তৈমুর লং
(১৩৩৬-১৪০৫ খ্রিষ্টাব্দ)
তুর্কী-মোঙ্গল সেনাধ্যক্ষ। এঁর মূল নাম
তৈমুর বিন তারাগাই বারলাস  (চাগাতাই ভাষায়: تیمور - তেমোর্‌, "লোহা")। ফার্সি ভাষায় তিমুরে ল্যাংগ্‌ (تیمور لنگ‎ )​ নামেও পরিচিত। এর অর্থ খোঁড়া তৈমুর। ইউরোপে তিনি 'তিমুর' (Timur) বা 'তিমুরলেন' (Timurlane) নামে পরিচিত।

আনুমানিক ১৩৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ এপ্রিল, সমরকন্দ থেকে প্রায় ৫০ মাইল দূরে অবস্থিত কেশ  নগরীর স্কারদু শহরের তৈমুর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা তারাকি ছিলেন মঙ্গোলিয়ান বার্লাস গোত্রের। মায়ের নাম তেকিনা খাতুন। ধর্মমতে তিনি ছিলেন নকশাবন্দী সুফি তরিকার মুসলমান। সেই সূত্রে তৈমুর নিজেকে ইসলামের একজন সৈনিক মনে করতেন। বাস্তব জীবনে তিনি ইসলামের আদর্শ বহির্ভুত এক নিষ্ঠুর দিগ্বিজয়ী সৈনিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

শৈশবে মোঙ্গল সেনাবাহিনীর এক অভিযানের সময় তৈমুরের মা এবং অন্যান্য ভাইদের  কয়েদী করে সমরখন্দে আনা হয়। এরপর এখানেই সে বড় হয়ে উঠতে থাকেন। অত্যন্ত মেধাবী তৈমুর ফার্সি, মঙ্গোলিয়ান এবং তুর্কি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তিনি ইসলামী আইন মঙ্গোলীয় শাসনতন্ত্রের অনেকটাই শিখেছিলেন কৈশোরেই। আর যুদ্ধবিদ্যা ছিল তাঁর সহজাত ক্ষমতার অংশ।

বিচিত্রগুণের অধিকারী তৈমুর কৈশোরেই বেছে নিয়েছিলেন অনৈতিকতা এবং নিষ্ঠুরতার পথ। তিনি নিজের সঙ্গীসাথিদের নিয়ে একটি ডাকাতের দল তৈরি করে,
ছোটখাট জিনিস লুট করে বেড়াতেন। পরে তরুণ বয়সে তিনি একটি সত্যিকারের ডাকাতের দল গঠন করেন। এই সময় আশপাশের অঞ্চলে ধনী ব্যক্তিরা আতঙ্কে থাকতেন। একবার তৈমুর তিনি এক বণিকের ভেড়ার পাল লুট করতে যান। ফেরার পথে তৈমুর রাখালদের তীরের আঘাতে মারাত্মকভাবে জখম হন। তার ডান হাত এবং ডান পা চিরতরে অকেজো হয়ে যায়। এই থেকে তাঁর নাম হয়ে যায় খোঁড়া তৈমুর বা তৈমুর লং।

তৈমুর যৌবনে পা রাখার পর, তাঁর মনে দৃঢ় আশা জাগে যে, একদিন তিনিও চেঙ্গিশ খানের মতো পৃথিবী শাসন করবেন। তাই খোঁড়া পা নিয়ে সমরবিদ্যার প্রশিক্ষণ নেন তিনি এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি অস্ত্র চালনায় বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন।

এই সময় মধ্য এশিয়া তথা
আমুদরিয়া এবং সির দরিয়া নদীবিধৌত অঞ্চল জুড়ে কোনো শক্তিশালী রাজশক্তি ছিল না। ফলে এই অঞ্চলে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করেছিল। বিশেষ করে বিভিন্ন যাযাবর দল এবং স্থানীয় নেতাদের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ লেগে থাকতো। এই অঞ্চলের স্থানীয় নেতারা দৃঢ়তার সাথে এই দ্বন্দ্ব নিরসনে ব্যর্থ ছিল। এই কারণে স্থানীয় জনগণ তাদের উপর অসন্তুষ্ট ছিল। ১৩৪৭ খ্রিষ্টাব্দে আমির কাজগান নামক একজন শক্তিশালী দলনেতা স্থানীয় নেতা চাগতাই খানাতের সর্দার বরলদেকে হটিয়ে নিজে ক্ষমতা দখল করেন। ১৩৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার পর, তিনি ঘাতকের হাতে নিহত হন। এরপর ক্ষমতায় অধিকার করেন তুঘলক তিমুর। ইতিমধ্যে তৈমুর লং নিজেকে যোদ্ধা হিসেবে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাই তুঘলক তিমুর তাঁকে বারলাস অঞ্চলের শাসক হিসেবে নিযোগ করেন।

উচ্চাভিলাষী তৈমুর এই ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকেই তুঘলককে অপসারণ করে ক্ষমতা দখলের নীলনকশা তৈরি করতে থাকেন। তুঘলক বিষয়টি বুঝতে পেরে তৈমুরকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এরপর তিনি আমির কাজগানের নাতি আমির হুসেইনের কাছে যান। তিনি প্রথমে তাঁর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন এবং পরে তাঁর  বোনকে বিয়ে করেন। এরপর আমির হুসেইনের সাথে করে তিনি একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করেন। ইতিমধ্যে সিংহাসনে বসেছিলেন
তুঘলক তিমুরের পুত্র আমির খোজা। ১৩৬৪ খ্রিষ্টাব্দে আমির খোজাকে পরাজিত করে মধ্য এশিয়ার সিংহাসনে বসেন।

প্রথম দিকে তৈমুর এবং হুসেইন যৌথভাবে শাসন করতে থাকেন। কিন্তু তৈমুর ভাগাভাগীর ক্ষমতায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। হুসেইনকে সরিয়ে ক্ষমতা গ্রহণের বড় বাধা ছিল
তৈমুরের স্ত্রী। ১৩৭০ খ্রিষ্টাব্দে তৈমুরের স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তিনি হুসেইনের সাথে পারিবারিক বন্ধন মুক্ত হয়ে হুসেনকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। এবং শেষ পর্যন্ত আমির হুসেইনকে হত্যা করে, তৈমুর নিজেকে মধ্য এশিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। এই সময় তিনি হুসেইনের স্ত্রীকে বিবাহ করেন। ১৩৭০ খ্রিষ্টাব্দের শেষে তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সমরকন্দকে তাঁর সাম্রাজ্যের রাজধানী বানান।

ক্ষমতা দখলের পর তিনি বিশাল এক সেনাবাহিনী গঠন করার উদ্যোগ নেন এবং অচিরেই তিনি মধ্য এশিয়ার একটি শক্তিশালী রাজশক্তিতে পরিণত হন। এই সময় রাশিয়ার সিংহাসনচ্যুত সম্রাট ছিল তোকতামিশ খান। রাশিয়ার রাজশক্তি তখন অনেকটা টলমল ছিল। এই অবস্থায় তোকতামিশ খান তৈমুরের সাহায্য প্রার্থনা করলে, তিনি সুযোগ লাগান। তিনি তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়ে তোকতামিশ খানের সাহায্যে রাশিয়া আক্রমণ করেন। এই আক্রমণে শত্রুপক্ষকে পরাজিত করে তৈমুর তোকতামিশ খানকে রাশিয়ার সিংহাসনে বসান।


এরপর তৈমুর পারস্যের দিকে অভিযান শুরু করেন। তিনি প্রথম পারশ্যের কার্তিদ সাম্রাজ্যের রাজধানী হেরাত
নগরী অবরোধ করেন। তৈমুরের কাছে বশ্যতা স্বীকার না করায়, হেরাতের সকল নাগরিককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার আদেশ দেন। ফলে কয়েক দিনের মধ্যে হেরাত মৃত-নগরীতে পরিণত হয়। এই নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে ১৩৮৩ খ্রিষ্টাব্দে হেরাত নগরী করায়ত্ত করেন। এই নিষ্ঠুরতার কথা প্রচারিত হলে, বিভিন্ন শহরগুলো কোনো বাধা না দিয়ে, আত্মসমর্পণ করে। এই সূত্রের তৈমুর প্রায় বিনাযুদ্ধে তেহরান দখল করেন। এরপর তিনি ধীরে ধীরে এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, আফগানিস্তান এবং ইরাকের কিছু অংশ তৈমুরের দখল করেন। এই সময় কিছু কিছু উচ্চাভিলাষী শাসক তৈমুরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে, তিনি তাঁদের কঠোর হাতে দমন করেন। কথিত আছে আফগানিস্থানের বিদ্রোহীদের দমন করার পর, তাঁদের মাথার খুলি দিয়ে একটি মিনার তৈরি করেছিলেন। এছাড়া ইস্পাহান শহরের ৭০ হাজার বিদ্রোহীর মাথার খুলি একটি অপরটির উপর জুড়ে দিয়ে মিনার তৈরি করা হয়। এ সকল কর্মকাণ্ডের ভিতর দিয়ে ১৩৮৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পুরো পারস্য সাম্রাজ্য তৈমুরের দখলে চলে আসে।

১৩৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তৈমুরের মিত্র এবং তোকতামিশ খান মধ্য এশিয়া আক্রমণ করে বসেন। রাজ্য হারনো তোকতামিশ খানকে তিনিই রাশিয়ার সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। তাঁর এই আচরণে তৈমুর অত্যন্ত দুঃখ পান। ফলে তিনি
তোকতামিশ খানের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। অবস্থা বেগতিক দেখে তোকতামিশ খান রাশিয়ায় ফিরে যান। তিনি তোকতামিশ খানের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযান বন্ধ রেখে ইরাকদের দিকে নজর দেন।

