রাসবিহারী বসুর সুবলদহের গ্রাম্য পাঠশালায় (বর্তমানে সুবলদহ রাসবিহারী বসু প্রাথমিক বিদ্যালয়)
লেখাপড়া কেন। রাসবিহারী বসু শৈশবে লাঠিখেলা শিখেছিলেন সুবলদহ গ্রামের শুরিপুকুর ডাঙায়। তিনি সুবলদহ গ্রামে তার ঠাকুরদা কালিচরণ বসু এবং তার শিক্ষকদের কাছ থেকে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী গল্প শুনে তার বিপ্লবী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। শোনা যায় যে, তিনি ইংরেজদের মূর্তি তৈরি করতেন এবং লাঠি খেলার কৌশলে সেই মূর্তিগুলোকে ভেঙে ফেলতেন। তিনি ডাংগুলি খেলতে খুব ভালোবাসতেন। তিনি শৈশবে সুবলদহ গ্রামে ১২ থেকে ১৪ বছর ছিলেন, এছাড়াও তিনি পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়ে প্রয়োজনে সুবলদহ গ্রামে এসে আত্মগোপন করতেন।
পিতা বিনোদবিহারী বসু কর্মোপলক্ষে হিমাচল প্রদেশের সিমলায়
বদলী হয়েছিলেন। মূলত পিতামহের তত্ত্বাবধানে তিনি সুবলদহ পাঠশালার
পাঠ শেষ করে চন্দনগরের মর্টন স্কুল ও ডুপ্লে কলেজে
লেখাপড়া করেন। চন্দনগরে থাকার সময় অধ্যাপক চারু রায়ের প্রভাবে বিপ্লবী মনোভাবপন্ন
হয়ে পড়েন। এই সময় তাঁর অপরাপর বিপ্লবী বন্ধুরা ছিলেন কানাই দত্ত, শ্রীশ ঘোষ, মতি
রায় প্রমুখ।
তাঁর সশস্ত্র বিপ্লবের সাথে সংশ্লিষ্টতা প্রথম ধরা পরে আলিপুর বোমা বিস্ফোরণের
সূত্রে। পুলিশ এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে তাঁর লেখা দুটি
চিঠির সন্ধান পান। এই সূত্রে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে
প্রথম অভিযুক্ত হন। পুলিশ তাঁকে
গ্রেফতার করলেও প্রমাণের অভাবে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু তিন সর্বক্ষণ পুলিশের
নজরদারিতে থাকেন। তাই তিনি চন্দননগর ছেড়ে দেরাদুনে চলে যান এবং ফরেস্ট রিসার্চ
ইন্সটিটিউটে হেডক্লার্কের পদে যোগদান করেন। এই সময় তিনি থাকতেন পল্টন
বাজারের কাচে ঘোসি গলিতে থাকতেন তিনি।
দেরাদুনে
অবস্থানকালে তিনি বাংলা, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন।
এই সময় তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে আমীরচাঁদ, দীননাথ চট্টোপাধ্যায়,
অবোধবিহারী, বালমুকুন্দ প্রমুখের সাথে। এ ছাড়া যুগান্তরের অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের
সাথে তাঁর বিশেষ হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। পর্বর্তী সময়ে যতীন্দ্রনাথ
মুখোপাধ্যায়ের (বাঘ যতীন) সাথে
তাঁর বিপ্লবী সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু
হয়েছিল।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে ডিসেম্বর দিল্লিতে তৎকালীন ভাইসরয় সর্ড হার্ডিঞ্জকে স্বাগত জানানোর জন্য
আয়োজন করা হয়েছিল। এই সময় চাঁদনি চকের এক বাড়ি থেকে বসন্ত বিশ্বাস নামক এক ১৬
বছরের বালক স্ত্রীলোকের ছদ্মবেশে হাতিতে বসা ভাইসরয়ের দিকে বোমা নিক্ষেপ করেন। এই
হামলায় হার্ডিঞ্জ আহত হন।এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন রাসবিহারী বসু। তিনি বোমা তৈরিতে সাহায্যও করেছিলেন। বিস্ফোরণের পরদিনই
তিনি দেরাদুনে ফিরে আসেন এবং নিজের কাজের জায়গায় স্বাভাবিক কাজকর্ম করা শুরু করেন।
এই হামলার সাথে তিনি কোনো ক্রমেই দায়ী নন, তা প্রমাণ করার জন্য, কয়েক মাস পর হার্ডিঞ্জকে স্বাগত জানিয়ে এক অনুষ্ঠানের আয়োজনও করেছিলেন।
অনেকদিন পর্যন্ত এই মামলার সাথে তাঁর সম্পৃক্ততা পুলিশ বুঝতে পারেনি।
১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ শে জানুয়ারি হার্ডিঞ্জের উপর হামলাকারীকে ধরিয়ে দেওয়ার
জন্য লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশ হত্যাকারী সন্ধান পেলো না।
এরপর ১৭ই মে লাহোরের লরেন্স গার্ডেন্স- অবস্থিত পুলিশ ক্লাবে 'বিষিন দাস' নামক
শ্রমিকের ছদ্মবেশে- বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন বসন্ত দাস। এবারের লক্ষ ছিল সিলেটের
প্রাক্তন এসডিও এবং তখনকার পাঞ্জবের সহকারী পুলিশ কমিশনার গর্ডন। এই হামলায় তিনি
রক্ষা পেলেও একজন চাপরাশি মারা গিয়েছিলেন।
১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই-আগষ্ট মাসে
দামোদর নদের উপচে পড় জলে বর্ধমানে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয়। রাসবিহারী বন্যা বিধ্বস্ত বরধমানে
ত্রাণকাজের জন্য সুবলদহ গ্রামে ফিরে আসেন। এই সময়
যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘ যতীন) এই ত্রাণ কার্যে
অংশগ্রহণ করেছিলেন।
বাঘ যতীন সমস্ত জেলার বিপ্লবী নেতা-কর্মীদের বন্যার্তদের
পাশে দাঁড়াবার আহবান করেন। বন্যার্তদের মাঝে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে তিনি গোপন বৈঠকে
বিপ্লবের মাধ্যমে ইংরেজকে হঠানোর পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করে নেন। এসময় নিষিদ্ধ
সশস্ত্র বিপ্লবী দলগুলো যতীনকেই তাঁদের সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত করেন। এই সূত্রে
রাসবিহারীর সাথে তাঁর বিশেষ বন্ধত্ব গড়ে উঠে।
বছর শেষের দিকে উত্তর ভারত থেকে রাসবিহারী বসু এসে সর্বাধিনায়ক
বাঘ যতীনকে সংগঠনের কাজ সম্পর্কে কিছু নির্দেশ দেন। এই সময়
শচীন স্যানাল যুক্ত হলেন এই বিপ্লবী পরিকল্পনার সাথে।এতকিছু কর্মকাণ্ডের পিছনে
রাসবিহারী বসুর হাত থাকলেও, তখনও তিনি পুলিশের কাছে সন্দেহের ঊর্ধে ছিলেন। কিন্তু
ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে এক একটি সূত্র অনুসরণ করে, পুলিশ শেষ পর্যন্ত
রাসবিহারী বসুকে বিপ্লবী হিসেবে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল।
রাসবিহারীর বিপ্লবী পরিচয়ের সূত্র পুলিশ পেয়েছিল ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে নভেম্বর
কলকাতার রাজাবাজার এলাকায় একটি অভিযানে গিয়ে। এদিন পুলিশ বিপ্লবী অমৃত হাজরাকে
খুঁজতে গিয়েছিল।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে
প্রথম
বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ছিল ইংরেজদের প্রধান শক্র। তাই জার্মানি থেকে ভারতের
স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রচারকার্য চালানোর জন্য 'বার্লিন কমিটি' তৈরি করেছিলেন
সেখানকার ভারতীয় ছাত্ররা। এই বছরের নভেম্বর মাসে সানফ্রান্সিসকো থেকে 'গদর'-নেতা
সত্যেন্দ্রনাথ বসু কলকাতায় আসেন। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন বিষ্ণুগণেশ পিংলে, কর্তারসিং
সরাংগা-সহ বিরাট একদল 'গদর'-কর্মী। পরে যতীন এঁদেরকে কাশীতে বশবাসরত রাসবিহারী বসুর
সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। সত্যেন রাসবিহারীকে জানান যে, বার্লিনে বীরেন চট্টোপাধ্যায়
পরিচালিত বিপ্লবীরা খোদ কাইজারের সঙ্গে চুক্তি সই করেছেন। এই চুক্তি অনুসারে তারা
ভারতে বিপ্লবের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ পৌঁছে দেবে। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পাঠানো
কয়েকটি জাহাজ-এর দায়িত্ব নিয়েছেন ওয়াশিংটনে জার্মান রাষ্ট্রদূত ব্যার্নস্টর্ফ ও
তার মিলিটারী আতাশে ফন্পাপেন। কাইজারের সনদ নিয়ে একটি বিপ্লবী মিশন রওনা হচ্ছে
কাবুল অভিমুখে। পথে তারা জার্মানির হাতে বন্দী ব্রিটিশ সৈন্যবহরের ভারতীয়
জওয়ানদের নিয়ে গড়ে তোলা বাহিনী নিয়ে কাবুল থেকে কুচকাওয়াজ করে হাজির হবে
দিল্লীতে এবং যোগ দেবে সশস্ত্র অভ্যুত্থানে। এছাড়া বার্মা সীমান্তেও সৈন্যবাহিনী
প্রস্তুত থাকছে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে বিদ্রোহ ঘোষণা করার জন্য। এক্ষেত্রে
দূরপ্রাচ্যে বিভিন্ন জার্মান দূতাবাস ও কনস্যুলেট সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত রাখা
হয়েছে। সর্বোপরি বিপ্লব শুরু হলে ২০ হাজার যোদ্ধা ভারতে চলে আসবে।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের
প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সৈন্যবাহিনীর মধ্যে
সশস্ত্র বিদ্রোহের জাগরণ সৃষ্টি করতে অবিরত কাজ করা শুরু করেন যতীন। তিনি গোপনে
গোপনে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। দেশ-বিদেশ থেকে বিপ্লবী গদার
পার্টির হাজার হাজার সশস্ত্র সদস্যের অংশগ্রহণও নিশ্চিত হয়। সংগ্রহ করা হয় বিপুল
পরিমাণ গোলাবারুদ।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ আগস্ট 'আত্মোন্নতি সমিতির' প্রতিষ্ঠাতা বিপিন বিহারী
গাঙ্গুলির সাহায্যে কলকাতার ধর্মতলায় 'রডা অ্যান্ড কোম্পানি'-র দোকান থেকে
বিপ্লবীরা ৫০টি মাউজার পিস্তল ও ৪৬০০ রাউন্ড কার্তুজ লুঠ করেন। এই লুণ্ঠনে নেতৃত্ব
দিয়েছিলেন
বাঘ যতীন। এই সময় রাসবিহারী কাশীতে শচীন্দ্রনাথ সান্যালের
সাথে মিলিত হয়ে বেনারস সমিতি পুনরগঠন করেন। এই সময় তিনি যুক্তপ্রদেশে বৈপ্লবিক
কর্মকাণ্ড বিস্তারে উদ্যোগ নেন। এছাড়া উত্তর প্রদেশে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটানোর
জন্য লাহোর যান। কিন্তু পুলিশের নজরদারীতে পড়ে যাওয়ার জন্য, তিনি প্রথমে লাহোর থেকে
কাশীতে ফিরে আসেন। এরপর সেখান থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন।
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে
বাঘ যতীন রাসবিহারী বসু ও শচীন্দ্রনাথ স্যানালের সহযোগিতায়
বেনারস, দানাপুর, সিকোল, এলাহাবাদ, জব্বলপুর, মীরাট, দিল্লি, রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর,
আম্বালা, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানের সৈন্যদের 'জাতীয় অভ্যূত্থানের' জন্য অনুপ্রাণিত
করে তাঁদেরকে প্রস্তুতি নিতে বলেন। জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন
হয়। বিদ্রোহ ঘটানোর দিন ধার্য করা হয় ২১ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত।
বাঘ যতীনের সঙ্গে পরামর্শ করে রাসবিহারী এই দিন ধার্য্য
করেছিলেন। এই অভ্যুত্থানে উল্লেখ ছিল- বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে মহীসুর, লাহোর,
ফিরোজপুর, রাওয়ালপিণ্ডি, জব্বলপুর, বেনারস দখল করে তেরংগা ঝাণ্ডা উড়িয়ে দেওয়া
হবে। নীল হবে মুসলমান কর্মীদের প্রতীক; হলদে হবে শিখদের জন্য এবং লাল হবে
