যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
(বাঘা যতীন)
১৮৭৯-১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দ
ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী বাঙালি বিপ্লবী।
বিশেষ নাম বাঘা যতীন।
১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার কয়া গ্রামে
জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মায়ের নাম শরৎশশী। তিনি ছিলেন স্বভাবকবি।
তাঁর শৈশব কেটেছিল ঝিনাইদহ জেলায় তাঁদের পৈতৃক বাড়িতে। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে যতীনের
পাঁচ বৎসর বয়সে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। এরপর তাঁর মা এবং বড় বোন বিনোদবালার সাথে তিনি মাতামহের বাড়ি কয়াগ্রামে চলে যান। যতীন শৈশব থেকেই শারীরিক শক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। শুধুমাত্র একটি ছোরা নিয়ে তিনি একাই একটি বাঘকে হত্যা করতে সক্ষম হন বলে তার নাম রটে যায় বাঘা যতীন।
১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে এন্ট্রান্স পাস করে তিনি কলকাতা সেন্ট্রাল কলেজে (বর্তমানের ক্ষুদিরাম বোস সেন্ট্রাল কলেজ) ভর্তি হন।
এই সময় এই কলেজের পাশেই এক বাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দ বাস করতেন। এখানে তিনি বিবেকানন্দের সংস্পর্শে
আসেন এবং স্বাধীনতার জন্য আধ্যাত্মিক বিকাশের কথা ভাবতে শুরু করেন। এসময়ে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিবেকানন্দের আহবানে যতীন তার বন্ধুদের দল নিয়ে এই রোগে আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিত হন।
স্বামী বিবেকানন্দের পরামর্শে যতীন শরীরচর্চার জন্য অম্বু গুহের কুস্তির আখড়ায় যোগ দেন। সেখানে তাঁর
পরিচয় ঘটে- শচীন বন্দোপাধ্যায়, শচীনের পিতা যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের সাথে।
উল্লেখ্য, যোগেন্দ্রনাথ তখনকার ইউরোপের মাৎসিনি, গারিবল্ডি প্রমুখ ইতালীয় বিপ্লবীদের জীবনের আলেখ্য রচনা করেছিলেন।
কলেজ পাঠের পাশাপাশি যতীন অ্যাটকিনসন সাহেবের স্টেনো টাইপিংয়ের ক্লাসে ভর্তি হন। ১৮৯৯
খ্রিষ্টাব্দে মজঃফরপুর চলে যান। সেখানে তিনি ব্যারিস্টার কেনেডীর সেক্রেটারি হিসাবে কাজে যোগ দেন।
তখন তাঁর বেতন ধার্য হয়েছিল মাসিক ৫০ টাকা। ভারতের জন্য মজুদ অর্থ দিয়ে ইংরেজ সরকার সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করছে সাম্রাজ্য রক্ষার স্বার্থে, তার বিরুদ্ধে কেনেডি কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে বক্তৃতা
দিতেন। কেনেডি'র স্ত্রী ও কন্যার জীবননাশ ঘটেছিল ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর বোমায়।
এই কেনেডির উৎসাহে মজঃফরপুরের তরুণদের জন্য যতীন ফুটবল ও অ্যাথলেটিক ক্লাব গড়ে তুলেন।
এই অবস্থায় হঠাৎ তাঁর মা শরৎশশীর অসুস্থতার সংবাদে যতীন কয়াগ্রামে আসেন। এখানে এসে
তিনি জানতে পারেন যে, এক কলেরা রোগীর সেবা করতে গিয়ে তার সংক্রমণে মায়ের মৃত্যুবরণ করেছেন।
পরে তাঁর দিদি বিনোদবালার কাছে যতীন জানতে পারেন যে, তার প্রয়াত মা কুমারখালীর উমাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে ইন্দুবালার সাথে যতীনের বিয়ের সম্বন্ধ করেছিলেন।
মায়ের ইচ্ছাপূরণের জন্য ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইন্দুবালাকে বিয়ে করেন। এই স্ত্রীর
গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাদের ৪টি সন্তান। এঁরা হলেন- অতীন্দ্র (১৯০৩-০৬), আশালতা (১৯০৭-৭৬), তেজেন্দ্র (১৯০৯-৮৯) এবং বীরেন্দ্র (১৯১৩-৯১)।
বিবাহের পর যতীন মজঃফরপুরে ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কেনেডী এই সংবাদ
জানতে পেরে, তাঁর বন্ধু বাংলা সরকারের অর্থসচিব হেনরি হুইলারের কাছে একটি চিঠি
লেখেন। এই চিঠিতে তিনি যতীনের জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
এই সুবাদে যতীনকে হুইলার নিজের স্ট্যানোগ্রাফার হিসাবে নিয়োগ দেন। এখানে তিনি
পেতেন মাসিক ১২০ টাকা। যতীনের পেশাগত নৈপুণ্যের সঙ্গে তার আত্মসম্মানবোধ ও দেশপ্রেম মুগ্ধ করে হুইলারকে।
১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ তাঁর মামা
ললিতমোহন চট্টোপাধ্যায়ের
সাথে বৈপ্লবিক আলোচনায় আসা-যাওয়া শুরু করেন। এই বাড়িতেই
অরবিন্দ ঘোষ
ও
অপর বিপ্লবী
যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে পরিচিত হন। এরপর তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন ধীরে ধীরে অরবিন্দের ঘনিষ্ট সহযোগী হিসেবে
পরিচিতি লাভ করেন। এই সময় তিনি শরীর গঠন আখড়ায় গাছে চড়া, সাঁতার কাটা ও বন্দুক ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। যুগান্তর দলে কাজ করার সময় নরেনের (এম.এন রায়) সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং একে-অপরের আস্থাভাজন হন।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে যুবরাজের ভারত সফরকালে কলকাতায় বিরাট শোভাযাত্রা উপলক্ষে যতীন স্থির করলেন এদেশে ইংরেজদের আচরণ প্রত্যক্ষ করাবেন যুবরাজকে।
তিনি দেখেন যে একটি ঘোড়াগাড়ির ছাদে একদল ইংরেজ সৈনিক হাসি-ঠাট্টা করছেন এবং তাদের বুটসমেত পা দুলছে গাড়ীর যাত্রী,
ও দেশী মহিলার নাকের সামনে। যুবরাজ নিকটবর্তী হওয়ামাত্র যতীন সৈনিকদের নেমে আসার
অনুরোধ করেন এবং তাদের গাড়িতে উঠলে সৈনিকরা তাঁকে প্রহার করেন। বিষয়টি দেখে যুবরাজ তার গাড়ী থামাতে বলেন।
পরে যুবরাজ দেশে ফিরে গিয়ে ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মে দীর্ঘ আলোচনা করে এর
প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে বলেন। এই বছরে তাঁর বড় ছেলে অতীন্দ্রের মৃত্যু হয়।
পুত্রের অকাল মৃত্যুর শোকে মুহ্যমান যতীন দিদি বিনোদবালা আর স্ত্রী ইন্দুবালাকে নিয়ে তীর্থভ্রমণে বের হন। হরিদ্বারে তারা স্বামী ভোলানন্দ গিরি'র কাছে দীক্ষা নিয়ে অন্তরের
শান্তি ফিরে পেলেন। এই বছরেই যতীন
এই সময় অরবিন্দ
ঘোষের শিষ্য
বারীন্দ্রকুমার ঘোষের
সাথে পরিচয় ঘটে এবং
'অনুশীলন
সমিতি'র
কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি এই সময় একটি বোমা কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এই কারখানার অভিজ্ঞতা নিয়ে অবিলম্বে
তিনি কলকাতার মানিকতলায় বারীণ আরো বড় করে কারখানা খোলেন। পরে নানা কারণে যতীনের সাথে
বারীন্দ্রকুমার বিরোধ ঘটে।
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে স্যার ডেনিয়েল হ্যামিলটনের সহযোগিতায় যতীন একাধিক মেধাবী ছাত্রকে বৃত্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন তারকনাথ দাস, গুরনদিৎ কুমার, শ্রীশ সেন, অধর লস্কর, সত্যেন সেন, জিতেন লাহিড়ি, শৈলেন ঘোষ
