মুন্সি আব্দুর রউফ, বীরশ্রেষ্ঠ
(১ মে ১৯৪৩ - ৮ এপ্রিল ১৯৭১)
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর সৈনিক।

১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের জন্ম ১লা মে, ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার সালামতপুরে জন্মগ্রহণ করেন।  উল্লেখ্য, পূর্বে এই গ্রামটি ছিল বোয়ালমারী উপজেলার অন্তর্গত। বর্তমানে সালামতপুর গ্রামটি রউফ নগর নামে পরিচিত।

তাঁর বাবা মুন্সি মেহেদি হাসান ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। মা মুকিদুন্নেসা ছিলেন গৃহবধূ। তাঁর ডাকনাম ছিলো রব। তাঁর দুই বোনের নাম ছিল জোহরা এবং হাজেরা।

শৈশবে তাঁর বাবার কাছে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তিনি বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেন নি। সংসারের প্রয়োজনে তিনি অষ্টম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় নানা কাজ কর্ম করতে থাকেন।

১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই মে তিনি তথকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে। চাকরি পাওয়ার জন্যম সে সময় তাঁকে ৩ বছর বেশি বয়স দেখাতে হয়েছিলো। চাকরি পাওয়ার পর, তাঁর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ হয়েছিল চুয়াডাঙ্গার ইআরপি ক্যাম্পে। এরপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয়। ছয় মাস পরে তাকে কুমিল্লায় নিয়োগ দেওয়া হয়।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে অপারেশন সার্চ লাইট -এর পর বাংলাদেশে অবস্থানরত ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের সদস্যরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়। এই সময় আব্দুর রউফ চট্টগ্রামের পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের ল্যান্স নায়েক হিসেবে ১১ নম্বর উইং-এ কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন।

এই সময় তিনি মাঝারি মেশিনগান ডিপার্টমেন্টের ১ নং মেশিনগান চালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি-মহালছড়ি জলপথের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। উল্লেখ্য এই জলপথ দিয়ে পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর চলাচল প্রতিরোধের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁর কোম্পানির উপর। কোম্পানিটি বুড়িঘাট এলাকার চিংড়িখালের দুই পাড়ে অবস্থান নিয়ে গড়ে তুলে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি।

৮ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের কোম্পানি মর্টার, মেশিনগান ও রাইফেল নিয়ে বুড়িঘাটের মুক্তিবাহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা ঘাঁটির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছিল। এই অভিযানে নৌপথে সাতটি স্পিডবোট এবং দুইটি লঞ্চ অংশ নেয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কাছাকাছি পৌঁছেই আক্রমণ শুরু করে। স্পিডবোট থেকে মেশিনগানের গুলি এবং আর লঞ্চ দুইটি থেকে তিন ইঞ্চি মর্টারের শেল নিক্ষেপ করছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে। পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিলো রাঙামাটি-মহালছড়ির জলপথ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা।

রাঙামাটির নানিয়ার চরমুন্সি আব্দুর রউফ, বীরশ্রেষ্ঠ-এর সমাধী।

পাকিস্তানি বাহিনীর গোলাগুলির তীব্রতায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে যায় এবং তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করে ফেলে। অপ্রতুল যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে থামানো যাবে না। তাই তিনি তখন কৌশলগত কারণে পশ্চাৎপসারণের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি সহযোদ্ধাদের পিছু হটার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য, নিজ পরিখায় থেকে পাকিস্তানি স্পিডবোটগুলোকে লক্ষ্য করে অবিরাম গুলি বর্ষণ করতে থাকেন। এই সময় তিনি সাতটি স্পিডবোট একে একে ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হন। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দুটি লঞ্চ নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং রউফের মেশিনগানের গুলির আওতার বাইরে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী এরপর লঞ্চ থেকে মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করে। একটি মর্টারের গোলা তাঁর বাঙ্কারে এসে পরে এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন।  উল্লেখ্য, এই সেদিন আব্দুর রউফের আত্মত্যাগের কারণে তাঁর কোম্পানির প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার জীবন রক্ষা পায়। পরে তাঁকে রাঙামাটির নানিয়ার চরে তাঁর কবর দেওয়া হয়।

তাঁর অপরিসীম বীরত্ব, সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্ব্বোচ সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। বাংলাদেশ রাইফেলস ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহি মুন্সি আব্দুর রউফকে অনরারি ল্যান্স নায়েক পদে মরণোত্তর পদোন্নতি প্রদান করে।

স্মৃতি সম্মাননা


তথ্যসূত্র: