লুকিয়াস কোর্নেলিয়াস সুল্লা
ইংরেজি Lucius Cornelius Sulla

প্রখ্যাত রোমান সেনাপতি। তাঁর পূর্ণ নাম
লুকিয়াস কোর্নেলিয়াস সুল্লা ফেলিক্স (Lucius Cornelius Sulla Felix)। সাধারণভাবে তাঁকে সুল্লা নামে অভিহিত করা হয়।

 

খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৮ অব্দে রোমের অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর জন্মের সময় তাঁদের পরিবার বেশ আর্থিক সঙ্কটের ভিতর ছিল। এই কারণে তিনি তৎকালীন রোমান মঞ্চশিল্পে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি তিনি রোমের প্রধান সেনা অধিনায়ক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু প্রথম জীবনের অভিনেতা, যাদুশিল্পী, নৃত্যশিল্পী তথা সকল ধরনের মঞ্চ-কলাকুশলীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। মঞ্চে কাজ কাজ করার সূত্রে তিনি গ্রিক-রোমান সাহিত্যে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে পেরেছিলেন এবং অত্যন্ত ভালো গ্রিক ভাষা জানতেন। তাঁর এই ভাষাজ্ঞান এবং অর্জিত অন্যান্য জ্ঞান রোমান রাজনীতির জন্য অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল।

 

খ্রিষ্টপূর্ব ১১২ অব্দের দিকে উত্তর আফ্রিকার নুমিডিয়ার রাজা জুগুর্থা (Jugurtha) সাথে রোমানদের যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে রোমানদের সেনাবহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন কুন্টাস সেচিল্লাস মেটেল্লাস (Quintus Caecilius Metellus)। কিন্তু  খ্রিষ্টপূর্ব ১০৭ অব্দ পর্যন্ত এই যুদ্ধে সাফল্য লাভ করতে পারেন নি। এই সময় গাইয়ুস মারিয়াস ছিলেন মেটেল্লাস-এর বাহিনীর একজন লেফটেন্ট। ইনি এই যুদ্ধে জয়লাভের কিছু কৌশল আবিষ্কার করেন। এই সময় সুল্লা তাঁকে কোয়েস্টোর (রোমান প্রজাতন্ত্রের অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষণ করার জন্য নির্বাচিত রাজকর্মকর্তা) হিসাবে নিয়োগ দেন। এই বৎসরেই তিনি কনসুল (রোমান প্রজাতন্ত্রের উচ্চতর রাজনৈতিক কর্মকর্তা। এক বৎসরের জন্য দুইজন কনসুল নির্বাচন করা হতো) হিসাবে নির্বাচিত হন। এই সময় সুল্লা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। গাইয়ুস মারিয়াস নবদ্যোমে রোমা সৈন্যদের নিয়ে রাজা জুগুর্থার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১০৬ অব্দে রোমান সৈন্যরা জুগুর্থার বাহীনীকে পরাজিত করে। এই সময় রোমান সেনারা সুল্লার তৎপরতায় রাজা জুগুর্থার রাজ্যের বিশাল অংশ অধিকার করতে সমর্থ হয়। পরাজিত জুগুর্থা মৌরিতানিয়ায় পালিয়ে যায়। এই সময় সুল্লা মৌরতানিয়ার রাজা বোক্কাস (প্রথম)-কে জুগার্থাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য উৎসাহ জোগান। রাজা বোক্কাস বিশ্বাসঘাতকতায় সুল্লা শেষ পর্যন্ত  জুগুর্থাকে বন্দী করে এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ করে, তাকে রোমে নিয়ে আসেন।

 

এই যুদ্ধের পর গাইয়ুস মারিয়াস রোমের শ্রেষ্ঠ সেনাপ্রধান হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। খ্রিষ্টপূর্ব ১০৪ অব্দের দিকে রোমান সৈন্যদের ভিতর নানা রকম মেরুকরণ শুরু হয়। রোমান সিনেট গাইয়ুস মারিয়াসের উপর রোমের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব দেয়। এই সময় সুল্লা ট্রাবুনাস মিলিটাম (tribunus militum, রোমান সেনাদলের একটি শাখা)-এর স্টাফ ছিলেন। অবশেষে রোমান ক্ষমতার টানপোড়নে খ্রিষ্টপূর্ব ১০১ অব্দে একটি যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধটি নামে ভেরেচেল্লে (Battle of Vercellae) পরিচিত। এই যুদ্ধের সময় রোমান বাহিনীর অন্তর্গত সেনাপতি ক্যাটুলাস (Catulus)-এর বাহিনীতে তিনি লেগেটাস (legatus, রোমান সেনাবাহিনীর জেনারেল সমতুল্য পদ, আধুনিক সেনাবহিনীর জেনারেল অফিসারের তুল্য) পদ লাভ করেন। এই যুদ্ধে জার্মান কিম্ব্রি (Cimbri) উপজাতিকে রোমান বাহিনী পরাজিত করে। ক্যাটুলাস মূলত একজন সাধারণ মানের সেনাপতি ছিলেন। তারপরেও সুল্লার কারণে এই যুদ্ধের কৃতিত্ব পান।


