ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রথম খণ্ডে (আশ্বিন ১৩৯০ : ১৯০৫ শক) উপস্থাপিত রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য
যে সংসারে প্রথম চোখ মেলেছিলুম সে ছিল অতি নিভৃত। শহরের বাইরে শহরতলীর মতো, চারি
দিকে প্রতিবেশির ঘরবাড়িতে কলরবে আকাশটাকে আঁট করে বাঁধে নি।
আমাদের পরিবার আমার জন্মের পূর্বেই সমাজের নোঙর তুলে দূরে বাঁধা-ঘাটের বাইরে এসে
ভিড়েছিল। আচার-অনুশাসন ক্রিয়াকর্ম সেখানে সমস্তই বিরল।
আমাদের ছিল মস্ত একটা সাবেক কালের বাড়ি, তার ছিল গোটাকতক ভাঙা ঢাল বর্শা ও মরচে-পড়া
তলোয়ার-খাটানো দেউড়ি, ঠাকুরদালান, তিন-চারটে উঠোন, সদর-অন্দরের বাগান, সংবৎসরের
গঙ্গাজল ধরে রাখবার মোটা মোটা জালা-সাজানো অন্ধকার ঘর। পূর্বযুগের নানা পালপার্বনের
পর্যায় নানা কলেবরে সাজে সজ্জায় তার মধ্য দিয়ে একদিন চলাচল করেছিল, আমি তার
স্মৃতিরও বাইরে পড়ে গেছি। আমি এসেছি যখন, এ বাসায় তখন পুরাতন কাল সদ্য বিদায়
নিয়েছে, নতুন কাল সবে এসে নামল, তার আসবাবপত্র তখনো এসে পোঁছয় নি।
এ বাড়ি থেকে এ-দেশিয় সামাজিক জীবনের স্রোত যেমন সরে গেছে তেমনি পূর্বতন ধনের
স্রোতেও পড়েছে ভাঁটা। পিতামহের ঐশ্বর্য দীপাবলী নানা শিখায় একদা এখানে দীপ্যমান
ছিল, সেদিন বাকি ছিল দহনশেষের কালো দাগগুলো, আর ছাই, আর একটিমাত্র কম্পমান ক্ষীণ
শিখা। প্রচুর উপকরণসমাকীর্ণ পূর্বকালের আমোদ-প্রমোদ-বিলাস-সমারোহের সরঞ্জাম কোণে
কোণে ধূলিমলিন জীর্ণ অবস্থায় কিছু কিছু বাকি যদি বা থাকে তাদের কোনো অর্থ নেই। আমি
ধনের মধ্যে জন্মাই নি, ধনের স্মৃতির মধ্যেও না।
নিরালায় এই পরিবারে যে স্বাতন্ত্র্য জেগে উঠেছিল সে স্বাভাবিক, মহাদেশ থেকে
দূরবিচ্ছিন্ন দ্বীপের গাছপালা জীবজন্তুরই স্বাতন্ত্র্যের মতো। তাই আমাদের ভাষায়
একটা কিছু ভঙ্গি ছিল কলকাতার লোক যাকে ইশারা করে বলত ঠাকুরবাড়ির ভাষা। পুরুষ ও
মেয়েদের বেশভূষাতেও তাই, চালচলনেও।
বাংলা ভাষাটাকে তখন শিক্ষিতসমাজ অন্দরে মেয়েমহলে ঠেলে রেখেছিলেন; সদরে ব্যবহার হত
ইংরেজি-চিঠিপত্রে, লেখাপড়ায়, এমন-কি, মুখের কথায়। আমাদের বাড়িতে এই বিকৃতি ঘটতে
পারে নি। সেখানে বাংলা ভাষার প্রতি অনুরাগ ছিল সুগভীর, তার ব্যবহার ছিল সকল কাজেই।
আমাদের বাড়িতে আর-একটি সমাবেশ হয়েছিল সেটি উল্লেখযোগ্য। উপনিষদের ভিতর দিয়ে
প্রাক্পৌরাণিক যুগের ভারতের সঙ্গে এই পরিবারের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। অতি বাল্যকালেই
প্রায় প্রতিদিনই বিশুদ্ধ উচ্চারণে অনর্গল আবৃত্তি করেছি উপনিষদের শ্লোক। এর থেকে
বুঝতে পারা যাবে সাধারনত বাংলাদেশে ধর্মসাধনায় ভাবাবেগের যে উদ্বেলতা আছে আমাদের
বাড়িতে তা প্রবেশ করে নি। পিতৃদেবের প্রবর্তিত উপাসনা ছিল শান্ত সমাহিত।
