রাম
হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র। অন্যান্য নাম: অযোধ্যানাথ, অযোধ্যাপতি, সীতাপতি।

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে
ত্রেতা যুগে আবির্ভুত বিষ্ণুর তিন অবতারের শেষ অবতার এবং বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে সপ্তম অবতার ইক্ষ্বাকুবংশীয়  রাজা দশরথের ঔরসে ও তাঁর অন্যতমা পত্নী কৈশল্যার গর্ভে রাম জন্মগ্রহণ করেন উল্লেখ্য রাজা দশরথের তিন স্ত্রী ছিল এঁরা হলেন কৌশল্যা, কৈকেয়ী, সুমিত্রা লক্ষণ ও শত্রুঘ্ন ছিলেন সুমিত্রার যমজ পুত্র এবং কৈকেয়ীর সন্তান ছিলেন ভরত। রামের জীবনচরিত রামের জন্মের আগেই রচনা করেছিলেন বাল্মীকি নামক এক ঋষি। এই গ্রন্থটিই রামায়ণ নামে খ্যাত।

এঁর বাহুদ্বয় ছিল আজানুলম্বিত, স্কন্ধ অতি উন্নত, গ্রীবাদেশ রেখাত্রয়ে অঙ্কিত, বক্ষস্থল অতি বিশাল, মস্তক সুগঠিত, ললাট অতি সুন্দর, স্কন্ধবক্ষসন্ধি দৃঢ়, চোয়াল, মোটা, চক্ষু আকর্ণবিস্তৃত ও বর্ণ শ্যামল। [প্রথম সর্গ। বালখণ্ড। বাল্মীকি রামায়ণ]
 

বিশ্বামিত্র মুনি রাক্ষসদের হাত থেকে যজ্ঞ রক্ষার জন্য দশরথের কাছে অনুরোধ করে, রাম ও লক্ষ্মণকে তাঁর আশ্রমে নিয়ে যান সে সময় রামের বয়স ছিল চৌদ্দ বসর রাম ও লক্ষণ সম্মিলিতভাবে তাড়কা ও অন্যান্য  রাক্ষসদের হত্যা করেন বিশ্বামিত্র রামের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে, তাঁকে বলা ও অতিবলা বিদ্যাসহ কিছু দিব্যাস্ত্র দান করেন সেখান থেকে বিশ্বামিত্র রাম-লক্ষ্মণকে নিয়ে মিথিলা নগরীর পথে অগ্রসর হন পথে গৌতম মুনির অভিশাপে অহল্যা রামের স্পর্শে শাপমুক্ত হন মিথিলায় এঁরা জনকরাজার আতিথ্য গ্রহণ করেন সেখানে বিশ্বামিত্রের পরামর্শে রাম জনকের হরধনু ভেঙে, তাঁর কন্যা সীতাকে লাভ করেন এবং একই আসরে সীতার কনিষ্ঠা ভগ্নী উর্মিলার সাথে লক্ষ্মণের বিবাহ হয় সেই সময়  বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম জীবিত ছিলেন অহঙ্কারবশত ইনি রামকে যুদ্ধে আহ্বান করেন এবং এই যুদ্ধে পরশুরাম পরাজিত হন। 
                 [একোনবিংশ সর্গ। বালখণ্ড।
 বাল্মীকি রামায়ণ] 

 

কিছুদিন পর দশরথ রামকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে অগ্রসর হলে, দশরথের দ্বিতীয়া স্ত্রী কৈকেয়ী ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন ইনি তাঁর দাসী মন্থরার পরামর্শে দশরথের এক পূর্ব প্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়ে রামকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে বাধা দেন ফলে কৈকেয়ীর পুত্র ভরত যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হন পক্ষান্তরে রামের চৌদ্দ বৎসরের বনবাস হয় এই বনবাসে সীতা ও লক্ষণ তাঁর অনুগামী হন।   
               [প্রথম সর্গ। বালখণ্ড। বাল্মীকি রামায়ণ]

 

রাম বনবাসে রওনা হয়ে নিষাদরাজের সাহায্যে গঙ্গানদী অতিক্রম করে প্রয়াগের কাছে ভরতদ্বাজ মুনির আতিথ্য গ্রহণ করেন পরে মুনির পরামর্শে ইনি চিত্রকূট পর্বতের দণ্ডকারণ্যে বাস করতে থাকেন উল্লেখ্য রামের বনে যাওয়ার কিছুদিন পর তাঁর পিতা তাঁর শোকে মৃত্যুবরণ করেন ভরত রাজ্যলোভ ত্যাগ করে রামকে ফিরিয়ে আনার জন্য দণ্ডকারণ্যে উপস্থিত হলে, রাম পিতৃসত্য রক্ষার জন্য সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন এরপর ভরত রামের প্রতীক স্বরূপ তাঁর জুতো নিয়ে যান এবং নন্দীগ্রামে থেকে রামের প্রতিনিধি হিসাবে রাজত্ব করতে থাকেন। 
               [প্রথম সর্গ। বালখণ্ড। বাল্মীকি রামায়ণ]

