শওকত আলী
(১৯১৮-১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ)
বাংলা ভাষা-আন্দোলনের একজন উল্লেখযোগ্য নেতা এবং রাজনীতিবিদ।

১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল ঢাকার গেন্ডারিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা শমসের আলী ছিলেন এলাকার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং মা মেহেরুন্নিসা খানম ছিলেন একজন গৃহিণী। দুই বছর বয়সে তিনি তাঁর মাকে হারান। তাই তিনি মামা এবং খালাদের কাছে প্রতিপালিত হয়েছেন।

তিনি মুসলিম হাই স্কুলে পড়েন। হাই স্কুল শেষ করার পর তিনি জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন এবং বি.কম ডিগ্রি লাভ করেন। ডিগ্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হলেও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে শেষ করতে পারেন নি।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকার সিদ্দিক বাজারের 'লিলি কটেজে' সংস্কৃতিমনা অধ্যাপক, সাহিত্যসেবী ও বুদ্ধিজীবীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় প্রাথমিকভাবে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরির কথা আলোচিত হয়। এরই সূত্র ধরে, এর কয়েকদিন পর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম-এর ১৯ নম্বর আজিমপুরের (ঢাকা) বাসায় অপর একটি সভা আহ্বান করা হয়। এই সভার আহ্বায়ক ছিলেন আবুল কাসেম। এই সভায় চূড়ান্তভাবে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সর্বসম্মতিক্রমে এই সংগঠনের নাম রাখা হয়- ' তমদ্দুন মজলিস'। ১৯৪৭ সালের ২রা সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয়।  এই সভার তিনি সদ্স্য ছিলেন।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২ মার্চ তিনি দ্বিতীয় ভাষা আন্দোলন উপ-কমিটির অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। এই উপ-কমিটি ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মার্চ সারাদেশে সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছিল। এটি ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম ধর্মঘট। ওই হরতালে শওকত আলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১১ মার্চ সকালে সেক্রেটারিয়েটের প্রথম গেটে (আব্দুল গনি রোড) পিকেটিং শুরু করেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধু), অলি আহাদসহ কয়েকজন এবং দ্বিতীয় গেটে (তোপখানা রোড) পিকেটিং করেন কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী, বরকত এবং অন্য দুজন।
 
শওকত আলি তার বন্ধুদের নিয়ে সচিবালয় ভবনের দ্বিতীয় প্রবেশ পথের সামনে পিকেটিং শুরু করেন। এই সময় কিছু সচিলবালয়ের কর্মী সামনের ফটক দিয়ে না ঢুকে, পাশের মসজিদের ফাঁক দিয়ে ঢুকে সচিবালয়ে ঢোকা শুরু করে।  এঁদের বাধা দেওয়ার জন্য দুজন হরতালকারীকে এখানে মোতায়ন করা হয়। এই সময় সার্জেন্ট রবার্টসন এসে হরতালকারীদের সাথে কথা বলে অন্যত্র চলে যান। এর কিছুক্ষণ পরে  সিটি পুলিশ সুপারন্টেন্ড চাথাম. আইজি জাকির হোসেন, তাঁর ডেপুটি  ওবায়দুল্লাহ আসেন। এঁরা প্রথমে সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। তখন হরতালকারীরা তাঁদের বাধা দেন নি। কিছুক্ষণ পরে এঁরা সচিবালয় থেকে বের হয়ে তাঁদের গাড়ি ভিতরে নেওয়ার আদেশ দেন। এই সময় গাড়ি ঢুকতে বাধা দেওয়ায়- পুলিশ সুপারন্টেন্ড  চ্যাথাম গোলাম মাহবুব এবং বরকতকে গ্রেফতার করা হলো বলে ঘোষণা দেন। এই সময় শওকত আলী গাড়ির সামনে সোজা মাটিতে শুয়ে পড়েন। তখন জাকির হোসেন তাঁকেও গ্রেফতার করার কথা ঘোষণা করে তাঁর একটি হাত ধরলেন। শওকত আলী অন্য হাত দিয়ে চকচকে গাড়ির বাম্পার ধরলেন। এরপর গাড়িটি চলতে শুরু করলে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আইজি তাঁর হাত ধরে ছিলেন। তাই গাড়ির সাথে তাঁকেও টেনে হিচড়ে নিয়ে যান এবং তিনি প্রচুর গালিগালাজ করতে থাকে।

আহত শওকত আলী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান

এরপর শওকত আলীম গোলাম মাহবুব, বরকতকে গ্রেফতার করে ওয়াজ ঘাটের কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি পূর্বে গ্রেফতার-কৃত  শেখ মুজিবর রহমান, খালেক নওয়াজ খান, শামসুল হক, অলি আহাদ, আব্দুল ওয়াহেদ প্রমুখকে দেখতে পান।

১২ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত তীব্র আন্দোলনের মুখে, ১৫ মার্চ খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আবুল কাশেম, কামরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ অংশগ্রহণ করেছিলেন। আলোচনা সাপেক্ষে দুই পক্ষের মধ্যে ৮টি বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে  সবাইকে মুক্তি দিলেও- পিকেটিং-এর অভিযোগসহ পৃথক অভিযোগে পুলিশ শওকত আলী ও কাজী গোলাম মাহবুবকে অব্যাহতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এ সময় মুক্তিপ্রাপ্ত অন্য নেতাকর্মীরা কারা কর্তৃপক্ষকে লক্ষ্য করে চিৎকার শুরু করে এবং সব নেতার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত তারা কারাগার ছাড়বেন না বলে ঘোষণা দেন। শেষ পর্যন্ত অন্য নেতাদের ছেড়ে দিতে হয় কর্তৃপক্ষকে।

১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাংলাকে জাতীয় ভাষা করার দাবিতে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সমাবেশ হল অভিমুখে র‌্যালি বের হয়। র‌্যালিটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হয়ে এসেম্বলি হলের পাশের চারকোণে পৌঁছায়। ছাত্ররা হল ঘেরাও করে অবরোধ করে। সংসদ সদস্য, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ সদস্যরা সবাই ঘেরাও হয়ে পড়েন। শওকত আলী, শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্যরা সংসদ সদস্য ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে লিপ্ত হন। আচমকাই পুলিশের ওপর হামলা চালায় ছাত্ররা। পুলিশ সদস্যরা লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ফাঁকা গুলি ছুড়তে থাকে। সেদিন ১৯ জন নেতাকর্মী আহত হন এবং শওকত আলী গুরুতর আহত হন।  

১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়। ২৩ জুনের সম্মেলনের আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন শওকত আলী। মূলত তাঁর  উদ্যোগে ১৫০ নং মোগলটুলিস্থ শওকত আলীর বাসভবন এবং কর্মী শিবির অফিসকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েক মাসের প্রস্তুতিমূলক তৎপরতার পর, ২৩ জুনের কর্মী সম্মেলনে দলের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।

শওকত আলীর অনুরোধে কলকাতা থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি মামলা পরিচালনার কাজে ঢাকায় এলে তিনি শওকত আলীকে মুসলিম লীগ ছেড়ে ভিন্ন একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। শওকত আলী এ পরামর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরের নেতৃবৃন্দকে নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করেন। এসময় কর্মী শিবিরের প্রধান নেতা ছিলেন শামসুল হক। অন্যদিকে কর্মী শিবির কেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মতৎপরতায় বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেনকামরুদ্দীন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, মো. তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান, আবদুল আউয়াল, মুহম্মদ আলমাস, শামসুজ্জোহা প্রমুখ।

মুসলিম লীগের আবুল হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগের অন্যায় কাজগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার লক্ষ্যেই এখানে কর্মী শিবির গড়ে তুলেছিলেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৪৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে ঢাকা এলে তার সঙ্গে শওকত আলীর আলোচনা হয়। শওকত আলী মওলানাকে পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরকেন্দ্রিক রাজনৈতিক তৎপরতার কথা জানান। এসময় মওলানা ভাসানী আলী আমজাদ খানের বাসায় অবস্থান করছিলেন। শওকত আলীর সঙ্গে তার প্রাথমিক আলোচনা সেখানেই হয়। এই আলোচনার সূত্র ধরে নতুন দল গঠনের জন্য একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন শওকত আলী। সেজন্যে ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে একটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়। মওলানা ভাসানী সেই বৈঠকে যোগদান করেন। এসময় খোন্দকার আবদুল হামিদের সঙ্গে পরামর্শ করে শওকত আলীর উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, ইয়ার মুহম্মদ খানকে সম্পাদক করে অন্যদেরসহ একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। উপর্যুক্ত সাংগঠনিক কমিটি ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন রোজ গার্ডেনে নতুন দল গঠনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এক সম্মেলন আহ্বান করে। রোজ গার্ডেনে ২৩ জুনের বিকেল ৩টায় সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শওকত আলী, আনোয়ারা খাতুন, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবদুল জব্বার খদ্দর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আতাউর রহমান খান, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আলী আমজাদ খান, শামসুদ্দীন আহমদ (কুষ্টিয়া), ইয়ার মুহম্মদ খান, মওলানা শামসুল হক, মওলানা এয়াকুব শরীফ, আবদুর রশিদ প্রমুখ।  

১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রহিমা খাতুনকে বিয়ে করেন।  উল্লেখ্য, রহিমা ঢাকার ফজলুল হক মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষা এবং নারী অধিকার বাস্তবায়ন সংঘের সভাপতি ছিলেন। এঁদের তিন পুত্র এবং একটি কন্যা।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটি ছিল ১৫০ নম্বর মোগলটুলীর বাড়িটি। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন বৈঠকসহ তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতেন শওকত আলী। তিনি তাঁর নিজস্ব তহবিল থেকে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সহযোগিতা ও চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করতেন। কয়েকবার এই বাড়িটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং রাজাকার, আলবদর বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়। তারা একাধিকবার শওকত আলীকে হত্যার অপচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের আলোচ্য পর্বে তিনি ছিলেন তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও বন্ধু। প্রাথমিক পর্যায়ে আওয়ামী লীগকে ঢাকা শহরে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।" (সূত্র : বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পূর্ণপাঠ, পৃষ্ঠা-১০৭)।

১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার সংবাদ শুনে তাঁর ব্রেইন স্ট্রোক হয়। ১৮ আগস্ট তিনি ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে মারা যান। ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।  

সম্মাননা


সূত্র:
পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, বদরুদ্দীন উমর।