এই যেমন একদিকে তেমনি অন্য দিকে আমার গুরুজনদের মধ্যে ইংরেজি সাহিত্যের আনন্দ ছিল
নিবিড়। তখন বাড়ির হাওয়া শেক্সপীয়রের নাট্যরস-সম্ভোগে আন্দোলিত, সার ওঅল্টার
স্কটের প্রভাবও প্রবল। দেশপ্রীতির উন্মাদনা তখন দেশে কোথাও নেই। রঙ্গলালের
“স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে” আর তার পরে হেমচন্দ্রের “বিংশতি কোটি মানবের
বাস” কবিতায় দেশমুক্তি-কামনার সুর ভোরের পাখির কাকলির মতো শোনা যায়। হিন্দুমেলার
পরামর্শ ও আয়োজনে আমাদের বাড়ির সকলে তখন উৎসাহিত, তার প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন
নবগোপাল মিত্র। এই মেলার গান ছিল মেজদাদার লেখা “জয় ভারতের জয়”, গণদাদার লেখা
“লজ্জায় ভারত-যশ গাইব কী করে”, বড়দাদার “মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি”। জ্যোতিদাদা
এক গুপ্তসভা স্থাপন করেছেন – একটি পোড়ো বাড়িতে তার অধিবেশন; ঋগবেদের পুঁথি, মড়ার
মাথার খুলি আর খোলা তলোয়ার নিয়ে তার অনুষ্ঠান; রাজনারায়ণ বসু তার পুরোহিত; সেখানে
আমরা ভারত-উদ্ধারের দীক্ষা পেলেম।
এই-সকল আকাঙ্ক্ষা উৎসাহ উদ্যোগ এর কিছুই ঠেলাঠেলি ভিড়ের মধ্যে নয়। শান্ত অবকাশের
ভিতর দিয়ে ধীরে ধীরে এর প্রভাব আমাদের অন্তরে প্রবেশ করেছিল। রাজসরকারের কোতোয়াল হয়
তখন সতর্ক ছিল না, নয় উদাসীন ছিল, তারা সভার সভ্যদের মাথার খুলি ভঙ্গ বা রসভঙ্গ
করতে আসে নি।
কলকাতা শহরের বক্ষ তখন পাথরে বাঁধানো হয় নি, অনেকখানি কাঁচা ছিল। তেল কলের ধোঁওয়ায়
আকাশের মুখে তখনো কালি পড়েনি। ইমারত-অরণ্যের ফাঁকায় ফাঁকায় পুকুরের জলের উপর
সূর্যের আলো ঝিকিয়ে যেত, বিকেলবেলায় অশথের ছায়া দীর্ঘতর হয়ে পড়ত, হাওয়ায় দুলত
নারকেল গাছের পত্র-ঝালোর, বাঁধা নালা বেয়ে গঙ্গার জল ঝরনার মতো ঝরে পড়ত আমাদের
দক্ষিন বাগানের পুকুরে, মাঝে মাঝে গলি থেকে পালকি-বেহারার হাঁইহুঁই শব্দ আসত কানে,
আর বড় রাস্তা থেকে সহিসের হেইও হাঁক। সন্ধ্যাবেলায় জ্বলত তেলের প্রদীপ, তারই ক্ষীণ
আলোয় মাদুর পেতে বুড়ী দাসীর কাছে শুনতুম রূপকথা। এই নিস্তব্ধপ্রায় জগতের মধ্যে আমি
ছিলুম এক কোণের মানুষ – লাজুক, নীরব, নিশ্চঞ্চল।
আরো একটা কারণে আমাকে খাপছাড়া করেছিল। আমি ইস্কুল পালানো ছেলে, পরীক্ষা দিই নি, পাস
করিনি, মাস্টার আমার ভাবীকালের সম্বন্ধে হতাশ্বাস। ইস্কুলঘরের বাইরে যে অবকাশটা
বাধাহীন সেইখানে আমার মন হাঘরেদের মতো বেরিয়ে পড়েছিল।
ইতিপূর্বেই কোন্ একটা ভরসা পেয়ে হঠাৎ আবিষ্কার করেছিলুম, লোকে যাকে বলে কবিতা সেই
ছন্দ-মেলানো মিল-করা ছড়াগুলো সাধারণ কলম দিয়েই সাধারণ লোকে লিখে থাকে। তখন দিনও এমন
ছিল, ছড়া যারা বানাতে পারত তাদের দেখে লোক বিস্মিত হত। এখন যারা না পারে তারাই
