মহালয়া: মহালয়ার সূচনা হয় পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে। মহালয়াতে তিথিতে পিতৃ-মাতৃহীন সন্তানেরা তাঁদের পূর্বপুরুষের স্মরণ করে, পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মারা পৃথিবীতে নেমে আসেন, প্রয়াত আত্মা যে সমাবেশ হয় বলে এর নাম মহালয়। এই মহালয় থেকে মহালয়া। মহালয়াতে গঙ্গায় অঞ্জলি প্রদান করা হয় পূর্বপুরুষের আত্মারবং জগতের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা ও জল ও তিল দিয়ে অঞ্জলি প্রদান করেন । প্রয়াত আত্মাদের শান্তি কামনায় নিবেদিত অনুষ্ঠানকে তর্পণ বলা হয়।
মহাপঞ্চমী: মহালয়ার পরে পঞ্চম তিথির সন্ধ্যায় দুর্গা দেবীর আগমনী মন্ত্র উচ্চারিত হয়। এই অনুষ্ঠানের করণীয় বিষয়গুলো হলো-
- চক্ষুদান: দেবীর মূর্তিতে চোখ আঁকা হয়। পৌরাণিক মতে- এই দিনে, দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করার জন্য মর্ত্যে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। মূলত দেবীর বোধন হয় মহাপঞ্চমীতে।
- চণ্ডীপ-পাঠ: চণ্ডী পাঠের মাধ্যমে দেবী দুর্গা মহিমা পাঠ করা হয়।
একে বলা হয় মহাপঞ্চমী। তবে
মহাষষ্ঠী: দেবীপক্ষের ষষ্ঠ দিন। মহাষষ্ঠীতে দেবীকে পূজামণ্ডপে স্থাপন করা হয়। দেবীর চক্ষু দানের পর, আনুষ্ঠানিক বোধন হয় মহাষষ্ঠীতে। মূলত বোধন হলো জাগ্রত করা। তাই দেবী - বোধন এর অর্থ হলো- দেবীকে জাগিয়ে তোলা। আর এক অর্থে একে অকালবোধন বলা হয়। হিন্দু শাস্ত্র মতে সূর্যের উত্তরায়ন দেবতাদের সকাল। উত্তরায়নের ছয় মাসকে দেবতাদের এক দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। সকালে সমস্ত দেব-দেবীর পুজো করা হয়। আবার দক্ষিণায়ন শুরু হলে ছয় মাসের জন্য নিদ্রা যান সমস্ত দেব-দেবী। এই দক্ষিণায়ন হলো দেবতাদের রাত। রাতে দেব-দেবীর পুজো করা হয় না। কিন্তু দক্ষিণায়নের ছয় মাসের মধ্যেই দুর্গাপুজো হয় বলে বোধনের মাধ্যমে আগে দেবী দুর্গাকে ঘুম থেকে তোলা হয়। পুরাণে এর সঙ্গে একটি কাহিনিও জড়িত। রাবণের সঙ্গে যুদ্ধের আগে দুর্গার বোধন করেছিলেন দশরথ পুত্র রামচন্দ্র রামচন্দ্র। এর পর দুর্গার আরাধনা করে শক্তি ও সৌভাগ্যের প্রার্থনা করেন তিনি। অকালে দুর্গাকে জাগিয়ে তোলা হয়েছিল বলেই একে অকাল বোধন বলা হয়ে থাকে।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী এ দিনই স্বর্গ থেকে মর্তে পদার্পণ করেন দেবী দুর্গা। সঙ্গে থাকেন তাঁর চার সন্তান লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী। পূজামণ্ডপে চারসন্তান-সহ দেবীমূর্তি স্থাপনের পর- মহাষ্ঠীতে পালনীয় আচার হলো- কল্পারম্ভ, বোধন, অধিবাস এবং আমন্ত্রণ।কল্পারম্ভ শুরু হয় ষষ্ঠীর সকালে । এই সময় দশভূজার সামনে প্রার্থনা করা হয় , যেন ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত গোটা পূজা পর্বে কোন বিঘ্ন না ঘটে। এরপর ঘট ও জলে পূর্ণ একটি তামার পাত্র মণ্ডপের কোণে স্থাপন করা হয়। কল্পারম্ভে ব্যবহার করা হয় -ষোড়শ উপাচার। এগুলো হলো-আসন, স্বাগত, পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, স্থানীয়, বসন, ভূষণ, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, মধুপর্ক, তাম্বুল, তর্পণ ও নতি। মতান্তরে- আসন, স্বাগত, পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, মধুপর্ক, পুনরাচমনীয়, স্নান, বসন, আভরণ, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য ও চন্দন (দ্রঃ- শক্তিপূজায়- আসন ও স্বাগত স্থলে নৈবেদ্য ও পুনরাচমনীয় এবং মধু স্থলে মদ্য)।