প্রমুখ। এদের কাছে নির্দেশ ছিল যে, তাঁর যেন উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক লড়াইয়ের কায়দা ও বিস্ফোরক প্রস্তুতের তালিম নিয়ে আসেন।
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে বিশেষ কর্ম-দায়িত্ব নিয়ে হুইলারের সচিবদের সংগে যতীন সপরিবারে দার্জিলিংয়ে স্থানান্তরিত
হন। সমস্ত উত্তর বাংলার মতো এখানেও যতীন "অনুশীলন
সমিতি'র-এর সক্রিয় শাখা স্থাপন করেছিলেন।
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রিল, রাত সাড়ে বারটায় বিহারের মুজাফ্ফরপুর ইউরোপীয়ান ক্লাবের সামনে
ক্ষুদিরাম বসু
ও প্রফুল্ল চাকী বোমা নিক্ষেপ করেন। এই বোমা হামলার পর পুলিশ অনুসন্ধানের সূত্রে ২রা মে
৩২ নম্বর মুরারিপুকুরের বাগান বাড়িতে বোমা তৈরির কারখানা আবিষ্কার করেন এবং বোমা তৈরি মূল পরিকল্পনাকারী
হিসেবে বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ এই বোমা হামলার তদন্তের সূত্রে
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে মে মামলা দায়ের করে। ঐতিহাসিকভাবে এই মামলা 'আলীপুর বোমা মামলা' নামে চিহ্নিত করা হয়।
এই মামলার রায় প্রকাশিত হয় ৬ই মে। এই রায় অনুসারে বারীন ঘোষকে ফাঁসি দেওয়া হয়। পরে আপিলে তিনি তাঁর
মৃত্যুদণ্ড রহিত করা হয় এবং ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়।
এই বোমা হামলায় ব্যবহৃত বোমা তৈরির সাথে বাঘা যতীনের সংম্পৃক্ততা থাকলে, পুলিশ বাঘা
যতীনের 'বাংলা গভর্নরের পার্সোনাল সেক্রেটারি' হওয়ার সুবাদে রেহাই পান। কিন্তু
তাঁর উপর পুলিশী নজর তীব্রতর করা হয়।
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে ক্যাপ্টেন মার্ফি ও লেফটেন্যান্ট সমারভিল প্রমুখ চারজন সামরিক অফিসারের সঙ্গে যতীনের মারপিট হয় শিলিগুড়ি স্টেশনে। চারজনের চোয়াল ভেঙ্গে ধরাশায়ী করে দেবার অপরাধে যতীনের নামে মামলা রুজ্জু হলে সারাদেশে বিপুল হর্ষ জাগে-কাগজে কাগজে। এই নিয়ে লেখালেখির বহর দেখে সরকার চাপ দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করে।
এই বছরে যতীন অস্ত্র-ব্যবসায়ী নূর খাঁর কাছ থেকে অস্ত্র কিনে বাদা অঞ্চলে রাজনৈতিক
কর্মীদের মধ্যে বিতরণ করতেন। এসব অস্ত্র দিয়ে কর্মীরা সংগঠনের জন্য ডাকাতি করতেন।
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২ জুন মাস থেকে ধীরে ধীরে এই কার্যক্রম বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ডাকাতির পাশাপাশি এঁরা ইরেজ রাজকর্মচারী এবং ইংরেজের সহযোগী দেশীয় দালালদের
হত্যাকাণ্ড শুরু করে। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে ১০ ফেব্রুয়ারি প্রসিকিউটর আশু বিশ্বাসের হত্যা
করে।
১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ নভেম্বর ব্রিটিশ সরকার ম্যাজিস্ট্রেট সামসুল
আলমকে স্পেশাল ক্ষমতা দেন। এই ক্ষমতাবলে তিনি যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারবেন।
ব্রিটিশ সরকারের দেয়া এই ক্ষমতাবলে ম্যাজিস্ট্রেট সামসুল আলম বিপ্লবীদের
উপর গ্রেফতার ও অকথ্য নির্যাতন শুরু করে। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি কলকাতা হাইকোর্ট
থেকে সিড়ি বেঁয়ে নামার সময়,
সামসুল আলমকে বিপ্লবী বীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তকে গুলি করে হত্যা করেন। যতীনের নির্দেশে
এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, এই তথ্য জানার পর
ব্রিটিশ সরকার যতীনের উপর গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করে। যতীন তখন কয়েকজন সহযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে কলকাতার ২৭৫ নং আপার
চিৎপুর রোড়ের বাড়িতে তাঁর এক অসুস্থ মামার সেবাযত্ন করছিলেন। সেই বাড়ি থেকে যতীনকে
টেগার্ট গ্রেফতার করে। এরপর যতীনের উপর অকথ্য নির্যতন চালিয়ে কোনো গোপন আদায় করতে
পুলিশ ব্যর্থ হয়। হতাশ হয়ে তাঁকে প্রথমে প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হয় রাজনৈতিক কয়েদী
হিসেবে। পরে
তাঁকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তর করা হয়েছি। সরকার পক্ষ তাঁর নামে মামলাকে 'হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা'
নামে অভিহিত করেছিল। এ মামলা চলেছিল এক বছরেরও বেশী সময় ধরে। এ সময় '"অনুশীলন
সমিতি'কে বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটিশদের
নির্মম অত্যাচারের ফলে কয়েকজন বিপ্লবী মারা যান এবং কয়েকজন পাগল হয়ে যান। যথাযথ
প্রমাণের অভাবে যতীনকে দোষী প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের একুশ ফেব্রুয়ারি যতীন এ মামলা থেকে মুক্তি পান।
জেল থেকে মুক্তি লাভের পর তিনি তাঁর দিদি বিনোদবালা, স্ত্রী
ইন্দুবালা, কন্যা আশালতা আর দু'বছরের ছেলে তেজেন্দ্রনাথকে নিয়ে যশোরের ঝিনাইদাতে
বসবাস শুরু করেন। এসময় তিনি ঠিকাদারী ব্যবসা শুরু করে ব্রিটিশ সরকারকে
পুরোপুরী সংসারী হওয়ার চিত্র দেখান। যশোর শহরে আর মাগুরাতে তাঁর দুটি শাখা অফিস ছিল।
ব্যবসার আড়ালে গোপনে গোপনে বিপ্লবী কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এ সময় তিনি নরেন
সন্ন্যাসী নামে পুরো ভারত চষে বেড়ান এবং বিভিন্ন স্থানে বিপ্লবীদের একত্র করার কাজ
চালিয়ে যান।
১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে ভীষণ বন্যা ও মহামারীর শুরু হলে, যতীন তাঁর দলবল নিয়ে বর্ধমান ও
কাশীতে বন্যার্তদের সেবা-যত্ন শুরু করেন। এসময় তিনি সমস্ত জেলার বিপ্লবী
নেতা-কর্মীদের বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াবার আহবান করেন। বন্যার্তদের মাঝে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে যতীন গোপন বৈঠকে
বিপ্লবের মাধ্যমে ইংরেজকে হঠানোর পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করে নেন। এসময় নিষিদ্ধ
সশস্ত্র বিপ্লবী দলগুলো যতীনকেই তাঁদের সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত করেন। এই সময় তাঁর
সাথে পরিচয় ঘটেছিল বিপ্লবী
রাসবিহারী বসু-এর
সাথে।
রাসবিহারী বসু
ইতিমধ্যে
লাহোর বিপ্লবের পরিকল্পনা করে ফেলেছিলেন। ওই বছর শেষের দিকে উত্তর ভারত
থেকে
রাসবিহারী
এসে সর্বাধিনায়ক যতীনকে সংগঠনের কাজ সম্পর্কে কিছু নির্দেশ দেন।
এই সময় শচীন স্যানাল যুক্ত হলেন এই বিপ্লবী পরিকল্পনার সাথে।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে
জার্মানি ছিল ইংরেজদের প্রধান
শক্র। তাই জার্মানি থেকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রচারকার্য চালানোর জন্য 'বার্লিন
