মোহিনী চৌধুরী
(১৯২০-১৯৮৭)
প্রসিদ্ধ বাঙালি কবি, গীতিকার ও চিত্র পরিচালক।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর (রবিবার ২০ ভাদ্র ১৩২৭) বর্তমান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
পিতার নাম
মতিলাল চৌধুরী, মায়ের নাম গোলাপকামিনী দেবী। এঁদের চার ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মোহিনীর অবস্থান তৃতীয়।
মোহিনী চৌধুরীর লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়েছিল গ্রামের পাঠশালায়। এরপর পিতার সাথে তাঁর
কর্মস্থলে কলকাতায় চলে আসেন। পিতা মতিলাল কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ভাড়া-বাড়িতে
থাকতেন। এই সূত্রে মোহিনীকে প্রবেশিকা পর্যন্ত ৪টি স্কুল বদলাতে হয়। এই
স্কুলগুলো হলো- প্রথমে পঞ্চানন ইনস্টিটিউশন, সরস্বতী ইনস্টিটিউশন। সবশেষে তিনি রিপন
কলেজ-স্কুল (সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে থেকে স্টার-মার্কস এবং মাসিক দশ টাকা বৃত্তি-সহ,
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৯তম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
এবং এই কলেজে আইএইএসসি ক্লাসে ভর্তি হন। ১৩৩৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বিভাগে আইএইএসসি পাশ করেন।
পরীক্ষায় এত ভালো ফল করার পরও, আর্থিক অনটনের কারণে চাকরিতে প্রবেশ করতে হয়।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে জেনারেল পোস্ট অফিসে কেরানির পদে চাকরি শুরু করেন। ১৯৪১
খ্রিষ্টাব্দে সহকর্মী হিসেবে পান কথাশিল্পী শক্তিপদ রাজগুরু। পরে
উভয়ের ভিতরে গভীর বন্ধুত্ব সৃষ্টি
হয়েছিল। এই সময় থেকে মোহিনী কবিতা ও গান লেখা শুরু করেন। আর শক্তিপদ রাজগুরু
গল্প লেখা শুরু করেন।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর রচিত প্রথম দুটি
গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল। গান দুটি হলো- রাজকুমারী ওলো নয়নপাতা খোল, সোনার টিয়া ডাকছে গাছে ওই বুঝি ভোর হল।
গান দুটির সুরকার ছিলেন কমল দাশগুপ্ত। শিল্পী ছিলেন কুসুম গোস্বামী।
১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে কমল দাশগুপ্তের সুরে মোহিনী চৌধুরীর দুটি গানের রেকর্ড প্রকাশিত
হয়েছিল। গান দুটি হলো- 'ভুলি নাই ভুলি নাই', 'নয়ন তোমায় হারায়েছি প্রিয়া স্বপনে তোমারে পাই'
গান দুটি গেয়েছিলেন
জগন্ময় মিত্র । এই গান দুটি প্রকাশের পর মোহিনী চৌধুরী গীতিকার
অসম্ভব জনপ্রিয়তা পান। এই বছরে ১২ই জুলাই তিনি
কোটালিপাড়ার রতাল গ্রামের সুরেশচন্দ্র কাব্যতীর্থের প্রথমা কন্যা
লীলাদেবীকে বিবাহ করেন।
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়-এর
পরিচালিত ''অভিনয় নয়' নামক
চলচ্চিত্রের জন্য গান রচনা করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। ছবিতে ব্যবহৃত সাতটি গানের ভিতরে ৫টি গান রচনা করেছিলেন মোহিনী চৌধুরী।
এরপর
থেকে নিয়মিতভাবে গ্রামোফোন রেকর্ড, কলকাতা বেতার এবং এবং চলচিত্রের অন্যতম গীতিকার
হিসেবে গান লেখা শুরু করেন। গান রচনার জন্য সময় দেওয়ার জন্য, তিনি জেনারেল পোস্ট অফিসের
চাকরি ছেড়ে দেন।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়-এর
পরিচালিত
একই গ্রামের ছেলে ছবির জন্য গান রচনা করেন।
১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে জেনারেল পোস্ট অফিসের চাকরি ছেড়ে দেন। শচীন দেব বর্মণ তখন পাকাপাকি
ভাবে মুম্বাইয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে। কারণ এই সময় নিজেই
একটি ছবি তৈরির কথা ভাবছিলেন। এই সূত্রে ‘সাধনা’ নামক একটি ছবির কাজ শুরু করেন। এই
ছবি শেষ করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যান। পাওনাদারদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে তাঁর বাবা
তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেনে। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে দেউলিয়া মোহিনী চেতলায় এক
ভাড়াবাড়ির এক কামরার ঘরে কোনও রকমে মাথা গুঁজলেন। এর ভিতরে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়-এর
পরিচালিত
ব্লাইন্ড লেন
ছবির জন্য তিনি গান রচনা করেন।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে
দিয়ে তিনি বিজ্ঞানী এবং সাংসদ
মেঘনাদ সাহার সংসদীয় সচিবের পদ নিয়ে দিল্লী যান।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পরিচালিত 'সাধনা'
ছবিটি মুক্তি পেলেও ব্যবসায়িক সফলতা থেকে বঞ্চিত হয়। এর তিনি
মেঘনাদ সাহার সংসদীয় সচিবের পদ ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন এবং শিল্পপতি
দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের 'বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল-এ যোগদান
করে। এখানে তিনি দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের একান্ত সচিবের কাজ করেছেন।
এরই মধ্যে তাঁর দুই বছরের শিশুপুত্র আগুনে পুড়ে
মারা গেল।
দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তখন বেশ কিছু সিনেমার প্রযোজক ছিলেন। তাঁর মাধ্যমে পরিচয়
হয়েছিল
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। হেমন্ত তাঁকে ‘নায়িকা সংবাদ’ ছবির জন্য দুটো গান লিখে
দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তাঁর লেখা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গলায় ‘কী
মিষ্টি দেখো মিষ্টি কী মিষ্টি এ সকাল’ আর ‘কেন এ হৃদয় চঞ্চল হল’ দুটো গানই অসম্ভব
জনপ্রিয়তা পায়। এর পর ‘শুকসারী’ ছবিতে
উত্তম কুমারের জন্য লিখেছিলেন ‘সখি চন্দ্রবদনী, সুন্দরী ধনি...’
গানটি। এটিই ছিল মোহিনীর লেখা শেষ সাড়া জাগানো গান।
এরপর দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের
চাকরিটা চলে গেলে তিনি ফের অসহনীয় দারিদ্র দশায় পড়েন।
১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে মে তিনি চরম হতাশার মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন।
মোহিনী চৌধুরীর
গানের তালিকা