বেলগাছের তলে ঘট -পূজার মাধ্যমে দেবীকে আহ্বান করে হয়। একে সাধারণত ষষ্ঠী পূজা বলা হয়। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেব ঘটে অবস্থান নে ন । পরে সেই ঘট, বেলপাতা, ডালসহ নবপত্রিকা মূল মন্দিরে স্থাপন করা হ য় ।
সন্ধ্যায় দুর্গার মুখের আবরণ উন্মোচন করা হয় । এটি হলো দেবীর আনুষ্ঠানিক বোধন । ধারণ করা হয় , বোধনের মধ্য দিয়ে প্রতিমার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়। বোধনের পর বিল্ব শাখার দেবীকে আহ্বান জানানো হয়। অশুভ শক্তি দূরের জন্য ঘটের চারপাশে তীরকাঠিতে সুতো জড়িয়ে আমন্ত্রণ প্রক্রিয়া শুর হয়।
এরপর শুরু হয় অধিবাস। দুর্গামূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশটি উপকরণের প্রয়োজন হয়- এগুলো হল- মাটি (নিষিদ্ধ পল্লীর), চন্দন্, ধূপাদি গন্ধদ্রব্য, শিলা, ধান, দুর্বা, ফুল, ফল দই, ঘি, স্বতিকচিহ্ন (চালের গুঙড়ি দিয়ে তৈরি), সিঁদুর, শঙ্খ, কাজল, গোরচনা, সাদ সরষে, সোনা, রূপা, তামা, দীপ এবং দর্পণ।
মহা সপ্তমী : এই দিনে সকালে চক্ষুদানের মধ্য দিয়ে ত্রিনয়নী দেবীর প্রতিমায় ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’হয় ।
দেবী দুর্গার সবচেয়ে ভয়ানক কালরাত্রি রূপের পুজো করা হয়। অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা করেন দেবী কালরাত্রি। দেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন করা হয়।
দিনব্যাপী চণ্ডী ও মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে পূজা, দেবী-দর্শন, দেবীর পায়ে ভক্তদের অঞ্জলি দেওয়া, প্রসাদ গ্রহণের মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠানিকতা চলে।
মহা অষ্টমী: এই দিনের পূজা দুর্গাষ্টমী নামে পরিচিত। এই রূপের নাম মহাগৌরী। এই রূপটি শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে মান্য করা হয়। কোনো কোনো অঞ্চলের সনাতন ধর্মীদের মতে- দেবী চামুণ্ডা এই দিনে দুর্গার কপাল থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং চণ্ড ও মুণ্ড এবং রক্তবীজ (মহিষাসুরের সহযোগী অসুর)কে বিনাশ করেছিলেন।
মহাষ্টমীতে দুর্গাপূজার সময় ৬৪ জন যোগিনী ও মাতৃকার (দুর্গার রূপ) পূজা করা হয়। এই দিনে বিশেষভাবে অষ্টশক্তির পূজা করা হয়। এই অষ্টশক্তি হলেন- ব্রাহ্মণী, মহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বরাহী, নরসিংহী, ইন্দ্রাণী এবং চামুণ্ডা।
মহাষ্টমীর পূজা শেষে কুমারী পূজা করা হয়। এই পূজায় আদ্যঋতু দর্শন করেন নাই এমন কন্যাকে পূজা করা হয়।সন্ধিপূজা: অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমীর সূচনার প্রথম ২৪ মিনিট জুড়ে সন্ধিপূজা হয়। অষ্টম ও নবম তিথির সন্ধিকালে এই পূজা হয়ে থাকে। তাই একে সন্ধি পূজা বলা হয়।
মহা নবমী:
এদিন ১০৮টি মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে ও ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে পূজা হবে দেবীদুর্গার। এছাড়া এছাড়া নীলকণ্ঠ, নীল অপরাজিতা ফুল ও যজ্ঞের মাধ্যমে মহানবমীর পূজা সম্পন্ন করা হয়।
কালিকাপুরাণে বলা হয়েছে,
নবম্যাং বলিদান্তু কর্ত্তব্যং বৈ যথাবিধি।
জপং হোমঞ্চ বিধিবৎ কুর্য্যাত্তত্র বিভূতয়ে॥
অর্থাৎ বিভূতি লাভের জন্য নবমী তিথিতে যথাবিধি বলিদান করা কর্তব্য। তার সঙ্গে জপ ও হোম করা হয়। এক্ষেত্রে জপ বলতে চণ্ডিপাঠ এবং চণ্ডিজপ বোঝায়। দুর্গাপূজার ষষ্ঠাদি কল্প অনুসারে, নবমীতে দুর্গাপূজার সম্পত ঘটে
দশমী: দশমী পুজা শুধুমাত্র দেবী বিদায়ের আচরিত সংক্ষিপ্ত পুজা অনুষ্ঠান হয়। এবং দিন শেষে দেবীমূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয়।