কমিটি' তৈরি করেছিলেন সেখানকার ভারতীয় ছাত্ররা।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে সানফ্রান্সিসকো থেকে 'গদর'-নেতা সত্যেন্দ্রনাথ বসু
কলকাতায় আসেন।
তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন বিষ্ণুগণেশ পিংলে, কর্তারসিং সরাংগা-সহ বিরাট একদল 'গদর'-কর্মী।
পরে যতীন এঁদেরকে কাশীতে বশবাসরত রাসবিহারী বসুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। সত্যেন
রাসবিহারীকে জানান যে, বার্লিনে বীরেন চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত বিপ্লবীরা খোদ কাইজারের সঙ্গে চুক্তি সই করেছেন।
এই চুক্তি অনুসারে তারা ভারতে বিপ্লবের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ পৌঁছে দেবে। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পাঠানো কয়েকটি জাহাজ-এর দায়িত্ব নিয়েছেন ওয়াশিংটনে জার্মান রাষ্ট্রদূত ব্যার্নস্টর্ফ ও তার মিলিটারী আতাশে ফন্পাপেন। কাইজারের সনদ নিয়ে একটি বিপ্লবী মিশন রওনা হচ্ছে কাবুল অভিমুখে। পথে তারা জার্মানির হাতে বন্দী ব্রিটিশ সৈন্যবহরের ভারতীয় জওয়ানদের নিয়ে গড়ে তোলা বাহিনী নিয়ে কাবুল থেকে কুচকাওয়াজ করে হাজির হবে দিল্লীতে
এবং যোগ দেবে সশস্ত্র অভ্যুত্থানে। এছাড়া বার্মা সীমান্তেও সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত থাকছে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে বিদ্রোহ ঘোষণা করার
জন্য। এক্ষেত্রে দূরপ্রাচ্যে বিভিন্ন জার্মান দূতাবাস ও কনস্যুলেট সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত
রাখা হয়েছে। সর্বোপরি বিপ্লব শুরু হলে ২০ হাজার যোদ্ধা ভারতে চলে আসবে।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত
সৈন্যবাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের জাগরণ সৃষ্টি করতে অবিরত কাজ করা শুরু করেন যতীন।
তিনি গোপনে গোপনে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। দেশ-বিদেশ
থেকে বিপ্লবী গদার পার্টির হাজার হাজার সশস্ত্র সদস্যের অংশগ্রহণও নিশ্চিত হয়।
সংগ্রহ করা হয় বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ আগস্ট 'আত্মোন্নতি সমিতির' প্রতিষ্ঠাতা বিপিন বিহারী গাঙ্গুলির সাহায্যে কলকাতার ধর্মতলায়
'রডা অ্যান্ড কোম্পানি'-র দোকান থেকে
বিপ্লবীরা ৫০টি মাউজার পিস্তল ও ৪৬০০ রাউন্ড কার্তুজ লুঠ করেন। এই লুণ্ঠনে নেতৃত্ব
দিয়েছিলেন বাঘাযতীন।
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাসবিহারী বসু ও শচীন্দ্রনাথ স্যানালের
সহযোগিতায় বেনারস, দানাপুর, সিকোল, এলাহাবাদ, জব্বলপুর, মীরাট, দিল্লি,
রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর, আম্বালা, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানের সৈন্যদের 'জাতীয়
অভ্যূত্থানের' জন্য অনুপ্রাণিত করে তাঁদেরকে প্রস্তুতি নিতে বলেন।
জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। বিদ্রোহ ঘটানোর দিন ধার্য করা
হয় ২১ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত। যতীনের সঙ্গে পরামর্শ করে রাসবিহারী এই দিন ধার্য্য
করেছিলেন। এই অভ্যুত্থানে উল্লেখ ছিল- বিপ্লবের প্রথম পর্যায়েমহীসুর, লাহোর, ফিরোজপুর, রাওয়ালপিণ্ডি, জব্বলপুর, বেনারস
দখল করে তেরংগা ঝাণ্ডা উড়িয়ে দেওয়া হবে। নীল হবে মুসলমান কর্মীদের প্রতীক; হলদে
হবে শিখদের জন্য এবং লাল হবে হিন্দুদের জন্য। কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে সমস্ত রেলপথ উড়িয়ে দেওয়া হবে, যাতে করে সরকার পক্ষ প্রত্যুত্তরের জন্য সৈন্যবাহিনী না আনাতে পারে। কিন্তু পরে ২১ ফেব্রুয়ারির পরিবর্তন করে ১৯ ফেব্রুয়ারি
করা হয়। প্রধান লক্ষ্যস্থল পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোর। সেইসঙ্গে বারাণসী ও জব্বলপুর
সেনা ঘাঁটিও প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করে অধীরভাবে। রাসবিহারী বসু, শচীন
স্যানাল ও হেরাম্বলালগুপ্ত এই সশস্ত্র বিপ্লবী বাহিনীর প্রধান গুপ্ত দপ্তর স্থাপন
করেন লাহোর শহরের ৪টি গুপ্তস্থানে।
বিপ্লবী রামশরণ দাসের বাড়িতে বিদ্রোহের আদেশ
প্রদান করা হবে- এমনটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারি এই ষড়যন্ত্রের খবর ফাঁস করে দেয় রামশরণ দাস।
এপর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সৈন্য পাঠিয়ে
বিভিন্ন স্থানের ভারতীয় সৈন্যদেরকে অস্ত্রহীন করে এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি ৪টি গুপ্ত প্রধান
দপ্তরের একটিতে অকস্মাৎ হামলা চালায়। বিপ্লবীদের একটি দল ১৯ তারিখ সন্ধ্যেবেলায়
লাহোরে নিযুক্ত ব্রিটিশ সেনানিবাসে হামলা চালিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এই সশস্ত্র
হামলায় দুপক্ষের অনেক লোক মারা যায়। ব্রিটিশ প্রশাসন সমস্ত শক্তি দিয়ে এই সশস্ত্র বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র দমন করতে সক্ষম হয়।
এটাই ঐতিহাসিক 'লাহোর ষড়যন্ত্র' নামে পরিচিত।
এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ ফেব্রুয়ারি যতীন এক গুপ্ত বৈঠকে,
দায়িত্বশীল দলনেতাদের করণীয় দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। এ সময় সুরেশ নামক এক গোয়েন্দা পুলিশ অফিসার
এই সংবাদ জানতে পারে। ২৮শে ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা সুরেশ সদলবলে টহলে বেরিয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়লাট যাবেন-তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা পাকা করতে। সুরেশকে যতীনের সহকারীরা
চিত্তরায় গুলি করে পালিয়ে যায়। আহত সুরেশ মৃত্যুর আগে লিখিত বক্তব্যে বলেন
যে, যতীনের সঙ্গীরা তাকে মেরেছে।
তাই ব্রিটিশ সরকার যতীনের উপর আবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে এবং তাঁকে
জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মোটা অংকের টাকা ঘোষণা করে।
ইতিমধ্যে জার্মান সরকার জানিয়েছিল, অস্ত্র বোঝাই ৩টি জাহাজ ভারতের উড়িষ্যা উপকূলে পাঠাবে: সেই অনুযায়ী, ম্যাভেরিক, আ্যানি লার্সেন ও হেনরি-এস নামে তিনটে জাহাজ রওনা
দেয়। কৃপাল সিং নামে এক বিশ্বাসঘাতক 'গদর' কর্মীর রাসবিহারী'র প্রচেষ্টার কথা
প্রকাশ করে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চেকোস্লোভাকিয়া থেকে সমাগত বিপ্লবীরা ইন্দো-জার্মান সহযোগিতার সংবাদ ফাঁস করে দেয়। মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের উদ্যোগে জার্মান সরকারের
সঙ্গে জার্মান বিভিন্ন দূতাবাসের পত্র ও তারবার্তা হস্তগত করে। সব মিলিয়ে পুরো
পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যায়। তিনটি জাহাজের একটি
হাতিয়ায়, একটি সুন্দরবনের রায়মঙ্গলে এবং একটি ওড়িশার বালেশ্বর উপকূলে পৌঁছনোর
কথা ছিল। ইংরেজ সরকার আটক করে তিনটে জাহাজকেই। বালেশ্বরে বাঘা যতীনের গোপন
আস্তানাতেও হানা দেয় পুলিশ। উল্লেখ্য, সুন্দরবনের জাহাজের অস্ত্র গ্রহণের দায়িত্বে
ছিলেন
যতীন্দ্রনাথ ঘোষাল।
তিনি শেষ পর্ন্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।
পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়ে বাঘাযতীন ও
তার সঙ্গী বিপ্লবীদের পিছু নিয়েছিলেন। বিপ্লবীরা অনাহারে-অর্ধাহারে এক জায়গা থেকে
আরেক জায়গায় পালিয়ে যেতে লাগলেন। এই সময় বাঘাযতীন পাল্টা
আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এই সময় ব্রিটিশ পুলিশরা বাঘা যতীনদের দলবলকে
ডাকাত বলে গ্রামে গ্রামে প্রচার করেছিল। তাই স্থানীয় মানুষদের কেউ কেউ ভয় পেয়ে
এবং ডাকাত ধরানোর পুরস্কারের লোভে বাঘাযতীনের গতিবিধির খবর জানিয়ে দিচ্ছিল
পুলিশকে।
৭ সেপ্টেম্বর গভীর রাত্রে যতীন নিজের সাময়িক আস্তানা মহলডিহাতে ফিরে আসেন।
একদিন বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বুড়িবালাম নদীর তীরে দোকানে চার সঙ্গীদের
নিয়ে খেতে বসেছিলেন বাঘাযতীন। পুলিশ গুপ্তচরের মাধ্যমে এই খবর পেয়ে এঁদের
ধরবার জন্য অগ্রসর হয়। এদের সহায়তা করেছিল বালেশ্বরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিলবি ও মিলিটারি লেফটেন্যান্ট রাদারফোর্ড।
বাঘা যতীনের
সঙ্গে ছিলেন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, জ্যোতিষচন্দ্র পাল, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত এবং নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। বাঘাযতীনও বিপদ আঁচ করে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হলেন। আশ্রয় নিলেন পরিখার
আড়ালে। পুলিশের সঙ্গে তাঁদের গুলির যুদ্ধ শুরু হল। ৮ সেপ্টেম্বর সারাদিন কেটে গেল গভীর জঙ্গলে। সারারাত পায়ে হেঁটে ৯ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা পৌঁছলেন বালেশ্বরের নদী বুড়ি বালামের উপকণ্ঠে।
পরে সাঁতার কেটে নদীর ওপারে গিয়ে যুদ্ধের পক্ষে মোটামুটি উপযুক্ত শুকনো এক ডোবার মধ্যে আশ্রয়
নেন। ১৯১৫ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর
স্বাধীনতা সংগ্রামের এক পবিত্র রণক্ষেত্রে পরিণত হল বুড়িবালামের তীর। গুলির যুদ্ধে
সেখানে চিন্তপ্রিয় রায়চৌধুরী শহিদ হলেন। গুরুতর আহত হলেন বাকি তিন জন। তাঁদের
গুলির সব ফুলিয়ে গিয়েছিল। পরে যতীন-সহ জ্যোতিষচন্দ্র পাল, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত এবং নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত
পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।
৯ সেপ্টেম্বর সূর্যাস্তের দিকে যতীন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। পরদিন বালেশ্বর সরকারি হাসপাতালে যতীন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
বিচারে জ্যোতিষচন্দ্র পাল, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত এবং নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের
১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল।