জগন্ময় মিত্র
(১৯১৮-২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে)
সুরকার, সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক।

১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৬ সেপ্টেম্বর কলকাতার চেতলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম যতীন্দ্রনাথ মিত্র। তাঁর জন্মের আগে যতীন্দ্রনাথ মৃত্যুবরণ করেন। কলকাতায় এঁদের আদি আবাস ছিল কলকাতার আপার সারকুলার রোডে, পরে বাড়ি বদল করে বালিগঞ্জে বসতি গড়েন। পৈতৃক বাড়ি ছিল ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবার মহকুমার মালা গ্রামে ।

স্কুলের লেখাপড়া শুরু হয় বালিগঞ্জের জগবন্ধু ইনস্টিটিউশনে। পরে ভর্তি হন চেতলা বয়েজ এইচ. ই. স্কুলে। শৈশবে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি সঙ্গীতের পাঠ নিয়েছিলেন তাঁর  পিতামহ বিধুভূষণ মিত্র এবং কাকা পঞ্চানন মিত্রের কাছে।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি কেশব মুখোপাধ্যায়ের কাছে ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুংরি, টপ্পা ইত্যাদির তালিম নেন।
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে চেতলা বয়েজ এইচ. ই. স্কুল থেকে। তিনি এন্ট্রান্স পাশ করেন।

১৯৩৬-৩৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি রেডিওতে গান গাওয়া শুরু করেন।

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বেঙ্গল মিউজিক অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় ধ্রুপদ, টপ্পা, ঠুংরি, রাগ প্রধান বাউল ও কীর্তনের প্রতিটি বিভাগে প্রথম হন। তবে আধুনিক তিনি তৃতীয় হয়েছিলেন। একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে দিলীপ কুমার রায় জগন্ময়ের গান শুনে মুগ্ধ হন এবং তাঁর কাছে গান শিখবে কিনা তা জানতে চান। জগন্ময় এই প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হলে- তিনি দিলীপ কুমার রায়র কাছে তালিম নেওয়া শুরু করেন। কিছুদিন পর দিলীপ কুমার রায় পণ্ডীচেরীতে তাঁর গুরু অরবিন্দ ঘোষের আশ্রমে চলে যান। যাওয়ার আগে তিনি সেকালের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত গুরু ভীষ্মদেব চট্টাপাধ্যায়ের কাছে গান শেখার ব্যবস্থা করে দিয়ে যান।

ভীষ্মদেব চট্টাপাধ্যায়ের যখন 'ফিল্ম কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া' কোম্পানির সঙ্গীত পরিচালক হন, তখন চলচ্চিত্রে গান  গাওয়ার সুযোগ লাভ করেন। এই কোম্পানির হিন্দি ছবি 'গরীবী'-তে গান গেয়েছিলেন।

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্টাব্দে প্রয়াগ সঙ্গীত সম্মেলনে খেয়াল গানের প্রতিযোগী হিসেবে নাম লেখান-

এই বছরেই তিনি এইচএমভিতে গান রেকর্ড করার সুযোগ পান। প্রণব রায়ের কথায় কমল দাসগুপ্তের সুরে ‘প্রিয় হতে প্রিয়তর’ এবং ‘তোমার মতন কত না নয়ন’ গান দুটির জন্য বিখ্যাতি হয়ে উঠেন। গানের সূত্রে কাজী নজরুল ইসলাম-এর সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। পরে বেশ কিছু নজরুলের গান তাঁর কণ্ঠে রেকর্ড হয়েছিল।

উল্লেখ্য, ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষের কাজী নজরুল ইসলাম-এর সাথে পরিচয় তাঁরপ্রসঙ্গে তিনি তাঁর 'শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে' গ্রন্থে [প্রতিভাস, কলকাতা। পৃষ্ঠা: ৩২-৩৪]আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থ মতে- এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি রেকর্ড কর্মকর্তা হেমচন্দ্র সোম, নজরুলের সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথম পরিচয় প্রসঙ্গে জগন্ময় মিত্র লিখেছেন-
'...কাজীদা জিজ্ঞাসা করলেন, 'কিছু ঠিক করেছিস কী গাইবি? একটু ইতস্তত করে বললাম, "আমি দু-একটা গান লিখে সুর করেছি।" কাজীদা বললেন, আচ্ছা শোনা"
জগন্ময় তাঁর লেখা সুরে গানটি শোনালেন। গানটি হলো- যদি বাসনা মনে দিবে দহন জ্বালা/তবে মনের কোণে কেন বাসিলে ভালো। নজরুল গানটি শোনার পর সুরের প্রশংসা করলেও বাণীর প্রশংসা করতে পারেন নি। তারপর নজরুল তিনি গানটি কয়েকবার জগন্ময়ের কাছে শুনে, সেই সুরের উপর 'শাওন রাতে স্মরণে আসে মোরে' গানটি রচনা করেছিলেন। এই গানটির সুর সম্পর্কে জগন্ময় লিখেছেন- 'আমার গুরু ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় একবার একটা গান আমাদের গেয়ে শুনিয়েছিলেন। সেটি হলো- 'আজি ঝরলা' । রাগের নাম বলেছিলেন, যতদূর মনে আছে 'ঝঞ্ঝা-মল্লার।'  অর্থাৎ মল্লার ঘরের কোনো একটি রাগ। ঝঞ্ঝা-মল্লার নামটা ঠিক শুনেছিলাম কি না, এখন সন্দেহ পোষণ করি। কারণ, এ নাম আর কোনো জায়গায় শুনতে পাইনি...।' কবি নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [জুন ২০১৮, পৃষ্ঠা ৪]-এ গানটির শিরোনামে রাগ 'চর্জ্যু কি মল্লার' উল্লেখ আছে।

জগ্মময় মিত্রের উল্লেখিত গ্রন্থ থেকে জানা যায় গানটি রেকর্ড করা হয়েছিল '১৮-৫-৩৯' তারিখে। গানটি রেকর্ড হয়েছিল আগে, কিন্তু রেকর্ডে প্রকাশিত হয়েছিল পরে। কারণ, রেকর্ডের এই গানের জুড়ি গান ছিল- অজয় ভট্টাচার্যের লেখা 'সন্ধ্যা যখন নামে গোপন পায়'। একই রেকর্ডে দুই রচয়িতার গান প্রকাশিত হলে- স্বত্বাধিকারের অর্থ ভাগাভাগি হতো। এই অসুবিধা দূর করার জন্য রেকর্ডে কোম্পানি নজরুলের রচিত অপর একটি গান 'গুনগুনিয়ে ভ্রমর এলো [তথ্য]' রেকর্ড করে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। আর উভয় গান মিলে রেকর্ডি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে।

 ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে মাঝামঝি সময়ে হেমচন্দ্র সোম তাঁকে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার অনুমতি নেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে যান। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান শুনে- প্রথমাবস্থায় দুটি গানের রেকের্ড করার অনুমতি দেন। গান দুটি হলো-

এই গান দুটি গানের রেকর্ড ডামি শুনে রবীন্দ্রনাথ রেকর্ড চূড়ান্ত করে দেন। এই রেকর্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসের ২৭ তারিখে।  এরপর রবীন্দ্রনাথের অনুমতিক্রমে আরও দুটি গান রেকর্ড করেন। গান দুটি হলো-

এরপরে তিনি আরও দুটি রবীন্দ্রনাথে গান রেকর্ড করেন। গান দুটি হলো- 'প্রথম আদি তব শক্তি' ও ভেঙেছে দুয়ার এসেছে জ্যোতির্ময়। এর ভিতরে ;প্রথম আদি তব শক্তি' গানটি তিনিই প্রথম রেকর্ডে গিয়েছিলেন।

১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে তিনি গীতা দে'কে বিবাহ করেন।

রেকর্ডের তাঁর গাওয়া দীর্‌ঘবাদন ২টি শোকগাঁথা-মূলক গান তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। এই গান ২টি হলো-
‘চিঠি’ (১৯৪২), ‘সাতটি বছর আগে’ ‘সাতটি বছর পরে’ (১৯৪৮)। গান দুটির রচয়িতা ছিলেন প্রণব রায়

২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

জগ্নময় মিত্রের গাওয়া উল্লেখযোগ্য গান

  • আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড় [১৯৫৫] কথা: মোহিনী চৌধুরী। সুর: কমল দাশগুপ্ত
    আমি স্বপন দেখেছি [১৯৫০] কথা: চারু মুখোপাধ্যায়। সুর: জগন্ময় মিত্র
  • গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায় [১৯৫১] কথা: কাজী নজরুল ইসলাম। সুর: কমল দাশগুপ্ত
  • জানি জানি গো [১৯৪২] কথা: সুবোধ পুরকায়স্থ। সুর: কমল দাশগুপ্ত
  • জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা [নজরুল ইসলাম] [তথ্য]
  • তুমি আজ কত দূরে [চিঠি – ১, ২] [১৯৪৮] কথা প্রণব রায়। সুর: সুবল দাশগুপ্ত
  • তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন [১৯৪৪] [কথা: প্রণব রায়। সুর: কমল দাশগুপ্ত]
  • তোমারে তো আজও ভুলি নাই [১৯৪৩] কথা: প্রণব রায়। সুর: কমল দাশগুপ্ত
  • প্রথম প্রদীপ জ্বালো [নজরুল ইসলাম] [তথ্য]
  • প্রিয় যদি নাহি আসে [১৯৪৩] কথা: হরেন ঘটক। সুর: গোপেন মল্লিক
  • প্রেমের না হবে ক্ষয় [১৯৪১] কথা: শৈলেন রায়। সুর হিমাংশু দত্ত
  • বাঁশরি কি বাজিবে না [১৯৫৫] কথা: চারু মুখোপাধ্যায়। সুর: জগন্ময় মিত্র
  • ভালবাসা মোরে ভিখারি করেছে [১৯৪৬] কথা: মোহিনী চৌধুরী। সুর: কমল দাশগুপ্ত
  • ভুলি নাই ভুলি নাই [১৯৪৪] কথা: মোহিনী চৌধুরী। সুর: কমল দাশগুপ্ত]
  • মেনেছি গো হার মেনেছি [১৯৪৩] কথা: সুবোধ পুরকায়স্থ। সুর: কমল দাশগুপ্ত
  • যাদের জীবন ভরা শুধু আঁখিজল [১৯৫৫] কথা: মোহিনী চৌধুরী। সুর: কমল দাশগুপ্ত
  • সাতটি বছর আগে [১৯৪২]  কথা: প্রণব রায়। সুর: সুবল দাশগুপ্ত
  • শাওন রাতে যদি [১৯৪০] কথা নজরুল ইসলাম। সুর: জগন্ময় মিত্র
  • সাতটি বছর পরে [১৯৪২] কথা: প্রণব রায়। সুর: সুবল দাশগুপ্ত
  • স্বপন সুরভী মাখা [১৯৫০] কথা: শৈলেন রায়। সুর: জগন্ময় মিত্র

সূত্র:
  • সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড,অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি-২০১৯ পৃষ্ঠা ১৩৬।
  • শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে। জগন্ময় মিত্র। প্রতিভাস। কলকাতা। ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫।