বারীন্দ্রকুমার ঘোষ
(১৮৮০-১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ)
ব্রিটিশ ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী। বারীন ঘোষ নামে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন।


১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই জানুয়ারি লণ্ডনের উপকণ্ঠে নরউডে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম কৃষ্ণধন ঘোষ, মায়ের নাম স্বর্ণলতা ঘোষ। উল্লেখ্য তাঁর পিতা কৃষ্ণধন ঘোষ তখন ইংল্যান্ডে চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া করতেন।

পিতামাতার সাথে ভারতে ফিরে আসেন এবং ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে দেওঘর-এর এক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। এরপর তিনি পাটনা কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে কিছুদিন লেখাপড়া করার পর, তিনি ঢাকায় তাঁর মেজো ভাই মনমোহন ঘোষের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক) কাছে চলে আসেন। ঢাকায় কিছুদিন থাকার পর, গুজরাটের বরোদায় বসবাসকারী তাঁর অপর সেজ দাদা অরবিন্দ ঘোষ কাছে চলে আসেন। এখানে তিনি রাইফেল চালনায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর ব্যাপক লেখাপড়া শুরু করেন। তাঁর দাদা অরবিন্দ ঘোষ -এর অনুপ্রেরণায় তিনি ধীরে ধীরে বিপ্লবী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।

ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বহু বিপ্লবী সংগঠন গড়ে উঠে। অরবিন্দ ঘোষ এ সকল সংগঠনগুলোকে সমন্বিত করার উদ্যোগ নেন।
১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি গুপ্ত বিপ্লবী দল গঠনের উদ্যোগ নেন। এই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য তিনি যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কলকাতায় পাঠান। 

১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে অরবিন্দের নির্দেশ অনুসরণ করে যতীন্দ্রনাথ কলকাতায় এসে একটি গুপ্ত দল গঠন করতে সক্ষম হন। ইতিমধ্যে ব্যারিষ্টার প্রমথনাথ মিত্র কলকাতায় বিপ্লবী দল হিসেবে ';
অনুশীলন সমিতি' স্থাপন করেন। উল্লেখ্য এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মার্চ। এই সমিতির কথা যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অরবিন্দকে জানান। এরপর অরবিন্দের নির্দেশে তাঁর অনুসারীরা  'অনুশীলন সমিতি'-ত যোগদান করেন।

১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে
যতীন্দ্রনাথকে সহায়তা করার জন্য, অরবিন্দ বারীন্দ্রকুমারকে কলকাতায় পাঠান। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি 'অনুশীলন সমিতি'র সাংগঠনিক কাজ করেন।

'
অনুশীলন সমিতি'র আদর্শকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, বারীন ঘোষ একটি পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তাব করেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই মার্চ থেকে অরবিন্দের সমর্থনে সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে 'যুগান্তর' প্রকাশিত হতে থাকে। যুগান্তর ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করলে, ব্রিটিশ কর্মকর্তারা এই পত্রিকার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। এই সূত্রে বেশ কয়েকবার তিনি রাজনৈতিক হয়রানির স্বীকারও হন।

১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কলকাতাস্থ মানিকতলায় মুরারীপুকুরে বারীন ঘোষদের বাগান বাড়িতে এই সশস্ত্র বিপ্লবী দলটি গঠিত হয়। এই দলটি পরবর্তী সময়ে 'যুগান্তর বিপ্লবী দল' নামে পরিচিতি লাভ করে। সাধারণভাবে এরপর তিনি সংগোপনে অস্ত্র সংগ্রহ ও বিস্ফোরক তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই পরিকল্পনার সূত্রে বিপ্লবীদের অত্যাধুনিক অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনের কর্মীদের কঠোর সাজা ও দমননীতির কারণে, কলকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড বাঙালিদের অত্যন্ত ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। িশেষ করে, আলিপুর আদালত প্রাঙ্গনে 'বন্দেমাতরম' ধ্বনি উচ্চারণ করার জন্য কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড, সুশীল সেন নামক ১৬ বছরের এক কিশোরকে প্রকাশ্য স্থানে বেত মারার আদেশ দেন। এই কারণে কিংসফোর্ডকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এবং এই সূত্রে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রিল, রাত সাড়ে বারটায় বিহারের মুজাফ্ফরপুর ইউরোপীয়ান ক্লাবের সামনে ক্ষুদিরাম বসু প্রফুল্ল চাকী বোমা নিক্ষেপ করেন। এই বোমা হামলার পর পুলিশ অনুসন্ধানের সূত্রে ২রা মে  ৩২ নম্বর মুরারিপুকুরের বাগান বাড়িতে বোমা তৈরির কারখানা আবিষ্কার করেন এবং বোমা তৈরি মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ এই বোমা হামলার তদন্তের সূত্রে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে মে মামলা দায়ের করে। ঐতিহাসিকভাবে এই মামলা 'আলীপুর বোমা মামলা' নামে চিহ্নিত করা হয়। এই মামলার রায় প্রকাশিত হয় ৬ই মে। এই রায় অনুসারে বারীন ঘোষকে ফাঁসি দেওয়া হয়। পরে আপিলে তিনি তাঁর মৃত্যুদণ্ড রহিত করা হয় এবং ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়।

প্রায় এক দশক পর ব্রিটিশ-ভারতীয় সরকার রাজনৈতিক বন্দীদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসের দিকে বারীন ঘোষকে কলকাতায় এনে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর দুবছর তিনি রাজনীতির অঙ্গন ছেড়ে কলকাতায় একটি আশ্রম খুলে বসেন এবং কিছুদিন সাংবাদিকতা করেন। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আশ্রমের কাজের জন্য অরবিন্দ ঘোষের পণ্ডিচেরি আশ্রমে যান। এই সময় তিনি অরবিন্দের  আধ্যাত্মিক ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হন।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। এই সময় তিনি পত্রিকায় কলাম লেখা শুরু করেন।

১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শৈলজা দেবীকে বিবাহ করেন। এই বছরেই তিনি
'The Dawn of India' নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন। এরপর তিনি কিছুদিন 'The Stateman'  পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন।

১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দৈনিক বসুমতী পত্রিকার সম্পাদক হন। এছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'রামানন্দ লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত হন।

১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

শেষ জীবনে তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো- দ্বীপান্তরের বাঁশি, পথের ইঙ্গিত, আমার আত্মকথা, অগ্নিযুগ, ঋষি রাজনারায়ণ।


সূত্র: