শাওন-রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে॥
ভুলিও স্মৃতি মম, নিশীথ-স্বপন সম
আঁচলের গাঁথা মালা ফেলিও পথ 'পরে॥
ঝুরিবে পুবালি বায় গহন দূর-বনে,
রহিবে চাহি' তুমি একেলা বাতায়নে।
বিরহী কুহু-কেকা গাহিবে নীপ-শাখে
যমুনা-নদীপারে শুনিবে কে যেন ডাকে।
বিজলি দীপ-শিখা খুঁজিবে তোমায় প্রিয়া
দু'হাতে ঢেকো আঁখি যদি গো জলে ভরে॥
যেন- যা ঘটতে পারে, সেই কষ্ট-কল্পনায় এই গান হয়ে উঠেছে দুঃখ-বিলাসে আত্ননিপীড়ন। তাই কবি কল্পনায় দেখতে পান বিরহিনী প্রেমিকার এক বেদনাবিধূর এবং অসহায়া দশা। বিরহী অনুভব করেন- যখন শ্রাবণের পূবালি বাতাসে দূরের গভীর অরণ্যে বিরহের বেদনা অশ্রু হয়ে ঝরে পড়বে, তখন তার বিরহিণী যেন একাকী জানালার পাশে বসে শুধু দেখবে তার ফেলে আসা দূর অতীতের মধুরপ্রেম, অনুভব করবে কাছে না পাওয়ার বেদনা। যখন বিরহী কোকিল, ময়ূর কদম ডালে বসে বিরহের গান গাইবে, তখন তার ভিতর দিয়ে যমুনা-নদী পারে হারানো প্রেমিকা যেন তার প্রেমিকের ডাক শুনতে পাবে। কবি কল্পনায় কদম্ব শাখায় কুহু-কেকার ধ্বনির ভিতর দিয়ে, যমুনা-তীরে বিরহী কৃষ্ণের অনুভবের ছায়াপাত ঘটে, সেখান যমুনা নদী হয়ে উঠেছে বিরহিনী রাধার বিরহ-বিহারের লীলাভূমি। যেখানে আকাশের বিদ্যুতের আলোয় বিরহীকৃ্ষ্ণ বিরহিনী রাধাকে খুঁজে ফিরছে। সব শেষে কবি এই দুঃখ-বিলাসের সমাধানে আসতে চেয়েছেন। গানের ভাষায় কবি উপস্থাপন করেছেন- এসব স্মৃতিকাতরতা ভরা স্বপ্নে যদি তার প্রেমিকার চোখ জলে ভরেও যায়, তাহলে সে যেন দুহাতে তাঁর বেদনাকে ঢেকে ব্যথাকে সম্বরণ করে।'যদি কোনো এক বরষণ মুখর শ্রাবণ রাতে, তাঁর প্রেমিকার স্মৃতিপটে তাঁর স্মৃতিতে ভেসে ওঠে, যদি বাইরের ঝড়ো বরিষণের সাথে তার চোখে বেদনার অশ্রু ঝরে পড়ে, 'তাহলে সে যেন তা গভীর রাতে দেখা স্বপ্নের মতো সকল স্মৃতি ভুলে যায়। যদি তাকে নিয়ে সেই প্রেয়সী কোনো স্মৃতির মালা গাঁথে, তা যেন ভাবনার পথেই ফেলে দেয়।'
'...কাজীদা জিজ্ঞাসা করলেন, 'কিছু ঠিক করেছিস কী গাইবি? একটু ইতস্তত করে বললাম, "আমি দু-একটা গান লিখে সুর করেছি।" কাজীদা বললেন, আচ্ছা শোনা"জগন্ময় তাঁর লেখা সুরে গানটি শোনালেন। গানটি হলো- 'যদি বাসনা মনে দিবে দহন জ্বালা/তবে মনের কোণে কেন বাসিলে ভালো'। নজরুল গানটি শোনার পর সুরের প্রশংসা করলেও বাণীর প্রশংসা করতে পারেন নি। তারপর নজরুল গানটি কয়েকবার জগন্ময়ের কাছে শুনে, সেই সুরের উপর 'শাওন রাতে স্মরণে আসে মোরে' গানটি রচনা করেছিলেন। এই গানটির সুর সম্পর্কে জগন্ময় লিখেছেন- 'আমার গুরু ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় একবার একটা গান আমাদের গেয়ে শুনিয়েছিলেন। সেটি হলো- 'আজি ঝরলা' । রাগের নাম বলেছিলেন, যতদূর মনে আছে 'ঝঞ্ঝা-মল্লার।' অর্থাৎ মল্লার ঘরের কোনো একটি রাগ। ঝঞ্ঝা-মল্লার নামটা ঠিক শুনেছিলাম কি না, এখন সন্দেহ পোষণ করি। কারণ, এ নাম আর কোনো জায়গায় শুনতে পাইনি...।' কবি নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [জুন ২০১৮, পৃষ্ঠা ৪]-এ গানটির শিরোনামে রাগ 'চর্জ্যু কি মল্লার' উল্লেখ আছে। গানটির সুরের সাথে চর্জযু কি মল্লার' রাগের কোনো মিল নেই।