দিত।’ (পৃ. ৯৭, স্বরসম্রাট উস্তাদ আলি আকবর খান, অতনু চক্রবর্তী, পারুল, কলকাতা, ২০১০)।
 

কিছুদিনের মধ্যে তিনি সঙ্গীতে এতটাই পারদর্শিনী হয়ে উঠেন যে, তাঁর পিতার অনুমতিক্রমে, পিতার শিষ্যদের সঙ্গীত শিক্ষা দিতেন। এই সময় নিখিল বন্দ্যোপাধ্যয়, ওস্তাদ বাহাদুর খান তাঁর শিষ্য হয়ে উঠেন।

 পণ্ডিত রবি শঙ্করের সাথে অন্নপূর্ণা (সুরবাহার)

১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পণ্ডিত উদয়শঙ্কেরের আগ্রহে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান পণ্ডিত রবি শঙ্করের সাথে অন্নপূর্ণার বিবাহে সম্মতি দেন।  এবং ওই বছরের ১৫ই মে সন্ধ্যা বেলা এই বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই সময় অন্নপূর্ণার বয়স ছিল ১৪ বৎসর। ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এঁদের প্রথম সন্তান শুভেন্দ্র শঙ্কর (১৯৪২-১৯৯২)-এর জন্ম হয়। শুভেন্দ্র তাঁর মায়ের  কাছেই সেতার বাদন শেখেন। এই সময় রবিশঙ্কর শুভেন্দ্রকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেল, অন্নপূর্ণা তাতে বাধা দেন এবং নিজেই পুত্রকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে থাকেন।

১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ওস্তাদ আলী আকবর খানের সঙ্গীত স্কুলের অনুষ্ঠানে কলকাতা ও দিল্লীতে পণ্ডিত রবি শঙ্কর এবং অন্নপূর্ণা দ্বৈত-বাদন পরিবেশন করেন। এরপর থেকে পণ্ডিত রবি শঙ্করের সাথে তাঁর ব্যক্তিত্বের সংঘাত ঘটে। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর থেকে তিনি অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করা বন্ধ করে দেন এবং সঙ্গীত শিক্ষক হিসাবেই নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন।

শুভেন্দ্র বড় হওয়ার পর, আমেরিকায় রবি শঙ্করের কাছে চলে যান। এরপর তিনি নিসঙ্গ হয়ে পড়েন। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর ছাত্র ঋষিকুমার পাণ্ডেকে বিবাহ করেন। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দ শুভেন্দ্র ভারতে এলে, অন্নপূর্ণা তাঁকে আপন করে নিতে পারেন নি। সেবার শুভেন্দ্র কয়েকটি অনুষ্ঠানে সেতার বাজিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বাজনা খুব খারাপ হওয়ার কারণে প্রচুর সমালোচনা হয়। এরপর হতাশ হয়ে তিনি ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকায় ফিরে যান।

১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে শুভেন্দ্রর মৃত্যু হয়। রবিশঙ্করের মৃত্যু হয় ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে, ঋষিকুমার পান্ডেয়র মৃত্যু হয় ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে। এরপর থেকে একাকী জীবন কাটিয়েছেন তাঁর সঙ্গীত সাধনা নিয়ে।

২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

 ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে পণ্ডিত রবি শঙ্করের সাথে

অন্নপূর্ণাও তাঁর পিতার মতো নানাবিধি বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শিনী ছিলেন। তিনি বহু গুণীশিল্পীকে সৃষ্টি করেছেন নানাবিধ যন্ত্রে। তিনি তাঁর পুত্র শুভেন্দ্র শঙ্করকে শিখেয়েছিলেন সেতার। এছাড়া সেতার শিখিয়েছেন পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রকান্ত সার্দেশমুখ, সুধীরফাডকে, হেমন্ত দেশাই, অধ্যাপক রূশিকুমার পাণ্ডে-কে।  তাঁর ভ্রাতুষ্পত্র আশিস খানকে শিখিয়েছেন সরোদ। সরোদের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শিষ্য হলেন দেবশর্মা, বীরেন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রদীপ বারোত, অমিত ভট্টাচার্য এবং বসন্ত কাব্রা। বাঁশি শিখিয়েছেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশি এবং পণ্ডিত নিত্যানন্দ হাল্দিপুরিকে। এছাড়া অনিয়মিতভাবে শিখিয়েছেন সন্ধ্যা আপ্তে (সেতার), লীনাতা ভাজে (সেতার), অমিত হিরন রায় (সেতার), স্তুতি দে (সরোদ), উমা গুহ (সরোদ), মিলিন্দ শেওরে (বাঁশি), কাকলি রাই (সুরবাহার)।

১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পদ্মভূষণ উপাধি পান।
১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে সঙ্গীত নাটক আকাডেমি পুরস্কার পান।
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে দেশিকোত্তম উপাধি (বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়) পান।
২০০৪ খ্রিষ্টাব সঙ্গীত নাটক আকাদেমী সম্মাননা পান।