দুর্গা
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা {হিন্দু দেবী | হিন্দু দৈবসত্তা | হিন্দু পৌরাণিক সত্তা | ভারতীয় পৌরাণিক সত্তা | পৌরাণিক সত্তা | অতিপ্রাকৃতিক বিশ্বাস | কাল্পনিক সত্তা | কল্পনা | সৃজনশীলতা | কর্মক্ষমতা | জ্ঞান | মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা | বিমূর্তন | বিমূর্ত-সত্তা | সত্তা |}

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে–  দেবী বিশেষ।

যে দেবী অগম্যা, দুষ্প্রাপ্যা বা যাকে সহজে পাওয়া যায় না এই অর্থে– দুর্গা। দুর্গ নামক দৈত্যকে দমন করে তিনি দুর্গা নাম প্রাপ্ত হন। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে– পরমাপ্রকৃতি স্বরূপা মহাদেবী, মহাদেবের পত্নী। তিনি জন্মমৃত্যু-রহিতা। সমগ্র জগত ব্যাপিয়া তিনি বিরাজমানা। তারপরেও জগতের কল্যাণে তিনি আবির্ভূতা হন।

খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে বেদব্যাস (বেদবিভাজক বেদব্যাস নয়)-কর্তৃক রচিত মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে - আদিকালে যখন যোগনিদ্রায় ছিলেন, তখন বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে উৎপন্ন মধু ও কৈটভ [মধুকৈটভ] নামক দুটি ভয়ঙ্কর অসুর ব্রহ্মাকে ভক্ষণ করতে উদ্যত হয়েছিল। এই যোগনিদ্রায়ই ছিলেন দেবী মহামায়া। এই সময় ব্রহ্মা বিষ্ণুর নাভিমূলে আশ্রয় নিয়ে যোগনিদ্রারূপী এই দেবীকে বন্দনা করেন। এই বন্দনার একাংশে ব্রহ্মা বলেন যে, - তিনি (ব্রহ্মা), বিষ্ণুমহাদেব এই দেবীর প্রভাবে শরীর লাভ করেছেন। তিনি মহাদেবের শক্তি হিসেবে বিরাজ করেন।   ব্রহ্মার বন্দনায় সন্তুষ্ট হয়ে, যোগমায়ারূপী এই দেবী, চোখ, মুখ, নাক, বাহু, হৃদয় ও বক্ষস্থল থেকে বাহির হয়ে, দেবীরূপে আবির্ভূতা হন।

মহামায়া বিষ্ণুর দেহ ছেড়ে গেলে তিনি জেগে উঠেন এবং দেখতে পান যে মধুকৈটভ  ব্রহ্মাকে ভক্ষণ করতে উদ্যত হয়েছে।  ব্রহ্মাকে রক্ষা করার জন্য, বিষ্ণু এই অসুরদ্বয়ের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পাঁচ হাজার বছর যুদ্ধ করার পরও কেউ কাউকে পরাজিত করতে পারলেন না। এই সময়, অসুরদ্বয় মহামায়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, বিষ্ণুর যুদ্ধদক্ষতার প্রশংসা করেন এবং বিষ্ণুকে বর প্রার্থনা করতে বলেন। উত্তরে বিষ্ণু বলেন যে, 'তোমরা আমার বধ্য হও'।

বর প্রার্থনা করার কথা বলে মধুকৈটভ যে ভুল করেছিল, তা সংশোধনের জন্য কৌশল নিলেন। তাঁরা দেখলেন সমগ্র পৃথিবী জলমগ্ন। তাই তাঁরা
বিষ্ণুকে বলেন যে– তুমি আমাদেরকে জলহীনস্থানে হত্যা কর। এরপর বিষ্ণু তাঁর হাটুর উপর উভয় অসুরকে রেখে সুদর্শন চক্র দ্বারা তাঁদের শিরোশ্ছেদ করেন। পরে এই দুই অসুরের দেহের মেদ থেকেই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে বলে– হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে পৃথিবীর অপর নাম মেদিনী। 

মার্কেণ্ডেয় পুরাণের একাশীতিতম অধ্যায়ে ('শ্রীশ্রীদেবীমাহত্ম্য') আছে -'স্বারোচিষ' মন্বন্ন্তরে চৈত্রবংশের রাজা ছিলেন সুরথ। সে সময় কোলাবিধ্বংসী রাজারা একত্রিত হয়ে- রাজা সুরথকে পরাজিত করে, তাঁর রাজ্য দখল করে নেন। রাজ্য হারিয়ে সুরথ মেধস মুনির আশ্রমে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মুনি তাঁকে দেবী মহাময়া তথা দুর্গাকে পূজা করার পরামর্শ দেন।

মহিষাসুর উপাখ্যান
মার্কেণ্ডয় পুরাণের ৮২তম অধ্যায়ে রয়েছে- মহিষাসুর উপাখ্যান। এই উপাখ্যানে পাওয়া যায়- মহিষাসুর নামক অসুর স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতারিত করে স্বর্গ অধিকার করেছিল। পরাজিত দেবতারা এর প্রতিকারের জন্য ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। তাঁরা সবিস্তারে অসুরেদের অত্যাচারের কথা ব্যক্ত করেন। দেবতাদের এই অভিযোগ শোনার পর- ব্রহ্মাবিষ্ণু মহেশ্বর ক্রোধান্বিত হলে, তাঁদের তেজ প্রকাশিত হয়। এই সময় অন্যান্য দেবতারাও তাঁদের তেজ ত্যাগ করেন। এই সম্মলিত তেজরাশি থেকে দুর্গার আবির্ভাব হয়েছিল। দেবতার তেজ থেকে এই দুর্গার শরীরের বিভিন্ন অংশ তৈরি হয়েছিল। এ রূপগুলো হলো– মহাদেবের তেজে মুখ, যমের তেজে চুল, বিষ্ণুর তেজে বাহু, চন্দ্রের তেজে স্তন, ইন্দ্রের তেজে কটিদেশ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পায়ের আঙ্গুল, বসুদের তেজে হাতের আঙ্গুল, কুবেরের তেজে নাসিকা, প্রজাপতির তেজে দাঁত, অগ্নির তেজে ত্রিনয়ন, সন্ধ্যার তেজে ভ্রূ, বায়ুর তেজে কান এবং অন্যান্য দেবতাদের তেজে শিবারূপী দুর্গার সৃষ্টি হয়েছিল।

