বিষয়: নজরুল সঙ্গীত।
শিরোনাম: রিম্ ঝিম্ রিম্ঝিম্ ঝিম্ ঘন দেয়া বরষে
রিম্ ঝিম্ রিম্ঝিম্ ঝিম্ ঘন দেয়া বরষে।
কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে॥
কদম তমাল ডালে দোলনা দোলে
কুহু পাপিয়া ময়ূর বোলে
মনের বনের মুকুল খোলে,
নট-শ্যাম সুন্দর মেঘ পরশে॥
হৃদয় যমুনা আজ কূল জানে না গো।
মনের রাধা আজ বাধা মানে না গো,
ডাকিছে ঘরছাড়া ঝড়ের বাঁশি
অশনি আঘাত হানে দুয়ারে আসি’,
গরজাক গুরুজন ভবনবাসী –
আমরা বাহিরে যাব ঘনশ্যাম দরশে॥
- ভাবার্থ: ভারতীয় লোকগীতি এবং লোকনৃত্যের একটি ধারা হলো কাজরি। এটি
এক সময় ভারতের ভোজপুরি ভাষা রচিত বর্ষাভিত্তিক লোকগান এবং লোক-উৎসব ছিল।
কালক্রমে তা ভারতের বিভিন্ন ছড়িয়ে পড়েছিল। অঞ্চল বিশেষে রাধাকৃষ্ণের বর্ষাকালীন
দোল-উৎসবের অঙ্গ হিসেবে কাজরি গান ও নাচ করা হয়। এই গানটি কাজারি অঙ্গের। এ
গানের রাধাকৃষ্ণ এসেছে কবির মনোজগতের রূপকল্পে। এই বিচারে একে বলা যায়-
বর্ষাঋতুর কাজরি অঙ্গের গান হিসেবে অভিহিত করলে, যথার্থ বৈষ্ণব সঙ্গীতের অংশ
হিসেবে দোলোৎসবের গান বলা যায় না। এই গানের সাথে মিশে আছে সংস্কার ভেঙে
ঘরের বাইরে আসার ইঙ্গিত।
ঘন বর্ষায় কাজরি উৎসবে পুর নারীরা- 'রিম্ ঝিম্ রিম্ঝিম্ ঝিম্' শব্দে মুখরিত
বর্ষায় কাজরি নাচের আনন্দোৎসবে মেতে উঠছে। এই উৎসবের নট-শ্যাম সুন্দর মেঘ পরশে
কদম তমাল ডালে বাঁধা দোলনা দুলছে, বর্ষার কুহু পাপিয়া ময়ূর তাদের স্বভাবজাত
সুরে ডাকছে। এ সবই বর্ষার সাধারণ রূপ। কিন্তু কাজরি উৎসবের আমেজে উপস্থাপিত
হয়েছে।
এই উৎসবের আমেজে মনের প্রেয়সী রাধা, ঘর ছেড়ে যেনো অভিসারের প্রত্যাশায় উন্মুখ
হয়ে আছে। আর হৃদয়ের প্রেমযমুনা হয়ে উঠেছে উদ্বেলিত। এই গানের ঝড়ের ধ্বনি যেনো
শ্যামের বাঁশি হয়ে মনের রাধাকে অভিসারে যাওয়ার আহ্বান করেছে।
সকল প্রাকৃতিক বিঘ্নকে অগ্রাহ্য করে পুরনারীরা এই উৎসবে অংশ নেয়ার জন্য
বদ্ধপরিকর। তাই দুয়ারে যতই বজ্র-বিদ্যুৎ আঘাত হানুক, গুরুজনরা যতই নিষেধের
হুঙ্কার ছাড়ুক, তারা প্রকৃতির ঘনশ্যাম দর্শনের এই উৎসবে বাইরে যাবেই। এই গানের
দুয়ার মূলত মনের দুয়ার এবং গুরুজনরা হলো প্রথাগত সংস্কারের অভিভাবক। আর ভবনবাসী
হলো প্রথাগত জনপদের সংস্কার। প্রেম জগতের শ্যামের সাথে মিলিত হওয়ার
প্রত্যয়, এই উৎসবকে মহিমান্বিত করেছে। এই বিচারে এ গানের কাজরি হলো-
প্রথাভাঙার উৎসব মাত্র।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে
সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ৭
ডিসেম্বর তারিখে (শনিবার ২১ অগ্রহায়ণ ১৩৪৭),
কলকাতার
মিনার্ভা থিয়েটারে
দেবেন্দ্রনাথ রাহা রচিত 'অর্জুন বিজয়'
নামক নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। উক্ত নাটকে এই গানটি পরিবেশিত
হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪১ বছর ৬ মাস।
- মঞ্চ:
অর্জুন-বিজয়
(নাটক)। নাট্যকার দেবেন্দ্র রাহা। পরিচালনা শরৎচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়। প্রথম মঞ্চস্থ-
মিনার্ভা থিয়েটার [৭ ডিসেম্বর ১৯৪০ (শনিবার,
২১ অগ্রহায়ণ ১৩৪৭)]।
নর্তকীগণ-সহ নৃত্য-গান। শিল্পী: প্রভা,
আন্নাকালী, ইন্দু, রাধারাণী, পটল, সুশীলা, কমলা, মুক্তা ইত্যাদি। সুর:
নজরুল ইসলাম]
- গ্রন্থ: নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ (নজরুল ইনস্টিটিউট, মাঘ
১৪১৮। ফেব্রুয়ারি ২০১২)। ১৭২৪ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ৫১৩।