অসাধারণ বলে গণ্য। পয়ার-ত্রিপদী মহলে আপন আবাধ অধিকারবোধের অক্লান্ত উৎসাহে লেখায়
মাতলুম। আট অক্ষর দশ অক্ষরের চৌকো-চৌকো কত রকম শব্দভাগ নিয়ে চলল ঘরের কোণে আমার
ছন্দ-ভাঙাগড়ার খেলা। ক্রমে প্রকাশ পেল দশজনের সামনে।
এই লেখাগুলি যেমনি হোক এর পিছনে একটি ভূমিকা আছে – সে হচ্ছে একটি বালক, সে কুনো, সে
একলা, সে একঘরে, তার খেলা নিজের মনে। সে ছিল সমাজের শাসনের অতীত, ইস্কুলের শাসনের
বাইরে। বাড়ীর শাসনও তার হালকা। পিতৃদেব ছিলেন হিমালয়ে, বাড়ীতে দাদারা ছিলেন
কর্তৃপক্ষ। জ্যোতিদাদা, যাঁকে আমি সকলের চেয়ে মান্তুম, বাইরে থেকে তিনি আমাকে কোনো
বাঁধন পরান নি। তাঁর সঙ্গে তর্ক করেছি, নানা বিষয়ে আলোচনা করেছি বয়স্যের মতো। তিনি
বালককেও শ্রদ্ধা করতে জানতেন। আমার আপন মনের স্বাধীনতার দ্বারাই তিনি আমার
চিত্তবিকাশের সহায়তা করেছেন। তিনি আমার পরে কর্তৃত্ব করবার ঔৎসুক্যে যদি দৌরাত্ম
করতেন তা হলে ভেঙে-চুরে তেড়ে-বেঁকে যা-হয়-একটা-কিছু হতুম, সেটা হয়তো ভদ্রসমাজে
সন্তোষজনকও হত, কিন্তু আমার মতো একেবারেই হত না।
শুরু হল আমার ভাঙাছন্দে টুকরো কাব্যের পালা, উল্কাবৃষ্টির মতো ; বালকের যা-তা ভাবের
এলোমেলো কাঁচা গাঁথুনি। এই রীতি-ভঙ্গের ঝোঁকটা ছিল সেই একঘরে ছেলের মজ্জাগত। এতে
যথেষ্ট বিপদের শঙ্কা ছিল। কিন্তু এখানেও অপঘাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেছি। তার কারন,
আমার ভাগ্যক্রমে সেকালে বাংলা সাহিত্যে খ্যাতির হাটে ভিড় ছিল অতি সামান্য –
প্রতিযোগিতার উত্তেজনা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে নি। বিচারকদের দন্ড থেকে অপ্রশংসার অপ্রিয়
আঘাত নামত, কিন্তু কটূক্তি ও কুৎসার উত্তেজনা তখনো সাহিত্যে ঝাঁঝিয়ে ওঠে নি।
সেদিনকার অল্পসংখ্যক সাহিত্যিকের মধ্যে আমি ছিলেম বয়সে সব চেয়ে ছোটো, শিক্ষায় সব
চেয়ে কাঁচা। আমার ছন্দগুলি লাগাম-ছেঁড়া, লেখবার বিষয় ছিল অস্ফুট উক্তিতে ঝাপসা,
ভাষার ও ভাবের অপরিণতি পদে পদে। তখনকার সাহিত্যিকেরা মুখের কথায় বা লেখায় প্রায়ই
আমাকে প্রশয় দেননি – আধো-আধো বাধো-বাধো কথা নিয়ে বেশ একটু হেসেছিলেন। সে হাসি
বিদূষকের নয়, সেটা বিদূষণ-ব্যবসায়ের অঙ্গ ছিল না। তাঁদের লেখায় শাসন ছিল, অসৌজন্য
ছিল না লেশমাত্র। বিমুখতা যেখানে প্রকাশ পেয়েছে সেখানেও বিদ্বেষ দেখা দেয় নি। তাই
প্রশ্রয়ের অভাব সত্ত্বেও, বিরুদ্ধ রীতির মধ্য দিয়েও, আপন লেখা আপন মতে গড়ে
তুলেছিলেম।
সেদিনকার খ্যাতিহীনতার স্নিগ্ধ প্রথম প্রহর কেটে গেল, প্রকৃতির শুশ্রুষা ও
আত্মীয়দের স্নেহের ঘনচ্ছায়ায় ছিলেম বসে। কখনো কাটিয়েছি তেতালার ছাদের প্রান্তে
কর্মহীন অবকাশে মনে মনে আকাশ-কুসুমের মালা গেঁথে, কখনো গাজিপুরে বৃদ্ধ নিমগাছের
তলায় বসে ইঁদারার জলে বাগান সেঁচ দেবার করুনধ্বনি শুনতে শুনতে অদূর গঙ্গার স্রোতে
কল্পনাকে অহৈতুক বেদনায় বোঝাই করে দূরে ভাসিয়ে দিয়ে। নিজের মনের আলো-আধাঁরের মধ্যে
থেকে হঠাৎ পরের মনের কনুইয়ের ধাক্কা খাবার জন্যে বড় রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে হবে এমন
কথা সেদিন ভাবিও নি। অবশেষে একদিন খ্যাতি এসে অনাবৃত মধ্যাহ্নরৌদ্রে টেনে বের করলে।
তাপ ক্রমেই বেড়ে উঠল, আমার কোণের আশ্রয় একেবারে ভেঙে গেল। খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে যে
গ্লানি এসে পড়ে আমার ভাগ্যে অন্যদের চেয়ে তা অনেক বেশি আবিল হয়ে উঠেছিল। এমন অনবরত,
এমন অকুন্ঠিত, এমন অকরুন, এমন অপ্রতিহত অসন্মাননা আমার মতো আর কোনো সাহিত্যিককে
সইতে হয় নি। এও আমার খ্যাতি-পরিমাপের বৃহৎ মাপকাটি। এ কথা বলবার সুযোগ পেয়েছি যে,
প্রতিকূল পরীক্ষায় ভাগ্য আমাকে লাঞ্ছিত করেছে, কিন্তু পরাভবের অগৌরবে লজ্জিত করে
নি। এ ছাড়া আমার দুর্গ্রহ কালো বর্ণের এই যে পটটি ঝুলিয়েছেন এরই উপরে আমার
বন্ধুদের সুপ্রসন্ন মুখ সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাঁদের সংখ্যা অল্প নয়, সে কথা বুঝতে
পারি আজকের এই অনুষ্ঠানেই। বন্ধুদের কাউকে জানি, অনেককেই জানি নে। তাঁরাই কেউ কাছে
থেকে দূরে থেকে এই উৎসবে মিলিত হয়েছেন, সেই উৎসাহে আমার মন আনন্দিত। আজ আমার মনে
হচ্ছে তাঁরা আমাকে জাহাজে তুলে দিতে ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছেন – আমার খেয়াতরী পাড়ি দেবে
দিবালোকের পরপারে তাঁদের মঙ্গলধ্বনি কানে নিয়ে।
আমার কর্মপথের যাত্রা সত্তর বছরের গোধূলিবেলায় একটা উপসংহারে এসে পৌঁছল। আলো ম্লান
হবার শেষ মুহূর্তের এই জয়ন্তী অনুষ্ঠানের দ্বারা দেশ আমার দীর্ঘজীবনের মূল্য
স্বীকার করবেন।
ফসল যতদিন মাঠে ততদিন সংশয় থেকে যায়। বুদ্ধিমান মহাজন খেতের দিকে তাকিয়েই আগাম দাদন
দিতে দ্বিধা করে, অনেকটা হাতে রেখে দেয়। যখন গোলায় উঠল তখনই ওজন বুঝে দামের কথা
পাকা হতে পারে। আজ আমার বুঝি সেই ফলন-শেষের হিসাব চুকিয়ে দেবার দিন।
যে মানুষ অনেক কাল বেঁচে আছে সে অতীতেরই সামিল। বুঝতে পারছি, আমার সাবেক বর্তমান এই
হাল থেকে বেশ খানিকটা তফাতে। যে-সব কবি পালা শেষ করে লোকান্তরে তাঁদেরই আঙিনায়
কাছটায় আমি এসে দাঁড়িয়েছি, তিরোভাবের ঠিক পূর্ব-সীমানায়। বর্তমানের চলতি রথের বেগের
মুখে কাউকে দেখে নেবার যে অস্পষ্টতা সেটা আমার বেলা এতদিনে কেটে যাবার কথা। যতখানি
দূরে এলে কল্পনার ক্যামেরায় মানুষের জীবনটাকে সমগ্রলক্ষ্যবদ্ধ করা যায় আধুনিকের
পুরোভাগ থেকে আমি ততটা দূরেই এসেছি।
পঞ্চাশের পরে বানপ্রস্থের প্রস্তাব মনু করেছেন। তার কারণ মনুর হিসাবমত পঞ্চাশের পরে
মানুষ বর্তমানের থেকে পিছিয়ে পড়ে। তখন কোমর বেঁধে ধাবমান কালের সঙ্গে সমান ঝোঁকে পা
ফেলে চলার বেগে যতটা ক্লান্তি ততটা সফলতা থাকে না, যতটা ক্ষয় ততটা পূরণ হয় না। অতএব
তখন থেকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে থাকে সেই সর্বকালের মোহানার দিকে যাত্রা করতে হবে
যেখানে কাল স্তব্ধ। গতির সাধনা শেষ করে তখন স্থিতির সাধনা।
মনু যে মেয়াদ ঠিক করে দিয়েছেন এখন সেটাকে ঘড়ি ধরে খাটানো প্রায় অসাধ্য। মনুর যুগের
নিশ্চয়ই জীবনে এত দায় ছিল না, তার গ্রন্থি ছিল কম। এখন শিক্ষা বল, কর্ম বল, এমন-কি,
আমোদপ্রমোদ খেলাধুলা, সমস্তই বহুব্যাপক। তখনকার সম্রাটেরও রথ যত বড়ো যত জমকালো হোক,
এখনকার রেলগাড়ীর মতো তাতে বহু গাড়ির এমন দ্বন্দ্বসমাস ছিল না। এই গাড়ীর মাল খালাস
করতে বেশ একটু সময় লাগে। পাঁচটায় আপিসে ছুটি শাস্ত্রনির্দিষ্ট বটে, কিন্তু খাতাপত্র
বন্ধ করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বাড়িমুখো হবার আগেই বাতি জ্বালতে হয়। আমাদের সেই দশা।
তাই পঞ্চাশের মেয়াদ বাড়িয়ে না নিলে ছুটি মঞ্জুর অসম্ভব। কিন্তু সত্তরের কোঠায় পড়লে
আর ওজর চলে না। বাইরের লক্ষণে বুঝতে পারছি, আমার সময় চলল আমাকে ছাড়িয়ে – কম করে
ধরলেও অন্তত দশ বছর আগেকার তারিখে আমি বসে আছি। দূরের নক্ষত্রের আলোর মতো, অর্থাৎ
সে যখনকার সে তখনকার নয়।
তবু একেবারে থামবার আগে চলার ঝোঁকে অতীত কালের খানিকটা ধাক্কা এসে পড়ে বর্তমানের
উপরে। গান সমস্তটাই সমে এসে পৌঁছলে তার সমাপ্তি ; তবু আরো কিছুক্ষণ ফরমাশ চলে
পালটিয়ে গাবার জন্যে। সেটা অতীতেরই পুনরাবৃত্তি। এর পরে বড়োজোর দুটো-একটা তান
লাগানো চলে, কিন্তু চুপ করে গেলেও লোকসান নেই। পুনরাবৃত্তিকে দীর্ঘকাল তাজা রাখবার
চেষ্টাও যা আর কইমাছটাকে ডাঙায় তুলে মাসখানেক বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টাও তাই।
এই মাছটার সঙ্গে কবির তুলনা আরো একটু এগিয়ে নেওয়া যাক। মাছ যতক্ষণ জলে আছে ওকে কিছু
কিছু খোরাক জোগানো সৎকর্ম, সেটা মাছের নিজের প্রয়োজনে। পরে যখন তাকে ডাঙায় তোলা হল
তখন প্রয়োজনটা তার নয়, অপর কোনো জীবের। তেমনি কবি যতদিন না একটা স্পষ্ট পরিণতিতে
পৌঁছয় ততদিন তাকে কিছু কিছু উৎসাহ দিতে পারলে ভালই – সেটা কবির নিজেরই প্রয়োজনে।
তার পরে তার পূর্নতায় যখন একটা সমাপ্তির যতি আসে তখন তার সম্বন্ধে যদি কোনো প্রয়োজন
থাকে সেটা তার নিজের নয়, প্রয়োজন তার দেশের।
দেশ মানুষের সৃষ্টি। দেশ মৃন্ময় নয়, সে চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশমান হয় তবেই দেশ
প্রকাশিত। সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা ভূমির কথা যতই উচ্চকন্ঠে রটাব ততই জবাবদিহির দায়
বাড়বে। প্রশ্ন উঠবে প্রাকৃতিক দান তো উপাদান মাত্র, তা নিয়ে মানবিক সম্পদ কতটা গড়ে
তোলা হল। মানুষের হাতে দেশের জল যদি যায় শুকিয়ে, ফল যদি যায় মরে, মলয়জ যদি বিষিয়ে
ওঠে মারীবীজে, শস্যের জমি যদি হয় বন্ধ্যা, তবে কাব্যকথায় দেশের লজ্জা চাপা পড়বে না।
দেশ মাটিতে তৈরী নয়, দেশ মানুষে তৈরী।
তাই নিজের সত্তা প্রমানেরই খাতিরে অহরহ তাকিয়ে আছে তাদেরই জন্যে যারা কোনো সাধনায়
সার্থক। তারা না থাকলেও গাছপালা জীবজন্তু জন্মায়, বৃষ্টি পড়ে, নদী চলে, কিন্তু দেশ
আচ্ছন্ন থাকে মরুবালুতলে ভূমির মতো। এই কারণেই দেশ যার মধ্যে আপন ভাষাবান্ প্রকাশ
অনুভব করে, তাকে সর্বজনসমক্ষে নিজের বলে চিহ্নিত করবার উপলক্ষে রচনা করতে চায়।
যেদিন তাই করে, যেদিন কোনো মানুষকে আনন্দের সঙ্গে সে অঙ্গীকার করে, সেদিনই মাটির
কোল থেকে দেশের কোলে সেই মানুষের জন্ম।
আমার জীবনের সমাপ্তিদশায় এই জয়ন্তী অনুষ্ঠানের যদি কোনো সত্য থাকে তবে তা এই
তাৎপর্য নিয়ে। আমাকে গ্রহন করার দ্বারা দেশ যদি কোনো ভাবে নিজেকে লাভ করে থাকে তবে
আজকের এই উৎসব অর্থহীন। যদি কেউ এ কথায় অহংকারের আশঙ্কা করে আমার জন্যে উদ্বিগ্ন
হন তবে তাঁদের উদ্বেগ অনাবশ্যক। যে খ্যাতির সম্বল অল্প তার সমারোহ যতই বেশি হয়,
ততই তার দেউলে হওয়া দ্রুত ঘটে। ভুল মস্ত হয়েই দেখা দেয়, চুকে যায় অতি ক্ষুদ্র হয়ে।
আতশবাজির অভ্রবিদারক আলোটাই তার নির্বাণের উজ্জ্বল তর্জনীসংকেত।
এ কথায় সন্দেহ নেই যে, পুরস্কারের পাত্র-নির্বাচনে দেশ ভুল করতে পারে। সাহিত্যের
ইতিহাসে ক্ষণমুখরা খ্যাতির মৌনসাধন বার বার দেখা গেছে। তাই আজকের দিনের আয়োজনে আজই
অতিশয় উল্লাস যেন না করি, এই উপদেশের বিরুদ্ধে যুক্তি চলে না। তেমনি তা নিয়ে এখনই
তাড়াতাড়ি বিমর্ষ হবারও আশু কারণ দেখি না। কালে কালে সাহিত্যবিচারের রায় একবার
উলটিয়ে আবার পালটিয়েও থাকে। অব্যবস্থিতচিত্ত মন্দগতি কালের সবশেষ বিচারে আমার
ভাগ্যে যদি নিঃশেষ ফাঁকিই থাকে তবে এখনই আগাম শোচনা করতে বসা কিছু নয়। এখনকার মতো
এই উপস্থিত অনুষ্ঠানটাই নগদ লাভ। তার পরে চরম জবাবদিহির জন্যে প্রপৌত্রেরা রইলেন।
আপাতত বন্ধুদের নিয়ে আশ্বস্তচিত্তে আনন্দ করা যাক, অপর পক্ষে যাঁদের অভিরুচি হয়
তাঁরা ফুৎকারে বুদ্বুদ্ বিদীর্ণ করার উৎসাহে আনন্দ করতে পারেন। এই দুই বিপরীত
ভাবের কালোয় সাদায় সংসারের আনন্দধারায় যমের ভগ্নী যমুনা ও শিবজটানিঃসৃতা গঙ্গা মিলে
থাকে। ময়ূর আপন পুচ্ছগর্বে নৃত্য করে খুশি, আবার শিকারি আপন লক্ষ্যভেদ্গর্বে তাকে
গুলি করে মহা আনন্দিত।
আধুনিক কালে পাশ্চাত্য দেশে সাহিত্যে কলাসৃষ্টিতে লোকচিত্তের সম্মতি অতি ঘন ঘন বদল