এরপর দেবতারা তাঁকে বস্ত্র, পোশাক ও অস্ত্র দান করলেন। এক্ষেত্রে যাঁরা যা দান করলেন, তা হলো– মহাদেব দিলেন শূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, বরুণ দিলেন শঙ্খ, অগ্নি দিলেন শক্তি, বায়ু দিলেন ধনু ও বাণপূর্ণ তূণীর, ইন্দ্র দিলেন বজ্র, ঐরাবত দিলেন ঘণ্টা, যম দিলেন কালদণ্ড, বরুণ দিলেন পাশ, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা ও কমণ্ডলূ, সূর্য দিলেন রশ্মি, কালখড়্গ ও নির্মল চর্ম, ক্ষিরোদ সাগর দিলেন অক্ষয়বস্ত্রসহ বিভিন্ন অলঙ্কার ও আভরণ, বিশ্বকর্মা দিলেন পরশুসহ নানাবিধ অস্ত্র, অভেদ্য কবচমালা, হিমালয় দিলেন সিংহ, কুবের দিলেন অমৃতের পান পাত্র, শেষ নাগ দিলেন নাগহার ও অন্যান্য দেবতারা তাঁদের সাধ্যমতো বিষয় উপহার দিলেন। এরপর দেবতারা সমবেতভাবে তাঁকে সম্মান দেখানোর সাথে সাথে দেবী অট্টহাস্য করতে লাগলেন। তাঁর হাসিতে পৃথিবী কম্পিত হতে লাগলো। অসুররা এই কম্পনের কারণ জানতে এসে দেবীকে দেখলো। এরপর দেবীর সাথে অসুরের যুদ্ধ আরম্ভ হলো। এই যুদ্ধে মহিষাসুরের পক্ষে যে যে সেনাপতি বিশাল বাহিনী নিয়ে অংশগ্রহণ করেছিল, তারা হলো–

চামর ও চিক্ষুর : চতুরঙ্গ সৈন্য্য
মহাহনু : অযুত হাজার রথ ও সৈন্য
অসিলোমা : পঞ্চাশ নিযুত রথ ও সৈন্য
বাস্কল : ষাট লক্ষ সৈন্য সহস্র হাতি ও এক কোটি রথ।
বিড়ালাক্ষ : অযুত সৈন্য ও পঞ্চাশ অযুত রথ

এছাড়া অন্যান্য ছোট খাট সেনাপতিরা তাঁদের সাধ্যমতো সেনাদল নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এই সময় মহিষাসুর নিজে কয়েক কোটি রথ হাতি, অশ্ব ও সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।

অসুরদল দুর্গাকে আক্রমণ করলে, ইনি তা অবলীলায় প্রতিহত করলেন। তারপর ইনি শ্বাস ত্যাগ করলে, শতসহস্র প্রমথ সৈন্য সৃষ্টি হলো। এই সৈন্যরা পরশু, পট্টিশ, অসি ও ভিন্দিপালের আঘাতে অসুরদের হত্যা করতে লাগলো। দেবী ত্রিশূল, গদা, শক্তি, ঋষ্টি, খড়গ ব্যবহার করে অসুরদের বিনাস করতে লাগলেন। ক্রমে সকল সৈন্য ও সেনাপতিরা নিহত হলে, মহিষাসুর নিজে মহিষের রূপ ধরে সারা পৃথিবী ক্ষুব্ধ করে দেবীর মুখোমুখী হলো, দেবী তাকে পাশ দিয়ে বেঁধে ফেললেন। এই অবস্থায় মহিষাসুর তার মহিষরূপ ত্যাগ করে, সিংহের রূপ ধারণ করলো। এই সময় দেবী তার শিরশ্ছেদ করলেন। সাথে সাথে অসুর খড়গধারী পুরুষ মূর্তিতে উপস্থিত হলো। এবার দেবী এই মূর্তিকে তার খড়গসহ কেটে ফেললে, অসুর হাতির রূপ ধরলো। তারপর শুড় দিয়ে দেবীর বাহন সিংহকে টানার চেষ্টা করলে, দেবী এঁর শুড় কেটে দিলেন। এবার অসুর পুনরায় মহিষের রূপ ধরে পুনরায় ত্রিলোক তছনছ করে বেড়াতে লাগলো। এই সময় দেবী অমৃত পান করে ক্রোধে হাসতে লাগলেন। অসুর শিঙ দিয়ে পর্বত উত্তোলন করে দেবীর প্রতি নিক্ষেপ করলে, দেবী শর নিক্ষেপ করে তা চূর্ণ করে ফেললো। এরপর দেবী মধুপান করে মহিষাসুরের উপর লাফিয়ে উঠে পায়ের নিচে চেপে ধরলেন। তারপর গলার উপর পা রেখে শূল দ্বারা আঘাত করলেন। এরপর মহিষের মুখ থেকে অসুরের নিজ মূর্তির অধ্বাংশ বের হওয়ার সাথে সাথে, দেবী তাকে বেঁধে ফেললেন। এই অবস্থায় অসুর যুদ্ধ করতে থাকলে, দেবী খড়গ দিয়ে তার শিরশ্ছেদ করলেন। এরপর দেবতা ও ঋষিরা দেবীর বন্দনা করলেন। দেবতারা বললেন, তাঁরা এরূপ বিপদে পড়লে, দেবী যেন পুনরায় তাঁদের উদ্ধার করেন। দেবী সেই বর দিয়ে অন্তর্হিত হলেন।

কথিত আছে, দুর্গা মহিষাসুরকে তিনবার হত্যা করেন। প্রথমবার ইনি অষ্টাভূজা উগ্রচণ্ডা রূপে, দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার ভদ্রাকালী ও দশভূজা দুর্গারূপে। মহিষাসুরের অনুরোধে মহিষাসুর দুর্গার উক্ত তিন ধরনের মূর্তির সাথে পূজিত হয়ে থাকেন।

শুম্ভ-নিশুম্ভ বধ
শুম্ভ-নিশুম্ভ নামে দুই অসুর ইন্দ্রপুরী দখল করে ত্রিলোক অধিকার করে। এরা সূর্য ও চন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এছাড়া কুবের, যম, বরুণ , অগ্নি, ও বায়ুর অধিকার লাভ করে। এরপর দেবতারা মাতঙ্গ মুনির আশ্রমে এসে- দুর্গার আরাধনা করেন। আরাধনায় তুষ্ট হয়ে এই দেবী প্রথমে মাতঙ্গ মুনির স্ত্রীর রূপ ধরে দেবতাদের কাছে আসেন এবং পরে একটি বিশেষ মূর্তি ধারণ করেন। এই মূর্তিতে এঁর চার হাত ও গলায় নরমুণ্ডমালা ছিল। এই মূর্তি মাতঙ্গ মুনির স্ত্রীর রূপ মাতঙ্গী'র দেহরূপ থেকে নির্গত হয়েছিল বলে– এর নাম হয়েছিল মাতঙ্গী। এই মূর্তীতে দুর্গার মাথায় একটি মাত্র জটা থাকায় ইনি একজটা নামে অভিহিত হয়ে থাকেন। 

মার্কেণ্ডেয় পুরাণের মতে, হিমালয়ে গিয়ে দেবতারা দেবীর স্তব করেছিলেন। এই সময় পার্বতী জাহ্নবী নদীতে স্নান করতে অগ্রসর হলে, দেবতাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কার স্তব করছো। এই বাক্য শেষ হওয়ার সাথে সাথে, পার্বতীর শরীরকোষ থেকে দুর্গা দেবী প্রকাশিত হলেন। এই কারণে, দেবীর অপর নাম কৌষিকী। এরপর পার্বতী কৃষ্ণকায় মূর্তি ধারণ করলেন। এই রূপের জন্য তিনি কালিকা নামে অভিহিত হলেন।

এরপর তিনি মনোহর মূর্তি ধারণ করে হিমালয়ে আশ্রয় নেন। এই সময় শুম্ভ-নিশুম্ভের সেনাপতি চণ্ড-মুণ্ড এই নারীরূপ সম্পর্কে শুম্ভ-নিশুম্ভকে জানান। এরপর শুম্ভ-নিশুম্ভ দেবীর কাছে সুগ্রীব নামক এক দূতের দ্বারা বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। দেবী এই দূতকে জানান যে, যে তাঁকে যুদ্ধে হারাতে পারবেন, তাঁকেই তিনি বিবাহ করবেন। এই কথা শুনে শুম্ভ-নিশুম্ভ ধূম্রলোচনকে সেনাপতি করে দেবীকে চুল ধরে লাঞ্ছিত করে তাদের কাছে আনতে বলে। ধূম্রলোচনক ৬০ হাজার সৈন্য নিয়ে দেবীকে ধরতে আসেন। ধূম্রলোচন দেবীর সম্মুখে এলে, দেবী তাঁকে ভস্মীভূত করেন।

এরপর শুম্ভ-নিশুম্ভ দেবীকে ধরে আনার জন্য চণ্ড-মুণ্ডকে পাঠান। হিমালয়ের শিখরে তাঁরা দেবীকে আক্রমণ করলে– দেবীর ললাট থেকে অপর একটি ভয়ঙ্কর দেবী নিষ্ক্রান্ত হন। এই দেবী কালী নামে অভিহিত হয়ে থাকেন। মূলত কালীর ছিল চারটি হাত। এর মধ্যে দুই ডান হাতে ছিলে খট্বাঙ্গ ও চন্দ্রহাস, বাম দুই হাতে রয়েছে চর্ম ও পাশ। এঁর গলায় ছিলে নরমুণ্ডু ও দেহ বাঘের ছালে আবৃত। এঁর দাঁত দীর্ঘ, রক্তচক্ষু, বিস্তৃত মুখ ও স্থূল কর্ণ। যুদ্ধ ক্ষেত্রে আবির্ভুতা হয়েই দেবী অসুর সৈন্য ও হাতি ঘোড়া মুখে পুড়ে আহার করা শুরু করেন। ফলে অসুর সৈন্যরা ভীত হয়ে পড়লেন।

এই সময় তিনি কালীরূপ-সহ দশটি রূপ ধরে যুদ্ধ করেছিলেন। এই দশটিরূপকে দশটি নামে অভিহিত করা হয়। এই নামগুলো হলো– দিগম্বরী, আকর্ণনয়না, পূর্ণযৌবনা, মুক্তকেশী, লোলজিহবা, মুণ্ডমালাবিভুষিতা, চতুর্ভুজা, শ্যাম বর্ণ ও কালী।

এরপর চণ্ড-মুণ্ড দেবীর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অস্ত্র নিক্ষেপ করলে, দেবী তা মুখে গ্রহণ করে অট্টহাস্য করতে লাগলেন। এরপর তিনি চণ্ড ও মুণ্ডকে হত্যা করলেন। এই দেবী চণ্ড-মুণ্ডকে হত্যা করে দুর্গার মূল মূর্তির কাছে গেলে, দুর্গা তাঁকে চামুণ্ডা (চণ্ড-মুণ্ডকে হত্যা করার কারণে) নামে অভিহিত করেন। উল্লেখ্য অম্ (সূক্ষ্ম) রূপযুক্তা– এই অর্থে কালীর অপর নাম অংস্বরূপা।

যুদ্ধে দেবতাদের সহায়তা

চণ্ড-মুণ্ডের নিহত হওয়ার কথা শুনে, শুম্ভ নিজেই বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে অগ্রসর হন। এই সময় অন্যান্য দেবতারা দেবীকে শক্তি ও অস্ত্র দ্বারা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। এই সময় যে সকল দেবতারা সাহায্য করার জন্য এসেছিলেন, তাঁরা হলেন– ব্রহ্মার তাঁর ক্ষমতা নিয়ে হংসবাহনে এবং ব্রহ্মাণী অক্ষসূত্র ও কমণ্ডলু ধারণ করে আসেন । ষাড়ের পিঠে চড়ে মহাদেব সর্পবলয় ও চন্দ্ররেখা ভূষণ ধারণ করে ত্রিশূল হাতে নিয়ে আসেন। গুহরূপিণী কৌমারী ময়ুর বাহনে শক্তিশেল নিয়ে আসেন। বৈষ্ণবী শক্তি নিয়ে গরুড়ের পিঠে চড়ে আসেন বিষ্ণু। এঁর হাতে ছিল শঙ্খ, চক্র, গদা ও খড়্গ। এছাড়া বিষ্ণুর যজ্ঞবরাহ মূর্তি, নৃসিংহমূর্তিও যোগ দিয়েছিলেন এর সাথে। ইন্দ্র এসেছিলেন বজ্র হাতে ঐরাবতে চড়ে।

দেবী চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলে, তাঁর শরীর থেকে চণ্ডিকা শক্তি নিষ্ক্রান্ত হলো। এরপর দেবী কিছু শর্ত দিয়ে মহাদেবকে চণ্ড-মুণ্ডের কাছে দূত হিসাবে পাঠান। দেবী তিনটি শর্ত মান্য করার শর্তে যুদ্ধ থামাতে চেয়েছিলেন। শর্ত তিনটি হলো- ইন্দ্র ত্রিলোকের অধিপতি হবেনম দেবতারা হবির্ভোজন করবেন এবং অসুরার পাতালে গমন করবেন। চণ্ডিকার দূত হিসেবে শুম্ভ-নিশুম্ভের কাছে গিয়েছিলেন বলে- মহাদেবের নাম হয়েছে শিবদুতী। মহাদেবের শুম্ভ-নিশুম্ভ এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে, দেবীকে আক্রমণ করলে, দেবীর চণ্ডিকা ও কালী মূর্তিসহ- সকল দৈবশক্তি নিয়ে অসুরদের হত্যা করা শুরু করে। এই যুদ্ধে সকল দেবতা নিজ নিজ শক্তি দিয়ে যুদ্ধ করা শুরু করেন। এই যুদ্ধে অসংখ্য অসুর-সৈন্য নিহত হতে থাকলে, অনেক অসুর যোদ্ধা সমরক্ষেত্র থেকে পালানো শুরু করে।

এরপর ভীত অসুর সৈন্যদের উৎসাহ দিয়ে রক্তবীজ নামক অসুর যুদ্ধক্ষেত্রে এলো। এই অসুরের রক্ত মাটিতে পড়লে, তা থেকে অসংখ্য অসুর সৈন্য জন্মগ্রহণ করতো বলে, এর এরূপ নামকরণ করা হয়েছিল। রক্তবীজ ইন্দ্রের-শক্তির সাথে যুদ্ধ শুরু করলে, এই শক্তি বজ্র দ্বারা তাকে আঘাত করলেন। এর ফলে আহত রক্তবীজের শরীর থেকে নির্গত রক্ত বিন্দু থেকে অসংখ্য অসুর সৈন্য সৃষ্টি হতে থাকলো। অন্যান্য দৈব শক্তির আঘাতের ফলে একই ঘটনা ঘটতে থাকলে, অচিরেই যুদ্ধক্ষেত্র অসুর সৈন্যে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। এরপর চণ্ডিকা কালীকে ডেকে বললেন যে রক্তবীজকে আঘাত করলে, যে রক্তপাত হবে, তা কালী খেয়ে ফেললে, সৈন্য উৎপাদন বন্ধ হবে। এরপর চণ্ডিকা রক্তবীজকে আঘাত করলে, কালী তার রক্ত খেয়ে ফেলতে লাগলেন। একসময় রক্তবীজ রক্তশূন্য হয়ে ভূমিতে পতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে।

 শুম্ভ-নিশুম্ভ বধ
রক্তবীজের হত্যার পর শুম্ভ-নিশুম্ভ নিজেরাই সসৈন্যে যুদ্ধক্ষেত্রে আসে। এই যুদ্ধে প্রাথমিকভাবে দেবীর শরাঘাতে নিশুম্ভ ভূপাতিত হলে, শুম্ভ তাঁকে আক্রমণ করে। কিন্তু কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর শুম্ভ শূলের আঘাতে মূর্চ্ছিত হয়। পরে নিশুম্ভ চেতনা লাভ করে দেবীকে পুনরায় আক্রমণ করে। দেবী প্রথমে নিশুম্ভের বুকে শূলের আঘাত করলে, তার হৃদয় থেকে একটি পুরুষ মূর্তি নির্গত হয়। এরপর দেবী খড়গের আঘাতে এই পুরুষের শিরশ্ছেদ করেন। ফলে নিশুম্ভের মৃত্যু হয়। এরপর শুম্ভ চেতনা লাভ করে দেবীকে বলে যে, এই সব সহকারী শক্তির বলে যুদ্ধ করছে, মূলত দেবীর কোন শক্তি নেই। শুম্ভের এই কথা শুনে দেবী সকল সহকারী শক্তি তাঁর দেহের ভিতর টেনে নিয়ে এককভাবে শুম্ভের মুখোমুখী হন। এরপর শুম্ভ তাঁকে আক্রমণ করলে, দেবী সকল আক্রমণ প্রতিহত করলেন। এই সময় শুম্ভ দেবীকে আকাশে তুলে নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। একসময় দেবী শুম্ভকে পৃথিবীতে নিক্ষেপ করে মাটিতে নেমে এলে, শুম্ভ মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে দেবীকে আক্রমণ করে। কিন্তু দেবী শূলের আঘাতে শুম্ভকে হত্যা করেন।

আদ্যাদেবী রূপ সতী
বিভিন্ন পুরাণ মতে– এই দেবী দক্ষের কন্যা হিসাবে সতী নামে পরিচিতা। কালিকা পুরাণ মতে– দক্ষ মহামায়াকে [দুর্গা] কন্যারূপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করেন। দক্ষের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহামায়া দক্ষকে বলেন, –তিনি অবিলম্বে তাঁর (দক্ষের) পত্নীর গর্ভে তাঁর কন্যারূপ জন্মগ্রহণ করবেন এবং মহাদেব-এর স্ত্রী হবেন। তবে তাঁকে (দুর্গাকে) যথাযথ সমাদর না করলে তিনি দেহত্যাগ করবেন। এরপর দক্ষ অসিক্লী-কে বিবাহ করেন। বীরিণী'র গর্ভে মহামায়া জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষ এঁর নাম রাখেন সতী। [১-৪৪। অষ্টমোহধ্যায়, কালিকাপুরাণ]

সতী যৌবনে পদার্পণ করলে, মহাদেব-এর সাথে তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু মহাদেব দক্ষকে যথোচিত সম্মান প্রদর্শন না করায় ইনি ক্রমে ক্রমে মহাদেবের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেন। বিবাহের এক বৎসর পর, দক্ষ এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন। এই যজ্ঞে দক্ষ মহাদেব ও সতী কাউকেই নিমন্ত্রণ করলেন না। সতী নারদের মুখে এই যজ্ঞের কথা জানতে পেরে অযাচিতভাবে যজ্ঞে যাবার উদ্যোগ নেন। মহাদেব এই যাত্রায় সতীকে বাধা দেন। এতে সতী ক্রুদ্ধ হয়ে– তাঁর মহামায়ার দশটি রূপ প্রদর্শন করে মহাদেবকে বিভ্রান্ত করেন। এর দশটি রূপ ছিল– কালী, তারা, রাজ-রাজেশ্বরী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামূখী, মাতঙ্গী ও মহালক্ষ্মী। মহাদেব শেষ পর্যন্ত সতীকে দক্ষের যজ্ঞানুষ্ঠানে যাবার অনুমতি প্রদান করেন। কিন্তু যজ্ঞস্থলে দক্ষ মহাদেবের নিন্দা করলে– সতী পতি নিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহত্যাগ করেন। সতীর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে ক্রুদ্ধ মহাদেব নিজের জটা ছিন্ন করলে, বীরভদ্র জন্মলাভ করেন। পরে বীরভদ্র দক্ষের যজ্ঞ পণ্ড করে মুণ্ডুচ্ছেদ করেন।

এরপর মহাদেব সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন। এর ফলে সৃষ্টি ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হলে, বিষ্ণু তাঁর চক্র দিয়ে সতীদেহকে একান্নভাগে বিভক্ত করে দেন। এই ৫১টি খণ্ড ভারতের বিভিন্ন স্থানে পতিত হয়। ফলে পতিত প্রতিটি খণ্ড থেকে এক একটি মহাপীঠ উৎপন্ন হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রতিটি মহাপীঠকে পবিত্র তীর্থস্থান হিসাবে বিবেচনা করেন। দেখুন : পীঠস্থান

কালিকা পুরাণের মতে– ব্রহ্মা, বিষ্ণু শনি যোগবলে সতীর দেহে ঢুকে এই দেহকে বিভাজিত করেন। এই বিভাজিত অংশগুলির মধ্যে– দেবীকূটে পদযুগল, ঊড্ডীয়ানে উরুযুগল, কামপর্বতে যোনিমণ্ডল, এর পূর্বভাগে নাভিমণ্ডল, জলন্ধরে সুবর্ণহার শোভিত স্তনযুগল, পূর্ণগিরিতে স্কন্ধ ও গ্রীবা এবং কামরূপের শেষভাগে মস্তক। সতীর অন্যান্য দেহাংশ খণ্ড খণ্ড করে দেবতারা আকাশগঙ্গায় নিয়ে যান। [৪০-৪৬। অষ্টাদশোহধ্যায়, কালিকাপুরাণ]

দেহত্যাগের পর সতী এর পত্নী হওয়ার কামনায় হিমালয়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। এরপর যথাসময়ে ইনি হিমালয়ের ঔরসে মহাদেব- মেনকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেন। হিমালয় পর্বতের কন্যা বলে ইনি পার্বতী নামে অভিহিত হন। অচলের (পর্বতের) কন্যা বলেই তাঁর অপর নাম অচলকন্যা। একই অর্থে এঁর অপরাপর নাম– অগত্মাজা, অচলনন্দিনী, অদ্রিজা, অদ্রিতনয়া, অদ্রিনন্দিনী।

পূর্বজন্মে তিনি দক্ষের কন্যা ছিলেনন। তখন তাঁর নাম ছিল সতী এবং তাঁর স্বামী ছিলেন শিব বা মহাদেবএই জন্মে ইনি মহাদেবকে স্বামী হিসাবে পাওয়ার জন্য তপস্যা শুরু করেন। তপস্যার জন্য এই সময় মহাদেব হিমালয়ে এলে, পার্বতী মহাদেবের পূজা আরম্ভ করেন। মহাদেব এই সময় ধ্যানে এতটাই মগ্ন ছিলেন যে, পার্বতীর এই পূজাকে উপলদ্ধি করতে পারলেন না। এদিকে তারকাসুর দেবতা ও মানবকুলের উপর অত্যাচার শুরু করলে, সকলে মিলে এর প্রতিকারের জন্য ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা তাদের জানলেন যে, একমাত্র মহাদেবের পুত্র এই অসুরকে হত্যা করতে পারবেন। সে কারণে, মহাদেবের সাথে পার্বতীর বিবাহ হওয়া প্রয়োজন। ব্রহ্মার ভবিষ্যৎ-বাণী অনুসারে দেবতারা মহাদেবের ধ্যানভঙ্গের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন এবং প্রেমের দেবতা মদনদেবকে [কামদেব] মহাদেবের কাছে পাঠালেন। কামদেব কামবাণ নিক্ষেপ করে মহাদেবের ধ্যান ভঙ্গ করলেে, মহাদেবের তৃতীয় নয়নের তেজ দ্বারা ইনি ভষ্মীভূত হন। এরপর মহাদেব আরাধনার জন্য অনত্র্য চলে যান। এরপর গভীর দুঃখে পার্বতী কাতর হয়ে পড়লে নারদ এসে পার্বতীকে জানালেন যে, তপস্যার দ্বারা মহাদেবের পূজা করলেই ইনি তাঁকে লাভ করবেন। 

এরপর মহাদেবকে স্বামী হিসাবে পাওয়ার জন্য ইনি কঠোর তপস্যা শুরু করেন। গ্রীষ্মের কঠোর উত্তাপ ও শীতকালের প্রচণ্ড শীতকে বরণ করে আত্মপীড়নের মধ্যে এই সাধনা অব্যাহত রাখেন। তপস্যাকালে ইনি খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেন। একসময় তিনি শুধুমাত্র গাছের পাতা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করতে থাকেন। এই কারণে, পার্বতী একপর্ণিকা নামে অভিহিত হন। এরপরও পার্বতী মহাদেবকে স্বামী হিসাবে পেলেন না। এরপর ইনি গলিতপত্র পর্যন্ত গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত করলেন। তখন ইনি অপর্ণা নামে পরিচিতি লাভ করেন। এই কঠোর তপস্যা দেখে তাঁর মা মেনকা বলেছিলেন- উ (হে পার্বতী) মা (না, তপস্যা কোরো না)। সেই থেকে ইনি উমা নামে পরিচিত হন।

পরে তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে পার্বতীর কাছে উপস্থিত হয়ে ভিক্ষা প্রার্থনা করেন। পার্বতী বৃদ্ধকে স্নান করে এসে আহার গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। বৃদ্ধবেশী মহাদেব গঙ্গায় স্নান করতে গেলে একটি মকর (পৌরাণিক মৎস্য বা কুমির) আক্রমণ করে। বৃদ্ধ উমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে– পার্বতী বৃদ্ধকে রক্ষা করার জন্য অগ্রসর হন। এই সময় মহাদেব তাঁর স্বমূর্তি ধারণ করে পার্বতীর হাত ধরেন। পার্বতী বিষয়টি তাঁর পিতা হিমালয়কে জানালে– হিমালয় পার্বতীকে মহাদেবের হাতে সমর্পণ করেন। তপস্যার দ্বারা ইনি মহাদেবকে প্রসন্ন করেন বলে– এঁর অপর নাম গৌরী।

বিবাহের পর এঁরা হিমালয়ের কৈলাশ, মন্দর প্রভৃতি পর্বতে আমোদ-প্রমোদে রত ছিলেন। একবার অন্ধক নামক অসুর এখানে উপস্থিত হলে– মহাদেব শূলের আঘাতে অন্ধককে হত্যা করেন। মহাদেবের তৃতীয় নয়নের উৎপত্তি নিয়ে একটি গল্প আছে। পার্বতী একবার পরিহাস ছলে শিবের দুই চোখ হাত দিয়ে আবৃত করলে– সমগ্র চরাচর অন্ধকার হয়ে যায়। জগতকে আলোকিত করার জন্য তাঁর তৃতীয় নয়নের উদ্ভব ঘটে। এই তৃতীয় নয়নের জ্যোতিতে হিমালয় ধ্বংস হয়ে গেলে– পার্বতীর অনুরোধে তা আবার পুনস্থাপিত হয়। তবে এটি প্রক্ষিপ্ত কাহিনী বলেই মনে হয়। কারণ– পার্বতীর সাথে শিবের বিবাহের পূর্বেই তাঁর তৃতীয় নয়নের তেজে কামদেব ভস্মীভূত হন।

কালিকা পুরাণ মতে– দুন্দুভি নামক জনৈক দৈতরাজ, ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে– দেবতাদের পরাজিত করেছিলেন। কৈলাসে মহাদেব ও পার্বতীকে [দুর্গা] একত্রে ভ্রমণ করার সময় পার্বতীকে দেখে মোহিত হন, এবং তাঁকে অধিকার করার চেষ্টা করলে- মহাদেবের অগ্নিদৃষ্টিতে ইনি ভস্মীভূত করেন। [চতুর্থোহধ্যায়, কালিকাপুরাণ]

দুর্গাপূজা
দুর্গা বৈদিক দেবী নয়, তা বৈদিক যুগে দুর্গা পূজা ছিল না। বৈদিক যুগে ঋতুভিত্তিক যজ্ঞ ছিল। ধারণা করা হয়, শরৎ বা বসন্তের প্রারম্ভে যে যজ্ঞ ছিল, তাই পৌরাণিক কালে দেবী দুর্গার পূজা হিসেবে প্রচলিত হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৩০০ অব্দের ভিতরে রচিত রামায়ণের সূত্রে জানা যায়, রাবণবধের জন্য দুর্গাপূজা করেছিলেন। দুর্গাপূজার শুরুর দিকে পূজার সময় ছিল বসন্তকাল। বনবাসকালে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয় কামনায় রামচন্দ্র শরৎকালে দেবীকে পূজা করে অকালে জাগ্রত করেন। দুর্গার অকালবোধন সূত্রে সেই থেকে শরৎকালে দুর্গা পূজা শুরু হয়।

খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দের দিকে রচিত মার্কণ্ডেয় পুরাণে পাওয়া যায়- রাজ্য হারিয়ে রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি, মেধস মুনির উপদেশে দেবীর মৃণ্ময়ী মূর্তি তৈরি করে পূজা করেছিলেন।

মহিষাসুরমর্দিনী রূপে দুর্গাপূজার প্রথম উল্লেখ আছে ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ’। এছাড়া বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণ, কালিকাপুরাণ বৃহদ্ধর্মপুরাণে দুর্গাপূজার বিবরণ পাওয়া যায়। নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে একাধিক মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি বাংলার নানা স্থানে পাওয়াও গিয়েছে। এ থেকে ধারণা করা যায়, পৌরাণিক যুগেই বঙ্গদেশে বর্তমান দুর্গাপূজার আদিরূপের উদ্ভব হয়েছিল। একাদশ শতকের ভবদেব ভট্ট কয়েকজন আরও প্রাচীন স্মৃতিকারের নাম উল্লেখ করে মৃন্ময়ী মূর্তিতে দুর্গাপূজার বিধান দিয়েছিলেন।

বঙ্গদেশে দুর্গাপূজা হয়েছিল বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরে। তবে সে সময়ের শুধু দুর্গা পূজিতা হয়েছেন রাজরাজেশ্বরী দেবী হিসেবে। উল্লেখ্য, সে সময়ে প্রদ্যুম্ননগরে ছিল মল্লভূমের রাজধানী এবং রাজবংশের কুলদেবী ছিলেন দেবী রাজরাজেশ্বরী। রাজা জগৎমল্ল ছিলেন এই বংশের ১৯তম রাজা। তাঁর রাজত্বকাল ৯৯৪ থেকে ১০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে। লোকশ্রুতি আছে একদিন রাজা নির্জনে থাকার সময় দেখেন যে একটি সারস তাঁর পোষ্য কুকুরকে বারবার আক্রমণ করছে। এরপর তিনি দেখেন যে মৃন্ময়ী রূপে দেবী এসে তাঁকে রাজধানী বিষ্ণুপুরে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। সেই নির্দেশ মেনে তিনি জঙ্গল সাফ করে প্রদ্যুম্ননগর থেকে রাজধানী বিষ্ণুপুরে সরিয়ে আনেন এবং মৃন্ময়ী দেবীর মূর্তি পূজা শুরু করেন। এই বাড়িতে একটি একচালা ঘরে প্রথম মৃন্ময়ী  মূর্তির পূজা শুরু হয়। এই পূজায় মল্ল-রানির নির্দেশে মূর্তিতে লক্ষ্মী-গণেশ ও কার্তিক-সরস্বতী স্থানবদল হয়। লক্ষ্মীর স্থলে গণেশ ও গণেশের স্থলে লক্ষ্মী এবং কার্তিকের স্থলে সরস্বতী ও সরস্বতীর স্থলে কার্তিক আসে। কথিত আছে পরিবারে নারীদের সর্বোচ্চ স্থান দেওয়ার উদ্দেশ্যে রানি এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই কারণে লক্ষ্মী ও সরস্বতী উপরে এবং এঁদের পায়ের কাছে কার্তিক ও গণেশ স্থান পায়। মূর্তি স্থাপনের এই রীতিকে বলা হয় বিষ্ণুপুরী ঘরানা বা জগৎমল্ল-প্রথা।

এরপর চতুর্দশ শতাব্দীর বিদ্যাপতির ‘দুর্গাভক্তি-তরঙ্গিণী’ গ্রন্থে এবং শূলপাণির ‘দুর্গোৎসব-বিবেক’ গ্রন্থে দুর্গাপূজা পদ্ধতির উল্লেখ আছে। রঘুনন্দনের (১৫৪০-১৫৭৫) ‘দুর্গাপূজা তত্ত্ব’ গ্রন্থে এই বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।  রঘুনন্দনমূলত এই বিধান দিয়েছিলেন পূর্বে রচিত পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্র অনুসরণে। এই সময় তিনি পৌরাণিক বিধির বাইরে দেশাচার বা কুলাচার হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত বঙ্গদেশে দূর্গাপূজার যে আদি-সময় হিসেবে জানা যায়, তা হলো- কোন্নগরে ঘোষাল বংশের আশুতোষ ঘোষালের দুর্গাপূজার কথা। উল্লেখ্য, কনৌজ-এর পাঁচ কুলীন ব্রাহ্মণের এক ব্রাহ্মণ সুধানিধির বংশকে ‘ঘোষাল’ উপাধি প্রদান করেছিলেন লক্ষণ সেন। পরে আকবরের আমলে এঁরা জমিদারি লাভ করেছিলেন। এই ঘোষাল বংশের আশুতোষ ঘোষাল কোন্নগরে আসেন ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দে। আর ঘোষাল বংশের পারিবারিক নথি থেকে জানা যায়, কোন্নগরের বাড়িতে দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল ১৪৫৪ খ্রিষ্টাব্দে। এরপর বাংলায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার সোনারপুরের কাছে মালঞ্চ গ্রামের জনৈক চামু (বাগচী) ব্রহ্মচারী ১৪৯১ খ্রিষ্টাব্দে দুর্গাপূজা করে ছিলেন। এর কাছাকাছি সময় শ্রীচৈতন্যের (১৪৮৬ -১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) প্রধান শিষ্য নিত্যানন্দ খড়দহে স্বগৃহে প্রতিমায় দুর্গোৎসব করেছিলেন।

১৫০৭ খ্রিষ্টাব্দে চন্দননগরের খলিসানির বসু বাড়িতে দুর্গাপূজার প্রবর্তন করে করুণাময় বসু। এরপর দেখা যায়, ১৫২২ খ্রিষ্টাব্দের শরৎকালে চন্দননগরের কমললোচন বসুর বাড়িতে দুর্গাপূজা হয়েছিল। ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে হাওড়া আমতার রসপুরের যশচন্দ্র রায় বাড়িতে দুর্গাপূজা জা হয়েছিল বলে জানা যায়।

এরপর বড় করে দুর্গাপূজা করে খ্যাতি লাভ করেন নদীয়ার তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ । উল্লেখ্য, সম্রাট আকবর কংসনারায়ণকে 'রাজা' খেতাব এবং একই সাথে সুবে বাংলার দেওয়ানের পদ প্রদান করেন। কংসনারায়ণ সম্রাটের উপহার ও খেতাব গ্রহণ করলেও, সুবে বাংলার দেওয়ানের পদ প্রত্যাখ্যান করলেন সবিনয়ে। অবশ্য গৌড়ের মহামারীতে মুনেম খাঁর মৃত্যু হইলে, তিনি অস্থায়ীভাবে কিছুকাল সুবেদারী করিয়া গৌড়েশ্বর হইয়াছিলেন। পরে তিনি কেবলমাত্র বঙ্গের দেওয়ান ছিলেন।

বাংলা-বিহারের দেওয়ানের পদ দান করেছিলেন।  বৃদ্ধবয়সে কংসনারায়ণ দেওয়ানি ছেড়ে বর্তমান এখন রাজশাহীর তাহেরপুরে বসবাস শুরু করেন। সে সময় দেওয়ানকে স্থানীয়রা ‘রাজা’ বলতো। এই সময় তিনি মহাযজ্ঞ করার সিদ্ধান্ত নেন। বংশানুক্রমিক পুরোহিত নাটোর বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্য বংশের পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী তাঁকে বলেন, চারটি মহাযজ্ঞের বিশ্বজিত ও রাজসূয় যজ্ঞের অধিকারী শুধু সম্রাটরা। কিন্তু কংসনারায়ণের বংশ ছিল পশুবলি-বিরোধী। তাই অশ্বমেধ বা গোমেধ যজ্ঞ বাদ পড়ে যায়। এর বিকল্প হিসেবে তিনি দুর্গাপূজা'র বিধান দেন। ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে এই পূজা সম্পন্ন হয়েছিল।

কংস নারায়ণের পরে বাংলাদেশের হরিপুরের পাবনাতে এই পুজোর সূচনা করেন কংসনারায়ণের ছেলে মুকুন্দরাম রায়। সেই সময় হুসেন শাহের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরে রাজা শ্রীহট্ট সেনের বাড়িতে বিগ্রহ নিয়ে টাঙ্গাইলে আসেন মুকুন্দরাম। এবং রাজচক্রবর্তী উপাধি নিয়ে বসত শুরু করেন। কেবলমাত্র এই বিগ্রহটি বাঁচানোর জন্য তিনি তার উপাধি পরিবর্তন করেন। মুকুন্দরাম রায় থেকে চক্রবর্তী হন। তার পরে প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়িয়ে ফের যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এবং যুদ্ধে জয়ীও হন ।ঐতিহাসিক এই দুর্গামূর্তিতে লক্ষ্মী-সরস্বতী নেই। আছেন কার্তিক ও গণেশ। নিত্যপুজোয় ৯ রকমের ভাজা দিয়ে ভোগ দেওয়া হয় মাকে। দুর্গাপুজোর সময় অষ্টধাতুর মূর্তির পাশে মৃণ্ময়ী মূর্তি পূজিতা হন।

দুর্গার সকল রূপের নাম-তালিকা:
অগসূতা, অগাত্মজা, অতসীপুষ্পবর্ণাভা, অদ্রিজা, অদ্রিতনয়া, অনন্তা, অনাদ্যা, অন্নদা, অন্নপূর্ণা, অপরাজিতা, অপর্ণা, অব্যয়া, অভয়া, অমোঘা, অম্বা, অম্বালা, অম্বালিকা, অক্বিকা, অষ্টভুজা, অসুরনাশিনী, আদিদেবী, আদিভুতা, আদ্যা, আদ্যাশক্তি, আনন্দময়ী, আর্যা, ঈশানী, ঈশ্বরী, উমা, কপর্দিনী, কাত্যায়নী, কাণ্ডবারিণী, কামাক্ষী, কৈলাশবাসিনী, কৌশিকী, ঈশানী, গিরিকুমারী, গিরিজা, গিরিনন্দিনী, গিরিবালা, চণ্ডবতী, জগদক্বা, জগদ্ধাত্রী, জগন্ময়ী, জগন্মাতা, জয়ন্তী, জয়া, গিরিসূতা, গৌতমী, গৌরী, চণ্ডী, চামুণ্ডা, জগজ্জননী, জগদ্গৌরী, জ্বালমালিনী, তারিণী, ত্রিগুণা, ত্রিনয়না, ত্রিনয়নী ত্রিশূলধারিণী, ত্রিশূলিনী, দক্ষকন্যা, দক্ষজা, দশভুজা, দাক্ষায়ণী, দনুজদলনী, দানবদলনী, দুর্গা, নগনন্দিনী, নন্দা, নিস্তারিণী, পরমাপ্রকৃতি, পরমেশ্বরী, পর্বতদুহিতা, পর্বতসূতা, পার্বতী, প্রকৃতি, বভ্রবী, বাভ্রবী, বাসন্তী, বিজয়া, বিন্ধ্যবাসিনী, বিশ্বেশ্বরী, ভগবতী, ভদ্রকালী, ভদ্রাণী, ভবতারিণী, ভাস্বতী, মঙ্গলা, মহাদেবী, মহাবিদ্যা, মহামায়া, মহাশক্তি, মঙ্গলচণ্ডী, মহিষাসুরমর্দিনী, মহেশানী, মহেশী, মোক্ষদা, যোগমায়া, রাজরাজেশ্বরী, রুদ্রাণী, সতী, সর্বজ্ঞা, সাবিত্রী, শঙ্করী, শরণ্যা, শর্বাণী, শাকক্ভরী, শারদা, শিবপত্নী, শিবপ্রিয়া, শিবা, শিবানী, শুভঙ্করী, শুভচণ্ডী, শূলিনী, শৈলজা, শৈলসূতা, শৈলেয়ী, সনাতনী, সর্বজয়া, সর্বমঙ্গলা, সর্বাণী, সর্বার্থসাধিকা, সাত্তি্বকী, সিংহবাহিনী, সুরেশ্বরী, হিমালয়নন্দিনী, হৈমবতী।

দুর্গার দশ মহাবিদ্যা:
সূত্র: