খ্রিষ্টীয় ১৯শ শতাব্দে পূর্ব ভারতে প্রাপ্ত সূর্যমূর্তি। মাৎসুওকা মিউজিয়াম অফ আর্ট, টোকিও, জাপান |
অমৃতলাভের জন্য দেবতা ও দানবেরা
সমুদ্রমন্থন
করেছিল। এই মন্থনে
ধন্বন্তরি
অমৃতভাণ্ড হাতে উত্থিত হন।
কিন্তু দানবরা
লক্ষ্মী এবং অমৃতলাভের জন্য দেবতাদের সাথে
কলহের সৃষ্টি করতে থাকে। এই
সময়
বিষ্ণু মোহনীয়া নারীর রূপ ধরে, দানবদের সম্মুখে এলে, দানবরা মোহিত হয়ে,
অমৃতভাণ্ড নারীরূপী
বিষ্ণুর হাতে তুলে দিলেন। এরপর দানবরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দেবতাদের আক্রমণ
করে। এই অবসরে
বিষ্ণু নরদেবকে সাথে নিয়ে অমৃতকুণ্ড নিয়ে পালিয়ে যান। আর দেবতারা
বিষ্ণুর কাছ থেকে সেই
অমৃত নিয়ে পান করেন।
পরে
রাহু
নামক
দানব এই অমৃত চুরি পান করতে গেলে
চন্দ্র
ও সূর্যের তা দেখে ফেলেন এবং
বিষ্ণুকে তা
জানিয়ে দেন। এরপর বিষ্ণু
সুদর্শনচক্র
দ্বারা
রাহুর শিরোশ্ছেদ করেন।
এই কারণে,
রাহু
মস্তক অমৃতের প্রভাবে অমর
হয়ে যায়। সেই থেকে
চন্দ্র ও সূর্য
রাহুর চির শত্রুতে পরিণত হন। এই কারণে মাঝে মাঝে
রাহুর
চন্দ্র
ও সূর্যকে
গ্রাস করা করার চেষ্টা করেন।
হিন্দু মতে- এইভাবে সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের ব্যাখ্যা প্রদান করা
হয়েছে।
[সূত্র: মহাভারত। আদিপর্ব।
অষ্টাদশ-ঊনবিংশ অধ্যায়]
রাহুর
এই গ্রাস করার চেষ্টার কারণে, একবার সূর্য দেবতাদের উপর রেগে যান। দেবতাদের
পক্ষালম্বন করে,
রাহুর
অমৃতপানের বিষয় তিনি জানিয়েছিলেন বলেই মাঝে মাঝে সূর্য এই বিপদে পড়েন। কিন্তু
রাহু
যখন তাঁকে গ্রাস করতে আসে, তখন কোনো দেবতাই তাঁকে রক্ষা করার জন্য আসেন না। এই
ক্ষোভ থেকে একবার সূর্য সংহারক-মূর্তি ধারণ করেন। তিনি বিশ্বজগৎ ধ্বংস করার জন্য
তার তেজ বৃদ্ধি করেন। ফলে রাত্রিকালেও মহাদাবদাহের সৃষ্টি হয়। দেবতা এবং ঋষিরা এই
দাবদাহে উদ্বিগ্ন হয়ে ব্রহ্মার কাছে যান।
ব্রহ্মা
এর
প্রতিকার হিসেবে
কশ্যপপুত্র
অরুণকে
সূর্যের রথের সারথি হিসেবে নিয়োগ করেন। এর ফলে সূর্য তেজ বৃদ্ধি করলেও
অরুণ,
সে তেজকে হ্রাস করে দেবেন। এরপর
অরুণ
রথের সারথি হলে, সূর্যের তেজ থেকে জগৎ রক্ষা পেয়েছিল।
[সূত্র: মহাভারত। আদিপর্ব। চতুর্বিংশ অধ্যায়]
মহাদেবের বরে সুকেশী রাক্ষস
একটি আকাশে চলাচল করতে পারে, এমন একটি পুরী লাভ করেন। সেই পুরীর
ঔজ্জ্বল্যে সূর্যের ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয়ে যায়। সেই কারণে সূর্য
সুকেশীকে ভূতলে পাতিত করেন। এর ফলে, মহাদেব ক্রুদ্ধ হয়ে, সূর্যকে ভূতলে পাতিত করেন।
সূর্যের এই দুর্দশা দেখে অন্যান্য দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা মহাদেবকে
স্তব করে সন্তুষ্ট করেন এবং সূর্যকে সাথে নিয়ে বারাণসীতে যান। সেখানে সূর্যের
দুর্দশা লোপ করেন এবং সূর্যের নাম দেন লোল। লোল নামক অর্ক (সূর্য) অর্থে তাঁকে
লোলার্ক নামে অভিহিত করা হয়। [বামনপুরাণ (১১-১১৫)]
রাবণ দিগ্বিজয়ে বের হয়ে, সুমেরু শিখরে রাত্রি
যাপন করেন। পরে পুষ্পক রথে চড়ে সূর্যলোকে যান। সেখানে সূর্যের তেজে কাতর হয়ে
তিনি প্রহস্ত নামক এক অনুচরকে দিয়ে সূর্যের সাথে
যুদ্ধ করার প্রস্তাব পাঠান। সূর্য তার দণ্ডী নামক এক অনুচরকে বলেন 'তুমি
রাবণের নিকট যাও এবং তাকে হয় পরাজিত কর, না হয় বলো পরাজিত হলাম।' দণ্ডী এই কথা
সূর্যকে জানালে, রাবণ নিজেকে জয়ী ভেবে ফিরে যান।
[উত্তরকাণ্ড, ত্রয়োবিংশ সর্গ, প্রক্ষিপ্ত ২। বাল্মীকি রামায়ণ। হেমচন্দ্র
ভট্টাচার্য অনূদিত]
বিশ্বকর্মা
কন্যা সংজ্ঞার সাথে সূর্যের বিবাহ হয়।
সূর্য সংজ্ঞার সাথে মিলিত হয়ে তিনটি সন্তান উৎপন্ন করেন।
এদের নাম রাখা হয় মনু,
যম ও যমুনা।
সংজ্ঞা সূর্যের প্রখর দ্যুতি ও তেজ সহ্য করতে না পেরে নিজের মতো করে ছায়াকে সৃষ্টি
করেন।
এই ছায়াকে সূর্যের কাছে পাঠিয়ে ইনি উত্তরকুরুবর্ষে অবস্থান করতে থাকেন।
সূর্য পরে ছায়ার সাথে মিলিত হয়ে তিনটি সন্তান উৎপন্ন করেন।
এদের নাম রাখা হয় সার্বনি মনু,
শনি ও তপতী।
পরে সূর্য সংজ্ঞার কৌশল বুঝতে পেরে উত্তরকুরুতে অশ্বরূপ ধারণ করে সংজ্ঞার সাথে
মিলিত হন।
এই মিলনের ফলে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের জন্ম হয়।
এরপর সূর্য সংজ্ঞাকে ফিরিয়ে আনেন।
সংজ্ঞার উপযোগী করার জন্য বিশ্বকর্মা সূর্যকে আটটি ভাগে ভাগ করেন।
এই আটটি ভাগ পৃথিবীতে পতিত হলে–
বিশ্বকর্মা এগুলি দিয়ে বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র,
শিবের ত্রিশূল,
কুবেরের অস্ত্র,
কার্তিকেয়ের তরবারি ও অন্যান্য দেবতাদের অস্ত্র নির্মাণ করে দেন।
অন্যত্র কথিত
আছে– সূর্যপত্নী সংজ্ঞা সূর্যের তাপ সহ্য করতে অসমর্থ হলে, বিশ্বকর্মা সূর্যকে মোট
১২টি ভাগে ভাগ করেন।
সেই ১২টি অংশ ভিন্ন ভিন্ন নামে ভিন্ন ভিন্ন মাসে উদিত হয়।
এগুলি হলো–
বৈশাখ মাসের অংশের নাম– তপন
জ্যৈষ্ঠ মাসের অংশের নাম– ইন্দ্র
আষাঢ় মাসের অংশের নাম– রবি
শ্রাবণ মাসের অংশের নাম– গভস্তি
ভাদ্র মাসের অংশের নাম– যম
আশ্বিন মাসের অংশের নাম– হিরণ্যরেতাঃ
কার্তিক মাসের অংশের নাম– দিবাকর
অগ্রহায়ণ মাসের অংশের নাম– চিত্র/মিত্র
পৌষ মাসের অংশের নাম– বিষ্ণু
মাঘ মাসের অংশের নাম– অরুণ
ফাল্গুন মাসের অংশের নাম– সূর্য
চৈত্র মাসের অংশের নাম– বেদজ্ঞ
এদের সূর্যের আত্মারূপী অংশ হিসেবে ১২টি ভাগকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। এই অর্থের সূর্যের অপরনাম দ্বাদশাত্মা। এই নামগুলো হলো- অর্যমা, উরুক্রম, ত্বষ্টা, ধাতা, পূষা, বরুণ, বিধাতা, বিবস্বান, ভগ, মিত্র, শত্রু ও সবিতা। ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডলের ৬২ সূক্তের ১০ম শ্লোকে রয়েছে "তৎ সবরিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো যো নঃ প্রচেদয়াৎ। [যিনি আমাদের ধীশক্তি প্রেরণ করেন, আমরা সে সবিতাদেবের সে বরণীয় তেজ ধ্যান করি]। এই অর্থে সবিতা ধীশক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। কিন্তু সবকিছু সূর্য থেকে সৃষ্টি এই অর্থে সর্বপ্রসবিতা এবং জগৎস্রষ্টা।
মহাভারতে বর্ণিত আছে– কুন্তী দেবী দুর্বাসার কাছ থেকে বর পেয়ে সূর্যকে আবাহন করলে, সূর্য কুন্তীর সাথে মিলিত হন। এই মিলনের ফলে কর্ণ নামক মহাবীরের জন্ম হয়। আবার রামায়ণের মতে– সূর্যের বীর্য ঋক্ষরজার গ্রীবায় পতিত হলে সুগ্রীবের জন্ম হয়। সূর্য পুত্র বৈবস্বত মনু ইক্ষ্বাকুরের পিতা ছিলেন। সেই থেকে পৃথিবীতে সূর্য বংশের সূচনা হয়। দেখুন : সূর্য বংশ
বিন্ধ্যপর্বতের
সাথে সূর্যের বাক-বিতণ্ডার ফলে,
পৃথিবী ধ্বংসের উপক্রম হয়।
পরে অগস্ত্য মুনি এই সংকট থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেন।
[দেখুন : অগস্ত্য (অগস্ত্য যাত্রা)]
মহাদেব দক্ষের যজ্ঞ নষ্ট করার সময়- সূর্য বাধা দিতে এলে বীরভদ্র এর দাঁত বিনষ্ট করেছিলেন। সেই কারণে দন্তহীন অর্থে- অজম্ভ, অদন্ত । বৃহদ্ধর্ম্ম পুরাণ (উত্তর ৯) মতে, সূর্য, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু নবগ্রহ নামে পরিচিত। হিন্দু মতে সকল মঙ্গল কাজে এই সকল গ্রহের পূজা করার আছে।