হয়, এটা দেখা যাচ্ছে। বেগ বেড়ে চলেছে মানুষের যানে-বাহনে, বেগ অবিশ্রাম ঠেলা দিচ্ছে
মানুষের মনপ্রাণকে।
যেখানে বৈষয়িক প্রতিযোগিতা উগ্র সেখানে এই বেগের মূল্য বেশি। ভাগ্যের হরির লুট নিয়ে
হাটের ভিড়ে ধুলার ’পরে যেখানে সকলে মিলে কাড়াকাড়ি, সেখানে যে মানুষ বেগে জেতে মালেও
তার জিত। তৃপ্তিহীন লোভের বাহন বিরামহীন বেগ। সমস্ত পশ্চিম মাতালের মতো টলমল করছে
সেই লোভে। সেখানে বেগবৃদ্ধি ক্রমে লাভের উপলক্ষ না হয়ে স্বয়ং লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।
বেগেরই লোভ আজ জলে স্থলে আকাশে হিস্টিরিয়ার চীৎকার করতে করতে ছুটে বেরোল।
কিন্তু প্রাণপদার্থ তো বাষ্পবিদ্যুতের-ভূতে-তাড়া-করা লোহার এঞ্জিন নয়। তার একটি আপন
ছন্দ আছে। সেই ছন্দে দুই-এক মাত্রা টান সয়, তার বেশি নয়। মিনিট কয়েক ডিগবাজি খেয়ে
চলা সাধ্য হতে পারে, কিন্তু দশ মিনিট যেতে না যেতে প্রমাণ হবে যে মানুষ বাইসিকেলের
চাকা নয়, তার পদাতিকের চাল পদাবলীর ছন্দে। গানের লয় মিষ্টি লাগে যখন সে কানের সজীব
ছন্দ মেনে চলে। তাকে দুন থেকে চৌদুনে চড়ালে সে কলাদেহ ছেড়ে কৌশলদেহ নেবার জন্যই
হাঁসফাঁস্ করতে থাকে। তাগিদ যদি আরো বাড়াও তা হলে রাগিণীটা পাগলা-গারদের সদর গেটের
উপর মাথা ঠুকে মারা যাবে। সজীব চোখ তো ক্যামেরা নয়, ভালো করে দেখে নিতে সে সময় নেয়।
ঘন্টায় বিশ-পঁচিশ মাইল দৌড়ের দেখা তার পক্ষে কুয়াশা দেখা। একদা তীর্থযাত্রা বলে
একটা সজীব পদার্থ আমাদের দেশে ছিল, ভ্রমণের পূর্ণস্বাদ নিয়ে সেটা সম্পন্ন হত। কলের
গাড়ীর আমলে তীর্থ রইল, যাত্রা রইল না ; ভ্রমণ নেই, পৌঁছনো আছে – শিক্ষাটা বাদ দিয়ে
পরীক্ষাটা পাস করা যাকে বলে। রেল-কোম্পানির কারখানায় কলেঠাসা তীর্থযাত্রার ভিন্ন
ভিন্ন দামের বটিকা সাজানো, গিলে ফেললেই হল – কিন্তু হলই না যে, সে কথা বোঝবারও
ফুরসত নেই। কালিদাসের যক্ষ যদি মেঘদূতকে বরখাস্ত করে দিয়ে এরোপ্লেন-দূতকে অলকায়
পাঠাতেন তা হলে অমন দুই-সর্গ-ভরা মন্দাক্রান্তা ছন্দ দু-চারটে শ্লোক পার না হতেই
অপঘাতে মরত। কলে-ঠাসা বিরহ তো আজ পর্যন্ত বাজারে নামে নি।
মেঘদূতের শোকাবহ পরিণামে শোক করবে না এমনতরো বলবান পুরুষ আজকাল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
কেউ কেউ বলছেন, এখন কবিতার যে আওয়াজটা শোনা যাচ্ছে সে নাভিশ্বাসের আওয়াজ। ওর সময়
হয়ে এল। যদি তা সত্য হয় তবে সেটা কবিতার দোষে নয়, সময়ের দোষে। মানুষের প্রাণটা
চিরদিনই ছন্দে-বাঁধা, কিন্তু তার কালটা কলের তাড়ায় সম্প্রতি ছন্দ-ভাঙা।
আঙুরের খেতে চাষি কাঠি পুঁতে দেয়; তারই উপর আঙুর লতিয়ে উঠে আশ্রয় পায়, ফল ধরায়।
তেমনি জীবনযাত্রাকে সবল সফল করবার জন্যে কতকগুলি রীতিনীতি বেঁধে দিতে হয়। এই
