অগস্ত্য (ঋষি)
[শব্দরূপ: অভিধান অগস্ত্য]

হিন্দু পৌরাণিক ঋষি বিশেষ। বিন্ধ্যপর্বতকে স্তম্ভিত [দেখুন : অগস্ত্য যাত্রা] করে ইনি এই নামে অভিহিত হয়ে থাকেন।  ঋকবেদের মতে— কোনো এক যজ্ঞকালে, অপ্সরী ঊর্বশী'কে দেখে যজ্ঞকুম্ভে আদিত্য ও  বরুণ-এর বীর্যপাত হয়। ফলে, যজ্ঞকুম্ভ থেকে বশিষ্ঠ ও অগস্ত্য-এর জন্ম হয়। সে হিসাবে অগস্ত্যকে মিত্র (তেজময় সূর্য) ও বরুণের পুত্র বলা হয়। ভাগবতে- অগস্ত্যকে পুলস্তের পুত্র বলা হয়েছে।       

অগস্ত্য প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি কখনো বিবাহ করবেন না। একদিন ভ্রমণ করতে করতে তিনি একটি গুহামুখে এসে উপস্থিত হন, গুহার ভিতরে তাঁর পূর্বপুরুষদের অধোমুখে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পেলেন। পূর্ব-পুরুষদের কাছে এরূপ অবস্থার কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন যে,অগস্ত্য বংশ রক্ষা করছে না বলেই, তাঁরা এই শাস্তি ভোগ করছে। এরপর অগস্ত্য তাঁর পূর্ব-পুরুষদেরকে আশ্বাস দিলেন যে, তিনি বিবাহ করে সন্তান উৎপাদন করবেন। এরপর বিবাহের উপযুক্ত কন্যা পাওয়া উদ্দেশ্যে, তিনি পৃথিবীর সকল প্রাণীর সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠ অংশ নিয়ে একটি নারী নির্মাণ করলেন। সকল প্রাণীর সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠ অংশের লোপ (অপহরণ) করে সৃষ্টি হয়েছিল বলে এই নারীর নাম রাখা হয়েছিল লোপামুদ্রা

অগস্ত্য তাঁর সৃষ্ট লোপামুদ্রাকে প্রতিপালনের জন্য বিদর্ভরাজের উপর ভার দিলেন। এই কন্যা বিবাহযোগ্যা হলে, অগস্ত্য তাঁকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করলেন। একদিন ঋতুস্নান শেষে লোপামুদ্রা অগস্ত্যের কাছে এলে, অগস্ত্য সন্তান কামনায় তাঁকে আহ্বান করলেন। লোপামুদ্রা বললেন যে, পিতৃগৃহে (বিদর্ভরাজের গৃহে) যেরূপ তিনি যেরূপ অলঙ্কারে বিভূষিতা হয়ে শয়ন করতেন, তেমনি করে বিভূষিতা করতে হবে। নইলে তাঁকে অগস্ত্য কখনোই পাবেন না। অগস্ত্যের কাছে যথেষ্ঠ পরিমাণ সম্পদ না থাকায়, তিনি ভিক্ষায় বের হলেন। কিন্তু কোথাও যথেষ্ঠ অর্থ না পেয়ে, অনেকের পরামর্শে তিনি দানবরাজ ইল্বলের কাছে এলেন।

উল্লেখ্য, একবার এক তপস্বী ব্রাহ্মণের কাছে ইল্বল এমন একটি বর চেয়েছিলেন, যাতে তাঁর একটি ইন্দ্রের মতো পুত্র জন্মে। ব্রাহ্মণ এতে সম্মত না হলে, ইল্বল প্রথমে মায়াবলে তাঁর ভাই বাতাপি-কে মেষে রূপান্তরিত করেন। এরপর উক্ত মেষের মাংস রান্না করে ব্রাহ্মণকে খেতে দিলেন। ব্রাহ্মণের খাওয়া শেষে, ইল্বল বাতাপি'র নাম ধরে ডাকলে, বাতাপি ব্রাহ্মণের পেট ফুঁড়ে বের হয়ে আসেন। ফলে, ব্রাহ্মণের মৃত্যু হয়। এইভাবে, ইল্বল ও বাতাপি সম্মিলিতভাবে অনেক ব্রাহ্মণকে হত্যা করেছিলেন। ইল্বল তাঁকে যথেষ্ঠ আদর আপ্যায়ন করে ভোজনের জন্য অনুরোধ করলেন। একই ভাবে ইল্বল অগস্ত্যকে হত্যা করার জন্য মেষরূপী বাতাপি'র মাংস— অগস্ত্যকে দিয়েছিলেন। অগস্ত্যের খাওয়া শেষে ইল্বল বাতাপি'কে উচ্চস্বরে ডাকতে লাগলেন। কিন্তু বাতাপি অগস্ত্যের পেট থেকে বের হলো না। তখন অগস্ত্য জানালেন যে, বাতাপি সম্পূর্ণরূপে হজম হয়ে গেছে। এতে ইল্বল ভীত হয়ে, অগস্ত্যকে তার বাঞ্ছনীয় সম্পদ দান করে বিপদমুক্ত হন। এরপর লোপামুদ্রাকে অলঙ্কারে বিভূষিতা করে তাঁর সাথে মিলিত হলেন। যথা সময়ে এঁদের একটি পুত্রের জন্ম হলো। এই পুত্রের নাম রাখলেন— দৃঢ়স্যু।

অগস্ত্যের জীবনের সাথে বহু পৌরাণিক কাহিনী জড়িত আছে। যেমন—
ক. অগস্ত্যযাত্রা : ভারতের আর্য্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্যের মধ্যস্থলে বিস্তৃত পারবত্য অঞ্চলে রয়েছে বিন্ধ্য পর্বতমালা। পৌরাণিক যুগে বিন্ধ্যপর্বত সমস্ত পর্বতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও মাননীয় ছিল। একদিন দেবর্ষি নারদ বিন্ধ্যের কাছে এসে বলেন যে, সুমেরু পর্বতের সমৃদ্ধি বিন্ধ্যের অপেক্ষা বেশি। সমস্ত দেবতা সুমেরুতে দিন যাপন করেন ও সূর্য সমস্ত নক্ষত্রকে নিয়ে এই পর্বত পরিভ্রমণ করেন। এ কথা শোনার পর বিন্ধ্য সূর্যকে বললেন যে, উদয়াস্তকালে সুমেরু পর্বতের মতো করে তাঁকেও প্রদক্ষিণ করতে হবে। সূর্য এতে অসম্মত হলে, বিন্ধ্য নিজ দেহকে বর্ধিত করে সূর্যের পথ রোধ করে ফেললেন। ফলে সূর্যের উত্তাপে পর্বতের একদিকে জ্বলে পুড়ে যেতে থাকলো, অন্যদিকে প্রচণ্ড শীত ও অন্ধকারে জীবন বিপন্ন হয়ে পড়লো। দেবতারা এর প্রতিকারের উপায় না দেখে অগস্ত্যের শরণাপন্ন হলেন, অগস্ত্য বিন্ধ্যপর্বতের কাছে এলেন। উল্লেখ্য অগস্ত্য ছিলেন বিন্ধ্যপর্বতের গুরু। অগস্ত্যকে দেখে বিন্ধ্য গুরুভক্তিতে তাঁর মস্তক অবনত করলে, অগস্ত্য তাঁকে বললেন যে,— যতক্ষণ তিনি প্রত্যাবর্তন না করবেন, ততক্ষণ সে (বিন্ধ্য) এরূপ অবনতমস্তকে থাকবে। বিন্ধ্যকে এই অবস্থায় রেখে অগস্ত্য ১লা ভাদ্র তারিখে দক্ষিণদিকে যাত্রা করেন এবং কখনোই আর সেখানে ফিরে আসেন নি। অগস্ত্যের এই চির-প্রস্থানের কাহিনী অনুসারে বাংলাতে অগস্ত্যযাত্রা বাগধারা প্রচলিত রয়েছে।  

খ. অগস্ত্য কর্তৃক রামকে অস্ত্র দান : রাম বনবাসকালে, অগস্ত্যের আশ্রমে উপস্থিত হলে— ইনি রামকে বৈষ্ণবধনু, ব্রহ্মাস্ত্র, অক্ষয়তূণ দান করেন এবং এঁরই পরামর্শে, রাম গোদাবরী তীরে পঞ্চবটী বনে কুটির নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন।  

. রাজা নহুষের পতন: একবার ইন্দ্র ব্রহ্মহত্যার অভিশাপে সমুদ্রের মধ্যে বসবাস করছিলেন। এই সময় রাজা নহুষকে স্বর্গের রাজা করা হয়। রাজত্ব লাভের পর, নহুষ ইন্দ্রের পত্নী শচীকে ভোগ করার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন। শচী নহুষের কামনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বৃহস্পতি-র শরণাপন্ন হন। বৃহস্পতির পরামর্শে শচী নহুষকে বলেন যে, যদি নহুষ সাতজন ঋষি দ্বারা পরিচালিত রথে আরোহণ করে তাঁর কাছে আসেন, তবেই তিনি তাঁকে (নহুষকে) গ্রহণ করবেন। নহুষ সেই ব্যবস্থামতে রথে আরোহণ করেন। ওই রথের সাতজন ঋষির মধ্যে, অগস্ত্যও ছিলেন। হঠাৎ নহুষের পা অগস্ত্যের দেহ স্পর্শ করলে, ক্রুদ্ধ অগস্ত্য রাজাকে ‘সর্প হও’ অভিশাপ দেন। অভিশাপগ্রস্থ নহুষ, অগস্ত্যের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে, অগস্ত্য বলেন, যুধিষ্ঠির -এর স্পর্শে সে শাপ মুক্ত হবে।   
 

. অগস্ত্যর সমুদ্র পান : ইন্দ্র কর্তৃক বৃত্রাসুর নিহত হওয়ার পর, কালকেয় এবং অন্যান্য অসুররা দেবতাদের ভয়ে সমুদ্রের মধ্যে লুকিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। কিন্তু প্রতি রাত্রে এরা সমুদ্র থেকে উঠে এসে দেবতাদের উপর অত্যাচার চালাতো। এই অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেবতারা অগস্ত্যের শরণাপন্ন হন। দেবতাদের অনুরোধে অগস্ত্য সমুদ্রের সমস্ত পানি পান করলে, দেবতারা শুকনো সমুদ্রতলের অসুরদেরকে হত্যা করতে সমর্থ হন।