১৩৯২ খ্রিষ্টাব্দে পরিচালিত অভিযানে তিনি ইরাক দখল করে নেন। এবার তিনি
তোকতামিশ খানকে শাস্তি দেওয়ার জন্য রাশিয়া অভিযানে অগ্রসর হন। তেরেক নদীর তীরে তিনি তোকতামিশ খানের বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং ১৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে মস্কো দখল করেন।

এরপর তিনি ভারতবর্ষে দখলের জন্য মনস্থির করেন। সে সময়ে ভারতবর্ষে দিল্লীর অধিপতি ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পর, ক্ষমতার দ্বন্দে রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। দুর্বল শক্তি নিয়ে তখন রাজত্ব করছিলেন  দিল্লীর সুলতান নাসিরুদ্দিন শাহ তুঘলক। এই সুযোগে তিনি ১৩৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তৈমুর লং-এর পৌত্র পীর মোহ্ম্মদ ভারত আক্রমণ করে মুলতান জয় করে নেয়। এই সময় তৈমুর সমরখন্দে ছিলেন। পীর মোহম্মদের মুলতান জয়ের কথা শোনার পর তিনি নিজেই ভারতে চলে আসেন। ১৩৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর, প্রায় ৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে সিন্ধু নদের পাড়ে উপস্থিত হন। এরপর ভারতবর্ষে তৈমুর ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেন। তিনি সিন্ধুর দুই পাড়ের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেন। এরপর হত্যাযজ্ঞ চালাতে চালাতে দিল্লীর দিকে অগ্রসর হন। কথিত আছে দিল্লী আসার পথে প্রায় ১ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছিলেন। ফলে এই অঞ্চল জনবিরল উপত্যাকায় পরিণত হয়েছিল।
দিল্লীর সেনাবাহিনী তাঁর হস্তিবাহিনী নিয়ে তৈমুরকে আক্রমণ করেন। তৈমুর কৌশলে হিসেবে হাজার হাজার উটের পিঠ খড়ের গাদা দিয়ে বোঝাই করলেন। এরপর খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে উটগুলোকে হস্তিবাহিনীর দিকে হটিয়ে দেন। সুলতানের হস্তিবাহিনী জ্বলন্ত উটের আগ্রাসনে ভয় পেয়ে যায়। অবস্থা হিতে বিপরীত হয়ে যায়। হাতিগুলো উল্টো ঘুরে সুলতানকেই আক্রমণ করে বসে।

সুলতানের বাহিনী পরাজিত হলে, তিনি দিল্লী দখল করেন এবং সেখানে ব্যাপক গণহত্যা এবং লুটতরাজ করেন। তিনি ভারতবর্ষ থেকে বহু মূল্যবান সম্পদ লুট করেন। এই সময় তিনি ইরাকের রাজধানী বাগদাদের দখল হারানোর সংবাদ পান। ফলে ভারতবর্ষ থেকে তিনি সমরকন্দ ফিরে যান।
১৩৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুনরায় বাগদাদ আক্রমণ করেন। বরাবরের মতোই তিনি অনায়াসে বাগদাদ দখল করে নেন। এবার তৈমুরের আদেশে বাগদাদের ২০ হাজার বিদ্রোহীর শিরোশ্ছেদ করা হয়।

এই সময় অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান বায়েজিদ, তৈমুরের নিষ্ঠুরতরা কাহিনি শুনে  ক্রোধান্বিত হন। তিনি তৈমুরকে সতর্ক করে বার্তা প্রেরণ করেন। তৈমুর এই বার্তায় অপমানিত হন এবং অটোমান সাম্রাজ্য আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৪০১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে তুরস্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। সুলতান বায়েজিদ এই সংবাদে বিশাল বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যান। ১৪০২ খ্রিষ্টাব্দে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় দুই বাহিনী মুখোমুখি হয়। যুদ্ধে অটোমান সুলতান বায়েজিদ বন্দী হন এবং পরবর্তীতে তিনি বন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

সে সময়ের অটোমানদের দাপটে ইউরোপ তটস্থ ছিল। এই যুদ্ধ জয়ের পর ফ্রান্স, স্পেন-সহ অনেক ইউরোপীয় দেশ র তৈমুরের সাথে মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপন করে।

১৪০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

দ্বিগ্বিজয়ী বীর হিসেবে তৈমুর যতটা খ্যাতি লাভ করেছিলেন, তা ছাপিয়ে গেছে তাঁর নিষ্ঠুরতার কুখ্যাতি। তিনি নিজেকে ইসলামের সেবক হিসেবে নিজেকে দাবি করতেন। তৎকালীন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিলেন তাঁর ভাষায় কাফির। ভারতে তিনি কাফির নিধনে এসেছিলেন। তাঁর রচিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'তুজুক-ই-তৈমুরী-তে তিনি সেই কৈফিয়তই দিয়েছেন।

তাঁর স্ত্রীর তালিকা বেশ দীর্ঘ। বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের সূত্রে যে নামগুলো পাওয়া যায়, তা হলো- সারায় মুল্‌ক খানুম, চুলপান মুল্‌ক আঘা, আলজাজ তুর্খান আঘা, তুকাল খানুম, দিলশাদ আগা।