অনুশীলন সমিতি
ব্রিটিশ ভারতের একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন।

১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মার্চ (সোমবার ১০ চৈত্র ১৩০৮) এই সমিতি তৈরি হয়েছিল সতীশচন্দ্র বসুপ্রমথনাথ মিত্রের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়।

১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'আনন্দমঠ উপন্যাসের সূত্রে তৎকালীন বাঙালি তরুণ সমাজ বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবীত হয়ে উঠেছিলেন। সতীশচন্দ্র বসু এঁদেরই একজন ছিলেন। বিশেষ করে দেশের সেবা করার জন্য শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চর্চার ভিতর গড়ে ওঠ তরুণ প্রকৃত যোদ্ধা হয়ে উঠতে পারেন। এই আদর্শকে সামনে রেখে তৎকালিন জেনারেল এ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশানের (পরবর্তী সময়ের স্কটিশচার্চ কলেজ) ব্যায়ামাগারে সতীশচন্দ্র বসু প্রথম একটি 'কাশীনাথ সাহিত্য সমিতি' গড়ে তুলেছিলেন। এটি ছিল মূলতঅনুশীলন' প্রবন্ধের আদর্শে এই গড়ে ওঠা একটি সংগঠন। তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এখানে শরীর চর্চার পাশাপশি মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চর্চাকেন্দ্র হিসেব গড়ে উঠেছিল।

১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ড থেকে সদ্য প্রত্যাগত প্রমথনাথ মিত্রের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। উল্লেখ্য প্রমথনাথ মিত্র আয়ারল্যান্ড এবং রাশিয়ার বিপ্লবীদের কথা জানতে পারেন এবং এ সব আন্দোলোনের মতো করে- ভারতকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি বিপ্লবী দল গঠনের সংকল্প করেন। ভারতে ফিরে আসার পর তিনি দেখলেন স্বাধীনতার জন্য ইতিমধ্যে ছোটো ছোটো গুপ্ত সংগঠন তৈরি হয়েছে। প্রথম দিকে তিনি এসকল গুপ্ত সমিতিগুলোর ভিতরে সমন্বয় করার উদ্যোগ নেন। এ সকল দলের সার্বিক কর্মকাণ্ডে তিনি সন্তুষ্ট হতে না পেরে নিজেই ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে  'নিখিল বঙ্গ বৈপ্লবিক সমিতি' গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রায় একই সময়ে সতীশচন্দ্রের  কাশীনাথ 'কাশীনাথ সাহিত্য সমিতি' এবং 'নিখিল বঙ্গ বৈপ্লবিক সমিতি'র সমন্বয়ে একটি গুপ্ত বিপ্লবী দল গঠন করার উদ্যোগ নেন। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মার্চ (সোমবার ১০ চৈত্র ১৩০৮) উভয়ের প্রচষ্টায় গড়ে উঠেছিল অনুশীলন সমিতি'। এর কার্যালয় ছিল কলকাতার ১২ নং মদন মিত্র লেন। এর সভাপতি ছিলেন ব্যারিষ্টার প্রমথনাথ মিত্র, সহ-সভাপতি ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশঅরবিন্দ ঘোষ আর কোষাধ্যক্ষ ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রায় একই সময় বরোদায় অরবিন্দ ঘোষ একটি গুপ্ত বিপ্লবী দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য তিনি ১৯০১ খিষ্টাব্দে
যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কলকাতায় পাঠান। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে অরবিন্দের নির্দেশ অনুসরণ করে যতীন্দ্রনাথ একটি গুপ্ত দল গঠন করতে সক্ষম হন। ইতিমধ্যে ব্যারিষ্টার প্রমথনাথ মিত্র কলকাতায় বিপ্লবী দল হিসেবে 'অনুশীলন সমিতি' স্থাপন করেন। উল্লেখ্য এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মার্চ। এই সমিতির কথা যতীন্দ্রনাথ দূত মারফত অরবিন্দকে জানান। এরপর অরবিন্দের নির্দেশে তাঁর অনুসারীরা 'অনুশীলন সমিতি'-ত যোগদান করেন। ধীরে ধীরে এই সংগঠনের সাথে কলকাতার ছোট ছোট ক্লাব ও সংগঠন যোগদান করে। সংগঠনের কার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য একটি পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়। এর সভাপতি ছিলেন ব্যারিষ্টার প্রমথনাথ মিত্র, সহ-সভাপতি ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ অরবিন্দ ঘোষ আর কোষাধ্যক্ষ ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

 

সংগঠনের প্রথমাবস্থায় এই দলের অন্যতম মন্ত্রণাদাতা ছিলেন সতীশচন্দ্র বসু ও অরবিন্দ ঘোষ। বরোদার মহারাজার আর্মি বাহিনী থেকে সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত তরুণ বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ও অরবিন্দ ঘোষের ছোট ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষ তাঁকে এটি প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেন। পরবর্তী সময়ে এই সংগঠনের সাথে যুক্ত হন− বিপিনচন্দ্র পাল, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্দ্রচন্দ্র মল্লিক, সরলাদেবী, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। এই সমিতির প্রথম দিকে শরীরচর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, পরে সেনাবাহিনীর মতো করে একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীতে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এই সমিতিতে আগত যুবকদের অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে এদের নিয়ে তৈরি করা হয়, 'জাতীয় স্বেচ্ছাসৈন্যবাহিনী'।

১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে
অরবিন্দ পূর্ববাংলা সফর করেন। এই সময় তিনি পূর্ব-বাংলার বিপ্লবী দলগুলোর সাথে মিলিত হন এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে এঁদের সাথে আলোচনা করেন। এই সময় জাতীয় কংগ্রেস দলের রক্ষণশীল মনোভাবের বিরোধিতা শুরু হলেম অরবিন্দ সহিংস ভাবধারাকে সমর্থন করেন। ফলে চরমপন্থী দলটি '‌নিউ পার্টি' নামে অভিহিত হতে থাকে।  বলাই বাহুল্য. মূল কংগ্রসে থেকে অহিংস কংগ্রেসীরা পুরোপুরি মহাত্মা গান্ধী‌র অনুসৃত দলে পরিণত হয়েছিল। তাঁর এই রাজনৈতিক দর্শন তাঁর শিষ্যদের ভিতরে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। তবে তাঁর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিল বিপ্লবীদের মধ্যে। এই প্রচারণা শেষে তিনি বরোদাতে ফিরে যান।

১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ-রদ আন্দোলনর মাধ্যমে অহিংশ বিপ্লবী উভয় দলই নিজেদের ক্ষেত্রে প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছিল। বিশেষ করে তাঁর রচিত 'ভবানী মন্দির' নামক একটি পুস্তিকা, একটি নতুন হিন্দু-ধর্মাবলম্বী তরুণদের বিশেষভাবে উজ্জীবিত করেছিলেন।

১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে অরবিন্দ কলকাতা থেকে পুনরায় কলকাতায় আসেন। এই বছরে তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন যে, 'পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করাই ভারতের রাজনঠতিক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য‌'। এই উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে অরবিন্দ রাজনীতির ধারাকে দুটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এর একটি ধারার লক্ষ্য ছিল- জাতীয় কংগ্রেস প্রকাশ্যে অহিংস পদ্ধতিতে জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতির দ্বারা তাদের অধিকারের কথা বলবেন। অন্য ধারায় থাকবে গুপ্ত সমিতির মাধ্যমে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। এই বছরেই অনুশীলন সমিতি তাঁদের প্রচারণার জন্য প্রকাশে করে যুগান্তর নামক একটি সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা।

 

ঢাকাতে এর এর একটি শাখা খোলা হয় তৎকালীন ন্যাশনাল স্কুলে। কালক্রমে ঢাকা-শাখা একটি শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত হয়। ঢাকা শাখার অন্যতম সংগঠক ছিলেন পুলিনবিহারী দাস ও আনন্দচন্দ্র চক্রবর্তী। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এই সমিতির কার্যক্রম তীব্রতর রূপ লাভ করে। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে এই সমিতি একটি শক্তিশালী বিপ্লবী সংগঠনে পরিণত হয়।

 

১৯২০ থেকে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতর এর বহু নেতা ও কর্মী মার্ক্সবাদে দীক্ষিত হন এবং সশস্ত্র বিপ্লব থেকে সরে এসেছিলেন।

অনুশীলন সমিতির কালানুক্রমিক কার্যক্রম :
১৯০১-০২ খ্রিষ্টাব্দ: কলকাতায় এই সংগঠনটি গড়ে উঠে।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ: লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ-এর সিদ্ধান্তকে অকার্যকর করার জন্য, সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়ে, সংগঠনটি বিপ্লবী কার্যক্রম শুরু করে।
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দ: এই বৎসরের এপ্রিল মাসে, সংগঠনের কার্যক্রম প্রচার এবং জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সাপ্তাহিক 'যুগান্তর' প্রকাশ করা শুরু করে। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত
। এই সময় সমগ্র বঙ্গদেশে সমিতির শাখা খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ঢাকাস্থ ‘ন্যাশনাল স্কুলে’র প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক পুলিনবিহারী দাসের নেতৃত্বে ৮০ জন হিন্দু যুবক, সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় ঢাকা অনুশীলন সমিতি গঠন করে। পুলিনবিহারী দাস কর্তৃক ঢাকা অনুশীলন সমিতি'র পরিচালক ছিলেন।

১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ:

১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ

 

১৯০৯-১০ খ্রিষ্টাব্দ:

১৯১৩
 

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে ১৪ ডিসেম্বর: অতীন্দ্রমোহন রায়ের পরিকল্পনায় কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে হত্যা করেন অষ্টম শ্রেণির শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী। সূত্র : অতীন্দ্রমোহন রায়


১৯২৫

 

সূত্র :