ফণিমনসা
রক্তে আমার লেগেছে আবার সর্বনাশের নেশা। অন্ধকারের বিবর ছাড়িয়া বাহিরিয়া এসো গুরু,
কাজী নজরুল ইসলাম
সর্বনাশের ঘন্টা
রুধির-নদীর পার হতে ডাকে বিপ্লব-হ্রেষা।
হে দ্রোণাচার্য! আজি
এই নব জয়যাত্রার আগে
দ্বেষ-পঙ্কিল হিয়া হতে তব শ্বেত
পঙ্কজ মাগে
শিষ্য তোমার, দাও গুরু দাও তব রূপ-মসি ছানি"
অঞ্জলি ভরি শুধু
কুৎসিত কদর্মতার
গ্লানি।
তোমার নীচতা ভীরুতা তোমার, তোমার মনের কালি
উদ্গারো গুরু শিষ্যের শিরে, তব বুক হোক খালি।
বন্ধু গো! গুরু! দূষিত
দৃষ্টি দূর করো, চাহ ফিরে,
শয়তানে আজ পেয়েছে তোমায়, সে যে পাঁক ঢালে শিরে
!
চিরদিন তুমি যাহাদের মুখে মারিয়াছ
ঘৃণা-ঢেলা,
যে ভোগানন্দ দাসেদের
গালি হানিয়াছ দুই বেলা,
আজ তাহাদেরি বিনামার তলে আসিয়াছ তুমি নামি
বাদরেরে তুমি ঘৃণা করে ভালোবাসিয়াছ
বাঁদরামি।
হে অন্ত্রগুরু! আজি মম বুকে বাজে শুধু এই ব্যথা;
পাণ্ডবে দিয়া জয়-কেতু, হলে
কুক্কুর-কুরু-নেতা।
ভোগ নরকের নারকীয় দ্বারে
হইয়াছ তুমি দ্বারী
বহ্ম অস্ত্র বহ্ম
দৈত্যে দিয়া, হে ব্রহ্মচারী!
তোমার কৃষ্ণ-রূপ-সরসীতে ফুটেছে কমল কত
সে কমল ঘিরি নেমেছে মরাল কত সহস্র শত।
কোথা সে দিঘির উচ্ছল জল কোথা সে কমল রাঙা;
হেরি শুধু কাদা শুকায়েছে জল, সরসীর বাঁধ ভাঙা!
সেই কাদা মাখি চোখে-মুখে তুমি সাজিয়াছ ছি ছি সং,
বাঁদর-নাচের ভালুক হয়েছ; হেসে মরি দেখে ঢং!
হেরো দিবালোকে বাঁদরের বেদে কেটেছে গুস্ফ ভূরু।
মিত্র সাজিয়া শত্রু
তোমারে ফেলেছে নরকে টানি,
ঘৃণার তিলক পরাল তোমারে স্তাবকের শয়তানি।
যাহারা তোমারে বাসিয়াছে ভালো, করিয়াছে পূজা নিতি,
তাহাদের হানে অতি লজ্জার ব্যথা আজ
তব স্মৃতি।
নপুংসক ঐ শিখণ্ডী আজ
রথের সারথি তব-
হানো বীর তব বিদ্রূপ-বাণ, সব বুক পেতে লব
ভীষ্মের সম, যদি তাহে শর-শয়নের
বর লভি;
তুমি যত বলো, আমিই সে রণে জিতিব
অস্ত্র-কবি!
তুমি জানো, তুমি সম্মুখ-রণে পারিবে না পরাজিতে,
আমি তব কাল যশোরাহু সদা শঙ্কা তোমার চিতে।
রক্ত অসির কৃষ্ণ মসির যে কোনো যুদ্ধে, গুরু,
তুমি নিজে জানো তুমি অশক্ত, তাই করিয়াছি
শুরু
চোরা-বাণ ছোঁড়া বেল্লিকপনা বিনামা-আড়ালে থাকি,
ন্যাক্কার-আনা নপুংসকেরে রথ-সম্মুখে
রাখি।
হেরো গুরু আজ চারিদিক হতে ধিক্কার অবিরত
ছি ছি বিষ ঢালি জ্বালায় তোমার পুরানো প্রদাহ-ক্ষত।
আমারে যে সবে বাসিয়াছে ভালো মোর অপরাধ নহে।
কালীয়-দমন উদিয়াছে মোর বেদনার কালিদহে।
তাহার সে দাহ তোমারে দহেনি, দহেছে যাদের মুখ
তাহারা নাচুক জ্বলুনির
চোটে। তুমি পাও কোন্ সুখ
দগ্ধ-মুখ সে রাম-সেনাদলে নাচিয়া হে সেনাপতি !
শিব-সুন্দর-সত্য
তোমার লভিল এ কি এ গতি?
যদিই অসতী হয় বাণী মোর, কালের পরশুরাম
কঠোর কুঠারে নাশিবে তাহারে, তুমি কেন বদনাম
'কিনিতেছ গুরু! কেন এত তব হিয়া-দগ্দগি
জ্বালা?
হোলির রাজা কে সাজাল তোমারে পরায় বিনামা-মালা?
তোমার গোপন দুর্বলতারে, ছি ছি করে মসীময়
প্রকাশিলে গুরু, এইখানে তয় অতি বড় পরাজয়।
তুমি ভিডিও না গো-ভাগাড়ে-পড়া চিল-শকুনের
দলে,
শতদল-দলে তুমি যে মরাল শ্বেত-সায়রের জলে।
ওঠ গুরু, বীর, ঈর্ষা-পঙ্ক-শয়ন ছাড়িয়া পুন,
নিন্দার নহ, নান্দীর
তুমি, উঠিতেছে বাণী শুন!
উঠ গুরু উঠ, লহ গো প্রণাম, বেঁধে' দাও হাতে
রাখি,
ঐ হেরো শিরে চক্কর মারে বিপ্লব-বাজপাখি।
অন্ধ হয়ো না, বেত্র ছাড়িয়া নেত্র মেলিয়া চাহ-
ঘনায় আকাশে অসন্তোষের বিদ্রোহ-বারিবাহ।
দোতালায় বসি উতলা হয়ো না শুনি বিদ্রোহ-বাণী,
এ নহে কবির, এ কাঁদন ওঠে নিখিল-মর্ম ছানি।
বিদ্রূপ করি উড়াইবে এই বিদ্রোহ-তেতো জ্বালা
সুরের তোমরা, কি করিবে তবু হবে কান ঝালাপালা
অসুরের ভীম অসি-ঝনঝনে, বড় অসোয়াস্তি-কর!
বন্ধু গো এত ভয় কেন? আছে তোমার আকাশ-ঘর !
অর্গল এঁটে সেথা হতে
তুমি দাও অনর্গল গালি,
গোপীনাথ মলো? সত্য কি? মাঝে মাঝে দেখো তুলি
জালি।
বারীন ঘোষের দ্বীপাস্তর আর মির্জাপুরের বোমা,
লাল বাংলার হুমকানি,-ছি ছি এত অসত্য ও মা,
কেমন করে যে রটায় এ সব ঝুটো বিদ্রোহী দল!
সখা গো আমায় ধরো ধরো! মা গো, কত জানে এরা ছল!
সই লো আমার কাতুকুতু-ভাব হয়েছে যে, ঢলে পড়ি!
আঁচলে জড়ায়ে পা চলে না আর, হাত হতে পড়ে ছড়ি!
শ্রমিকের গাঁতি বিপ্লব-বোমা, আ ম'লো তোমরা মরো!
যত সব বাজে বাজখাই সুর, মেছুনি-বৃত্তি ধরো!
যারা করে বাজে দুখভোগ ত্যাগ, আর রাজরোষে
মরে,
ঐ বোকাদের ইতর ভাষায় গালি দাও খুব করে।
এই ইতরামি বাদরামি-আর্ট আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে
হন্যে কুকুর পেট পালি আর হাউহাউ মরি কেঁদে।
এই শয়তানি করে দিনরাত বলো আর্টের জয় !
আর্ট মানে শুধু বাদরামি আর মুখ-ভ্যাংচানো নয়।
আপনার নাক কেটে দাদা এই পরের যাত্রা ভাঙা,
ইহাই হইল আদর্শ আর্ট নাকি-সুর, কান-রাঙা!
আর্ট ও প্রেমের এই সখ মেড়ো মাড়োয়ারি দলই
জানে,
কোনো বিদ্রোহের অসন্তোষের রেখা নেই কোনোখানে।
সব ভুয়ো দাদা, ও-সবে দেশের কিছুই হইবে নাকো,
এমনি করিয়া জুতো খাও আর মলমল-মল মাখো!
জান-অঞ্জন-শলাকা তৈরি হতেছে এদের তরে,
দেখিবে এদের আর্টের আঁটুনি একদিনে গেছে ছুঁড়ে।
বন্ধু গো! গুরু! আঁখি খোলো, খোলো শ্রবণ হইতে তুলা,
ঐ হেরো পথে গুর্খা
সেপাই উড়াইয়া যায় ধূলা।
ঐ শোনো আজ ঘরে ঘরে কত উঠিতেছে হাহাকার,
ভূধর-প্রমাণ উদরে তোমার এবার পড়িবে মার!
তোমার আর্টের বাঁশরির সরে মুগ্ধ হবে না এরা,
প্রয়োজন-বাঁশে তোমার আর্টের আর্টশালা হবে
নেড়া।
প্রেমেও আছে গুরু, যু্দ্ধও
আছে, বিশ্ব এমনি ঠাঁই,
ভালো নাহি লাগে, ভালো ছেলে হয়ে, ছেড়ে যাও, মানা নাই।
আমি বলি-গুরু বলো তাহাদেরে কোন বাতায়ন-ফাঁকে
'সজিনার ঠ্যাঙা সজনীর
মতো হাতছানি দিয়ে ডাকে!
যত বিদ্রূপই করো গুরু তুমি জানো এ সত্য-বাণী,
কারুর পা চেটে মরিব না, কোনো প্রভু পেটে লাথি
হানি
ফাটাবে না পিলে; মরিৰ যেদিন মরিব বীরের মতো,
ধরা-মা' বুকে আমার রক্ত রবে হয়ে শাম্বত।
আমার মৃত্যু লিখিবে আমার জীবনের ইতিহাস-
ততদিন গুরু সকলের সাথে করে নাও পরিহাস !
কলিকাতা। কার্তিক, ১৩৩২
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের 'কল্লোল যুগ' গ্রন্থ থেকে জানা
যায়, ' কোনো বিশেষ এক পাড়া থেকে নজরুল-নিন্দা বেরুতে লাগল প্রতি সপ্তাহে।
১৩৩৩-এর কার্তিকে "কল্লোলে" নজরুল তার উত্তর দিলে কবিতায়। কবিতার নাম "সর্বনাশের
ঘণ্টা। গ্রন্থাকার কবিতাটি উদ্ধৃতি করার পর, লিখেছেন- 'মনে আছে এই কবিতা
নজরুল কল্লোল-আপিসে বেস লিখেছিল এক বৈঠকে। ঠিক কল্লোল-আপিসে হয়তো নয়,
মণীন্দ্রের ঘরে।' উল্লেখ্য, মণীন্দ্র চাকী ছিলেন কল্লোল পত্রিকার একমাত্র
বেতনভুক কর্মচারী। তিনি থাকতেন, কল্লোলো অফিসের এক গলি পরে তিনি থাকতেন।
কিন্তু এই ঘর হয়ে উঠেছিল কল্লোল অফিসের বাড়তি অঙ্গন।
উল্লেখ্যে,
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের 'কল্লোল যুগ' গ্রন্থের 'এক পাড়া' থেকে প্রকাশিত
পত্রিকাটি ছিল 'শনিবারের চিঠি'। আর কবিতার 'গুরু' ছিলেন কবি
মোহিতলাল মজুমদার। এই কবিতার উত্তরে মোহিতলাল মজুমদার শনিবারের চিঠি'র '৮
কার্তিক ১৩৩১' সংখ্যায় লিখেছিলেন 'দ্রোণ-গুরু' কবিতা।
'সর্বনাশের
ঘণ্টা' ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে
ফণি-মনসা
প্রথম সংস্করণে [শ্রাবণ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ (জুলাই ১৯২৭)] অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল
'সাবধানী ঘন্টা'
শিরোনামে।