অগ্রন্থিত প্রবন্ধ
নজরুল ইসলাম, কাজী


       তোমার পণ কি

নিবিড় অরণ্যমধ্যে গভীর নিশীথে শব্দ হইল, 'আমার মনস্কাকামনা কি সিদ্ধ হইবে?', নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া কে প্রশ্ন করিল, তোমার পণ কি?" আবার শ্রুত হইল, পণ আমার জীবনসর্বস্থ;
    -জীবন তো তুচ্ছ কথা, আর কি দিবে?
    -আর কি আছে? আর কি দিব?
    উত্তর হইল, ভক্তি!
   ওরে আমার তরুণ সাধক্‌, আজ ঐ শোন আঁধার ভেদ করিয়া। কার প্রশ্ন শোনা যাইতেছে, 'তোমার পণ কি? তুমি কি সিদ্ধিলাভ করিতে চাও? পিশাচের অত্যাচারে তোমার বুকে কি রণলিপ্সা জাগিয়া উঠিয়াছে? দুর্বৃত্ত দলনের নিমিত্ত সংহারমূর্তি লইয়া ভগবান কি তোমার হৃদয়ে আসিয়াছেন? পদ-মদ-মত্ত রাক্ষসের কণ্ঠনালী ছিন্ন করিবার, লোভ কি তোমার হৃদয়ে জাগিয়াছে? ওরে আমার বাংলার সাধক! তোমার প্রাণে কি রুদ্র বিষাণ বাজিয়া উঠিয়াছে? তাহা হইলে বলো, তোমার পণ কি?
   ঐ দেখো অত্যাচার তার সহস্র ফণা দোলাইয়া বিশ্বতরু গ্রাস করিতে উদ্যত প্রাণে প্রাণে পদাহতা দেবতায় তপ্ত শ্বাস, ঘরে পীড়িতের ক্রন্দন। তুমি এ কালনাগকে পিষিয়া মারতে পারিবে? তুমি কি বুকে বুকে আগুন জ্বালাইতে পারিবে? তাহা হইলে বলো, বীর, 'তোমার পণ কি?
   বলো, 'পণ আমার জীবনসর্বস্থ।' দুয়ারে আঘাত করিয়া বল- 'ওগো, কে আছ পতিত, কে আছ শূদ্র, তোমরা ওঠো, এ বাঁধন ছিঁড়ে ফেলতে হবে। এ সংসার যে ভেঙে ফেলতে হবে। তোরা আয়, কার কাঁচা প্রাণটা বলি দেবার লোভ হয়েছে আয়, তোরা আয়।'
   একবার- ওরে একবার তোরা এ তন্দ্রালসের বুকে আঘাত কর্‌, একবার তোরা চেঁচিয়ে বল্‌, 'পণ আমার জীবনসর্বস্ব' আবার প্রশ্ন হইল, জীবন তো তুচ্ছ কথা, আর কি দিবি? ওরে তরুণ, ওরে মাতাল, প্রাণ তো তুচ্ছ কথা, আর কি দিবি? তোদের ঈয়া, তোদের মায়া, তোদের আশা, তোদেরে ব্যথা- তোদের আর কি দিবি? তোদের মনের কোণে কি সুখের আশা আছে? ওরে দুঃখী, ওরে হিংস্র, তা ভেঙে ফেল্‌। সে যে সবটুকু চায়!
   আর কি দিবে?
   বাংলার ছেলে তুমি বলো, 'আমি সব দেবো, আমি সব নেব' পারিবে কি? যখন অগ্রসর হইতে হইতে একটি একটি করিয়া সেনাপতি আহত হইয়া পড়িবে, তখন সেই, শ্মশানে নিজ স্থান অধিকার করিয়া থাকিতে পারিবে কি? শত্রুর সেনা যুখনতোমার ঘরে রক্তস্রোত বহাইয়া দিবে, তখন তোমার চক্ষু পশ্চাতে ফিরিবে না তো? প্রিয়তম বলির করুণ ত্রন্দনে হাদয় কাঁপিয়া উঠিবে না তো? তাই বুঝি সে কঠোর স্বরে বলিতেছে, 'আর কি আছে, আর কি দিবে!' ভীষণ দুর্দিন। শত্রুরা একবার শেষ চেষ্টা করিতেছে। দেশে দেশে দানবরাজেরা ভীষণ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়াছে। যুগবাণীর কণ্ঠ রোধ করিয়া ফেলিবার জন্য তাহাদের রক্তাক্ত নখর প্রসারিত। ওগো, মরণপথের পথিক, তোমরা পারিবে কি? ক্ষত-বিক্ষত দেহেও তাহার বক্ষে আঘাত করিতে পারিবে কি?
   একে একে সেনাপতি সরিয়া যাইতেছে। অন্ধকার, ওরে চারিদিকে. অন্ধকার। তোমার এ জন্ধকারে চলিতে পারিবে তো? পথ-বাহক যদি হাত ছাড়িয়া দেয় তবে পথ ভুলিবে না তো? মাতার ক্রন্দন, প্রিয়ার ব্যাকুলতা- দলিত করিয়া একা এই অন্ধকারে, পথ চিতে পারিবে জো? তবে বলো, তোরা বলো-
                'ওরে চারিদিকে মোর
                        একি কারাগার ঘোর
                ভাঙ ভাঙ ভাঙ কারা
                        আঘাতে আঘাত কর্‌।