দুর্গাপূজা
সনাতন হিন্দু ধর্মে দুর্গা দেবীর পূজার আনুষ্ঠানিক  রূপকে দুর্গাপূজা বলা হয়।

ভারতের আদি আর্য-অনার্যদের মধ্যে প্রচলিত মাতৃদেবীর পূজার রূপান্তরের একটি বিশেষ অধ্যায় হলো- দুর্গাপূজা। আদি নেগ্রিটো ও প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের আদি মাতৃদেবী সিন্ধু সভ্যতায় নানা রূপ লাভ করেছিল। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী এ সবই আদি মাতৃদেবীর রূপান্তর মাত্র।

দুর্গা  বৈদিক দেবী নয়, তা ই বৈদিক যুগে দুর্গাপূজা ছিল না। বৈদিক যুগে ঋতুভিত্তিক যজ্ঞ ছিল। ধারণা করা হয়, শরৎ বা বসন্তের প্রারম্ভে যে যজ্ঞ ছিল, তাই পৌরাণিক কালে দেবী দুর্গার পূজা হিসেবে প্রচলিত হয়েছিল। দুর্গা পূজার প্রশস্ত সময় বসন্তকালের চৈত্রমাসে। একে বাসন্তী পূজা বলা হয়। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে- তখন ছিল সূর্যের দক্ষিণায়ন। এই সময় দেবতারা সব ঘুমিয়ে থাকেন। রামচন্দ্র দুরগাকে অসময়ে অর্থাৎ ঘুমন্ত দুর্গাকে জাগরিত করেছিলেন। এই অর্থেও একে দুর্গার অকালবোধন বলা হয়।

খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দের দিকে রচিত বাল্মীকি রামায়ণে দুর্গাপূজার কথা জানা যায় না। খ্রিষ্টীয় একাদশ শতাব্দী ভবদেব ভট্টের মাটির মূর্তিতে দুর্গাপূজার বিধান পাওয়া যায়। জীমূতবাহনের (আনুমানিক ১০৫০-১১৫০) দুর্গোৎসবনির্ণয়, বিদ্যাপতির (১৩৭৪-১৪৬০) দুর্গা ভক্তি-তরঙ্গিণী, শূলপাণির (১৩৭৫-১৪৬০) দুর্গোৎসব-বিবেক।

বাল্মীকি রামায়ণের কৃত্তিবাস যে ভাবানুবাদ করেছিলেন। এতে পাওয়া যায়- রাবণ বধের জন্য রামচন্দ্র দুর্গাপূজা করেছিলেন শরৎকালে। তিনি বাল্লীকি রামায়ণের অনেক পরে রচিত 'কালিকা পুরাণ'-এর কাহিনি অনুসরণ করেছেন। কালিকা পুরাণের ৬০তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে- রাবণ বধের জন্য, ব্রহ্মা  রামকে দিয়ে দুর্গার বোধন (জাগ্রত) করিয়েছিলেন। কিন্তু রামচন্দ্র দুর্গার   বোধন করেছিলেন  শরৎকালে। তাই দুর্গা র এই বোধনকে   অকালবোধন বলা হয় । এই বোধন ঘটেছিল ত্রেতাযুগে কৃত্তিবাসের ভাবানুবাদে লঙ্কাকাণ্ডের 'শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গোৎসব' অংশে দুর্গাপূজার বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। কালক্রমে বঙ্গদেশে বাল্মীকি রামায়ণে র পরিবর্তে  কৃত্তিবাসের ভাবানুবাদটাই ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বাঙালি হিন্দুদের কাছে গ্রহণযোগ্য ঊঠেছিল।

কৃত্তিবাসের রামায়ণ থেকে জানা যায় রাবণ মহাদেবকে তুষ্ট করে বরলাভ করে ছিলেন । দেবী দুর্গা ও তাঁর আরাধনায় তুষ্ট ছিলেন । যুদ্ধক্ষেত্রে মহাকালী স্বয়ং রাবণকে নিজের কোলে স্থান দ িয়েছিলেন । তাই রাবণের বিরুদ্ধে রামের জয় লাভের বিষয়ে দেবতারাও সন্ধিহান হয়ে উঠেছিল। তাই দেবতারা প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণ নি য়েছিলেন ।  পরে ব্রহ্মার পরামর্শে রাম দেবীর অকালবোধন করেছিলেন।

খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর দিকে রচিত মার্কণ্ডেয় পুরাণে পাওয়া যায়- প্রাচীন বঙ্গ রাজ্যের চন্দ্রবংশীয় রাজা সুরথ রাজ্য হারিয়ে তাঁর রাজ্যের রাজধানী বলিপুর ত্যাগ করেন। পথে তাঁর সাথে সর্বস্ব হারানো বণিক সমাধি বৈশ্যের সাথে দেখা হয়। পরে এঁদের সাথে মেধস মুনির দেখা হয়। মুনি এঁদের সব কথা শুনে দুর্গাপূজার পরামর্শ দেন। এরপর এঁরা মুনির পরামর্শ অনুসারে  অম্বিকারূপিণী দুর্গা দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি তৈরি করে পূজা করেছিলেন। তবে তাঁরা বসন্তকালে পূজা করেছিলেন। এই কারণে এই পূজাকে বলা হয় বাসন্তী পূজা।  এই পূজার পরে সুরথ ও সমাধি বৈশ্য তাঁদের হৃত গৌরব ফিরে পান। রাজা সুরথ রাজধানী ফিরে এসে বসন্তকালে দুর্গাপূজা করেছিলেন।

মহিষাসুরমর্দিনী রূপে দুর্গাপূজার প্রথম উল্লেখ আছে ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ’। এছাড়া বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণ, কালিকাপুরাণ বৃহদ্ধর্মপুরাণে দুর্গাপূজার বিবরণ পাওয়া যায়। নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে একাধিক মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি বাংলার নানা স্থানে পাওয়াও গিয়েছে। এ থেকে ধারণা করা যায়, পৌরাণিক যুগেই বঙ্গদেশে বর্তমান দুর্গাপূজার আদিরূপের উদ্ভব হয়েছিল। একাদশ শতকের ভবদেব ভট্ট আরও কয়েকজন  প্রাচীন স্মৃতিকারের নাম উল্লেখ করে মৃন্ময়ী মূর্তিতে দুর্গাপূজার বিধান দিয়েছিলেন।

বঙ্গদেশে দুর্গাপূজার সূত্রপাত হয়েছিল বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরে। সে সময়ে মল্লরাজ শ্রীমন্ত জগৎমল্ল দেব বন-বিষ্ণুপুরে।  কথিত আছে সে সময়ে প্রদ্যুম্ননগরে ছিল মল্লভূমের রাজধানী এবং রাজবংশের কুলদেবী ছিলেন দেবী রাজরাজেশ্বরী। রাজা জগৎমল্ল ছিলেন এই বংশের ১৯তম রাজা। তাঁর রাজত্বকাল ৯৯৪ থেকে ১০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে। লোকশ্রুতি আছে একদিন রাজা নির্জনে থাকার সময় দেখেন যে একটি সারস তাঁর পোষ্য কুকুরকে বারবার আক্রমণ করছে। এরপর তিনি দেখেন যে মৃন্ময়ী রূপে দেবী এসে তাঁকে রাজধানী বিষ্ণুপুরে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। সেই নির্দেশ মেনে তিনি জঙ্গল সাফ করে প্রদ্যুম্ননগর থেকে রাজধানী বিষ্ণুপুরে সরিয়ে আনেন এবং মৃন্ময়ী দেবীর মূর্তি পূজা শুরু করেন। এই বাড়িতে একটি একচালা ঘরে প্রথম মৃন্ময়ী  মূর্তির পূজা শুরু হয়। এই পূজায় মল্ল-রানির নির্দেশে মূর্তিতে লক্ষ্মী-গণেশ ও কার্তিক-সরস্বতী স্থানবদল হয়। লক্ষ্মীর স্থলে গণেশ ও গণেশের স্থলে লক্ষ্মী এবং কার্তিকের স্থলে সরস্বতী ও সরস্বতীর স্থলে কার্তিক আসে। কথিত আছে পরিবারে নারীদের সর্বোচ্চ স্থান দেওয়ার উদ্দেশ্যে রানি এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই কারণে লক্ষ্মী ও সরস্বতী উপরে এবং এঁদের পায়ের কাছে কার্তিক ও গণেশ স্থান পায়। মূর্তি স্থাপনের এই রীতিকে বলা হয় বিষ্ণুপুরী ঘরানা বা জগৎমল্ল-প্রথা।

