সাহানা দেবী
১৮৯৭-১৯৯০
সঙ্গীতশিল্পী।
১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
পিতামহ কালীনারায়ণ গুপ্ত ছিলেন সমাজসেবক এবং ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক। তাঁর পিতা প্যারীমোহন গুপ্ত
ছিলেন সিভিল সার্জেন। মায়ের নাম তরলা দেবী।
তাঁর জন্মের দেড় বছর পর, পিতা প্যারীমোহন গুপ্তের মৃত্যু হয়। এরপর তরলাদেবী শিশু
সাহানাকে নিয়ে তাঁর বাবার বাড়ি চলেন। সাহানার মামা বাড়িতে সঙ্গীতের চর্চা ছিল। তাঁর
মামা দেশবন্ধু
চিত্তরঞ্জন দাশ রাকনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে এবং আইনজীবী হিসেব বিখ্যত হলেও,
সঙ্গীতের প্রতি তাঁর প্রবল অনুরাগ ছিল। তিনি বেশকিছু গানও রচনা করেছিলেন। আর তাঁর
মাসি অমলা দাশ ছিলেন প্রখ্যত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। সাহানা দেবীর সঙ্গীতে হাতেখড়ি
হয়েছিল অমলা দাশের কাছে।
১৯০৫-০৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে নাগাদ ভবানীপুরের পোড়াবাজার মাঠে আয়োজিত এক প্রদর্শনীতে অমলা দাশের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় ‘মায়ার খেলা’ ও ‘কালমৃগয়া’।
এর ভিতরে কালমটগয়াতে ঋষিকুমার-এর ভূমিকায় গান ও অভিনয় করে দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ
করেন।
১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে ডাক্তার বিজয়কুমার বসুর সঙ্গে বিয়ে হয় সাহানা দেবীর। তিনি থাকতেন কাশীতে। ১৯১৭ থেকে ১৯২২
খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি স্বামীর সাথে কাশীতে ছিলেনা। ওই সময়ে রবীন্দ্রনাথ সেখানে গিয়ে কিছু দিন ছিলেন এবং তখন সাহানাকে বেশ কয়েকটি গান শিখিয়েছিলেন।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় লালা লাজপত রায়ের সভাপতিত্বে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন বসে। এখানে সরলা দেবী চৌধুরানীর পরিচালনায় সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত ‘বন্দে মাতরম্’ গানে গলা মিলিয়েছিলেন সাহানা।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের গয়া-কংগ্রেসে সভাপতি ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন। এখানেও সাহানা দেবী ও সতী দেবী মিলে গেয়েছিলেন ‘বন্দে মাতরম্’। স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায়
এই বছরে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। কাশীতে থাকার সময়
সঙ্গীতজীবনের কিছুটা ভাটা পড়েছিল। কলকতায় ফিরে তিনি আবার গানের ভিতরে ডুবে গেলেন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে কলকাতার এম্পায়ার রঙ্গমঞ্চে চার দিন ধরে অভিনীত হয়
রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটক। এই নাটকে জয়সিংহের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ও রঘুপতির
ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন দিনেন্দ্রনাথ । এ নাটকে রবীন্দ্রনাথ সাহানাকে নিয়েছিলেন গানের জন্যে। এ নাটকে
প্রথমে তিনটি গান ছিল। গানগুলো হলো- ‘ওগো পুরবাসী’, ‘আমি একলা চলেছি এ ভবে’ এবং ‘থাকতে আর তো পারলি নে মা’।
সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে সাহানা যুক্ত হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ সাতটি গান যুক্ত করেছিলেন।
এর ভিতরে মধ্যে দু’টি পুরনো গান, ‘তিমিরদুয়ার খোলো’ ও ‘দিন ফুরালো হে সংসারী’। আর
নতুন গান ছিল- ‘আমার আঁধার ভালো’, ‘কোন ভীরুকে ভয় দেখাবি’, ‘আঁধার রাতে একলা পাগল’, ‘আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে’ এবং ‘জয় জয় পরমা নিষ্কৃতি হে নমি নমি’।
উল্লেখ্য, গানগুলি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে
রবীন্দ্রনাথের কাছে শিখিয়েছিলেন।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে সাহানা দেবী প্রথম বার রেকর্ডে দুটি
রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন। গান দুটি হলো— ‘আমার যাবার বেলায়’ এবং ‘যদি তারে নাই চিনি গো’।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। এই সময় রবীন্দ্রনাথ সাহানাকে আশ্রমের একটি আলাদা বাড়িতে রেখেছিলেন।
পরে সেখান থেকেই নৈনিতালের কাছে এক স্যানেটোরিয়মে চলে যান। ট্রেনে
কাশী পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ তাঁর যাত্রাসঙ্গী ছিলেন। সাহানা লখনউতে প্রথমে অতুলপ্রসাদের
বাড়িতে ওঠেন এবং সেখান থেকে পরদিন স্যানেটোরিয়মে চলে যান।
এরপর
দিলীপকুমার রায়ের সংস্পর্শে এসে সাহানা দেবীর শেষ জীবন মোড় নিয়েছিল আধ্যাত্মিক অভিমুখে। বিপ্লবী অরবিন্দকে তিনি দেখেছিলেন অনেক আগেই। ঋষি অরবিন্দও তাঁকে প্রভাবিত করেছিলেন।
যক্ষ্মা থেকে মুক্তি লাভের পর তিনি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে কিছু দিন একা একা ঘুরে
বেড়ান।
এই সময় তিনি নজরুলের কাজী নজরুলের কিছু গানের স্বরলিপি করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য
ছিল- কে বিদেশী বন উদাসী। এই স্বরলিপিটি প্রকাশিত হয়েছিল
ভারতবর্ষ।
পত্রিকার 'জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৫'
(মে-জুন ১৯২৮) সংখ্যায়  
;[নমুনা]
১৯২৮
খ্রিষ্টাব্দে সাহানা দেবী চলে গেলেন পন্ডিচেরি আশ্রমে। এরপর তিনি নিভৃতচারী হয়ে
অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত করেন। এখানে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ৬ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র:
- স্মৃতির খেয়া: সাহানা দেবী (প্রাইমা
পাবলিকেশনস, ২০০৪)
- আসা যাওয়ার মাঝখানে (দ্বিতীয় পর্ব): নলিনীকান্ত সরকার
(মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, ১৯৮৫)