অরুণ
বানান বিশ্লেষণ: +র্+উ+ণ্+অ
উচ্চারণ : o.run
(ও.রুন্)।

শব্দ-উৎস: সংস্কৃত रुणः ঃ>বাংলা
রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ:
(গমন করা) +উন্ (উনন্),  কর্তৃবাচ্য

ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা { পক্ষী |  হিন্দু পৌরাণিক সত্তা | ভারতীয় পৌরাণিক সত্তা | পৌরাণিক সত্তা | কাল্পনিক সত্তা | কল্পনা | সৃজনশীলতা | কর্মক্ষমতা | জ্ঞান | মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা | বিমূর্তন  | বিমূর্ত-সত্ত | সত্তা |}

হিন্দু পৌরাণিক পক্ষী বিশেষ। এর অপর নাম অনূরু।

কশ্যপ ঋষি দক্ষ নামক প্রজাপতির কদ্রু বিনতা নামক দুই কন্যাকে বিবাহ করেন। একবার উভয় স্ত্রীর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে,  কশ্যপ উভয়কে বর দিতে ইচ্ছা করেন। কদ্রু বলশালী সহস্র নাগপুত্র ও বিনতা কদ্রুপুত্র অপেক্ষা বলশালী এবং তেজস্বী দুটি পুত্র প্রার্থনা করলেন। কশ্যপ  সেই বরই মঞ্জুর করেন।

মহাভারতে অরুণ ও গরুড়ের জন্মের একটি কাহিনি পাওয়া যায়। একবার কশ্যপ পুত্রলাভের আশায় একটি মহাযজ্ঞ করেন। উক্ত যজ্ঞে সাহায্য করার জন্য দেবতাগণ, ঋষিগণ ও গন্ধর্বগণ অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইন্দ্র নিজের ক্ষমতাবলে প্রচুর কাঠ যোগাড় করে আনার সময় দেখতে পান যে, ক্ষুদ্রাকার বালখিল্য ঋষিরা সমবেতভাবে একটি পত্রবৃন্ত আনার চেষ্টা করছিলেন। উল্লেখ্য বালখিল্যরা উপাসনার জন্য প্রায় অনাহারে থাকতেন। এই কারণে তাঁরা দুর্বল ছিলেন। এ ছাড়া এঁরা আকারে এতটাই ক্ষুদ্র ছিলেন যে, গরুর পায়ের চাপে মাটিতে যে গর্ত হয়, তাতে জমে থাকা পানিতে ডুবে যেতেন। বলাই বাহুল্য এরূপ বালখিল্যদের একটি পত্রবৃন্ত সংগ্রহ করা এবং তা বহন করে নিয়ে যাওয়াটা অনেক কঠিন ছিল। ইন্দ্র বালখিল্যদের এই পত্রবৃন্ত সংগ্রহের দৃশ্য দেখে উপহাস করেন। এতে বালখিল্যরা অপমানিত হন, এবং ইন্দ্রের চেয়ে শক্তিশালী পুত্র কামনায় যজ্ঞ করেন। বিষয়ট ইন্দ্র জানতে পেরে, কশ্যপের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। কশ্যপ ইন্দ্রের অনুরোধে বালখিল্যদের কাছে এসে কার্যসিদ্ধির প্রার্থনা করলেন। বালখিল্যরা এ প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। এরপর কশ্যপ বালখিল্যদের বলেন যে, ইন্দ্রকে ত্রিভুবনের নিয়ন্ত্রণ অধিকার ব্রহ্মা দিয়েছেন। সুতরাং ইন্দ্রের চেয়ে শক্তিশালী কেউ হলে, ব্রহ্মার নিয়ম লঙ্ঘিত হবে। তাই বালখিল্যদের ইন্দ্র হবে পক্ষীদের ইন্দ্র। যেহেতু বালখিল্যরা কশ্যপর পুত্রকামনায় যজ্ঞ করছিলেন, তাই এক্ষেত্রে কি করা উচিৎ, তা বিবেচনার ভার কশ্যপকেই প্রদান করেন। এর কিছুদিন পর বিনতা যখন পুত্রকামনায় ঋতুস্নান শেষে কশ্যপের কাছে আসেন। তখন কশ্যপ বিনতাকে জানান যে, বালখিল্যদের প্রার্থনা অনুসারে তাঁর গর্ভে দুটি পুত্র জন্মগ্রহণ করবে। এই পক্ষীরূপী ওই দুই পুত্র পক্ষীজাতির ইন্দ্র হবে।
            [সূত্র: মহাভারত। আদিপর্ব। একত্রিংশ অধ্যায়]


যথাসময়ে
কশ্যপ বরে কদ্রু এক সহস্র নাগপুত্রের ডিম ও বিনতা দুটি ডিম প্রসব করলেন। পাঁচশ বৎসর পর কদ্রুর ডিম থেকে এক হাজার নাগ পুত্রদের জন্ম হলো। কিন্তু বিনতার ডিম থেকে কোন সন্তানের জন্ম হলো না। তাই রাগে দুঃখে তিনি একটি ডিম অসময়ে ভেঙে ফেললেন। এই ভাঙা ডিম থেকে ঊর্ধ্ব-ভাগ সম্পূর্ণ ও নিম্নভাগ অসম্পূর্ণ হয়ে অরুণের জন্ম হয়। অসময়ে এই ডিম ভাঙার জন্য অরুণ তাঁর মাকে অভিশাপ দিয়ে বলেন যে, পাঁচশত বৎসর কদ্রুর দাসী হয়ে থাকতে হবে। অরুণ আরো বলেন যে, যদি অসময়ে দ্বিতীয় ডিমটি না ভাঙা হয়, তবে উক্ত ডিম থেকে অপর যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, সেই পুত্রই বিনতার দাসত্ব মোচন করবে। অরুণের বাক্যানুসারে অপর ডিমটি থেকে গরুড়-এর জন্ম হয়। এরপর অরুণ আকাশপথে সূর্যের কাছে যান এবং সূর্যের রথের সারথি হন।
        [সূত্র: মহাভারত। আদিপর্ব। ষোড়শ অধ্যায়। অরুণ ও গরুড়ের জন্ম]

 

এরপর একদিন উচ্চৈঃশ্রবা নামক অশ্বের লেজের বর্ণ নিয়ে কদ্রুর সাথে বিনতার তর্ক উপস্থিত হলে- কদ্রু অশ্বের লেজ কালো ও বিনতা সাদা বলেন। পরের দিন এই বিষয়টি মীমাংসার জন্য উভয়ই শর্ত সাপেক্ষে রাজী হন। শর্তটি ছিল- এই তর্কে যিনি জয়ী হবেন, তাঁর অধীনে অপরজনকে দাসত্ব করতে হবে। পরদিন  উচ্চৈঃশ্রবাকে দেখতে উভয়ই অগ্রসর হলে- কদ্রু তাঁর সর্পপুত্রদের আদেশ দিলেন যে, তারা যেন উচ্চৈঃশ্রবার লেজে জড়িয়ে থেকে তা কালো বর্ণের করে দেয়। কদ্রুর এই আদেশ অনুসারে সে সকল সাপ উচ্চৈঃশ্রবার লেজে অবস্থান নেয় তারা কদ্রুর আশীর্বাদ লাভ করে। এরপর কদ্রু বিনতা উভয়ই দূর থেকে উচ্চৈঃশ্রবাকে পরীক্ষা করে- দেখতে পান যে এর লেজ কালো। তখন শর্তানুসারে বিনতা কদ্রুর দাসীতে পরিণত হয়।

দূরের সাগরপারে যখন
বিনতা যখন হেরে গিয়ে কদ্রুর দাসী হয়, সেই সময় গরুড় ডিম ফুটে বের হয়ে আসে। খুব অল্প সময়ের ভিতরে তার দেহ বৃদ্ধি পেয়ে প্রকাণ্ডরূপ ধারণ করে। এর ফলে দেবগণ এবং ঋষিগণ ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় গরুড়কে স্তূতিবাক্য দ্বারা সন্তুষ্ট করেন। এরপর গরুড়  তার নিজদেহকে সংকুচিত করে, দেবতা এবং ঋষিদের আস্বস্ত করেন। এরপর গরুড় তাঁর ভাই অরুণকে সাথে নিয়ে তাঁর মা বিনতার সাথে দেখা করতে যান। এই সময় সূর্য দেবতাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে, সারা পৃথিবী দগ্ধ করার উদ্যোগ নেন। এই কারণে গরুড় অরুণকে পূর্বদিকে নিরাপদ স্থানে রেখে আসেন।
       
 [সূত্র: মহাভারত। আদিপর্ব। ষোড়শ-চতুর্বিংশ অধ্যায়। ]
 

সূর্য সংহারক-মূর্তি ধারণ করলে রাত্রিকালেই মহাদাবদাহের সৃষ্টি হয়। দেবতা এবং ঋষিরা এই দাবদাহে উদ্বিগ্ন হয়ে ব্রহ্মার কাছে যান। ব্রহ্মা এর প্রতিকার হিসেবে অরুণকে সূর্যের রথের সারথি হিসেবে নিয়োগ করেন। এর ফলে সূর্য তেজ বৃদ্ধি করলেও অরুণ, সে তেজকে হ্রাস করে দেবেন। এরপর অরুণ রথের সারথি হলে, সূর্যের তেজ থেকে জগৎ রক্ষা পেয়েছিল।
        [সূত্র: মহাভারত। আদিপর্ব। চতুর্বিংশ অধ্যায়]