 

এরপর ইনি চিত্রকূট ত্যাগ করে দণ্ডকারণ্যে আসেন। এখানে তিনি বিরাধ নামক এক রাক্ষসকে হত্যা করেন। এরপর ইনি শরভঙ্গ, সূতীক্ষ্ণ, অগস্ত্য এবং ইধ্মবাহের সাথে দেখা করেন। অগস্ত্য তাঁকে বৈষ্ণবধনু, ব্রহ্মাস্ত্র ও অক্ষয়তূণ দান করেন এরপর মুনির পরামর্শে ইনি গোদাবরী নদীর তীরে পঞ্চবটী নামক বনে কুটির নির্মাণ করে বাস করতে থাকেন এই সময় এই বনের অধিকর্তী ছিলেন রাবণ বিধবা বোন শূর্পনখা রামের রূপে মুগ্ধ হয়ে, শূর্পনখা তাঁকে প্রণয় নিবেদন করলে, রাম তা প্রত্যাখ্যান করেন কোনো কোনো মতে, শূর্পনখা রামের কাছে সাড়া না পেয়ে লক্ষণের কাছেও অনুরূপ নিবেদন করেছিলেন ব্যর্থ শূর্পনখা এরপর সীতাকে গ্রাস করার চেষ্টা করলে, রামের নির্দেশে লক্ষ্মণ তার নাক ও কান কেটে দেন এরপর শূর্পনখার অধীনস্থ সেনাপতি খর ও দুষণ রাম-লক্ষ্মণকে আক্রমণ করলে, এঁরা উভয় সেনাপতিকে হত্যা করেন এরপর রাম-লক্ষণ একত্রে সমগ্র পঞ্চবটী বন রাক্ষসমুক্ত করেন শূর্পনখা এরপর লঙ্কায় গিয়ে রাবণকে সকল বিষয় অবগত করান এবং সীতার রূপলাবণ্য বর্ণনা করে রাবণকে উত্তেজিত করে তোলেন রাবণ সীতা লাভের আশায় এবং বোনের অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য পঞ্চবটীতে আসেন এরপর তাড়কা রাক্ষসীর পুত্র মারীচের  সাহায্যে ইনি সীতাকে অপহরণ করেন

 

এদিকে রাম-লক্ষণ কুটিরে ফিরে এসে সীতাকে না দেখতে পেয়ে, তাঁর অনুসন্ধানে বের হলেন পথে জটায়ু পাখির মুখে সব শুনে, খুঁজতে খুঁজতে অগ্রসর হলেন পথে এঁরা মস্তকবিহীন প্রেতকে (কবন্ধ) হত্যা করলে, কবন্ধের আত্মা সীতার খোঁজ করার জন্য রাজা সুগ্রীবের সাহায্য গ্রহণ করতে বললেন এরপর এঁরা সুগ্রীবের উদ্দেশ্যে ঋষমূকপর্বতে আসেন এবং বানরদের কাছ থেকে সীতার অলঙ্কার পান সেখানে কিষিন্ধ্যার অধিপতি সুগ্রীবের সাথে রামের সখ্যতা স্থাপিত হয় সুগ্রীব অবশ্য রামের কাছে একটি শর্ত রাখেন শর্তটি হলো- সুগ্রীবের ভাই বালীকে হত্যা করে, কিষিন্ধ্যারাজ্য সুগ্রীবের হাতে ন্যস্ত করলে, ইনি রামকে সাহায্য করবেন রাম শর্তানুসারে বালীকে হত্যা করে, সুগ্রীবের হাতে রাজ্য প্রদান করেন
 

এরপর রাম হনুমানকে সীতার সংবাদ আনার জন্য লঙ্কায় পাঠান হনুমান লঙ্কায় পৌঁছে অশোকবন তছনছ করেন এবং লঙ্কা দগ্ধ করে সীতার সংবাদ রামকে পৌঁছে দেন এরপর রাম বানর সৈন্যদের সহায়তায় সমুদ্রের উপর সেঁতু নির্মাণ করে লঙ্কায় উপস্থিত হন এই সময় রাবণের কনিষ্ঠ ভাই বিভীষণ রামের পক্ষে যোগ দেন

যুদ্ধে রাবণের পুত্র ইন্দ্রজিৎ অসাধারণ বিক্রম প্রদর্শন করেন প্রথমে ইনি রাম-লক্ষণকে নাগপাশে বন্দী করেন কিন্তু গরুড়ের সাহায্যে এই বন্ধন থেকে উভয়ই মুক্তি লাভ করেন এরপর রাবণ-পক্ষের ধূম্রাক্ষ, বজ্রদংশ, অকল্পন ও প্রহস্ত সেনাপতিরা নিহত হলে, রাবণ কুম্ভকর্ণকে অকালে জাগিয়ে তোলেন যুদ্ধে কুম্ভকর্ণ নিহত হন এরপর বিভীষণের সাহায্যে লক্ষণ অন্যায়ভাবে নিরস্ত্র অবস্থায় নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ইন্দ্রজিৎকে হত্যা করেন পুত্র-শোকাতুর রাম শক্তিশেল দ্বারা লক্ষণকে আঘাত করলে, লক্ষণ মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যান পরে হনুমান দ্বারা সংগৃহীত বিশল্যকরণী দ্বারা লক্ষ্মণ জীবন ফিরে পান এরপর রাম-রাবণের প্রচণ্ড যুদ্ধের পর ইনি রাবণকে হত্যা করতে সক্ষম হন
 

এরপর সীতাকে উদ্ধার করে, বিভীষণকে লঙ্কার রাজপদে আসীন করে অযোধ্যার ইনি পথে রওনা দেন এই সময় বন্দিনী সীতার সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠলে, সীতা অগ্নি পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করলেন যে, তিনি সতী এরপর রাম চৌদ্দ বৎসর পর সীতা ও লক্ষণসহ অযোধ্যাতে প্রবেশ করলেন ভরত রামের হাতে রাজ্য ফিরিয়ে দিলে, তিনি রাজত্ব শুরু করেন। কিছুদিন রাজত্ব করার পর সীতার সতীত্ব নিয়ে পুনরায় প্রজাদের ভিতর গুঞ্জন শুরু হলে, রাম সীতাকে বাল্মীকির তপোবনে নির্বাসন দেন আর তাঁর তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে সাথে লক্ষণকে প্রেরণ করলেন এই সময় সীতা গর্ভবতী ছিলেন এই আশ্রমে সীতা যমজ সন্তান প্রসব করেন বাল্মীকি এই দুই পুত্রের নাম দেন লব ও কুশ
 

সীতাকে নির্বাসন দেওয়ার কিছুদিন পর রাম অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন বাল্মীকি উক্ত যজ্ঞস্থলে লব-কুশকে নিয়ে উপস্থিত হন উক্ত আসরে লব-কুশ রামায়ণের গান করেন এই গান শুনে রাম মুগ্ধ হন এবং খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে, লব-কুশ তাঁরই পুত্র বাল্মীকির কাছ থেকে সমুদয় জেনে এবং বাল্মীকির অনুরোধে সীতাকে ফিরে আসার অনুমতি দিলেন এরপরও প্রজাদের সামনে সীতার সতীত্ব পরীক্ষার কথা পুনরায় উত্থাপিত হলে, সীতা ব্যথিত হয়ে মাতা বসুমতীর কাছে, তাঁর কোলে স্থান দেবার জন্য অনুরোধ করলেন সেই সময় পৃথিবী দ্বিবিভঙ্গত হলে- সীতা তাঁর মধ্যে প্রবেশ করেন
 

এরপর থেকে সীতার অবর্তমানে রাম অত্যন্ত বিষণ্ণচিত্তে দিন কাটাতে লাগলেন এমনি একদিন কালপুরুষ রামের সাথে গোপনে দেখা করতে এলে, তাঁদের গোপন আলোচনার প্রহরী হিসাবে লক্ষণকে নিযুক্ত করলেন কালপুরুষের আজ্ঞানুসারে রাম প্রতিজ্ঞা করলেন যদি তাঁদের এই গোপন আলোচনা কেউ গোপনে শোনে, দেখে বা একত্রে দুজনকে আলোচনারত অবস্থায় পর্যবেক্ষণ করে তবে সে রামের বধ্য হবে বা ত্যাগ করতে হবে ঘটনাক্রমে এই আলোচনা চলাকালে, দুর্বাসা মুনি উপস্থিত হয়ে রামের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করলেন লক্ষণ তাঁকে বাধা দিলে, দুর্বাসা তাঁকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হন পরে লক্ষ্মণ রামের সামনে উপস্থিত হয়ে, দুর্বাসার আগমন বার্তা জানালেন ফলে সত্য রক্ষার্থে ইনি লক্ষ্মণকে ত্যাগ করলেন লক্ষণকে ত্যাগ করার পর ইনি আরো বেশি শোকাতুর হয়ে পড়েন এরপর ইনি তাঁর পুত্র কুশকে কোশলের রাজা ও লবকে উত্তর কোশলের রাজা করে গৃহত্যাগ করেন রাজ্য ছেড়ে ইনি সরযুনদীর তীরে যোগালম্বন করেন এবং সেই অবস্থাতেই ইনি মৃত্যুবরণ করেন