চিত্তরঞ্জন দাশ, দেশবন্ধু
১৮৭০-১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ
আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী, কবি ও লেখক।
১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই নভেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম ভুবনমোহন দাশ ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের সলিসিটার। মায়ের নাম নিস্তারিণী দেবী।
উল্লেখ্য এই পরিবারের আদি নিবাস ছিল মুন্সীগঞ্জের তেলিরবাগে।
১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ভবানীপুরের (কলকাতা) লন্ডন মিশনারি সোসাইটির ইনস্টিটিউশনে
ভর্তি হন এবং প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন।
প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর তিনি লণ্ডন মিশনারি স্কুলের ভরতি হন। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
এই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করেন।
১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
কলেজ জীবনে তিনি সুরেন্দ্রনাথের স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সদস্য
ছিলেন।
উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি ইংল্যান্ড
যান। এরপর ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্যারিস্টারি
পাশ করে ভারতে ফিরে আসেন এবং ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টার হিসেবে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেন।
১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে রাজকোর্টের বরদাপ্রসাদ
হাওলাদারের কন্যা বাসন্তীদেবীকে বিবাহ করেন।
১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মার্চ কলকাতার ১২ নং মদন মিত্র লেনে,
ব্রিটিশ-ভারতে বিপ্লবী গুপ্ত সংগঠন
অনুশীলন সমিতি স্থাপিত হয়।
এর সভাপতি ছিলেন ব্যারিষ্টার
প্রমথনাথ মিত্র, সহ-সভাপতি ছিলেন
চিত্তরঞ্জন দাশ। এই সমিতির প্রতিষ্ঠকাল থেকে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এই সমিতির
সহ-সভাপতি ছিলেন।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এই সময় তিনি এস.এন ব্যানার্জী, বি.সি পাল ও অরবিন্দ ঘোষের সহকর্মী হিসেবে বাংলায় বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে
প্রসারের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
এই সময় তিনি আইনজীবী হিসেবে চিত্তরঞ্জন দাশ সিভিল কোর্টের প্র্যাকটিসের পরিবর্তে ক্রিমিনাল কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন। এজন্য তাঁকে প্রায়ই মফস্বলে যেতে হত। তিনি গরীব মক্কেলের কাছ থেকে
প্রায়ই কোন টাকা নিতেন না। আইনজীবী হিসেবে জনপ্রিয়তা
অর্জন করার পর চিত্তরঞ্জন দাশ মফস্বল ছেড়ে কলকাতায় প্রাকটিস শুরু করেন এবং পুনরায়
সিভিল কেসগুলো পরিচালনা করে বেশ সাফল্য পান।
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কংগ্রেসের কলকাতা
প্রতিনিধি নির্বাচিত হন।
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে মুরারিপুকুর বোমা মামলায় অরবিন্দ ঘোষের উপর
রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ বিনা পারিশ্রমিকে এই মামলায় লড়েন।
তিনি এত সুনিপুণ দক্ষতায় মামলাটিতে বিবাদী পক্ষ সমর্থন করেন যে অরবিন্দকে শেষ
পর্যন্ত বেকসুর খালাস দেয়া হয়।
১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলায় বিবাদী পক্ষের কৌশলী ছিলেন। এই মামলার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার অনুশীলন সমিতির প্রধান পুলিন বিহারী দাশ এবং সঙ্গীদেরকে নির্বাসন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও বিভিন্ন মেয়াদে কারদণ্ড দিয়েছিল। কিন্তু চিত্তরঞ্জন দাশ এই রায়ের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করেন। তাঁর আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পরিবর্তে ৬ মাসের শাস্তি এবং ৩৩ জনের মধ্যে ১১ জনের তুলনামূলক কম শাস্তি হয়েছিল।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে চিত্তরঞ্জন দাশ ‘দিল্লী ষড়যন্ত্র মামলা’ পরিচালনা করেন। এটাও ছিল একটি রাজনৈতিক মামলা।
‘দিল্লী ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ১৪ জন বিপ্লবীকে লর্ড হার্ডিঞ্জ হত্যা প্রচেষ্টার সাথে যুক্ত করে।
কিন্তু চিত্তরঞ্জন দাশের তীক্ষ্ম যুক্তির কাছে ইংরেজ সরকার হেরে যায় এবং তিনি জয়ী হন।
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে ভবানীপুরে অনুষ্ঠিত বাংলার প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন তিনি।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘আলিপুর ট্রাঙ্ক মার্ডার কেস- মামলা থেকে তিনি পাঁচ জন ব্যক্তিকে মুক্ত করেন।
এই বছর চিত্তরঞ্জন দাশ হাতে নেন
'অমৃতবাজার পত্রিকা মামলা'। কলকাতা হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ অভিমত প্রকাশ করে যে, কলকাতা উন্নয়ন ট্রাস্ট কোনো ব্যক্তিগত জমি রাখতে পারবে না। একই সময় হাইকোর্টে অন্য একজন বিচারক রায় দেন যে, কলকাতা উন্নয়ন ট্রাস্ট সেই ক্ষমতা রাখে। এরকম বিপরীতধর্মী মতামতের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি স্পেশাল ব্রাঞ্চ গঠন করা হয়। প্রধান বিচারপতি
Sir Lancelot Sanderson
, বিচারপতি
Jonh Woodroffe
এবং
Mr. Chitty
নিয়ে এই বেঞ্চ গঠন করা হয়। কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা অমৃতবাজার এ ব্যাপারে মন্তব্য করে সম্পাদকীয় ছাপে। পত্রিকাটি স্পেশাল বেঞ্চের গঠন সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলে। এই অবস্থায় প্রধান বিচারপতি অমৃতবাজারকে শোকজ করেন এবং আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন।
'অমৃতবাজার পত্রিকা' তখনকার কলকাতা বারের প্রখ্যাত আইনজীবীদের নিযুক্ত করে।
এঁদের মধ্যে ছিলেন মি. জ্যাকসন, মি. নরটন, ব্যোমকেশ চক্রবর্ত্তী এবং চিত্তরঞ্জন দাশ।
মামলার শেষের দিকে অন্য তিন আইনজীবী সরে দাঁড়ালে একমাত্র চিত্তরঞ্জন দাশ
মামলা পরিচালনা করেন এবং জয়ী হন।
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরে ব্রিটিশ সরকার জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড চালায়। ব্রিটিশের নানা টালবাহানার পর এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠ তদন্ত ও বিচারের জন্য সর্ব-ভারতীয় কংগ্রেস একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, সদস্য ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহেরু, আব্বাস তৈয়্যবজী এবং ড. জাকির হোসেন। তদন্ত কমিটির অধিকাংশ খরচ বহন করেন চিত্তরঞ্জন দাশ।
তাঁর প্রজ্ঞার সূত্রে হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠ তদন্ত
করা সম্ভব হয়েছিল।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তিনি
মহাত্মা গান্ধীকে সমর্থন করেন এবং আইনজীবীর পেশা পরিত্যাগ করেন।
এই অসামান্য ত্যাগের জন্য ভারতবর্ষের জনগণ কর্তৃক তিনি 'দেশবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রিন্স অব ওয়েলসের কলকাতা সফর বর্জনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। গান্ধী যখন অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করেন তখন তিনি তার তীব্র সমালোচনা করেন এবং বিষয়টিকে গুরুতর ভুল বলে নিন্দা করেন।
করেন। এই
বছরেই চিত্তরঞ্জন দাশ-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় 'বাঙ্গালার কথা' নামক একটি
সাপ্তাহিক পত্রিকা। স্বদেশী ভাবপুষ্ট লেখা প্রকাশের জন্য, ব্রিটিশ-ভারতের পুলিশ
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন দাশ-কে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেয়।
এই সময় পত্রিকার হাল ধরেন তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে গয়ায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের
৪০তম অধিবেশনে। এই সভার সভপতিত্ব
করেছিলেন চিত্তরঞ্জন। এই অধিবেশনে পরিষদে তাঁর
সকল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়।
এরপর তিনি কংগ্রেসের সভাপতির পদে ইস্তফা দেন। এই সময় পণ্ডিত মতিলাল নেহরু,
হাকিম আজমল খান, আলী ভ্রাতৃদ্বয় ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় কংগ্রেসের কর্মীদের নিয়ে
স্বরাজ দলের ভিত্তি স্থাপন করেন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় বিধান পরিষদের নির্বাচনে
স্বরাজ দল উল্লেখযোগ্য বিজয় সাফল্য লাভ করেন।
তিনি নিজে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জ্বলন্ত অগ্রদূত ছিলেন বলে বাংলার সাম্প্রদায়িক সমস্যা নিরসনে স্মরণীয়ভাবে সাফল্যলাভ করেছেন। বেঙ্গল প্যাক্ট নামে সাধারণভাবে পরিচিত এক চুক্তির মাধ্যমে তিনি বাংলার মুসলমানদের আস্থাভাজন হয়ে তাদেরকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত স্বরাজ্য পরিষদ দলের এক সভায় চুক্তিটির শর্তাবলি গৃহীত হয়। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কোকনদ সেশনে চুক্তিটি বাতিল করা হলে, তিনি এর তীব্র সমালোচনা করেন।
এই বছরের লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত শ্রমিক
ইউনিয়নের কংগ্রেসে তিনি সভাপতিত্ব করেন। এ্ই বছরেই
তিনি স্বরাজ্য দলের মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিকী দ্য ফরওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে জুন মাসে সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলন কর্তৃক তিনি চুক্তিটির শর্তাবলি অনুসমর্থন করিয়ে নিতে সক্ষম হন। এই বছরে
কলকাতা কর্পোরেশন-এর নির্বাচনে স্বরাজবাদী বিজয় অর্জন করে এবং চিত্তরঞ্জন দাশ প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন।
এই বছরে কলকতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত শ্রমিক ইউনিয়নের
কংগ্রেসে তিনি সভাপতিত্ব করেন। এই বছরে তিনি কলকাতা
কর্পোরেশনের মুখপত্র মিউনিসিপ্যাল গেজেটও প্রতিষ্ঠা করেন। এই
সময় তিনি ডেপুটি মেয়র হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন
হোসেন শহীদ
সোহ্রাওয়ার্দীকে ।
এছাড়া শরৎচন্দ্র বসু অল্ডারম্যান এবং সুভাষচন্দ্রকে চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার পদে
নিয়োগ দিয়েছিলেন। এই বছরে
তারকেশ্বর মন্দিররের
পুরোহিতের বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। সাধারণভাবে তাঁর এই আন্দোলনটি
তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ
আন্দোলন নামে অভিহিত করা হয়েছিল। উল্লেখ্য,
তারকেশ্বর মন্দিররে
পুরোহিতরা 'মোহান্ত' নামে পরিচিত
ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে এই মন্দিরের মোহান্ত'দের নিয়ে নানারকম অনাচারের অভিযোগ ছিল। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে (১২৮০ বঙ্গাব্দ) মোহান্তের নামে প্রথম নারীঘটিত অভিযোগ উঠেছিল। তখন থেকেই মোহান্তদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ-সহ নানা ধরনের অনাচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল। দীর্ঘদিন পর ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ (১৩৩১ ৩১ বঙ্গাব্দ) দিকে তৎকালীন মোহান্ত সতীশচন্দ্র গিরির নামে নারীঘটিত এবং অর্থ আত্মসাতের মতো অভিযোগ ওঠে। এই সময় স্থানীয় মানুষ এর প্রতিবাদ শুরু করে। এরই সূত্রে ধরে ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ২৭শে জ্যৈষ্ঠ (মঙ্গলবার ১০ জুন ১৯২৪) থেকে দেশবন্ধু
চিত্তরঞ্জন দাশ তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূচনা করেন।
মূলত এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ১০ম মোহান্ত শ্রীমন্ত গিরির আমলে প্রথম অনাচারের সংবাদ আলোড়িত করে। হত্যা ও অবৈধ
নারী-সম্ভোগের জন্য এই মোহান্তের ফাঁসি হয়েছিল ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে (১২৩১ বঙ্গাব্দ)।
সে সময়ের প্রখ্যাত দৈনিক পত্রিকা 'সমাচার দর্পণ'-এ এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশিত
হয়েছিল।
এরপর ১২তম মোহান্ত মাধবচন্দ্র গিরি সম্পর্কে একই ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এই
মোহান্ত এলোকেশী নামক এক মহিলাকে ধর্ষণ করে। এই অপরাধে তাঁর কারাদণ্ড হয়। এই সময়
তাঁর শিষ্য শ্যাম গিরি মোহান্ত পদ লাভ করেন। জেল থেকে ফিরে মাধবচন্দ্র গিরি মোহান্ত
পদ লাভের আবেদন করে। কিন্তু শ্যাম গিরি ও উত্তর পাড়ার মুখোপাধ্যায় ব্রাহ্মণরা এর
বিরোধিতা করলে, মাধবচন্দ্র গিরি মোহান্ত পদ লাভের জন্য আদালতে মামলা করেন। মামলায়
তিনি আদলতে বলেন যে, যেহেতু তিনি দশনামা সন্ন্যাসী তাই পরনারী গমনে তাঁর কোনো বাধা
নাই। তাছাড়া ফৌজদারি জেল খেটে এসেছে, সেই কারণে মোহান্ত পদ পুনরায় লাভ করতে পারে।
এই মামলায় মাধবচন্দ্র গিরি তাঁর মোহান্ত পদ ফিরে পেয়েছিলেন।
এরপর থেকে মাধবচন্দ্র গিরি আরও অত্যাচারী হয়ে ওঠে। এরই সূত্রে ধরে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের
(১৩৩১ বঙ্গাব্দ) শুরু
দিকে স্বামী বিশ্বানন্দ এবং পণ্ডিত ধরানাথ ভট্টাচার্য প্রতিবাদ ও প্রচারণা শুরু করেন।
এই সময় স্থানীয় অধিবাসীরা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে এর প্রতিকার চেয়ে আবেদন
করেন।
এই অন্দোলন উপলক্ষে একটি প্রতিবাদী কমিটি তৈরি করা হয়। এই কমিটির সভাপতি
ছিলেন স্বামী সচ্চিদানন্দ। এছাড়া কমিটির অন্যতম সক্রিয় সদস্য ছিলেন আসানসোল ট্রেড
ইউনিয়ন নেতা স্বামী বিশ্বানন্দ। এই সময় স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে উদ্বুদ্ধ
'বীরদল' নামক স্বেচ্ছাসেবী তরুণরা এগিয়ে আসেন। এর নেতৃত্ব দেন বীরদলের নেতা স্বামী
বিশ্বানন্দ এবং স্বামী সচ্চিদানন্দ। পরে প্রাদেশিক কংগ্রেসের পক্ষ থেকে নেতাজী
সুভাষচন্দ্র বসু, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং চিত্তরঞ্জন দাস বীরদলকে সমর্থন
করেন। ৮ই এপ্রিল নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিষয়টি
স্বচক্ষে দেখার জন্য তারেকশ্বর যান। এরপর ৩০ এপ্রিল চিত্তরঞ্জন দাস সেখানে যান।
এই সূত্রে তারকেশ্বরের বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস একটি কমিটি
গঠন করে। এই কমিটির সদস্য ছিলেন- চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু, ডাঃ এএম
দাশগুপ্ত, অনুলবরণ রায়, পণ্ডিত ধরানাথ ভট্টাচার্য, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং
মৌলানা আক্রাম খাঁ। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসের সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক
কংগ্রেসের সভায় এই বিষয়ে সদস্য হিসেবে থাকতে চিত্তরঞ্জন অস্বীকার করলে, দায়িত্ব গ্রহণ করেন
প্রতাপচন্দ্র গুহরায়।
১৩৩১ বঙ্গাব্দের ২৭শে জ্যৈষ্ঠ (মঙ্গলবার
১০ জুন ১৯২৪) থেকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, আনুষ্ঠানিকভাবে তারেকেশ্বর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূচনা
করেন। এই অন্দোলন উপলক্ষে একটি প্রতিবাদী কমিটি তৈরি করা হয়। এই কমিটির সভাপতি
ছিলেন স্বামী সচ্চিদানন্দ। এই সময় এই আন্দোলনে সুভাষচন্দ্র বসু বিশেষভাবে সহযোগিতা
করেন।
এই আন্দোলনের মুখে ২২শে সেপ্টেম্বর সতীশচন্দ্র গিরি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন প্রভাতচন্দ্র গিরির হাতে। এই সময় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন আষাঢ় মাসের তৃতীয় সপ্তাহের (মে মাসের প্রথম সপ্তাহ) দিকে। এই সময় তিনি একটি গান রচনা করেন। গানটি হলো-
জাগো আজ দণ্ড-হাতে চণ্ড বঙ্গবাসী।
গানটির শিরোনাম ছিল 'মোহান্তের মোহ-অন্তের গান'।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই জুন চিত্তরঞ্জন দাশ মৃত্যুবরণ করেন।