দেশে একটা কথা উঠেছে যে,
মুক্তির জন্য যে আন্দোলন আমরা চালাচ্ছি আমাদের তা ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত ধরে নিতে হবে। দেশে যখন মুক্তির জন্যে ভাঙ ভা বলে রব
করে লাখ লাখ লোক আগল ভেঙে বেরিয়ে এল, তখন তারা এক নতুনভাবে মাতোয়ারা হয়ে মানুষের মতো মানুষ দেখে তার পিছনে
পিছনে চলতে লাগল। কিন্তু আজ যখন তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হলো তখন তাঁর মতে ব্যাখ্যা নিয়ে তর্ক উঠে সঙ্ঘ ভেঙে যাবার
যোগাড় হল। এমনি করেই যুদ্ধের পরই সজ্ঘ থেকে জীবন চলে গিয়েছিল, পড়েছিল শুধু
বাইরের একটা আচার। ঠিক তেমনি আজ যেন আমাদের ভিতর থেকে প্রাণটুকু
যাবার উপক্রম হয়েছে- তার্কিকেরা তাকে ধরে রাখবার কোনো চেষ্টাই করছেন
না। কেউ কেউ এত বেশি গোঁড়া আর সাবধানি হয়ে পড়েছেন, কিন্তু ধবংসকে ডেকে
আনবার মতো সাহস বা মতা তাদের আছে বলে গন হয় না। কারণ আমাদের মনে
তো কই সাড়া খুঁজে পাচ্ছি না।
আমরা শুনতে পাচ্ছি যে, আমাদের ধর্মের ভিতর দিয়ে চলতে হবে কিসের জন্যে
আমাদের ধর্মকে আশ্রয় করতে হবে? ওরে শূদ্র, তুই এবার ওঠ। উঠে বল্, 'আমি ব্রাহ্মণ
নয় যে ধর্মের ব্যখ্যা নিয়ে পড়ে থাকব। আমি আর তোমার মুখের দিকে চেয়ে থাকব না।
আমায় বাঁচতে হবে- যেমন করে হোক আমি বাঁচব।' ওরে পতিত, ওরে চিরলাঞ্ছিত,
তুই দেখ্ সারা বিশ্ব তোকে ধ্বংস করতে উদ্যত। দেবতা তাঁর জল ঝড় নিয়ে, প্রকৃতি
তার রোগ মহামারী নিয়ে তোকে পিষে ফেলতে ব্যস্ত। আচার তার জগদ্দল পাথর তোর
বুকে বসিয়ে দিয়েছে- সমাজ তোর কষ্ঠরোধ করে ফেলেছে। ধনীর অট্টহাস্য তোর
প্রাণের করুণ কাঁদুনি ঢেকেছে।
'কিসের ধর্ম? আমার বাঁচাই আমার ধর্ম। দেবতার জল-ঝড়কে আমি বাঁধব,
প্রকৃতিকে আমি প্রতিত্ঘাত দেবো। আচারের বোঝা ঠেলে ফেলে দেবো, সমাজকে ধ্বংস
করব। সব ছারেখারে দিয়েও আমি বাঁচব।
আমার আবার ধর্ম কি? যার ঘরে বসে কথা কইবার অধিকার নেই, দুপুর রাতে
দুঃস্বপ্নে যার ঘুম ভেঙে যায়, অত্যাচারকে চোখ রাঙাবার যার শক্তি নেই, তার আবার
ধর্ম কি? যাকে নিজের ঘরে পরে এসে অবহেলায় পশুর মতো মেরে ফেলতে পারে, যার
ভাই-বোন বাপ-মাকে মেরে ফেললেও বাক্যস্ফূট করবার আশা নাই তারা আবার ধর্ম কি
দুবেলা দুটি খাবার জন্য 'যার বাঁচা, একটু আরাম করে কাল কাটিয়ে দেবার
জন্যই যার থাকা তার আবার ধর্ম কি?
মানুষের দাস তুমি, তোমার আবার ধর্ম কি? তোমার ধর্মের কথা বলবার
অধিকার কি?
ওরে আমার তরুণ আমার লক্ষ্মীছাড়ার দল, তোরা আয়, তোরা আয় ছুটে আয়-
এই ভণ্ডামি থেকে চলে আয়। তোরা বন্ আমাদের আগে বাঁচতে হবে। কিসের শিক্ষা?
কে শেখাবে? দাস কখনও দাসকে শেখাতে পারে? আমরা কিছু শিখবো না, আমরা কিছু
শুনব না; আগে বাঁচব- আমরা বাঁচব।
একবার মনে ভেবে দেখো- তাদের কথা ভেবে দেখো। দেশছাড়া লক্ষ্মীছাড়ার দল
আজ কোনো বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কে জানে তারা কত মরে গেছে, কত-ঘা সয়েছে?
তারা তো কথাটি কয়নি। সেই কবে, গৃহহীন হয়ে প্রবাস বরণ করে, হাটে-মাঠে বেড়াচ্ছে,"
তবু তারা কথাটি কয়নি। তাদেরে তপ্তশ্বাস আজ কি তোমার বুকে বয়ে যাচ্ছে না? তুমি
যে পথ দিয়ে দিনের পর দিন তিল তিল শুধু সুখের সন্ধানে চলে যাও, তারই একপাশে বদ্ধ ঘরে
তারা যে দিনের পর দিন তিল তিল করে মরতে চলেছে, সে-খবর তুমি রাখো কি?
সেই অন্ধকারে সহস্র আঘাত খেয়ে তারা যে বছরের পর বছর কাটিয়ে তাদের
ধর্মকি?
তারা বুঝেছে বাঁচাই তাদের ধর্ম- তারা জানে এই তিল তিল করে মরার ভিতরেই
জীবন। তাই তারা এ মরণের পথ বেছে নিয়েছে।
ওগো তরুণ, আজ কি তুমি ধর্ম নিয়ে পড়ে থাকবে- তুমি কি বাঁচবার কথা ভাববে
না? ওরে অধীন, ওরে ভণ্ড তোর আবার ধর্ম কি? যারা তোকে ধর্ম শিখিয়েছে, তারা
শত্রু এলে বেদ নিয়ে পড়ে থাকত? তারা-কি দুশমন এলে- কোরআন পড়তে ব্যস্ত
থাকত? তাদের রণকোলাহলে বেদমন্ত্র ডুবে যেত, দুশমনের খুনে তদর মসজিদের ধাপ
লাল হয়ে যেত। তারা আগে বাঁচত।
ধূমকেতু
পত্রিকার প্রথম বর্ষ। দ্বাবিংশ সংখ্যা [১ অগ্রহায়ণ ১৩২৯,
শুক্রবার ১৭ নভেম্বর ১৯২২ ] সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল।