হনুমান
অঞ্জনাতনয়,
অঞ্জননন্দন,
অঞ্জনাপুত্র, হনুমান।
হিন্দু পৌরাণিক
কাহিনি মতে—
বায়ু (পবন)
দেবতার ঔরসে অঞ্জনা (কেশরী নামক বানরের স্ত্রী) নামক বানরীর গর্ভে ইনি জন্মগ্রহণ
করেন।
একবার অঞ্জনার রূপে মুগ্ধ হয়ে
পবন
দেবতা তাঁকে আলিঙ্গন করেন।
এতে অঞ্জনা ক্ষুব্ধ হয়ে পবনদেবতাকে তিরস্কার করলে,
পবন দেবতা তাঁকে জানান যে, তিনি অঞ্জনার সাথে মনে মনে মিলিত হয়েছেন।
তারপরেও এই মিলন থেকে এক পরাক্রান্ত এক পুত্রের জন্ম হবে।
উল্লেখ্য,
এই পুত্রই হনুমান।
কার্তিক মাসের শুক্লা চতুর্দশীতে অঞ্জনা এক গুহার মধ্যে হনুমানকে প্রসব করেন।
একে বলা হয় অনর্কচতুর্দশী।
এই উপলক্ষে কাশীতে প্রতিবৎসর এই তিথিতে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
প্রসবের পর
অঞ্জনা ক্ষুধার্ত হয়ে বনে ফল আনতে গেলে,
হনুমান ভোরের সূর্যকে ফল মনে করে,
খাবারের জন্য লাফ দিয়ে বহু শত যোজন অতিক্রম করেন।
এই সময়
পবন
দেবতা বাতাসকে শীতল করে দেন। শিশু বিবেচনায়
সূর্য
তাঁকে দগ্ধ করা থেকে
বিরত থাকেন।
সেই দিনই
রাহু
সূর্যকে গ্রাস করার জন্য অগ্রসর হলে,
হনুমান
সূর্যকে ত্যাগ করে
রাহুকে গ্রাস করতে উদ্যত হন।
রাহু ভয় পেয়ে
ইন্দ্রের শরণাপন্ন হন।
এরপর
ইন্দ্র
রাহুকে সাথে করে
ঐরাবতে চড়ে সূর্যের কাছে উপস্থিত হন।
এবার হনুমান
ঐরাবতকে গ্রাস করতে উদ্যত হলে,
ইন্দ্র
বজ্রদ্বারা হনুমানকে আঘাত করেন।
ফলে তাঁর হনুর হাড় ভেঙে যায় এবং ইনি পর্বত শিখরে পতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
পুত্রের এই দশা দেখে
পবন
পর্বতগুহায় প্রবেশ করে পুত্রের জন্য বিলাপ করতে
থাকেন।
ফলে বাতাসের অভাবে সমগ্র চরাচরে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়।
তখন সকল দেবতা
ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলে,
ব্রহ্মা
পবনের
কাছে উপস্থিত হয়ে,
হনুমানকে পুনর্জীবিত করেন।
পবন
খুশি হয়ে আবার বাতাস প্রবাহিত করেন।
এই শিশুর হনু বজ্রের আঘাতে ভেঙেছিল বলে এর নাম রাখা হয় হনুমান।
এরপর বিভিন্ন দেবতা হনুমানকে বিবিধ প্রকার বর প্রদান করেন।
ইন্দ্র
বর দেন যে বজ্রে এঁর মৃত্যু হবে না এবং তাঁর ইচ্ছা মৃত্যু হবে।
সূর্য
তাঁর শতাংশ তেজ দান করেন।
ব্রহ্মা
বলেন,
হনুমান ব্রহ্মজ্ঞ ও চিরজীবি হবেন এবং সকল ব্রহ্মশাপের অবধ্য হবেন।
মহাদেব
ও
বিশ্বকর্মা
বলেন,
ইনি তাঁদের সকল অস্ত্রের অবধ্য হবেন।
এ
ছাড়াও অন্যান্য দেবতাগণ বিবিধ প্রকার বর প্রদান করেন।
এরপর শিশু
হনুমান বিভিন্ন ঋষিদের আশ্রমে উপদ্রব শুরু করলে,
ঋষিদের অভিশাপে ইনি দীর্ঘদিন তাঁর নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্মৃত হয়ে থাকেন।
হনুমান কর্তৃক সাগর লঙ্ঘনের পূর্বে
জাম্ববান
হনুমানকে তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত
করেছিলেন।
এরপর থেকে ইনি তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে আর বিস্মৃত হন নি।
রাবণ
সীতাকে
অপহরণ করলে,
সীতার খোঁজে
রাম-লক্ষ্মণ
কিষ্কিন্ধ্যায় উপস্থিত হন।
এই সময়
সুগ্রীব
তাঁদের পরিচয় জানার জন্য হনুমানকে পাঠান।
হনুমান এঁদের পরিচয় লাভ করার পর,
এঁদেরকে পিঠে চড়িয়ে
সুগ্রীবের কাছে এনেছিলেন।
এরপর
রাবণ ও
সীতার অনুসন্ধানে
সুগ্রীব বিভিন্ন দিকে চর পাঠান।
হনুমানও
রামের আংটি নিয়ে দক্ষিণ দিকে যান।
এই অনুসন্ধানকালে সম্পাতির কাছে
সীতার অবস্থান জানতে পেরে ইনি সাগর লঙ্ঘন করে
লঙ্কায় উপস্থিত হন।
পথিমধ্যে
দেবতা,
গন্ধর্ব
ও ঋষিরা হনুমানের শক্তি পরীক্ষার জন্য নাগমাতা
সুরসাকে পাঠালে,
ইনি পরীক্ষায় জয়লাভ করে লঙ্কার পথে রওনা দেন।
সুরসা রাক্ষসরূপ ধারণ করে হনুমানের পথরোধ করে বলেন যে,
দেবতারা তাঁকে তাঁর খাদ্যরূপে নির্দিষ্ট করেছেন।
উত্তরে হনুমান বললেন যে,
তিনি
সীতাকে উদ্ধার করতে লঙ্কায়
রামের
দূত হয়ে যাচ্ছেন।
সীতার সংবাদ রামকে দিয়ে তিনি সুরাসার মুখে প্রবেশ করবেন।
এরপর সুরসা বলেন যে,
কেহই আমাকে অতিক্রম করে যেতে পারবে না,
এই বর লাভ করেছেন।
এরপর হনুমানকে মুখে প্রবেশ করা কথা বলে তার মুখ প্রসারিত করলেন।
প্রথমে হনুমান তাঁর দেহকে ১০ যোজন বিস্তৃত করলে,
সুরসাও মুখ ১০ যোজন বিস্তৃত করলেন।
এরপর সুরসা ২০ যোজন মুখ বিস্তৃত করে হনুমান ৩০ যোজন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলেন।
এইভাবে দুইজনের আয়তন ক্রমেই বৃদ্ধি হওয়ার সময়,
হনুমান হঠাৎ করে নিজেকে অঙ্গুষ্ট প্রমাণ আকৃতি ধারণ করলেন।
পরে সুরসার মুখে প্রবেশ করে আবার বেরিয়ে এলেন।
এরপর সুরসা নিজমুর্তি ধারণ করে হনুমানকে আশীর্বাদ করেন।
পথে
সিংহিকা
নামক এক রাক্ষসীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।
এই রাক্ষসী জীবের ছায়া আকর্ষণ করে আহার করতো।
হনুমানের ছায়া আকর্ষণ করে তাঁকে আহার করার উদ্যোগ নিলে,
হনুমান প্রথমে তাঁর শরীর বৃদ্ধি করেন।
সেই কারণে
সিংহিকাও মুখ বিস্তার করতে হয়।
পরে হনুমান হঠাৎ করে তাঁর শরীর সংকুচিত করে,
সিংহিকার শরীরে প্রবেশ করেন এবং হৃদপিণ্ড ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে তাকে হত্যা করেন।
লঙ্কায় প্রবেশ
করে ইনি তাঁর দেহ বিড়ালের মতো ছেটো করে
সীতাকে খুঁজতে থাকেন।
এবং শেষ পর্যন্ত অশোকবনে
সীতাক দেখতে পান।
এরপর ইনি
সীতাক
রামের
আংটি দেখিয়ে আশ্বস্ত করেন।
এর প্রতিদানে
সীতা
তাঁকে চূড়ামণি দান করেন এবং
রামের
বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য সীতা
তাঁকে তাঁর মাথার মণি প্রদান করেন।
ফেরার সময় ইনি অশোক বন ধ্বংস করেন।
তাঁকে ধরার জন্য
রাবণ
তাঁর পাঁচ সেনাপতি ও পুত্র
অক্ষয়কুমারের
অধীনে এক বিশাল
সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন।
এই যুদ্ধে হনুমান
অক্ষয়কুমার-সহ
সকলকেই হত্যা করেন।
এই সময় রাবণের নাতি
জম্বুমালীও
নিহত হন।
এরপর
রাবণ
তাঁর শ্রেষ্ঠপুত্র
ইন্দ্রজিৎকে প্রেরণ করেন।
ইন্দ্রজিৎ
হনুমানের উদ্দেশ্যে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলে,
ব্রহ্মার সম্মানার্থে ও রাবণের সাক্ষাৎলাভের আশায় ব্রহ্মাস্ত্রের বন্ধন স্বীকার
করেন।
বন্দী অবস্থায় রাবণের সামনে তাঁকে উপস্থিত করা হলে,
ইনি সীতাকে অপহরণের জন্য
রাবণকে তিরস্কার করেন।
ক্ষিপ্ত রাবণ তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে,
বিভীষণের
অনুরোধে এই হত্যাকাণ্ড থেকে রাবণ নিজেকে বিরত রাখেন।
কিন্তু এর পরিবর্তে রাবণ হনুমানের লেজে আগুন লাগানোর আদেশ দেন।
রাক্ষসেরা সেই আদেশ অনুসারে হনুমানের লেজে আগুন লাগিয়ে ছেড়ে দিলে,
ইনি লাফিয়ে লাফিয়ে লেজের আগুন দ্বারা সমস্ত লঙ্কা নগরীতে আগুন ধরিয়ে দেন।
এই সময় সীতার প্রার্থনায় হনুমান লেজের আগুন থেকে রক্ষা পান।
লঙ্কায় অগ্নিকাণ্ড ঘটানোর পর ইনি সমুদ্রে লেজের আগুন নিভিয়ে,
পুনরায় সাগর লঙ্ঘন করে রামের কাছে ফিরে আসেন এবং রামকে সকল বিষয় জানান।
লঙ্কা যুদ্ধের
সময় ইনি এককভাবে অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
তাঁর হাতে
---ধুম্রাক্ষ, অকল্পন, দেবান্তক, ত্রিশিরা, নিকুম্ভ নামক রাক্ষসে সেনাপতি নিহত হয়। ইন্দ্রজিৎ-বধের সময় ইনি লক্ষ্মণের বাহন হয়েছিলেন। রাবণের নিক্ষিপ্ত শক্তিশেলের আঘাতে লক্ষ্মণ মৃতপ্রায় হলে, সুষেণের পরামর্শে বিশল্যকরণী নামক ঔষধি আনার জন্য গন্ধমাদন পর্বতে যান। বিবিধ গাছপালার মধ্যে ইনি এই গাছটি খুঁজে না পেয়ে, পুরো পর্বত তুলে আনেন। পরে এখান থেকে সঠিক গাছটি নিয়ে লক্ষ্মণকে জীবিত করা হয়। যুদ্ধ শেষে ইনি সীতার কাছে রাবণবধের সংবাদ দেন এবং সীতাকে রামের কাছে পৌঁছে দেন। অযোধ্যায় রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা ফিরে আসার সময় রাম হনুমানকে নন্দীগ্রামে ভরতের মনোভাব জানার জন্য পাঠিয়েছিলেন। অযোধ্যা থেকে ফেরার সময়, রাম তাঁর শরীরের সমস্ত অলঙ্কার হনুমানকে প্রদান করেন। সেই সাথে রাম হনুমানকে বর দেন যে, যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন হনুমানও জীবিত থাকবেন।
দ্বাপর যুগে ভীম
যখন দ্রৌপদীর অনুরোধে পদ্ম সংগ্রহের জন্য ভুল করে মানুষের অগম্য স্বর্গপথে রওনা
দেন,
তখন
হনুমান তাঁর পথরোধ করে বসেছিলেন।
উল্লেখ্য ভীমও ছিলেন পবন দেবতার পুত্র।
সে কারণে হনুমান ছিলেন ভীমের বড় ভাই।
ভীম হনুমানকে পথ ছেড়ে দিতে বললে,
হনুমান তাতে রাজী হলেন না।
ভীম তাঁর অগ্রজকে চিনতে না পেরে আস্ফালন করতে থাকলে,
হনুমান তাঁর লেজ বিছিয়ে দিয়ে বললেন,
তুমি এই লেজ সরিয়ে তোমার গন্তব্যে যাও।
এরপর ভীম বহু চেষ্টা করেও উক্ত লেজ সরাতে অক্ষম হলে,
হনুমান তাঁর পরিচয় দেন।
এরপর ভীম তাঁর অগ্রজের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সমুদ্র লঙ্ঘনের পূর্বে হনুমানের রূপ কেমন ছিল তা দেখার জন্য আবেদন জানালে, হনুমান তাঁকে বিন্ধ্যাপর্বতের মতো বিশাল রূপ দেখান। এরপর হনুমান পদ্মবনের প্রকৃত পথ দেখান। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ইনি আড়ালে থেকে ভীমকে সাহায্য করেছিলেন।