অরবিন্দ ঘোষ, শ্রীঅরবিন্দ
(১৮৭২-১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ)
ব্রিটিশ ভারতের প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা ও যোগী।

১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগষ্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কৃষ্ণধন ঘোষ ছিলেন তৎকালীন বাংলার রংপুর জেলার জেলা সার্জন। মা স্বর্ণলতা দেবী ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্ম অনুসারী ও সমাজ সংস্কারক রাজনারায়ণ বসুর কন্যা।

১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর দুই অগ্রজ মনমোহন ঘোষ এবং বিনয়ভূষণ ঘোষের সাথে তাঁকে দার্জিলিং-এরলোরেটো কনভেন্টে লেখাপড়ার জন্য পাঠানো হয়। এই স্কুলে দুই বছর লেখাপড়া করার পর, ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর এই দুই সহোদর-সহ তাঁকে বিলেতের ম্যাঞ্চেস্টার শহরে পাঠান হয়। এই শহরের জনৈক রেভারেন্ড এবং শ্রীমতি ড্রিয়ুইটের তত্ত্বাবধানে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ড্রিয়ুইট পরিবার এই তিন ভাইকেই ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষাদান করেন।

১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে অরবিন্দ লন্ডনের সেইন্ট পলস স্কুলে ভর্তি হন এবং এই স্কুল থেকে তিনি গ্রিক, লাতিন এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া করেন।  এরপর তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কিংস কলেজের বৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করেন এবং আইসিএস এর লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হন। এই সময় তিনি আইসিএস পাশ করে ব্রিটিশদের সেবা করতে হবে, এই কথা ভেবে তিনি নিজেকে অপরাধী ভাবতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত তিনি অশ্বারোহণ পরীক্ষায় হাজির না হয়ে অকৃতকার্য হন। এই সময় বারোদার মহারাজ তৃতীয় সায়াজিরাও গায়কোয়াড় বিলেত ভ্রমণ করছিলেন। তিনি মহারাজের সাথে দেখা করে বারোদা স্টেস সার্ভিসে যোগদানের ব্যবস্থা করেন। এই সূত্রে তিনি জাহাজে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে অরবিন্দর বাবা বোম্বের এজেন্টের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, পর্তুগালের উপকূলে অরবিন্দের জাহাজডুবি ঘটেছে। এই খবরে তাঁর পিতা তীব্র মানসিক আঘাত পান এবং মৃত্যুবরণ করেন। এই বছরেই তিনি বারোদার সার্ভিস এন্ড সেটলমেন্ট বিভাগে যোগদান করেন। পরে তিনি এই স্টেটের কোষাগার পদ লাভ করেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি সচিবালয়ে গায়কোয়াড়ের জন্য বক্তৃতা লেখার কাজে নিযুক্ত হন। বরোদায় থাকার সময় তিনি মহারাষ্ট্রের গুপ্ত বিপ্লবী দলের নেতা ঠাকুর সাহেবের কাছে বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষা নেন।

১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি গুপ্ত বিপ্লবী দল গঠনের উদ্যোগ নেন। এই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য তিনি যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কলকাতায় পাঠান। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে অরবিন্দের নির্দেশ অনুসরণ করে যতীন্দ্রনাথ একটি গুপ্ত দল গঠন করতে সক্ষম হন।

ইতিমধ্যে ব্যারিষ্টার প্রমথনাথ মিত্র কলকাতায় বিপ্লবী দল হিসেবে '
অনুশীলন সমিতি' স্থাপন করেন। উল্লেখ্য এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মার্চ। এই সমিতির কথা যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অরবিন্দকে জানান। এরপর অরবিন্দের নির্দেশে তাঁর অনুসারীরা  'অনুশীলন সমিতি'- যোগদান করেন। ধীরে ধীরে কলকাতার ছোট ছোট ক্লাব ও সংগঠন 'অনুশীলন সমিতি'তে যোগদান করে। সংগঠনের কার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য একটি পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়। এর সভাপতি ছিলেন ব্যারিষ্টার প্রমথনাথ মিত্র, সহ-সভাপতি ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ ও অরবিন্দ ঘোষ। আর কোষাধ্যক্ষ ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে যতীন্দ্রনাথকে সহায়তা করার জন্য, অরবিন্দ তাঁর ছোটো ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে কলকাতায় পাঠান। অরবিন্দ বরোদায় থাকলেও সংগঠনের জন্য মাঝে মাঝে কলকাতায় আসতেন। 'অনুশীলন সমিতি' আদর্শকে যুবসমাজের ভিতর ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ করেন। এর মাধ্যমে তিনি অখণ্ড বঙ্গদেশে আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সূত্রে অখণ্ড বাংলায় যে জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়, অরবিন্দ তার সুযোগ নিয়ে বাংলায় 'অনুশীলন সমিতি'-কে সুংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। তিনি ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে 'ভবানী মন্দির' নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। এই পুস্তিকায় তিনি পার্বত্য অঞ্চলে মা ভবানীর একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব করেন। এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে, যুবকরা স্বদেশী ভাবনায় সংগ্রামী হয়ে উঠবেন, এটাই তিনি মনে করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত 'ভবানী মন্দির প্রতিষ্ঠিত না হলেও, বাংলার হিন্দু যুবকদের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে অনেকাংশে সক্ষম হয়েছিলেন।

'
অনুশীলন সমিতি'- কে গতিময় করার জন্য তিনি ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে বরোদা থেকে কলকাতায় এসে বাস করা শুরু করেন। এই সময় কংগ্রসের ভিতরে একটি চরমপন্থী দলের উদ্ভব হয়। এই দলটি অনানুষ্ঠানিক নাম ছিল 'নিউ পার্টি'। কলকাতায় আসার পর অরবিন্দ এই দলের অন্যতম নেতায় পরিণত হন। পরে প্রায় প্রকাশ্যে এই 'নিউ পার্টি'র নাম দেওয়া হয় 'ন্যাশনালিষ্ট'।  এই দলের পক্ষ থেকে ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে অরবিন্দ প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন 'পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করাই ভারতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য'। এই বছরেই তিনি নবপ্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন।

'
অনুশীলন সমিতি' আদর্শকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, বারীন্দ্র ঘোষ একটি পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তাব করেন। পরে অরবিন্দের সমর্থনে 'যুগান্তর' নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই মার্চ থেকে 'যুগান্তর' প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা জুলাই আপত্তিকর প্রবন্ধ ছাপানোর অভিযোগে পুলিশ যুগান্তর কার্যালয়ে খানাতল্লাস চালায়। এই সময় সরকার ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে পত্রিকার সম্পাদক মনে করে গ্রেফতার করে। অরবিন্দের পরামর্শ ক্রমে ব্রিটিশ আদালতে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত কোনো ধরনের বিবৃতি দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। একই সাথে অরবিন্দ তৎকালীন 'বন্দেমাতরম' পত্রিকায় ব্রিটিশ বিরোধী লেখা অব্যাহত রাখেন। যুগান্তরের কিছু কিছু প্রবন্ধ 'বন্দেমাতরম' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।  সরকার এই পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে অরবিন্দকে সন্দেহ করে এবং ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই আগষ্ট তাঁকে গ্রেফতার করে। এই সন্দেহকে প্রমাণ করার জন্য এই পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক বিপিনচন্দ্র পালকে সাক্ষী হিসেবে ডাকা হয়। কিন্তু বিপিনচন্দ্র পাল সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন। প্রমাণের অভাবে অরবিন্দ মুক্তি পান।

১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে 'বন্দেমাতরম' পত্রিকায় রাজদ্রোহমূলক প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য, তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তিনি এই মামলা থেকে মুক্তি লাভ করেন।  এরপর তিনি সনাতন ধর্ম প্রচার ও জাতীয়দল পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন। এই সূত্রে তিনি ইংরেজি সাপ্তাহিক 'কর্মযোগিন' এবং এবং বাংলা 'ধর্ম' পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এরপর তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ত্যাগ করেন এবং ফরাসী মহিলা মাদাম পল রিশার (শ্রীমা) সাথে পণ্ডিচেরীতে আশ্রম গড়ে তোলেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই ডিসেম্বরে এই আশ্রমে তিনি দেহত্যাগ করেন।