চতুর্দশ শতাব্দীর বিদ্যাপতির ‘দুর্গাভক্তি-তরঙ্গিণী’ গ্রন্থে এবং শূলপাণির ‘দুর্গোৎসব-বিবেক’ গ্রন্থে দুর্গাপূজা যে পদ্ধতির উল্লেখ আছে, সেই পদ্ধতি অনুসরণে এখানে পূজো হতো। এই মতে- পুজোর বোধন শুরু হতো চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে। মহানবমীর ১৫ দিন দেবীর চামুণ্ডা মূর্তির রূপ ও রঙ আজও একই রকম আছে । প্রাচীন রীতি অনুসারে দেবীর মুখমণ্ডল পানপাতার মত। টানা ত্রিনয়ন, গায়ের রঙ অতসী ফুলের মতন বা শিউলির বোটার রং। গণেশের রঙ লাল এবং  রাজপুত্র বেশে কার্তিক। চালচিত্র তিনভাগে বিভক্ত। তাতে দশমহাবিদ্যার ছবি আঁকা থাকে, দেবীর দুপাশে থাকেন শিব ও রাম। মূল আটচালা বাড়ি ছাড়া বড় বাড়ি, মেজ বাড়ি, মাঝের বাড়ি, বেনাকী বাড়ী, কালীকিংকর বাড়ি, বিরাটি ও নিমতা-পাঠানপুর বাড়ি-সহ মোট আটটি পূজো এই রীতিতে এখনও প্রচলিত রয়েছে।

রঘুনন্দনের (১৫৪০-১৫৭৫) ‘দুর্গাপূজা তত্ত্ব’ গ্রন্থে এই বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।  রঘুনন্দনমূলত এই বিধান দিয়েছিলেন পূর্বে রচিত পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্র অনুসরণে। এই সময় তিনি পৌরাণিক বিধির বাইরে দেশাচার বা কুলাচার হিসেবে কিছু বিষয় গ্রহণ করেছিলেন গ্রহণ করেছিলেন।

বঙ্গদেশে দূর্গাপূজার ক্রমবিকাশের ধারায় পাওয়া যায়- কোন্নগরে ঘোষাল বংশের আশুতোষ ঘোষালের দুর্গাপূজার কথা। উল্লেখ্য, কনৌজ-এর পাঁচ কুলীন ব্রাহ্মণের এক ব্রাহ্মণ সুধানিধির বংশকে ‘ঘোষাল’ উপাধি প্রদান করেছিলেন লক্ষণ সেন। পরে আকবরের আমলে এঁরা জমিদারি লাভ করেছিলেন। এই ঘোষাল বংশের আশুতোষ ঘোষাল কোন্নগরে আসেন ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দে। আর ঘোষাল বংশের পারিবারিক নথি থেকে জানা যায়, কোন্নগরের বাড়িতে দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল ১৪৫৪ খ্রিষ্টাব্দে। মিথিলার প্রসিদ্ধ পণ্ডিত বাচস্পতি তাঁর গ্রন্থে দুর্গা প্রতিমার পূজা পদ্ধতির সবিস্তার বর্ননা দিয়েছেন।

কথিত আছে আশুতোষ ঘোষাল স্বপ্নে তাঁদের আদি বাড়ির পিছনে একটি নিম গাছের ডালে নারায়ণকে শিলা রূপে দেখ তে পান । এই নারায়ণরূপী শিলা উদ্ধারের পর , গ্রামের প্রজারা পুজো করার জন্য আশুতোষ বাবুর কাছে আবেদন করেন। এরপর হঠাৎ একদিন গৃহকর্তা নরসিংহ মূর্তি দেখতে পান। এরপর দুর্গা স্বয়ং তাঁকে স্বপ্নাদেশ দেন যে নারায়ণকে বাহন করে তিনি যেন তাঁর পুজো করেন। স্বপ্নাদেশ অনুসারেই দুর্গা মূর্তি বানিয়ে আদি বাড়ির ঠাকুর দালানে ১৪৫৪ থেকে দুর্গা পুজ া শুরু হয়।

১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী জেলার তাহিরপর গ্রামে রাজা কংস নারায়ণ দুর্গাওঊজা করেছিলেন। উল্লেখ্য, রাজা কংস নারায়ণ ছিলেন মনুসংহিতার টীকাকার কুল্লুক ভট্টের পুত্র। এই পূজার   কুল পুরোহিত ছিলেন রমেশ শাস্ত্রী। তিনি দুর্গাপূজায় দুর্গামূর্তি, পূজার আবশ্যকীয় রীতি ও মন্ত্রের বিধানও দিয়েছিলেন রমেশ শাস্ত্রী।

 এরপর বাংলায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার সোনারপুরের কাছে মালঞ্চ গ্রামের জনৈক চামু (বাগচী) ব্রহ্মচারী ১৪৯১ খ্রিষ্টাব্দে দুর্গাপূজা করে ছিলেন। এর কাছাকাছি সময় শ্রীচৈতন্যের (১৪৮৬ -১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) প্রধান শিষ্য নিত্যানন্দ খড়দহে স্বগৃহে প্রতিমায় দুর্গোৎসব করেছিলেন।

১৫০৭ খ্রিষ্টাব্দে চন্দননগরের খলিসানির বসু বাড়িতে দুর্গাপূজার প্রবর্তন করে করুণাময় বসু। এরপর দেখা যায়, ১৫২২ খ্রিষ্টাব্দের শরৎকালে চন্দননগরের কমললোচন বসুর বাড়িতে দুর্গাপূজা হয়েছিল।

১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে কোচবিহারের রাজা বিশ্বসিংহের প্রতিষ্ঠিত ‘দুর্গাবাড়ি’ বা ‘দেবীবাড়ী’র দুর্গাপূজা খ্যাতি লাভ করেছিল।

১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে হাওড়া আমতার রসপুরের যশচন্দ্র রায় বাড়িতে দুর্গাপূজা জানা হয়েছিল বলে জানা যায়।

সম্রাট আকবর স্থানীয় শাসক কংসনারায়ণকে বাংলার দেওয়ানের পদ দান করেছিলেন।  এবং তাঁকে রাজ উপাধী দিয়েছিলেন। বৃদ্ধবয়সে কংসনারায়ণ দেওয়ানি ছেড়ে বর্তমান রাজশাহীর তাহেরপুরে বসবাস শুরু করেন। এই সময় তিনি একটি মহাযজ্ঞ করার সিদ্ধান্ত নেন। বংশানুক্রমিক পুরোহিত নাটোর বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্য বংশের পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী তাঁকে বলেন, চারটি মহাযজ্ঞের বিশ্বজিত ও রাজসূয় যজ্ঞের অধিকারী শুধু সম্রাটরা। কিন্তু কংসনারায়ণের বংশ ছিল পশুবলি-বিরোধী। তাই অশ্বমেধ বা গোমেধ যজ্ঞ বাদ পড়ে যায়। এর বিকল্প হিসেবে তিনি দুর্গাপূজা'র বিধান দেন। ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে এই পূজা সম্পন্ন হয়েছিল।

১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে কাশীশ্বর দত্ত চৌধুরীর উদ্যোগে দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল। তবে এই পূজা জমিদারের ঠাকুরদালান অথবা নাটমন্দিরে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দ বরিষায় সাবর্ণ গোত্রীয় লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় দুর্গাপূজা শুরু করেন। লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী ভগবতীদেবী বড়িশার আটচালায় প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন। সাবর্ণ পরিবারের দ্বাবিংশতিতম পুরুষ ও প্রথম জমিদার রায় লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার চৌধুরী প্রবর্তিত আটচালার দুর্গোৎসব বঙ্গদেশে সপরিবারে শ্রীদুর্গার প্রতিমা-পুজোর প্রাচীনতম নিদর্শন। ।

১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণনগরের রাজা নবকৃষ্ণ দেব শোভাবাজার রাজবাড়ীরতে শরৎকালীন দুর্গাপূজার  আয়োজন করে। এই সময় দুর্গাপূজা একটি হিন্দুদের একটি অন্যতম ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়েছিল। ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার বারো জন ব্রাহ্মণ যুবকের যৌথ উদ্যোগে দুর্গাপূজার আয়োজন হয়েছিল। বারো ইয়ার বা বন্ধু মিলে ওই পুজো ‘বারোইয়ারি’ নামে প্রচলিত হয়েছিল। পরে শব্দটি ‘বারোয়ারি’ পূজা নামে খ্যাত হয়ে আছে। বর্তমান বারোয়ারি পুজোর এরই বিবর্তন। কলকাতায় ‘বারোয়ারি’ দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন রাজা হরিনাথ রায়। 

এই পূজার ৭টি কল্প বিহিত আছে- এই সকল ৭টা কল্পের মধ্যে সামর্থ্যানুসারে যে কোন কল্পে পূজা করা হয়।

