১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুলাই (৫ শ্রাবণ ১২৪০ বঙ্গাব্দ), তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার (বর্তমান
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা)কুমারখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম হরচন্দ্র
মজুমদার। মায়ের নাম কমলিনী দেবী। খুব ছোট বেলায় তিনি পিতামাতাকে হারান। তিনি কিছুদিন কৃষ্ণনাথ মজুমদারের
ইংরেজি স্কুলে অধ্যায়ন করেন। এরপর অর্থাভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পথ বন্ধ হয়ে
যায়।
কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি দু’পয়সা বেতনে কুমারখালী 'বাজারের একটি কাপড়ের
দোকানে চাকরি নেন। তিনি দিনের বেলায় খরিদ্দারের তামাক-সাজা, কাপড়-গোছানোর কাজ করতেন এবং সন্ধ্যায়
তিনি দোকানের হিসেবের খাতা মেলাতেন। এরপর কিছুদিন তিনি নীলকুঠিতে শিক্ষানবিস হিসেবে চাকরি।
শেষপর্যন্ত তিনি কুঠিয়ালের কৃষক নিপীড়ন ও অনাচার সহ্য করতে না পেরে চাকরিতে ইস্তফা
দেন।
যৌবনের প্রারম্ভে তিনি সমাজ সেবার ব্রত গ্রহণ করেন। বিশেষ করে গ্রামবাংলার অবহেলিত
শিক্ষা বিস্তারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
তিনি তাঁর বন্ধুদের সাথে নিয়ে ১৮৫৫
খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি নিজ গ্রামে ভার্নাকুলার বিদ্যালয় স্থাপন করেন। উল্লেখ্য
তাঁর বন্ধুদের মধ্যে গোপাল কুণ্ডু, যাদব কুণ্ডু ও গোপাল স্যান্যালের নাম বিশেষভাবে
জানা যায়। তিনি ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু আর্থিক অসুবিধার
কথা বিবেচনা করে, তিনি বিনাবেতনেই প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতেন। ক্রমে ক্রমে এই বিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়লে, বিদ্যালয়টি
সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত হয়। এই সময় প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাঙাল হরিনাথের বেতন
নির্ধারণ হয় ২০ টাকা। তবে তিনি নিম্ন শ্রেণির শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর জন্য নিজে পনেরো টাকা বেতন গ্রহণ
করেন।
এরপর ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর কৃষ্ণনাথ মজুমদারের সহায়তায় কুমারখালিতে
একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি তিনি মহাজন,
জমিদারের হাত থেকে অত্যাচারিত ও নিষ্পেষিত কৃষক সম্প্রদায়ের রক্ষার জন্য
সাংবাদিকতার পেশা বেছে নেন। প্রথম দিকে তিনি
সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লিখতেন। তবে এই পত্রিকায় সকল সংবাদ ছাপার সুযোগ ছিল না।
তাই ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' নামক একটি মাসিক পত্রিকা
প্রকাশ করেন। সে সময়ে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন প্রেস
থেকে। এই সময় তিনি নীলকর সাহেব অর্থাৎ শিলাইদহের জোড়াসাঁকোর ঠাকুর জমিদারের বিরুদ্ধে
সোচ্চার হয়ে কৃষকদের পক্ষে প্রবন্ধ লিখে তোলপাড় সৃষ্টি করেন। জমিদার
হরিনাথকে শায়েস্তা করার জন্য ভাড়াটে লাঠিয়াল বাহিনী পাঠায়। কিন্তু বাউল সাধক লালন
ফকির নিজেই তার দলবল নিয়ে কাঙালকে রক্ষা করার জন্য জমিদারের লাঠিয়ালদের প্রতিরোধ
করেন। অবশ্য জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী ফিরে গেলে কাঙাল হরিনাথ রক্ষা পান।
পত্রিকাটি ক্রমে ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠলে, এই পত্রিকাকে তিনি প্রথমে পাক্ষিক
এবং পরে সাপ্তাহিক পত্রিকায় পরিণত করেন। উল্লেখ্য সে সময় সাপ্তাহিক 'গ্রামবার্তা
প্রকাশিকা'র মূল্য ছিল মাত্র ১ পয়সা। পত্রিকাটি তা ‘কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নর যন্ত্রে মুদ্রিত ও কুমারখালী থেকে প্রকাশিত হতো।
১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে কুমারখালির নিজ গ্রামেই গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকাটির জন্য 'এম.এন প্রেস'
নামক নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এক্ষেত্রে
প্রায় ১৮ বছর রাজশাহীর রাণী স্বর্ণকুমারী দেবী' পত্রিকাটি প্রকাশের জন্য আর্থিক
সাহায্য করেছিলেন। পরে আর্থিক কারণে ও সরকারের মুদ্রণ শাসনের ব্যবস্থার জন্য পত্রিকাটিকে বন্ধ
হয়ে যায়।
‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’কে ঘিরে লেখক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। এর ফলে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, রায় বাহাদুর জলধর সেন,
দীনেন্দ্র কুমার রায়, মীর মশাররফ হোসেন, শিবচন্দ্র বিদ্যানর্ব প্রমুখ সাহিত্যিকদের
সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।
পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি
লালন সাঁই-এর বাউল দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হন। এই সময় তিনি নিজে গান রচনা
করা শুরু করেন এবং বাউলদের সাধুসঙ্গে যোগদান করতেন। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর,
তিনি ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি বাউল দল তৈরি করেন। এই সময় তাঁকে বিশেষভাবে
সহায়তা করেছিলেন অক্ষয়কুমার মৈত্র ও জলধর রায়। এই দলটি কাঙ্গাল ফকির চাঁদের
দল হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল।
১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি তিন
পুত্র, এক কন্যা এবং স্ত্রী স্বর্ণময়ীকে রেখে যান।
কাঙাল হরিনাথের প্রকাশিত গ্রন্থাবলি::