যুদ্ধের শেষে বিজয়ীর বেশে সুল্লা রোমে ফিরে আসেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৯৭ অব্দে তিনি সিনেট কর্তৃক প্রায়েটোর আরবান (
Praetor urbanus) পদ লাভ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৯৬ অব্দে তিনি সিলিসিয়া (আধুনিক তুরস্কের আনাতোলিয়া অঞ্চল) প্রদেশের প্রো-কোনসুলে হিসাবে নিয়োগ পান। এই বৎসরে তিনি আবার রোমে ফিরে আসেন।

 

খ্রিষ্টপূর্ব ৯১ অব্দের দিকে রোমান সাম্রাজ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটেছিল সোকি (Socii) নামক রোমের ইতালিয়ান মিত্রদের সাথে শত্রুতার সূত্রে। মূলত ইতালিয়ান উপদ্বীপের অধিবাসীরা সোকি নামক একটি স্বশাসিত নগর রাষ্ট্রে বসবাস করতো। রোমান বাহিনীর সাথে তাদের মিত্রতা ছিল। রোমান শাসকরা এই উপদ্বীপকে রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিলে এই যুদ্ধের সৃষ্টি হয়। এই যুদ্ধে সুল্লা অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৮৯ অব্দে, হির্পিনি প্রদেশের তিনি ঈক্লানুম (Aeclanum) নগর ভস্মীভূত করেন এবং এই নগর সংলগ্ন অঞ্চল অধিকারে আনতে সক্ষম হন। এই বিজয়ের পর সোকি'র মনোবল ভেঙে পড়ে। এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ৮৮ অব্দে উপদ্বীপবাসীরা রোমের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। এই সময় রোমান সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ সম্মানসূচক Corona Graminea লাভ করেন।

রোম সাম্রাজ্যের এই ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের ফলে গ্রিক রাজন্যবর্গের সাথে সংঘাতের জন্ম দেয়। এই সময় পোন্টুস রাজ্যের রাজা মিথ্রিডাটেস ৪র্থ (
Mithridates VI)-এর নেতৃত্বে অন্যান্য গ্রিক রাজারা একত্রিত হয়ে একটি সম্মিলিত বাহিনী গড়ে তোলে। এই সম্মিলিত বাহিনী রোমান ও বিথিনিয়া রাজ্যের (Kingdom of Bithynia) যুদ্ধ ঘোষণা করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৮৯ অব্দে এই বিদ্রোহ শুরু হলেও, এই যুদ্ধ শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব  ৮৭ অব্দের দিকে।

খ্রিষ্টপূর্ব  ৮৭ অব্দের বসন্তকালে সুল্লা তাঁর বাহিনী নিয়ে ইল্লিরিয়া (Illyria)-তে পৌঁছান। খ্রিষ্টপূর্ব  ৮৬ অব্দে  সুল্লা যখন এশিয়া মাইনরে যুদ্ধরত ছিলেন, তখন গাইয়ুস মারিয়াস সুল্লার প্রথমা স্ত্রীর কন্যা কোর্নেলিয়াকে তাঁর স্বামী-সহ বাড়ি থেকে বিতারিত করেন।

ইনি এথেন্সের উদ্দেশ্যে সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করেন। এই যুদ্ধে সুল্লা জয় লাভ করেন। এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ৮৩ অব্দের দিকে তিনি রোমে ফিরে আসেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৮২ অব্দের শেষের দিকে রোমান সিনেট তাঁকে
dictator legibus faciendis et reipublicae constituendae causa পদে অভিষিক্ত করেন। এর ফলে প্রায় সমগ্র রোম সাম্রাজ্যের প্রশাসকের দায়িত্ব লাভ করেন। তাঁর অবর্তমানে যাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল তাঁদেরকে হত্যার আদেশ দেন। এর ভিতরে প্রায় ১৫০০ সিনেটর এবং অভিজাত লোক ছিল। আর ছিল বহু সাধারণ মানু ও সৈনিক। সব মিলিয়ে প্রায় ৯০০০ লোককে হত্যা করা হয়েছিল। প্রায় ৬ মাস ব্যাপী তিনি রোমে স্বৈরশাসন পরিচালনা করেন। তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে দেন। এই সময় তিনি জুলিয়াসকে এই মর্মে আদেশ করেন যে, সে যেন তাঁর স্ত্রী কোর্নেলিয়া সিন্নিলা-কে অবিলম্ব ত্যাগ করে। কিন্তু জুলিয়াস এই আদেশ অমান্য করেন এবং সুল্লা'র ভয়ে লুকিয়ে পড়েন। পরে জুলিয়াসের প্রভাবশালী আত্মীয় ও বন্ধুদের দ্বারা তিনি সুল্লা'র কাছে ক্ষমা পান।

 

খ্রিষ্টপূর্ব ৮১ অব্দে তিনি এই পদ ত্যাগ করেন। এবং ধীরে ধীরে রোমে আবার গণতন্ত্রের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৮০ অব্দে কুইন্টাস সেসিলিয়াস মেটেল্লাস পিয়াস (Quintus Caecilius Metellus Pius) -এর সথে তিনি কাউন্সিলার হিসাব সহভাগী হয়ে ক্ষমতা ভোগ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৭৯ অব্দে তিনি রাজনৈতিক সকল কর্মকাণ্ড থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ রচনা করেন।

 

খ্রিষ্টপূর্ব ৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।


সূত্র :
http://en.wikipedia.org/wiki/Lucius_Cornelius_Sulla
http://www.roman-empire.net/republic/sulla.html

http://antiquitatis.com/rome/biographies/bio_sulla.html