কংসনারায়ণ
বাংলার বারো ভুঁইয়াদের একজন এবং রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা।

কংসনারায়ণ ছিলেন ভট্টনারায়ণের বংশধর। ভট্টনারায়ণ দিল্লীর সম্রাট বা বাংলার কোনো স্বাধীন সুলতানের কাছ থেকে বঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের দেওয়ানি লাভ করেন। এই সময় তিনি ২২ পরগণার অধিকার লাভ করেন এবং 'সিংহ' উপাধি লাভ করেন। বারাহী নদীর তীরে রামবাম নামক স্থানে তিনি তাঁর রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন। ভট্টনারায়ণের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র উদয় নারায়ণ রাজা হন। এই উদয়ের পৌত্র ছিলেন কংসনারায়ণ।

সুলতানী আমলে তিনি চট্টগ্রামে মগ দমনে বীরের ভূমিকা পালন করেন। মোগল-পাঠান দ্বন্দ্বের ভিতরে বাংলার মসনদে ছিলেন নবাব সুলেমান কররানি (শাসনকাল ১৫৬৬-১৫৭২) সুলেমানের প্রধান সেনাপতি ছিলেন হিন্দু-বিদ্বেষী কুখ্যাত কালাপাহাড়। কালাপাহাড় হিন্দুদের উপর ভয়াবহ অত্যাচার চালায় এবং বিভিন্ন মন্দির ধ্বংস করতে থাকে। এর প্রতিকারের জন্য নবাবের কাছে আবেদন করলে, নবাব তা প্রত্যাখ্যান করেন। এই কারণে তিনি তাঁর ফৌউদার পদ ত্যাগ করেন। এরপর সিন্দুরীর জমিদার ঠাকুর কালীদাস রায়, সাঁতোরের জমিদারপুত্র গদাধর সান্যল ও দিনাজপুরের রাজভ্রাতা গোপীকান্ত রায়ের সাথে পরামর্শ করে- দিল্লি সম্রাট আকবরের শরণাপন্ন হন। এর প্রতিকারের জন্য সম্রাট আকবর বাংলা অভিযান করলেন। ইতিমধ্যে সুলেমান কররানির মৃত্যুবরণ  করেছিলেন। নতুন নবাব হয়েছিলেন সুলেমান কররানির পুত্র দাউদ খাঁ। ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহলে মোগলদের কাছে পরাজিত ও নিহত হন দাউদ খাঁ। এরপর মো্গলরা রাজ্যের জমিজমার বন্দোবস্ত করার উদ্যোগ নেন। এই কাজে কংসনারায়ণ রাজা টোডরমলকে সাহায্য করন। কংসনারায়ণের সুদক্ষ সহযোগিতায় সুবে বাংলার জমিজমার জরিপ ও বন্দোবস্ত পুরোদমে চলছিল। সেই সময় আকবর রাজা টোডরমলকে দিল্লিতে ডেকে পাঠান। রাজা টোডরমল এই গুরুতর দায়িত্বপূর্ণ অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব অর্পণ করেন কংসনারায়ণের উপর।  কংসনারায়ণ অবশিষ্ট কাজ সুচারুভাবে শেষ করে সমস্ত হিসাবপত্র, চিঠা-পৈঠা ও নকশা পাঠিয়েছিলেন সম্রাটের কাছে। সম্রাট আকবর টোডরমলের সহায়তায় সব কাগজপত্র পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হন এবং মোগল সম্রাট আকবর বিশিষ্ট দূত মারফত কংসনারায়ণের জন্য পাঠালেন নানা রকম মূল্যবান উপহার পাঠান। সম্রাট তাঁকে 'রাজা' খেতাব দেন এবং একই সাথে সুবে বাংলার দেওয়ানের পদ প্রদান করেন। বৃদ্ধবয়সে কংসনারায়ণ দেওয়ানি ছেড়ে বর্তমান এখন রাজশাহীর তাহেরপুরে বসবাস শুরু করেন। সে সময় দেওয়ানকে স্থানীয়রা 'রাজা' বলতো। এই সময় তাহেরপুরে উন্নয়নে মনোযোগ দেন। এই সময় তিনি একটি মহাযজ্ঞ করার সিদ্ধান্ত নেন। বংশানুক্রমিক পুরোহিত নাটোর বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্য বংশের পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী তাঁকে বলেন, চারটি মহাযজ্ঞের বিশ্বজিত ও রাজসূয় যজ্ঞের অধিকারী শুধু সম্রাটরা। কিন্তু কংসনারায়ণের বংশ ছিল পশুবলি-বিরোধী। তাই অশ্বমেধ বা গোমেধ যজ্ঞে তিনি রাজী হন নি। এর বিকল্প হিসেবে রাজ পুরোহিত দুর্গাপূজা'র বিধান দেন। ১৫৮ খ্রিষ্টাব্দে এই পূজা সম্পন্ন হয়েছিল। উল্লেখ্য আগে থেকে বাংলায় দুর্গা-পূজার প্রচলন ছিল, তবে নবতর পদ্ধতিতে দুর্গোৎসবের বিধান চালু করেছিলেন তিনি। প্রতিমার পেছনে অর্ধ চন্দ্রাকার চালি তথা চালচিত্রের ব্যবহার তাঁর সময়ে চালু হয়েছিলএই চালিতে দশমহাবিদ্যা ও মহাদেবের স্থান রেখেছিলেন। এই ধরনের চালিকে বাংলা চালি বলা হয়।

তিনি প্রতিমার মুখের আদলে কিছু পরিবর্তন এনেছিলেন। তিনি দেবী প্রতিমায় টানাটানা চোখ ও টিয়াপাখির ঠোঁটের মত বাঁকানো নাক, দুই গাল সামান্য চাপা করে মূর্তি তৈরির ব্যবস্থা করেছেলেন। এই ধরনের মুখের আদলকে বলা হয় বাংলা মুখ । এছাড়া, দেবী প্রতিমার গায়ের বর্ন করেছেলেন গাঢ় হলুদ।

কংস নারায়ণের পরে বাংলাদেশের হরিপুরের পাবনাতে এই পুজোর সূচনা করেন কংসনারায়ণের ছেলে মুকুন্দরাম রায়। সেই সময় হুসেন শাহের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরে রাজা শ্রীহট্ট সেনের বাড়িতে বিগ্রহ নিয়ে টাঙ্গাইলে আসেন মুকুন্দরাম। এবং রাজচক্রবর্তী উপাধি নিয়ে বসত শুরু করেন। কেবলমাত্র এই বিগ্রহটি বাঁচানোর জন্য তিনি তার উপাধি পরিবর্তন করেন। মুকুন্দরাম রায় থেকে চক্রবর্তী হন। তার পরে প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়িয়ে ফের যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এবং যুদ্ধে জয়ীও হন ।ঐতিহাসিক এই দুর্গামূর্তিতে লক্ষ্মী-সরস্বতী নেই। আছেন কার্তিক ও গণেশ। নিত্যপুজোয় ৯ রকমের ভাজা দিয়ে ভোগ দেওয়া হয় মাকে। দুর্গাপুজোর সময় অষ্টধাতুর মূর্তির পাশে মৃণ্‌ময়ী মূর্তি পূজিতা হন।

কংসনারায়ণের দুই ছেলে মুকুন্দরাম রায় ও নরেন্দ্রনারায়ণ রায় । নরেন্দ্রনারায়ণ রায় সম্পত্তির দশ আনার উত্তরাধিকারী হন। রাজা কংসনারায়ণের পুত্র নরেন্দ্রনারায়ণের কন্যা উমাদেবী সাথে আনন্দীরাম রায়ের বিয়ে হয়। বংশের শেষ রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ অপুত্রক অবস্থায় মারা যান। ফলে বংশের পুত্রসস্তান না থাকায় আনন্দীরামের দশ আনা সম্পত্তির অধিকারী বিনোদরাম হলেন।


 তথ্যসূত্র :