বঙ্গদেশের বহুল প্রচলিত পূজা হলো- ষষ্ঠ্যাদি কল্প।

বঙ্গীয়জনপদে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা
অনানুষ্ঠানিকভাবে দুর্গাপূজার সূচনা হয় মহালয়া দিয়ে। মহালয়া: মহালয়ার সূচনা হয় পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে। মহালয়াতে তিথিতে পিতৃ-মাতৃহীন সন্তানেরা তাঁদের পূর্বপুরুষের স্মরণ করে, পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মারা পৃথিবীতে নেমে আসেন, প্রয়াত আত্মা যে সমাবেশ হয় বলে এর নাম মহালয়। এই মহালয় থেকে মহালয়া। মহালয়াতে গঙ্গায় অঞ্জলি প্রদান করা হয় পূর্বপুরুষের আত্মারবং  জগতের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা ও অঞ্জলি প্রদান করেন। 

মহাপঞ্চমী: মহালয়ার পরে পঞ্চম তিথির সন্ধ্যায় দুর্গা দেবীর আগমনী মন্ত্র উচ্চারিত হয়। একে বলা হয় মহাপঞ্চমী। মূলত দেবীর বোধন হয় মহাপঞ্চমীতে। তবে আনুষ্ঠানিক বোধন হয় মহাষষ্ঠীতে। মূলত বোধন হলো জাগ্রত করা। তাই দেবী - বোধন এর অর্থ হলো- দেবীকে জাগিয়ে তোলা। আর এক অর্থে একে অকালবোধন বলা হয়। হিন্দু শাস্ত্র মতে সূর্যের উত্তরায়ন দেবতাদের সকাল। উত্তরায়নের ছয় মাসকে দেবতাদের এক দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। সকালে সমস্ত দেব-দেবীর পুজো করা হয়। আবার দক্ষিণায়ন শুরু হলে ছয় মাসের জন্য নিদ্রা যান সমস্ত দেব-দেবী। এই দক্ষিণায়ন হলো দেবতাদের রাত। রাতে দেব-দেবীর পুজো করা হয় না। কিন্তু দক্ষিণায়নের ছয় মাসের মধ্যেই দুর্গাপুজো হয় বলে বোধনের মাধ্যমে আগে দেবী দুর্গাকে ঘুম থেকে তোলা হয়। পুরাণে এর সঙ্গে একটি কাহিনিও জড়িত। রাবণের সঙ্গে যুদ্ধের আগে দুর্গার বোধন করেছিলেন দশরথ পুত্র রামচন্দ্র রামচন্দ্র। এর পর দুর্গার আরাধনা করে শক্তি ও সৌভাগ্যের প্রার্থনা করেন তিনি। অকালে দুর্গাকে জাগিয়ে তোলা হয়েছিল বলেই একে অকাল বোধন বলা হয়ে থাকে।

মহাষষ্ঠী: দেবীপক্ষের ষষ্ঠ দিন। মহাষষ্ঠীতে দেবীকে পূজামণ্ডপে স্থাপন করা হয়। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী এ দিনই স্বর্গ থেকে মর্তে পদার্পণ করেন দেবী দুর্গা। সঙ্গে থাকেন তাঁর চার সন্তান লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী। পূজামণ্ডপে চারসন্তান-সহ দেবীমূর্তি স্থাপনের পর-  মহাষ্ঠীতে পালনীয় আচার হলো- কল্পারম্ভ, বোধন, অধিবাস এবং আমন্ত্রণ। 

কল্পারম্ভ শুরু হয় ষষ্ঠী র সকালে । এই সময় দশভূজার সামনে প্রার্থনা করা হয় , য েন ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত গোটা পূজা পর্বে কোন বিঘ্ন না ঘটে। এরপর ঘট ও জলে পূর্ণ একটি তামার পাত্র মণ্ডপের কোণে স্থাপন করা হয়। কল্পারম্ভে ব্যবহার করা হয় -ষোড়শ উপাচার। এগুলো হলো-আসন, স্বাগত, পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, স্থানীয়, বসন, ভূষণ, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, মধুপর্ক, তাম্বুল, তর্পণ ও নতি। মতান্তরে- আসন, স্বাগত, পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, মধুপর্ক, পুনরাচমনীয়, স্নান, বসন, আভরণ, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য ও চন্দন (দ্রঃ- শক্তিপূজায়- আসন ও স্বাগত স্থলে নৈবেদ্য ও পুনরাচমনীয় এবং মধু স্থলে মদ্য)।

বেলগাছের তলে ঘট -পূজার মাধ্যমে   দেবীকে আহ্বান করে হয়। একে সাধারণত ষষ্ঠী পূজা বলা হয়। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেব ঘটে অবস্থান নে ন । পরে সেই ঘট, বেলপাতা, ডালসহ নবপত্রিকা মূল মন্দিরে স্থাপন করা হ য় ।

সন্ধ্যায় দুর্গার মুখের আবরণ উন্মোচন করা হয় । এটি হলো দেবীর আনুষ্ঠানিক বোধন । ধারণ করা হয় , বোধনের মধ্য দিয়ে প্রতিমার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়।  বোধনের পর বিল্ব শাখার দেবীকে আহ্বান জানানো হয়। অশুভ শক্তি দূরের জন্য ঘটের চারপাশে তীরকাঠিতে সুতো জড়িয়ে আমন্ত্রণ প্রক্রিয়া শুর হয়।

এরপর শুরু হয় অধিবাস। দুর্গামূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশটি উপকরণের প্রয়োজন হয়- এগুলো হল- মাটি (নিষিদ্ধ পল্লীর), চন্দন্, ধূপাদি গন্ধদ্রব্য, শিলা, ধান, দুর্বা, ফুল, ফল দই, ঘি, স্বতিকচিহ্ন (চালের গুঙড়ি দিয়ে তৈরি), সিঁদুর, শঙ্খ, কাজল, গোরচনা, সাদ সরষে, সোনা, রূপা, তামা, দীপ এবং দর্পণ। 

মহা সপ্তমী : এই দিনে সকালে চক্ষুদানের মধ্য দিয়ে ত্রিনয়নী দেবীর প্রতিমায় ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’হয় ।
দেবী দুর্গার সবচেয়ে ভয়ানক কালরাত্রি রূপের পুজো করা হয়। অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা করেন দেবী কালরাত্রি। দেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন করা হয়।

দিনব্যাপী চণ্ডী ও মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে পূজা, দেবী-দর্শন, দেবীর পায়ে ভক্তদের অঞ্জলি দেওয়া, প্রসাদ গ্রহণের মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠানিকতা চলে।

মহা অষ্টমী: এই দিনের পূজা দুর্গাষ্টমী নামে পরিচিত। কোনো কোনো অঞ্চলের সনাতন ধর্মীদের মতে- দেবী চামুণ্ডা এই দিনে দুর্গার কপাল থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং চণ্ড ও মুণ্ড এবং রক্তবীজ (মহিষাসুরের সহযোগী অসুর)কে বিনাশ করেছিলেন।

মহাষ্টমীতে দুর্গাপূজার সময় ৬৪ জন যোগিনী ও মাতৃকার (দুর্গার রূপ) পূজা করা হয়। এই দিনে বিশেষভাবে অষ্টশক্তির পূজা করা হয়। এই অষ্টশক্তি হলেন- ব্রাহ্মণী, মহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বরাহী, নরসিংহী, ইন্দ্রাণী এবং চামুণ্ডা। 

মহাষ্টমীর পূজা শেষে কুমারী পূজা করা হয়। এই পূজায় আদ্যঋতু দর্শন করেন নাই এমন কন্যাকে পূজা করা হয়।

মহা নবমী: অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমীর সূচনার প্রথম ২৪ মিনিট জুড়ে  সন্ধিপূজা হয়।
এদিন
১০৮টি মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে ও ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে পূজা হবে দেবীদুর্গার। এছাড়া এছাড়া নীলকণ্ঠ, নীল অপরাজিতা ফুল ও যজ্ঞের মাধ্যমে মহানবমীর পূজা সম্পন্ন করা হয়।

কালিকাপুরাণে বলা হয়েছে,

নবম্যাং বলিদান্তু কর্ত্তব্যং বৈ যথাবিধি।
জপং হোমঞ্চ বিধিবৎ কুর্য্যাত্তত্র বিভূতয়ে॥

অর্থাৎ বিভূতি লাভের জন্য নবমী তিথিতে যথাবিধি বলিদান করা কর্তব্য। তার সঙ্গে জপ ও হোম করা হয়। এক্ষেত্রে জপ বলতে চণ্ডিপাঠ এবং চণ্ডিজপ বোঝায়।  

দুর্গাপূজার ষষ্ঠাদি কল্প অনুসারে, নবমীতে দুর্গাপূজার সম্পত ঘটে।

দশমী: দশমী পুজা শুধুমাত্র দেবী বিদায়ের আচরিত সংক্ষিপ্ত পুজা অনুষ্ঠান হয়। এবং দিন শেষে দেবীমূর্তি বিসর্জন  দেওয়া হয়।


সূত্র: