জোহানেস
কেপলার
Johannes
Kepler
প্রখ্যাত জার্মান গণিতবিদ ও
জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
১৫৭১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর জার্মানির
Baden-Württemberg রাজ্যের স্টুটগার্ট
অঞ্চলের ভাইল ডেআ স্টাট-এর একটি ফ্রি ইমপেরিয়াল সিটি-তে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর
পিতামহ সেবাল্ড কেপলার এই শহরের লর্ড মেয়র ছিলেন। তার বাবা হাইনরিশ কেপলারের ছিলেন
ভাড়াটে সৈনিক। কেপলারের জন্মের সময় তাঁর বড় দুই ভাই ও এক বোন ছিল। তাঁর বয়স যখন ৫
বছর তখন তাঁর পিতা পরিবার ছেড়ে চলে যান এবং আর কখনো ফিরে আসেন নি। ধারণা করা হয়,
নেদারল্যান্ডে সংঘটিত 'আশি বছরের যুদ্ধ'-এ তিনি মারা গিয়েছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল
কাটারিনা গুল্ডেনমান। তিনি ছিলেন একজন সরাইওয়ালার মেয়ে। তিনি ভেষজ ঔষধ নিয়ে কাজ
করতেন। ডাকিনীবিদ্যা চর্চার অভিযোগে তার বিচার হয়েছিল। গর্ভধারণের ৩৮তম সপ্তাহ
পূর্ণ হওয়ার আগেই কেপলারের জন্ম হওয়ার কারণে, কেপলার শৈশবে অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন।
শিশুকালে তিনি বেশ দুর্বল ছিলেন এবং নানা অসুখে ভুগতেন।
ছোট বেলায় তিনি গণিতে অত্যন্ত ভালো ছিলেন। কথিত আছে. মাতামহের সরাইখানায় আগত অনেক পথিককে গণিতের দক্ষতা দেখিয়ে মুগ্ধ করে দিতেন। শৈশবেই তিনি গণিতের পাশাপাশি জ্যোতির্বজ্ঞানের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হয়ে উঠেন। মাত্রা ৬ বছর বয়সে (১৫৭৭ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর মা তাঁকে একটি উঁচু জায়গায় নিয়ে গিয়ে ধূমকেতু দেখান। এর কিছুদিন পর তাঁর গুটি বসন্ত হয় এবং এই কারণে তাঁর দৃষ্টিশক্তি কমে গিয়েছিল। ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে এই দুর্বল দৃষ্টিশক্তি দিয়ে চন্দ্রগ্রহণ দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এই দুর্বল দৃষ্টিশক্তির জন্য তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণও ভালোভাবে করতে পারেন নি।
কেপলার প্রথমে গ্রামার স্কুল, পরে লাতিন স্কুল ও মাউলব্রোনে অবস্থিত ইভানজেলিক্যাল সেমিনারিতে (রোমান ক্যাথলিক যাজকদের প্রশিক্ষণ কলেজ) পড়া শেষ করেন এবং ১৫৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ইউনিভার্সিটি অফ ট্যুবিঙেনের ট্যুবিঙার স্টিফ্ট-এ ভর্তি হন। এখানে তিনি ফিটুস ম্যুলারের কাছে দর্শনশাস্ত্র এবং ইয়াকব হিয়ারব্রান্ডের কাছে ধর্মতত্ত্ব পড়েন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি গণিত এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের উচ্চতর পাঠ গ্রহণ করেন। একই সাথে জ্যোতিষবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেন।
এই সময় তিনি বিশেষভাবে
টলেমি ও
কোপার্নিকাসের জ্যোতির্বিজ্ঞান পাঠ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে, ১৫৯৪
খ্রিষ্টাব্দে তিনি অস্ট্রিয়ার গ্রাৎসে অবস্থিত প্রোটেস্ট্যান্ট স্কুলে গণিত ও
জ্যোতির্বিদ্যার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৫৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম গ্রন্থ
Mysterium Cosmographicum
(মহাবিশ্বের পবিত্র রহস্য) প্রকাশিত হয়। কেপলারের দাবি অনুসারে ১৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দে
১৯শে জানুয়ারি গ্রাৎসের একটি শ্রেণীকক্ষে রাশিচক্রে শনি ও বৃহস্পতি গ্রহের
পর্যাবৃত্ত সংযোগ পড়ানোর সময়, তাঁর মনে হয় যে, সুষম বহুভুজের অন্তর্বৃত্ত এবং
পরিবৃত্ত যেমন বহুভুজটির সাথে সর্বদা একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে আবদ্ধ হয়, মহাবিশ্বের
জ্যামিতিক ভিত্তিও সম্ভবত তেমনটাই। এরপর তিনি এ বিষয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা করেন,
কিন্তু অতিরিক্ত গ্রহ যোগ করেও শেষ পর্যন্ত সুষম বহুভুজদের এমন কোন সমাবেশ পান নি,
যা তখন পর্যন্ত জানা জ্যোতিষ্কগুলোর গতিপথ ব্যাখ্যা করতে পারে। শেষপর্যন্ত তিনি
ত্রিমাত্রিক বহুতলক নিয়ে কাজ শুরু করেন। এই গবেষণার সূত্রে তিনি আবিষ্কার করেন যে,
পাঁচটি প্লেটোনীয় ঘনবস্তুকে খ-গোলকের মাধ্যমে অন্তর্লিখিত এবং পরিলিখিত করা যায়।
তিনি বস্তুগুলোর একটিকে আরেকটির ভেতর স্থাপন করে প্রতিটিকে একটি অন্তর্বৃত্ত ও একটি
পরিবৃত্ত দ্বারা আবদ্ধ করেন। এক বস্তুর অন্তর্বৃত্ত তার পরের বস্তুটির পরিবৃত্তের
সাথে মিলে একটি খ-গোলক গঠন করে এমন ধারণা লাভ করেন। এই ভাবে পাঁচটি বস্তুর জন্য মোট
ছয়টি গোলক নির্ধারণ করেন। তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ছয়টি গ্রহকে এই গোলকে স্থান দেন। এই
গ্রহগুলো ছিল বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনি। একইভাবে তিনি অষ্টতলক,
বিংশতলক, দ্বাদশতলক, চতুস্তলকে এবং ঘনক স্থাপন করে পরীক্ষা করেন। এই গবেষণার সূত্রে
তিনি প্রতিটি গ্রহের খ-গোলকের সাথে তার কক্ষীয় পর্যায়কালের সম্পর্কসূচক একটি সূত্রও
আবিষ্কার করে ফেলেন। ভেতর থেকে বাইরের দিকে যেতে থাকলে কক্ষীয় পর্যায়কালের বৃদ্ধি
পরস্পরসংলগ্ন গ্রহ দুটির কক্ষীয় ব্যাসার্ধ্যের পার্থক্যের দ্বিগুণ হয়। পরে অবশ্য
সঠিক মান নির্ণয়ে সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনা করে তিনি এই সূত্রটি পরিত্যাগ করেছিলেন।
১৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দে কেপলারের সাথে ২৩ বৎসর বয়সী বিধবা বারবারা ম্যুলারের সাথে পরিচয়
হয় এবং প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে। বারাবারার আগের স্বামীর ঔরসে একটি কন্যা সন্তান
(নাম Gemma van Dvijneveldt)
ছিল। বারবারা বিগত স্বামী এবং পিতার দিক থেকে অত্যন্ত ধনী ছিল। তাই প্রথম দিকে
বারবারার পরিবার কেপলারের সাথে বিয়েতে সম্মতি দেয় নি। অবশেষে ১৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দের
২৭শে এপ্রিল উভয়ের বিয়ে হয়। এঁদের প্রথম দুটি সন্তান হাইনরিশ ও সুজানা-র শিশু
অবস্থায়ই তাদের মৃত্যু ঘটে। ১৬০২ খ্রিষ্টাব্দে তাদের মেয়ে সুজানা, ১৬০৪
খ্রিষ্টাব্দে ছেলে ফ্রিডরিশ এবং ১৬০৭ খ্রিষ্টাব্দে আরেকটি ছেলে লুডভিগের জন্ম হয়।
Mysterium Cosmographicum
প্রকাশের সূত্রে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসাবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়
গ্রাৎস স্কুলের পরিদর্শকদের পৃষ্ঠপোষকতায় কেপলার তার পূর্বতন কাজগুলো নিয়ে আরও
বিস্তারিত গবেষণা-গ্রন্থ প্রকাশের পরিকল্পনা করেন। এই সময় টাইকো ব্রাহের সাথে
জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়ক তত্ত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। মূলত উভয়
বিজ্ঞানী নিজেদের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে একত্রে কাজ করবেন এমনটা হয়ে উঠেনি প্রথম