হিন্দুদের জন্য। কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে সমস্ত রেলপথ উড়িয়ে দেওয়া হবে,
যাতে করে সরকার পক্ষ প্রত্যুত্তরের জন্য সৈন্যবাহিনী না আনাতে পারে। কিন্তু পরে ২১
ফেব্রুয়ারির পরিবর্তন করে ১৯ ফেব্রুয়ারি করা হয়। প্রধান লক্ষ্যস্থল পাঞ্জাব
প্রদেশের লাহোর। সেইসঙ্গে বারাণসী ও জব্বলপুর সেনা ঘাঁটিও প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা
করে অধীরভাবে। রাসবিহারী বসু, শচীন স্যানাল ও হেরাম্বলালগুপ্ত এই সশস্ত্র বিপ্লবী
বাহিনীর প্রধান গুপ্ত দপ্তর স্থাপন করেন লাহোর শহরের ৪টি গুপ্তস্থানে।
বিপ্লবী রামশরণ দাসের বাড়িতে বিদ্রোহের আদেশ প্রদান করা হবে- এমনটা সিদ্ধান্ত নেওয়া
হয়েছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারি এই ষড়যন্ত্রের খবর ফাঁস করে দেয় রামশরণ দাস। এপর ব্রিটিশ
কর্তৃপক্ষ সৈন্য পাঠিয়ে বিভিন্ন স্থানের ভারতীয় সৈন্যদেরকে অস্ত্রহীন করে এবং ১৯
ফেব্রুয়ারি ৪টি প্রধান গুপ্ত দপ্তরের একটিতে অকস্মাৎ হামলা চালায়। বিপ্লবীদের একটি
দল ১৯ তারিখ সন্ধ্যেবেলায় লাহোরে নিযুক্ত ব্রিটিশ সেনানিবাসে হামলা চালিয়ে আগুন
জ্বালিয়ে দেয়। এই সশস্ত্র হামলায় দুপক্ষের অনেক লোক মারা যায়। ফিরোজপুরের যুদ্ধে
বিপ্লবীদের প্রায় ৫০ জন শহিদ হন। লাহোরের মাইকেল ও'ডায়ারের নেতৃত্বে প্রায় প্রতিটি
বাড়িতে তল্লাসী চালানো হয়েছিল। ৪টি প্রধান গুপ্ত দপ্তরের একটিতে পুলিশ ১৩জন
নেতৃস্থানীয় বিপ্লবীকে গ্রেফতার করা হলো। পুলিশের ধারণা ছিল এই আস্তানায় রাসবিহারী
বসু ও পিংলে-কে পাওয়া যাবে। কিন্তু এই ১৩ জনের ভিতরে রাসবিহারী বসু ও পিংলে-কে পাওয়া
যায় নি। মাইকেল ও'ডায়ারে তাঁর 'India
as I khnew it' গ্রন্থে এরূপ বিবরণই
পাওয়া যায়।
লাহোর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার পরে, রাসবিহারী নানা স্থানে আত্মগোপন করে কাটান। এই
ভাবে দীর্ঘদিন নজর এড়িয়ে থাকা অসম্ভব বিবেচনা করে, ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ মে
কলকাতার খিদিরপুর বন্দর থেকে জাপানি জাহাজ 'সানুকি-মারু' সহযোগে তিনি ভারতবর্ষ
ত্যাগ করেন। ভারত ত্যাগের আগে তিনি নিজেই পাসপোর্ট অফিস থেকে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়,
রাজা প্রিয়নাথ ঠাকুর ছদ্মনামে পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁরই তৎপরতায় জাপানি
কর্তৃপক্ষ ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের পাশে দাঁড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতা
সংগ্রামে সক্রিয় সমর্থন যোগায়।
রাসবিহারী জাপানে পৌঁছেছিলেন ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে। সেখানে তাঁর সাথে পরিচয়
ঘটেছিলে সে সময়ের তরুণ চীনা নেতা বিশ্ববরেণ্য বিপ্লবী সান ইয়াৎ সেনের সাথে। ২৭
নভেম্বর ভারতীয় অপর বিপ্লবী টোকিয়োতে লালা লাজপত রায়ের সঙ্গে সভা
করেন। ব্রিটিশরা রাসবিহারীর জাপানে আছেন এই সংবাদ পাওয়ার
পর রাসবিহারীকে ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রত্যার্পণের ব্যাপারে জাপ সরকারের উপর চাপ
সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ সরকারের চাপে জাপান সরকার তাঁকে নির্বাসনের আদেশ দেন। শেষ পর্যন্ত জাপানের তৎকালীন
প্রভাবশালী নেতা মিত্সুরু তোয়ামার সাহায্যে তিনি আত্মগোপন করেন
টোকিওর বাণিজ্য অঞ্চল শিনজুকুতে, নাকামুরায়া বেকারির বেসমেন্টে। পরে নাকামুরায়া থেকে আজাবু অঞ্চলে
তিনি বাড়ি ভাড়া নেন।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুলাই টোকিওর নাকামুরায়া বেকারির মালিকের
মেয়ে তোশিকো সোমাকে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের পর শিবা অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় ভাড়াবাড়িতে উঠলেন নবদম্পতি। কিছু দিনের মধ্যেই গোয়েন্দারা
তাঁর অবস্থানের কথা জেনে যায়। ফলে তাঁকে আবার বাসা পাল্টাতে হয়। এইভাবে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জাপানের বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেড়াতে
থাকেন। পরে তাঁর উপর থেকে
জাপান সরকার নির্বাসন আদেশ তুলে নিয়েছিল।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ আগস্ট
এঁদের প্রথম সন্তান মাশাহিদের জন্ম হয়। তাঁর ভারতীয় নাম ছিল ভারতচন্দ্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
সময় মাত্র ২৪ বছর বয়সে যুদ্ধক্ষেত্রে মাশাহিদের মৃত্যু হয়েছিল। তাঁর অপর সন্তান
তেৎসুকো হিগুচি বসু'র জন্ম ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর। এই সূত্রে ১৯২৩
খ্রিষ্টাব্দের ২ জুলাই তিনি জাপানের নাগরিকত্ব লাভ করেন। এবং সেখানে তিনি সাংবাদিক-লেখক হিসেবে বাস করতে থাকেন সাংবাদিক
তথা লেখক হিসেবে। সে সময়ে রাসবিহারী নাকামুরায়ার বোস নামে পরিচিত ছিলেন। এরপর
তীব্র ভূমিকম্পে এঁদের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ফলে তিনি প্রচণ্ড আর্থিক কষ্টে পড়ে
যান। এই সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কিছু অর্থ সাহায্য করেছিলেন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে
রবীন্দ্রনাথ যখন জাপানে যান, তখন তিনি রাসবিহারীর বাসায় গিয়েছিলেন।
রাসবিহারীর জাপানি স্ত্রী তোশিকো যক্ষ্মায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮-২৯ মার্চ টোকিওতে তাঁর ডাকে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ বা ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি সেই সম্মেলনে একটি সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেন। ২২ জুন ব্যাংককে তিনি লীগের দ্বিতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র বসু কে লীগে যোগদান ও এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। যেসব ভারতীয় যুদ্ধবন্দি মালয় ও বার্মা ফ্রন্টে জাপানিদের হাতে আটক হয়েছিল তাদেরকে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগে ও লীগের সশস্ত্র শাখা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে যোগদানে উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে জাপানি সেনাকর্তৃপক্ষের একটি পদক্ষেপে তার প্রকৃত ক্ষমতায় উত্তরণ ও সাফল্য ব্যাহত হয়। তাঁর সেনাপতি মোহন সিংকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির নেতৃত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁর সাংগঠনিক কাঠামোটি থেকে যায়।
রাসবিহারী বসু ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি ( আজাদ হিন্দ ফৌজ নামেও পরিচিত) গঠন করেন।
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জানুয়ারি জাপানে রাসবিহারী বসুর মৃত্যু হয়।
সম্মাননা: