তারকেশ্বর মন্দির
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলী জেলার তারকেশ্বর শহরে অবস্থিত শিবমন্দির। ভারতের অন্যতম হিন্দু তীর্থক্ষেত্র হিসেবে এই মন্দিরকে মান্য করা হয়।

শ্রীনগেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্কলিত ও প্রকাশিত বিশ্বকোষ সপ্তম খণ্ডে [পৃষ্ঠা ৬৯৭-৬৯৬]- 'তারেকশ্বর' ভুক্তিতে উল্লেখ আছে
'কোন প্রাচীন পুরাণ অথবা তন্ত্রে ইহার বিবরণ না থাকায় ইহা আধুনিক বলিয়া বোধ হয়। তবে দুই তিন শত বৎসর্ অপেক্ষা যে প্রাচীন, তাহাতে সন্দেহ নাই। ভবিষ্য ব্রহ্মখণ্ডে (৭।৫৮) এই লিঙ্গের উল্লেখ আছে।'
সুধীর মিত্র তাঁর 'হুগলী জেলার ইতিহাস' (১৯৪৮, পৃষ্ঠা ৮১৪) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে,
'১৭৭৯-১৭৮১ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত বঙ্গদেশের মানচিত্রে তারকেশ্বরের অস্তিত্ব নাই। তবে ১৮৩০-১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বাঙ্গালা সরকার বঙ্গদেশের যে জরীপ করাইয়াছিলেন, তাহাতে 'তারেশ্বরী' নামক একটি স্থানের উল্লেখ আছে দেখিতে পাওয়া যায়।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, জৌনপুরের ডোভি পরগণার গোমতী নদীর তীরস্থ হরিপুরের রাজা বিষ্ণুদাসের সাথে কাশীর রাজা বলবন্ত সিংহের সংঘর্ষ হলে, প্রায় ৫০০ অনুচর-সহ বিষ্ণুদাস হুগলি অঞ্চলে চলে আসেন এবং হুগলির জঙ্গলাকীর্ণ হরিপালের রামনগরে বসতি স্থাপন করেন। এই সময় বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খানের অনুমতি নিয়ে তিনি জমিদারির পত্তন করেন। মুর্শিদকুলী খান তাঁর জমিদারী জন্য প্রাথমিকভাবে পাঁচশত বিঘা জমি দান করেছিলেন। 

তারকেশ্বরের মহাত্ম সম্পর্কে হিন্দু লোককাহিনি থেকে জানা যায়- রাজা বিষ্ণুদাসের এক গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী ভাই ভারমল্ল, ঘুরতে ঘুরতে জমিদারির গুড়ে-ভাটা নামক গ্রামে আসেন। এখানে রাজার গো-রক্ষক মুকুন্দদাসের কাছে জানতে পারেন যে, কিছু গাভী জঙ্গলে প্রবেশ করে একটি শিলার উপর দুগ্ধ দান করে। ভারমল্ল বিষয়টি রাজা বিষ্ণুদাসকে জানালে, রাজা উক্ত শিলাখণ্ডটি রামনগরে আনার উদ্যোগ নেন। শিলাটিকে তুলে আনার জন্য রাজার লোকেরা প্রথম দিন পঞ্চাশ হাত খনন করার পরও এর ভিত্তি খুঁজে না পেয়ে, সেদিনের মতো কাজ স্থগিত রাখেন। সে রাত্রে বিষ্ণুদাসকে তারকেশ্বর স্বপ্নে জানান যে, তিনি তারকেশ্বর শিব। তাঁর প্রসার গয়া গঙ্গা কাশী পর্যন্ত। সুতরাং খনন করে তাঁকে তোলা যাবে না। স্বপ্নে এই স্থানে মন্দির নির্মাণ করে, তার নাম যেন 'তারকেশ্বর মন্দির' নামে অভিহিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

স্বপ্নদর্শনের পর রাজা ১৭২৯ খ্রিষ্টাব্দে (১১৩৬ বঙ্গাব্দ) ওই শিলার উপরে একটি আটচালা ছাউনি দিয়ে মন্দির গড়ে তোলেন। সে সময়ে রাঢ়বাসীর কাছে বিশেষ তারেকশ্বর পরম আরাধ্য দেবতায় পরিণত হয়েছিল। রাজা মন্দিরের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য ১০২৩ বিঘা জমি দান করেন। আদি মন্দিরটি ভেঙে গেলে বর্ধমানের রাজা এর সংস্কার করেন। পরে পাতুল-সন্ধিপুর অঞ্চলের গোবর্ধন রক্ষিত এর পুনরায় সংস্কার করেন। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে (১২০৮ বঙ্গাব্দ) বালিগড়ের রাজা চিন্তামণি দে এই মন্দিরে প্রার্থনা করে আরোগ্য লাভ করার পর, মন্দিরের সামনে নাটমন্দির তৈরি করে দেন।

সে সময়ে এই মন্দিরে যাওয়ার জন্য তখন একমাত্র হাঁটা পথ ছিল। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে (১২৯২ বঙ্গাব্দ) নীলকমল মিত্রের উদ্যোগে শেওড়াফুলি থেকে তারকেশ্বর পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মিত হয়।

১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে (১২৯৮ বঙ্গাব্দ) চিন্তামণি দে তারকেশ্বরের বাজার এবং রাস্তাঘাট পাথর দিয়ে বাঁধাই করে দেন।
১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে (১৩০০ বঙ্গাব্দ) গঙ্গাধর মন্দিরের 'সিদ্ধপুকুর'-এর ঘাট পাকা করে দেন।

রাজা এবং ভল্লরাম মন্দিরের প্রথম মোহান্ত পদ দান করেন মুকুন্দরামকে। মুকুন্দরামের মৃত্যুর পর নতুন মোহান্ত হন জগন্নাথ গিরি। কথিত আছে জগন্নাথ গিরি চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ তীর্থে যাওয়ার পথে তারকেশ্বরের কথা জানতে পারেন। তিনি চন্দ্রনাথে যাওয়ার আগে তারকেশ্বরের পূজা করার জন্য এখানে আসেন। কিন্তু মন্দিরের ব্রাহ্মণ পূজার জন্য বৈশাখ পূর্ণিমা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। এই সময় ভল্লনাথের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে মুকুন্দরামের মৃত্যু হলে, ভল্লনাথ জগন্নাথ গিরিকে মন্দিরের মোহান্ত হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর ভল্লনাথ ও জগন্নাথ গিরি ভবিষ্যৎ মোহান্ত নির্ধারণের বিধি তৈরি করেন। এই বিধি অনুসারে- দশনামা সন্ন্যাসীরা এই মন্দিরের মোহান্ত হবেন। মোহান্তরা বিবাহ করবেন না। প্রধান মোহান্তের মৃত্যু হলে, তাঁর শিষ্যদের ভিতরে থেকে প্রধান শিষ্য যোগ্যতার বিচারে নতুন মোহান্ত পদ লাভ করবেন। এই সূত্রে মোট ১৪ জন সন্ন্যাসী মোহান্ত পদ লাভ করেছিলেন। এই মোহান্তরা হলেন- ১. মুকুন্দরাম ঘোষ, ২. জগন্নাথ গিরি. ৩. কমললোচন গিরি, ৪. শম্ভচন্দ্র গিরি, ৫. গোপালচন্দ্র গিরি, ৬. রাধাকান্ত গিরি, ৭. গঙ্গাধর গিরি, ৮. প্রসাদচন্দ্র গিরি, ৯. পরশুরাম গিরি, ১০. শ্রীমন্তগিরি, ১১. রঘুচন্দ্র গিরি, ১২. মাধবচন্দ্র গিরি, ১৩. সতীশচন্দ্র গিরি ১৪. প্রভাতচন্দ্র গিরি।

৯ম মোহান্ত পরশুরাম গিরি পর্যন্ত মোহান্তের বিধি পালিত হয়েছিল বলে জানা যায়। ১০ম মোহান্ত শ্রীমন্ত গিরির আমলে প্রথম অনাচারের সংবাদ আলোড়িত করে। হত্যা ও অবৈধ নারী-সম্ভোগের জন্য এই মোহান্তের ফাঁসি হয়েছিল ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে (১২৩১ বঙ্গাব্দ)। সে সময়ের প্রখ্যাত দৈনিক পত্রিকা 'সমাচার দর্পণ'-এ এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছিল। সুধীর মিত্রের 'হুগলী জেলার ইতিহাস' থেকে উক্ত পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ নমুনা দেখানো হলো।

;


এরপর ১২তম মোহান্ত মাধবচন্দ্র গিরি সম্পর্কে একই ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এই মোহান্ত এলোকেশী নামক এক মহিলাকে ধর্ষণ করে। এই অপরাধে তাঁর কারাদণ্ড হয়। এই সময় তাঁর শিষ্য শ্যাম গিরি মোহান্ত পদ লাভ করেন। জেল থেকে ফিরে মাধবচন্দ্র গিরি মোহান্ত পদ লাভের আবেদন করেন। কিন্তু শ্যাম গিরি ও উত্তর পাড়ার মুখোপাধ্যায় ব্রাহ্মণরা এর বিরোধিতা করলে, মাধবচন্দ্র গিরি মোহান্ত পদ লাভের জন্য আদালতে মামলা করেন। মামলায় তিনি আদলতে বলেন যে, যেহেতু তিনি দশনামা সন্ন্যাসী তাই পরনারী গমনে তাঁর কোনো বাধা নাই। তাছাড়া ফৌজদারি জেল খেটে এসেছে, সেই কারণে মোহান্ত পদ পুনরায় লাভ করতে পারে। এই মামলায় মাধবচন্দ্র গিরি তাঁর মোহান্ত পদ ফিরে পেয়েছিলেন।

এরপর থেকে মাধবচন্দ্র গিরি আরও অত্যাচারী হয়ে ওঠে। এরই সূত্রে ধরে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের (১৩৩১ বঙ্গাব্দ) শুরু দিকে স্বামী বিশ্বানন্দ এবং পণ্ডিত ধরানাথ ভট্টাচার্য প্রতিবাদ ও প্রচারণা শুরু করেন। এই সময় স্থানীয় অধিবাসীরা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে এর প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেন।

এই আন্দোলন উপলক্ষে একটি প্রতিবাদী কমিটি তৈরি করা হয়। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন স্বামী সচ্চিদানন্দ। এছাড়া কমিটির অন্যতম সক্রিয় সদস্য ছিলেন আসানসোল ট্রেড ইউনিয়ন নেতা স্বামী বিশ্বানন্দ। এই সময় স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে উদ্বুদ্ধ 'বীরদল' নামক স্বেচ্ছাসেবী তরুণরা এগিয়ে আসেন। এর নেতৃত্ব দেন বীরদলের নেতা স্বামী বিশ্বানন্দ এবং স্বামী সচ্চিদানন্দ। পরে প্রাদেশিক কংগ্রেসের পক্ষ থেকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু , শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং চিত্তরঞ্জন দাশ বীরদলকে সমর্থন করেন। ৮ই এপ্রিল সুভাষচন্দ্র বসু এবং শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিষয়টি স্বচক্ষে দেখার জন্য তারেকশ্বর যান। এরপর ৩০ এপ্রিল চিত্তরঞ্জন দাশ সেখানে যান।

এই সূত্রে তারকেশ্বরের বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সদস্য ছিলেন- চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু, ডাঃ এএম দাশগুপ্ত, অনুলবরণ রায়, পণ্ডিত ধরানাথ ভট্টাচার্য, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং মাওলানা আকরাম খাঁ। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভায় চিত্তরঞ্জন দাশ এই কমিটির সদস্য হিসেবে থাকতে অস্বীকার করলে, দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রতাপচন্দ্র গুহরায়।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুন (মঙ্গলবার ২৭শে জ্যৈষ্ঠ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ) থেকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, আনুষ্ঠানিকভাবে তারেকেশ্বর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূচনা করেন। এই অন্দোলন উপলক্ষে একটি প্রতিবাদী কমিটি তৈরি করা হয়। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন স্বামী সচ্চিদানন্দ। এই সময় এই আন্দোলনে সুভাষচন্দ্র বসু বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন।

এই আন্দোলনের মুখে ২২শে সেপ্টেম্বর সতীশচন্দ্র গিরি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন প্রভাতচন্দ্র গিরির হাতে। এই সময় কাজী নজরুল ইসলাম, এই আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন আষাঢ় মাসের তৃতীয় সপ্তাহের (মে মাসের প্রথম সপ্তাহ) দিকে। এই সময় তিনি একটি গান রচনা করেন। গানটি হলো-  
'জাগো আজ দণ্ড-হাতে চণ্ড বঙ্গবাসী'  [তথ্য]। গানটির শিরোনাম ছিল 'মোহান্তের মোহ-অন্তের গান'।
প্রায় চার মাস আন্দোলন করার পর, মাধবচন্দ্র গিরি পদত্যাগ করেন এবং ১৩তম মোহান্ত হিসেবে ক্ষমতা লাভ করেন  সতীশচন্দ্র গিরি এবং এই ধারার শেষ মোহান্ত ছিলেন প্রভাতচন্দ্র গিরি।

মোহান্তদের এই অনাচার বারবার যাতে না ঘটে, তার জন্য বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্টের রায় অনুসারে পুরাতন নিয়ম বিলুপ্ত করে, মন্দির পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় একটি ট্রাষ্টি বোর্ডের হাতে। এই নতুন প্রক্রিয়া মোহান্ত হয়েছিলেন দণ্ডিস্বামী।
সূত্র: