যে কাপুরুষ সেই শুধু নিজের দোষ
অন্যের ঘাড়ে চাপায়। নিজের দুর্বলতার দরুন সবলের “অন্যায় অন্যায়" বলে কান্নাকাটি
করা একটা 'ট্রডমার্ক' মেয়েলি ঢং। যাকে অন্যায় বলে মনে করো, বুক ফুলিয়ে তাকে
অন্যায় বলো, দেখবে- অন্যায়ের মুখ কালো হয়ে যাবে। যাকে অন্যায় মনে করো, তাকে
বিনাশের জন্যে তোমার বজ্র-আঘাত অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করো, দেখবে- অন্যায় আপনি 'গায়েব'
হয়ে গেছে। অন্যায় যদি তোমার বিষম আপত্তি সত্তেও তোমার নাকের ডগায় ধেই ধেই করে
নাচে আর কলা দেখায়, তাহলে বুঝতে হবে যে অন্যায়-বাঁদর তোমার “মুরোদ' যে কতটুকু তা
বেশ জেনে নিয়েছে। তুমি যে তার কচুও করতে পারবে না, তা জেনেই সে তোমার মুখের সামনে
অমন করে 'চাটু নাড়ছে। মাজা-ভাঙা রগ-টিলে তুমি একজন ডাকাত-বুকোদের হাত থেকে তোমার
চোরাই মাল ফিরিয়ে পেতে চাইলে আগে তাকে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করবার পাঁয়তারা ভাঁজা
আর কায়দা-কানুন শিখতে হবে। তা নাহলে দাদা ও-কান্নাকাটিতে ব্যাটাছেলের মন ভিজবে না।
দাও কসো, প্যাঁচের মতো প্যাঁচ দিয়ে ডাকাত বাছাধনকে যদি একবার ধরা-সই করতে পার,
তাহলে সে বাপ বাপ বলে তোমার চিজ তোমায় ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু ওই পিলু বারোয়াঁয় 'প্রাণ
আর বাঁচে কেমনে' করে কাঁদলে তাল-ধুমাধুম পড়বে তোমার জুতোর আলপনা-আঁকা পিঠে মুখে।
তোমরা চাচ্ছ স্বরাজ অর্থাৎ বাধীনতা। অর্থাৎ কিনা বাংলা করে বলতে
গেলে বোঝায়, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভূদের ও-ই সাত-সমুদ্দুর তেরো নদী পার করে তেপাস্তরের
মাঠে খেদিয়ে থুয়ে আসা! কথাটা শুনতে খুব মিষ্টি- এতই মিষ্টি যে, ও-কথাটা কেউ
পাকে-প্রকারে বললেও অমনি খুশিতে বাগেবাগ হয়ে “কাছা খুলে বাহু তুলে' উতরিঙ্গে-নাচ
শুরু করে দিই, আর যে-সে কথা বলে তাকে তো ড্যাং-তুলো করে কাঁধে না তুলে ছেডেং-ডেডেং
ডেডেং-ডেডেং করে বোধনের বাজনা বাজিয়ে দিই যে, ভগবান এসেছেন। কিন্ত সেই ভগবান যখন
বলেন যে, দেশের পায়ে তোমাদের স্বার্থকে বলিদান দাও, অমনি তোমাদের বলকে-ওঠা
ভক্তি-দুগ্ধ ছিঁড়ে এমনই টকো দই হয়ে ওঠে যে, কার বাবার সাধ্যি তা জিভে ঠেকায়! এই
ভাবের কুলকুচি দিয়ে ভুত ভাগাবে মনে করছ কিন্তু যেই ভূত দাঁত খিঁচিয়ে নখ উঁচিয়ে
একটু আঁচড়-কামড় বা গতিক বুঝে গোট দুচ্চার কিল কসিয়ে দেবে, অমনি তোমরা মায়ের
আঁচল-ঝাঁপা ছেলে মায়ের আঁচল আড়ে লম্বা দেবে আর বলবে, ভয়ানক অন্যায় ! এমন করে পরের
তাতে বেগুন পোড়ানোটা ধর্মে সইবে না।
কিন্ত ধর্মে যখন সইছেই, তখন বলতে হবে বইকী, যে, জবরদস্তির ধর্মের এমন একটা আবরণ আছে
যা কোনো দেবতার অভিশাপই ভেদ করতে পারে না।
এর মানে কী, জানো? যে ধর্ম মানুষকে এত অধার্মিক করে, এত পায়ের
তলায় এনে ফেলে, সে ধর্ম-বালখিল্যের ভিতর অনেক কিছু গলদ আছে। সিংহের চামড়ার ভিতরে
গাধা লুকিয়ে আছে। দোষ আমাদের। আমরা ধর্ম ধর্ম যতই করি, ধর্ম আমাদের নেই ধর্ম-পূজারি
হচ্ছে সত্যের পূজারি, সত্যের পূজারি কখনো কাপুরুষ হয় না। অন্তরে এত অধর্মের আখড়াই
আর বাহরে ধর্মের ফুটো ডুগডুগি পিটুলে কি কেউ ভয় পায় দাদা বীরভোগ্যা বসুন্ধরা কথাটা
মান্ধাতার আমলের পুরনো হলেও- বেজায় সত্য। ইংরেজ এ দেশ চঅধিকার করে আছে কেন, ছেড়ে
চলে,যাচ্ছে না কেন বলে মাথা খুঁড়লে চুল ছিঁড়লে ইংরাজ-রাজ অনুতপ্ত হয়ে তোমাদের হাতে
ভারত ছেড়ে দিয়ে পরাচিত্ত করবে না। ওরা বীরের জাত, ওদের কাজ-কর্ম সব মদ্দা রকমের।
তোমাদের এই চিঁচিঁ শব্দের কাতুকুতু খোঁচানিতে তারা তোমাদের আরও কষে দাববে।
তেরিয়া হয়েছ কি, সোজা প্রক্রিয়া- 'দে ধনাধ্বন মার ধনাধ্বন।' এই ধনঞ্জয়ের জোরেই
ব্যাটাছেলে তারা তোমাদের তুলোধুনো করে ছেড়ে দিচ্ছে। ওদের দোষ দিচ্ছি, কিন্তু আমরাই
যদি
ওদের বিলেতে গিয়ে রাজা হয়ে বসতুম, আর বিলিতি লোকগুলো আমাদের কাছে এই রকম আবদার করত,
আমরা তাদের প্রত্যেককে ধরে ধরে দুগ্গা বলে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিতুম। আণ্ডা বাচ্ছা
কাউকে ছাড়তাম না। তা তোমাদের যতই কেন পাগল বোবারা দেশের লোক হও। তোমরা সে কত বড়ো
কসাই-এর জাত তা তোমাদের জমিদার আর বড় লোকদের দিকে চেয়ে দেখলেই বুঝতে পারবে। তোমাদের
যদি সতিই কিছু করবার শক্তি থাকত, তাহলে কাঁদুনি না গেয়ে যা করবার তা সোজা করে যেতে।
একটি কথাও কইতে না। ব্যাটাছেলেকে ব্যাটাছেলের মতো বুক ঠুকে যদি 'চ্যালঞ্জ' করতে,
তাহলে তোমাদের স্বরাজলাভের আশা থাকলেও থাকতে পারত। আর এতে হারলেও তোমাদের অপমান হতো
না। বীরের কাছে বীরের পরাজয় সম্মানের। আলেকজাণ্ডার আর পুরু রাজার কথাটা মনে দেখো।
তারা দেশ জয় করেছে, তা যে করেই হোক। এত বড়ো পৃথিবীর সেরা দেশ, তা কিনা চোখ-রাঙানি
দেখে ছেড়ে দেবে! একি ছেলের হাতের মোয়া পেয়েছ, সকলের আগে এইবার মেয়েলি ঢং মাদিপনামো
ছেড়ে ব্যাটাছেলে হও, - আসে অহংকার আসুক, আসুক সম্ভ, আসুক গর্ব, তবু আর এসব
কাতুকুতুভাব সহ্য হয় না। চুলোয় যাক তোমার বিনয়, পায়ে মাড়িয়ে যাও লোক-দেখানো ভদ্রতা,
আমার ঝ্যাঁটা তোমার ওই সখি-ধরো-ধরো ভাবের ওপর, তুমি ব্যাটাছেলে হও, মর্দ-পুরুষ হয়।
'গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা পুরুষ হ।'
এমন করে নিজের ক্লীবতার জন্যে অন্যকে দোষ দিয় না। ভগবান আমাদের
দেশকে এই মেয়েলি মায়ার জাদু হতে মুক্ত করুন।
ধূমকেতু
পত্রিকার প্রথম বর্ষ। দ্বিতীয় সংখ্যা [৩০ শ্রাবণ ১৩২৯, মঙ্গলবার, ১৫
আগষ্ট ১৯২২] সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল।