অলি আহাদ
(১৯২৮-২০১২ খ্রিষ্টাব্দ)
বাংলা ভাষা-আন্দোলনের একজন উল্লেখযোগ্য নেতা এবং রাজনীতিবিদ।

১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার ইসলামপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবদুল ওহাব ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার।

১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। কলেজ জীবনেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী হিসাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে গণভোটে তিনি ত্রিপুরা জেলার ৪ সদস্য বিশিষ্ট ওয়ার্কাস ক্যাম্পের অন্যতম সদস্য ছিলেন।  পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনের কারণে এই বছরে তিনি আইএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে পারেন নি।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি  প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জানুয়ারিতে যখন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তিনি  প্রতিষ্ঠাতা  সদস্য হিসেব স্বীকৃতি পান।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলা ভাষা-আন্দোলনের সাথে গভীর ভাবে যুক্ত হন। এবং ছাত্রনেতা হিসেবে  অন্যান্য ছাত্রনেতাদের সাথে সক্রিয় ছিলেন। এই বছরে ১০ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে যে সভা হয়, সে সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন। এই দিনের আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল- যদি ১১ই মার্চ ১৪৪ ধারা জারি হয়, তা ভঙ্গ করে ধর্মঘট চালানো হবে কি না। সভায় শামসুল হক  ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু অলি আহাদ, আবদুল ওদুদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ধর্মঘট করার প্রস্তাব রাখেন। ১১ই মার্চ ধর্মঘট চলাকালে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অত্যাচারের প্রতিবাদে সভা অনুষ্ঠিত হলে, পুলিশ সভা পণ্ড করে দেয় এবং কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবর রহমান,
অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, রওশন আলম, রফিকুল আলম, আব্দুল লতিফ তালুকদার, শাহ্ মোঃ নাসিরুদ্দীন, নুরুল ইসলাম প্রমুখ। উল্লেখ্য ওই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন নঈমুদ্দিন আহমদ।  এই দিনই অন্যাদের  সাথে তাঁকে  কারাগারে পাঠানো হন।  

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্ণর জেনারেল কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ভারত বিভাগের পর এটাই ছিল তার প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফর।
 ২১ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান)  মুহম্মদ আলী জিন্নাহর গণ-সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজন করা হয়। সেখানে তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়"। ২৪ মার্চ মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়েও তিনি একই ধরণের বক্তব্য রাখেন।  একই দিনে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল জিন্নাহ্‌'র সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেন। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাশেম, তাজউদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম এবং নজরুল ইসলাম।

১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম পরীক্ষায় প্রথম হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কাগমারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক মেরুকরণের সময় তিনি মাওলানা ভাসানীর সাথে প্রগতিশীলদের পক্ষে যোগ দেন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, আধিপত্যবাদ বিরোধীতার নামে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন।

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে সভা সমিতি বন্ধ করার প্রতিবাদে, এই বছরের ২৮ জুন হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। ৯ই অক্টোবর ১৪৪ ধারা হাইকোর্ড জারিকে অবৈধ ঘোষণা করে। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন বিশেষ ক্ষমতা আইনে সরকার তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে।

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে খন্দকার মোশতাক আহমেদের  নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ডেমোক্রেটিক লীগে অলি আহাদ যোগ দেন। কিন্তু মতবিরোধের কারণে মোশতাক আহমেদকে বাদ দিয়ে তিনি আলাদাভাবে ডেমোক্রেটিক লীগ পুনঃগঠন করেন এবং দলটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

২০১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকায় মৃত্যবরণ করেন।

সম্মাননা: স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার ২০০৪ প্রদান করা হয়।