সংগঠনের প্রথমাবস্থায় এই দলের অন্যতম মন্ত্রণাদাতা ছিলেন
সতীশচন্দ্র বসু
ও অরবিন্দ ঘোষ। বরোদার
মহারাজার আর্মি বাহিনী থেকে সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত তরুণ বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ
ব্যানার্জী ও অরবিন্দ ঘোষের ছোট ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষ তাঁকে এটি প্রতিষ্ঠায়
সহযোগিতা করেন। পরবর্তী সময়ে এই সংগঠনের সাথে যুক্ত হন−
বিপিনচন্দ্র পাল,
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্দ্রচন্দ্র
মল্লিক, সরলাদেবী,
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
এই সমিতির প্রথম দিকে শরীরচর্চার মধ্যে
সীমাবদ্ধ থাকলেও, পরে সেনাবাহিনীর মতো করে একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীতে রূপ দেওয়ার
চেষ্টা করা হয়। এই সমিতিতে আগত যুবকদের অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে এদের
নিয়ে তৈরি করা হয়, 'জাতীয় স্বেচ্ছাসৈন্যবাহিনী'।
১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে
অরবিন্দ
পূর্ববাংলা সফর করেন। এই সময় তিনি পূর্ব-বাংলার বিপ্লবী দলগুলোর সাথে মিলিত হন এবং
ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে এঁদের সাথে আলোচনা করেন। এই সময় জাতীয় কংগ্রেস দলের
রক্ষণশীল মনোভাবের বিরোধিতা শুরু হলেম অরবিন্দ সহিংস ভাবধারাকে সমর্থন করেন। ফলে
চরমপন্থী দলটি 'নিউ পার্টি' নামে অভিহিত হতে থাকে। বলাই বাহুল্য.
মূল কংগ্রসে থেকে অহিংস কংগ্রেসীরা
পুরোপুরি মহাত্মা গান্ধীর অনুসৃত
দলে পরিণত হয়েছিল। তাঁর এই রাজনৈতিক দর্শন তাঁর শিষ্যদের ভিতরে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন।
তবে তাঁর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিল বিপ্লবীদের মধ্যে। এই প্রচারণা শেষে তিনি বরোদাতে ফিরে যান।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে
বঙ্গভঙ্গ-রদ আন্দোলনের মাধ্যমে অহিংশ বিপ্লবী উভয়
দলই নিজেদের ক্ষেত্রে প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছিল। বিশেষ করে তাঁর রচিত 'ভবানী
মন্দির' নামক একটি পুস্তিকা, একটি নতুন হিন্দু-ধর্মাবলম্বী তরুণদের বিশেষভাবে
উজ্জীবিত করেছিলেন।
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে অরবিন্দ কলকাতা থেকে পুনরায় কলকাতায় আসেন। এই বছরে তিনি প্রকাশ্যে
ঘোষণা দেন যে, 'পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করাই ভারতের রাজনঠতিক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য'।
এই উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে অরবিন্দ রাজনীতির ধারাকে দুটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এর একটি
ধারার লক্ষ্য ছিল- জাতীয় কংগ্রেস প্রকাশ্যে অহিংস পদ্ধতিতে জাতীয়তাবাদী ধারার
রাজনীতির দ্বারা তাদের অধিকারের কথা বলবেন। অন্য ধারায় থাকবে গুপ্ত সমিতির মাধ্যমে
সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। এই বছরেই অনুশীলন সমিতি তাঁদের প্রচারণার জন্য
প্রকাশে করে যুগান্তর নামক একটি
সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা।
ঢাকাতে এর এর একটি শাখা খোলা হয় তৎকালীন ন্যাশনাল স্কুলে। কালক্রমে ঢাকা-শাখা একটি শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত হয়। ঢাকা শাখার অন্যতম সংগঠক ছিলেন পুলিনবিহারী দাস ও আনন্দচন্দ্র চক্রবর্তী। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এই সমিতির কার্যক্রম তীব্রতর রূপ লাভ করে। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে এই সমিতি একটি শক্তিশালী বিপ্লবী সংগঠনে পরিণত হয়।
১৯২০ থেকে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতর এর বহু নেতা
ও কর্মী মার্ক্সবাদে দীক্ষিত হন এবং সশস্ত্র বিপ্লব থেকে সরে এসেছিলেন।
অনুশীলন সমিতির কালানুক্রমিক কার্যক্রম :
১৯০১-০২ খ্রিষ্টাব্দ: কলকাতায়
এই সংগঠনটি গড়ে উঠে।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ: লর্ড
কার্জনের বঙ্গভঙ্গ-এর সিদ্ধান্তকে অকার্যকর করার জন্য, সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে
নিয়ে, সংগঠনটি বিপ্লবী কার্যক্রম শুরু করে।
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দ: এই বৎসরের এপ্রিল মাসে, সংগঠনের কার্যক্রম প্রচার এবং জনগণকে
উদ্বুদ্ধ করার জন্য সাপ্তাহিক 'যুগান্তর'
প্রকাশ করা শুরু করে। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। এই সময় সমগ্র বঙ্গদেশে সমিতির শাখা খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
ঢাকাস্থ ‘ন্যাশনাল স্কুলে’র প্রতিষ্ঠাতা
প্রধান শিক্ষক পুলিনবিহারী দাসের নেতৃত্বে ৮০ জন হিন্দু যুবক, সেপ্টেম্বর মাসে
ঢাকায় ঢাকা অনুশীলন সমিতি গঠন করে। পুলিনবিহারী দাস কর্তৃক ঢাকা অনুশীলন সমিতি'র
পরিচালক ছিলেন।
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ:
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা জুলাই আপত্তিকর প্রবন্ধ ছাপানোর অভিযোগে পুলিশ যুগান্তর কার্যালয়ে খানাতল্লাস চালায়। এই সময় পুলিশ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে পত্রিকার সম্পাদক মনে করে গ্রেফতার করে। ২২শে জুলাই এর মকদ্দমা শুরু হলে, ভূপেন্দ্রনাথ ইংরেজের আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন থেকে বিরত থাকেন। মূলত তিনি আদালতে মামলার পক্ষ বা বিপক্ষে কোনো কিছু বলেন নি। ২৪শে জুলাই পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে, ভূপেন্দ্রনাথকে আদালত ১ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। এরপর এই পত্রিকা মুদ্রণ স্থান সাধনা প্রেস বাজেয়াপ্ত করে। এরপর যুগান্তরের কার্যালয় স্থানন্তরিত হয় কলকাতার ২৮/১ মির্জাপুর স্ট্রীটে।
৬ই ডিসেম্বর নব প্রতিষ্ঠিত পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর ট্রেনে ভ্রমণে বের হন। অনুশীলনের বিপ্লবীরা সেটি বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
২৩শে ডিসেম্বর ঢাকার প্রাক্তন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিষ্টার অ্যালেনকে হত্যা করার চেষ্টা করে।
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ
৩০শে কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট ও পরবর্তীকালে বিহারের মুজাফ্ফরপুরের জেলা জজ ডগলাস কিংসফোর্ড-কে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ভুলবশতঃ বিপ্লবীরা দুজন শ্বেতাঙ্গ মিসেস ও মিস কেনেডিকে হত্যা করে। ঘটনার সাথে জড়িত প্রফুল্ল চাকি পুলিশের কাছে ধরা না দিয়ে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু তাঁর সহযোগী ক্ষুদিরাম বসু ধরা পড়েন। পরে বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। এ ঘটনার পর থেকে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী বাংলার মহান বিপ্লবী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। এই ঘটনার সূত্রে কলকাতার মানিকতলার বাগানে একটি বোমা তৈরীর কারখানা আবিষ্কার হয়। অনুশীলন সমিতির জনৈক নেতা বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে তথাকথিত আলীপুর ষড়যন্ত্র মামলার আওতায় বিচারাধীনে আনা হয়।
১৯০৯-১০ খ্রিষ্টাব্দ:
আলীপুর মামলার সূত্রে পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় চালায়। এর ফলে অনুশীলন সমিতিতে সাময়িক বিভাজন দেখা দেয়। এই সময় পুলিশ পশ্চিমবঙ্গের সন্ত্রাসীদেরকে যুগান্তরের নামানুসারে যুগান্তর দল এবং পূর্ববঙ্গের সন্ত্রাসীদেরকে ঢাকা অনুশীলন সমিতি বলে চিহ্নিত করে। পশ্চিমবঙ্গের এই বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের পর হতে কিছু কালের জন্য কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র পূর্ববঙ্গে স্থানান্তরিত করা হয়। পুলিনবিহারী দাসের সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য ঢাকা অনুশীলন সমিতি দ্রুত প্রসার লাভ করে।
১৯১৩
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে ১৪ ডিসেম্বর: অতীন্দ্রমোহন রায়ের পরিকল্পনায় কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে হত্যা করেন অষ্টম শ্রেণির শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী। সূত্র : অতীন্দ্রমোহন রায়।
১৯২৫
সূত্র :
আমি সুভাষ বলছি। শৈলেশ দে
শিশু-বিশ্বকোষ (প্রথম খণ্ড)। বাংলাদেশ শিশু একাডেমী। আষাঢ় ১৪০২, জুন ১৯৯৫।
অগ্নিযুগের অগ্নিকথা 'যুগান্তর'। সংকলক ও সম্পাদক অংশমান রায়। শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম প্রকাশনা বিভাগ, সেপ্টেম্বর, ২০০১।