দিকে।
অবশেষে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে ৪ঠা
ফেব্রুয়ারি কেপলার প্রাগ শহরের ৩৫ কিলোমিটার দূরে
Benátky nad Jizerou
নামক একটি স্থানে টাইকো ব্রাহে এবং তার সহকারী ফ্রান্স টেংনাগেল ও ক্রিস্টিয়ান
সোরেনসেন লোঙ্গোমোন্টানাস-এর সাথে দেখা করেন। উল্লেখ্য এ স্থানে তখন টাইকোর নতুন
মানমন্দিরের নির্মাণ কাজ চলছিল। পরবর্তী দুই মাস তিনি অতিথি হিসেবে থেকে টাইকোর
মঙ্গল গ্রহের পর্যবেক্ষণগুলো বিশ্লেষণ করেন। প্রথমদিকে নিজের উপাত্ত বেশ যত্নের
সাথে গোপন করে রাখলেও কেপলারের তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে একসময় তাকে
আরও বেশি অধিকার দেন। এই কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য স্লোভাকীয় দার্শনিক, চিকিৎসক
ও রাজনীতিবিদ জোহানেস জেসেনিয়াস-এর সহায়তায় টাইকোর সাথে আনুষ্ঠানিক একটি চুক্তি
করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চুক্তির চেষ্টা তিক্ততায় পর্যবসিত হয় এবং কেপলার ৬ই
এপ্রিল প্রাগের উদ্দেশ্যে মানমন্দির ত্যাগ করেন। কিন্তু এর কিছুদিন পর কেপলার ও
টাইকো অবশ্য বেতন এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি করেন এবং জুন
মাসে কেপলার গ্রাৎসে ফিরে যান তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে আসেন।
১০ই জুলাই গ্রাৎসে চন্দ্রগ্রহণের সময় তিনি নিজস্ব পদ্ধতি ব্যবহার করে, আলোকবিদ্যার
উপর গবেষণা করেন এবং এই বিষয়ের উপর পরবর্তী সময়ে তিনি
Astronomiae Pars Optica
নামক বইটি রচনা করেন।
১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে ২রা আগস্ট গ্রাৎসের চার্চ প্রোট্যাস্ট্যান্ট থেকে ক্যাথলিক হতে
বলে। কেপলার এতে রাজি না হলে, সেখানাকার চার্চ কেপলার ও তার পরিবারকে গ্রাৎস থেকে
বহিষ্কার করে। এর কয়েক মাস পর তিনি সপরিবারের প্রাগ চলে আসেন। ১৬০১ খ্রিষ্টাব্দের
অধিকাংশ সময়ই টাইকো তাকে সরাসরি আর্থিক সহযোগিতা দেন। এই সময় কেপলার তাঁর গ্রহের
গতিপথ বিশ্লেষণ তত্ত্ব অনুসারে বিজ্ঞানী উরসুসের সমালোচনা করেন। সেপ্টেম্বর মাসে
টাইকো সম্রাটের কাছে তাঁর সহযোগী হিসেবে কেপলারকে একটি চাকরির কথা বলেন এবং তা
কার্যকরী হয়। এই প্রকল্পের কাজ ছিল কোপের্নিকাসের উপাত্তের উপর ভিত্তি করে
রাইনহোল্ডের করা প্রুটেনীয় জ্যোতিষ্ক তালিকার পরিবর্তে একটি নতুন তালিকা প্রণয়ন।
টাইকোর উপাত্তের ভিত্তিতে কেপলার নতুন তালিকাটি প্রণয়ন করেন, এবং হলি রোমান সম্রাট
রুডলফ দ্বিতীয়-এর সম্মানে এই তালিকার নাম রাখা হয় রুডলফীয় তালিকা। ১৬০১
খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে অক্টোবর টাইকোর আকস্মিক মৃত্যু হয়। এর পর কেপলার নতুন
রাজগণিতবিদ হিসেবে অভিষিক্ত হন। এই সময় কেপলার টাইকোর অসমাপ্ত কাজ শেষ করার
দায়িত্ব লাভ করেন।
রাজগণিত ও জ্যোতিষী হিসেবে কেপলার সম্রাটকে জ্যোতিষশাস্ত্র-ভিত্তিক উপদেশ দিতেন।
তিনি বিজ্ঞানমনষ্ক হওয়ায়, অন্যান্য জ্যোতিষীদের মতো করে কোনো অলীক সম্ভাবনার কথা না
বলে, বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ এবং সমকালীন বিষয়াবলী পর্যবেক্ষণ করে মতামত দিতেন।
১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে বিশেষভাবে আলোকতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৬০৪ খ্রিষ্টাব্দে ১লা জানুয়ারিতে সম্রাটের কাছে আলোকতত্ত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ Astronomiae Pars Optica উপস্থাপন করেন। এই বইয়ে উল্লেখিত বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল, আলোর তীব্রতা যে বিপরীত বর্গীয় সূত্র মেনে চলে তার বর্ণনা, সমতল ও বক্র দর্পণ থেকে প্রতিফলন ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেন। এই সময় তিনি মানুষের চোখের গঠন নিয়ে গবেষণা করেছিলেন।
সে সময়ে জ্যোতিষ শাস্ত্রে ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দ একটি বিশেষ বৎসর ছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে প্রতি ৮০০ বছর পরপর আকাশের একটি নির্দিষ্ট স্থানে বৃহস্পতি এবং শনি একই স্থানে দেখা যায়। একে বলা হয় গ্রহসংযোগ। মেষ, সিংহ ও ধনু রাশির সম্মিলিত হয় এমন জায়গায় এই সংযোগ ঘটে, তাই এই স্থানকে বলা হয় অগ্নিত্রিভুজ (fiery trigon বা triplcity)। তৎকালীন মানুষের ধারণা ছিল ৮০০ বছরের চক্র যখন নতুন করে শুরু হয় তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ঘটে। তাদের দাবী অনুসারে ১ খ্রিষ্টব্দের দিকে যে অগ্নিত্রিভুজ সংযোগ শুরু হয়েছিল তার পরই যিশু খ্রিষ্টেরর জন্ম হয়েছিল, আবার ৮০০ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিম ইউরোপ এবং ইউরোপীয় মধ্যযুগের সংজ্ঞা নির্ধারণকারী মহারাজা Charlemagne রোমান সম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হন। সেই ধারাবাহিকতায় এই হিসাব মতে ১৬০৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন মানুষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটার সম্ভাবনা দেখেছিলেন।
১৬০৪ খ্রিষ্টব্দের অক্টোবরে দেখা দেয় একটি তিনি একটি অতিনবতারা (SN 1604) । কেপলার এই নক্ষত্রটিকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। গ্রহসংযোগে নবতারার আবির্ভাব সাধারণ মানুষের ভিতরে প্রচলিত ধারণাকে আরও দৃঢ়তর করেছিল। তাই এই সময় কি ঘটবে, তা নিয়ে রাজ-জ্যোতিষী কেপলারের সমানে সংপ্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সে বৎসরে মূলত তেমন নতুন কিছুই ঘটে নি।
প্রথম দিকে গ্রহের গতিপথ নিয়ে তাঁর ভাবনা ছিল যে, গ্রহগুলো বৃত্তাকার পথে ঘোরে। ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গল গ্রহের গতিপথ দেখে তিনি বুঝতে পারেন যে, কক্ষপথের প্রকৃত আকৃতি উপবৃত্তের মত। এরপর তিনি গ্রহপথের প্রথম সূত্র হিসাবে বলেন- "সকল গ্রহ উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘোরে, যেখানে সূর্য থাকে উপবৃত্তের একটি ফোকাসে"। মঙ্গলগ্রহের উপর দীর্ঘ গবেষণার পর ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর Astronomia novaটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে
গ্যালিলিও, তাঁর নতুন দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে বৃহস্পতি গ্রহের চারটি
উপগ্রহ আবিষ্কার করেন। এই বিষয়ে গ্যালিলিও কেপলারের মতামত জানতে চান।
গালিলেওর নতুন দূরবীক্ষণ যন্ত্রে উদ্ভাবনের খবর পাওয়ার পর কেপলার কলোনের ডিউক
আর্নেস্টের কাছ থেকে একটি যন্ত্র ধার নিয়ে, এর আলোকবিদ্যা বিষয়ে তাত্ত্বিক ও
পরীক্ষণমূলক গবেষণা শুরু করেন। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই বিষয়ে একটি নতুন
পাণ্ডুলিপি রচনা করেন। ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে
Diopotrice
নামে এই প্রবন্ধটি প্রাকাশিত হয়।
১৬১১ খ্রিষ্টাব্দের শেষার্ধে তিনি অপর একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। এই প্রবন্ধটি
তাঁর মৃত্যুর পর Somnium
নামে প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধে তিনি পৃথিবীর পরিবর্তে সূর্যকে সৌরজগতের কেন্দ্র
হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল।
১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে
প্রাগে ধর্মীয়-রাজনৈতিক উত্তেজনা চরম রূপ ধারণ করে। এই সময় সম্রাট রুডলফের শারীরিক
অবস্থার অবনতির ঘটে। ফলে তাঁর ভাই মাটিয়াস তাঁকে বোহেমিয়ার রাজার পদ থেকে অবসর নিতে
বাধ্য করেন। পরে রুডলফ ও মাটিয়াস উভয়েই কেপলারের কাছে জ্যোতিষতাত্ত্বিক উপদেশ চান।
এই সুযোগে তিনি কিছু আপোসমূলক উপদেশের মাধ্যমে অবস্থার উন্নতি ঘটাতে চেষ্টা করেন,
গ্রহ-তারার অবস্থান সম্পর্কে খুব কমই মন্তব্য করেছিলেন যাতে রাজারা কোন আকস্মিক
পদক্ষেপ না নেন।
সে বছরই কেপলারের স্ত্রী বারবারা হাঙ্গেরীয় তিলকিত জ্বরে আক্রান্ত হন। এই সময় তাঁর
তিন সন্তানই গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়। এই সময় তাঁর ৬ বছর বয়সী সন্তান ফ্রিডরিশ মারা
যায়। ছেলের মৃত্যুর পর তিনি পাদোয়া ও ভ্যুআটেমবের্গের পৃষ্ঠপোষকদের কাছে
জ্যোতির্বিদ্যা বা গণিতের পদের জন্য আবেদন পত্র পাঠান। কিন্তু ধর্মীয় মতভেদের কারণে
কেপলারকে নিতে চান নি। উল্লেখ্য ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে গালিলেও ইউনিভার্সিটি অফ পাদোয়া
থেকে চলে যাওয়ায় পর একটি শূন্যপদের সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে পাদোয়া বিশ্ববিদ্যালয়
কর্তৃপক্ষ তাকে উক্ত শূন্যোদের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু কেপলার জার্মান ভূমিতে
থাকা শ্রেয় মনে করে, শিক্ষক ও জেলা গণিতবিদের একটি পদের জন্য অস্ট্রিয়ার লিনৎসে
যান। সেখান থেকে ফিরে আসার কিছুদিন পরই স্ত্রী বারবারা মৃত্যুবরণ করেন। ফলে কেপলার
লিনৎসে যাওয়ার তারিখ পিছিয়ে দেন। ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট রুডলফ মারা যান। এই সময়
তিনি চাকরিচ্যুত হন। পরে মাটিয়াস রোমান সম্রাজ্যের সম্রাট হওয়ার পর তিনি পূর্বতন
চাকরি পূর্ণ বেতনসহ ফিরে পান এবং চাকরি নিয়েই তাকে লিনৎসে চলে যাওয়ার অনুমতি পান।
১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
অস্ট্রিয়ার লিনৎস শহরে আসেন এবং রুডলফীয় তালিকা শেষ করেন।
১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে Nova stereometria
doliorum vinariorum রচনা শেষ করেন। এর
বিষয়বস্তু ছিল মদের বোতল বা এ ধরণের অন্যান্য বোতলের আয়তন পরিমাপের পদ্ধতি, ১৬১৫
খ্রিষ্টাব্দে এটি গ্রন্থাকারের প্রকাশিত হয়েছিল।
১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে ৩০শে অক্টোবর কেপলার ২৪ বছর বয়সী সুজানা রয়টিঙারকে (Susanna
Reuttinger) বিয়ে করেন। এই স্ত্রীর
গর্ভে প্রথম তিন সন্তান (মার্গারেটা রেগিনা, কাটারিনা ও সেবাল্ড) বাল্যকালেই মারা
যায়। অবশিষ্ট তিন কোর্ডুলা (জন্ম: ১৬২১), ফ্রিডমার (জন্ম: ১৬২৩) ও হিল্ডেবের্ট
(জন্ম: ১৬২৫) জন্মগ্রহণ করে।
১৬১৫ খ্রিষ্টাব্দে Epitome of Copernican Astronomy গ্রন্থটি তিন খণ্ডে রচনা করেন। প্রকাশকাল : প্রথম খণ্ড ১৬১৭ খ্রিষ্টাব্দ, দ্বিতীয় খণ্ড ১৬২০ খ্রিষ্টাব্দ এবং তৃতীয় ও শেষ খণ্ড ১৬২১ খ্রিষ্টাব্দ।
রুডলফীয় তালিকা এবং তার সাথে
সংশ্লিষ্ট এফিমেরিস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কেপলার একটি নতুন জ্যোতিষতাত্ত্বিক
বর্ষপঞ্জি প্রকাশ করেন এবং তা বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৬১৭ থেকে ১৬২৪
খ্রিষ্টাব্দের ভিতর প্রকাশিত হয় মোট ৬টি বর্ষপঞ্জি। এতে তিনি তিনি গ্রহের অবস্থান,
আবহাওয়া এবং এমনকি রাজনৈতিক ঘটনারও ভবিষ্যদ্বাণী করেন। অলৌকিকভাবে রাজনৈতিক
ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর অনেকগুলোই মিলে গিয়েছিল। ১৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের রাজনৈতিক
অস্থিতিশীলতা কমে যাওয়ার কারণে ভবিষ্যদ্বাণীর মিথ্যা প্রমাণিত হতে থাকে। তখন তিনি
তাঁর জনপ্রিয়তা হারান। তাঁর শেষ বর্ষপঞ্জি গ্রাৎসে জনসমক্ষে পোড়ানো হয়েছিল।
১৬১৫ খ্রিষ্টাব্দে উরসুলা রাইনগোল্ডের সাথে কেপলারের ভাই ক্রিস্টোফের আর্থিক
দ্বন্দ্ব চলছিল। আদালতে অভিযোগ করেন যে কেপলারের মা কাথারিনা অশুভ চোলাইকৃত মদ
খাইয়ে তাকে অসুস্থ করে দিয়েছে। এ নিয়ে বিতর্কের জন্ম হলে, ১৬১৭ খ্রিষ্টাব্দে
কাথারিনাকে ডাকিনীবিদ্যা চর্চার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। ১৬২০ খ্রিষ্টাব্দের
আগস্টে কাথারিনাকে ১৪ মাসের জন্য আটক করা হয়। কিন্তু কেপলারের উপযুক্ত আইনী
প্রতিরোধের কারণে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় ১৬২১ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে। ১৬২১
খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্যাখ্যা ও সংশোধন-সহ
Mysterium Cosmographicum
একটি বর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন। এর ভিতরে তাঁর
Harmony of the World
গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে।
১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
রুডলফীয় তালিকা সম্পূর্ণ করেন। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও বিশৃঙ্খলার কারণে কেপলার ও তার
পরিবার বিপদগ্রস্থ হয়। ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাথলিক কাউন্টার-রিফর্মেশনের এজেন্টরা
কেপলারের গ্রন্থাগার তালাবদ্ধ করে রাখে, ১৬২৬ খ্রিষ্টাব্দে লিনৎস শহর অবরোধ করা হলে
তিনি উলম শহরে চলে যান এবং সেখানে নিজ খরচায় তালিকাটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।
১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে জেনারেল ভালেনস্টাইনের অধীনে পরিচালিত রোমান সম্রাট
ফের্ডিনান্ডের সেনাবাহিনী জয়লাভ করে। ফলে কেপলারের অবস্থা অনুকূলে আসে এবং তিনি
ভালেনস্টাইনের উপদেষ্টা মনোনীত হন। এই সময় জেনারেলের সরাসরি রাজ-জ্যোতিষী না হয়েও
তিনি রাজ-জ্যোতিষীদের জন্য হিসাব-নিকাশ করে দিতেন।
১৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন, তাকে রেগেন্সবুর্গেই সমাধিস্থ করা
হয়। সুয়েডীয় সেনাবাহিনী গীর্জার প্রাঙ্গণ ধ্বংস করে দেয়া তার কবরটি হারিয়ে গিয়েছিল।
কেবল কেপলারের নিজের লেখা সমাধিলিপিটিই রক্ষিত আছে। সমাধিটির সমাধিলিপিতে আছে—
Mensus eram coelos,
nunc terrae metior umbras
Mens
coelestis erat, corporis umbra iacet.
[আমি একদিন আকাশ মেপেছি, আজ ছায়াকে মাপি, আমার মন ছিল আকাশের দিকে, আমার আর দেহ
বিশ্রাম নিল পৃথিবীতে।]
সূত্র :
http://en.wikipedia.org/wiki/Johannes_Kepler