রীতিনীতির আনেকগুলিই নির্জীব নীরস, উপদেশ-আনুশাসনের খুঁটি। কিন্তু বেড়ায় লাগানো
জিয়লকাঠের খুঁটি যেমন রস পেলেই বেঁচে ওঠে, তেমনি জীবনযাত্রা যখন প্রাণের ছন্দে
শান্তগমনে চলে তখন শুকনো খুঁটিগুলো অন্তরের গভীরে পৌঁছবার অবকাশ পেয়ে ক্রমেই প্রাণ
পেতে থাকে। সেই গভীরেই সঞ্জীবনরস। সেই রসে তত্ত্ব ও নীতির মতো পদার্থও হৃদয়ের আপন
সামগ্রীরূপে সজীব ও সজ্জিত হয়ে ওঠে, মানুষের আনন্দের রঙ তাতে লাগে। এই আনন্দের
প্রকাশের মধ্যেই চিরন্তনতা। একদিনের নীতিকে, আর-একদিন আমরা গ্রহন নাও করতে পারি,
কিন্তু সেই নীতি যে প্রীতিকে, যে সৌন্দর্যকে, আনন্দের সত্য ভাষায় প্রকাশ করেছে সে
আমাদের কাছে নূতন থাকবে। আজও নূতন আছে মোগল সাম্রাজ্যের শিল্প — সেই সাম্রাজ্যকে,
সাম্রাজ্যনীতিকে আমরা পছন্দ করি আর না করি।
কিন্তু যে যুগে দলে দলে গরজের তাড়ায় অবকাশ ঠাসা হয়ে নিরেট হয়ে যায় সে যুগ
প্রয়োজনের, সে যুগ প্রীতির নয়। প্রীতি সময় নেয় গভীর হতে। আধুনিক এই ত্বরা-তাড়িত
যুগে প্রয়োজনের তাগিদ কচুরিপানার মতোই সাহিত্যধারার মধ্যেও ভুরি ভুরি ঢুকে পড়েছে
তারা বাস করতে আসে না, সমস্যাসমাধানের দরখাস্ত হাতে ধন্না দিয়ে পড়ে। সে দরখাস্ত যতই
অলংকৃত হোক তবু সে খাঁটি সাহিত্য নয়, সে দরখাস্তই। দাবি মিটলেই তার অন্তর্ধান।
এমন অবস্থায় সাহিত্যের হাওয়া বদল হয় এ-বেলা ও-বেলা। কোথাও আপন দরদ রেখে যায় না।
পিছনটাকে লাথি মেরেই চলে, যাকে উঁচু করে গড়েছিল তাকে ধূলিসাৎ করে তার ’পরে
অট্টহাসি। আমাদের মেয়েদের পাড়ওয়ালা শাড়ী, তাদের নীলাম্বরী, তাদের বেনারসি চেলি
মোটের উপর দীর্ঘকাল বদল হয় নি; কেননা ওরা আমাদের অন্তরের অনুরাগকে আঁকড়ে আছে। দেখে
আমাদের চোখের ক্লান্তি হয় না। হত ক্লান্তি, মনটা যদি রসিয়ে দেখবার উপযুক্ত সময় না
পেয়ে বেদরদি ও অশ্রদ্ধাপরায়ণ হয়ে উঠত। হৃদয়হীন অগভীর বিলাসের আয়োজনে অকারণে অনায়াসে
ঘন ঘন ফ্যাশানের বদল। এখনকার সাহিত্যে তেমনি রীতির বদল। হৃদয়টা দৌড়তে দৌড়তে
প্রীতিসম্বন্ধের রাখী গাঁথতে ও পরাতে পারে না। যদি সময় পেত সুন্দর করে বিনিয়ে
বিনিয়ে গাঁথত। এখন ওকে ব্যাস্ত লোকেরা ধমক দিয়ে বলে, রেখে দাও তোমার সুন্দর। সুন্দর
পুরোনো, সুন্দর সেকেলে। আনো একটা যেমন- তেমন-করে-পাক-দেওয়া শণের দড়ি — সেটাকে বলব
রিয়ালিজ্ম্। এখনকার দুদ্দাড়-দৌড়াওআলা লোকের ঐটেই পছন্দ। স্বল্পায়ু হঠাৎ-নবাবের
মতো উদ্ধত — তার প্রধান অহংকার এই যে, সে অধুনাতন; অর্থাৎ তার বড়াই গুণ নিয়ে নয়,
কাল নিয়ে।
বেগের এই মোটর-কলটা পশ্চিমদেশের মর্মস্থানে। ওটা এখনো পাকা দলিলে আমাদের নিজস্ব হয়
নি। তবু আমাদেরও দৌড় আরম্ভ হল। ওদেরই হাওয়া-গাড়ির পায়দানের উপর লাফ দিয়ে আমরা উঠে
পড়েছি। আমরাও খর্বকেশিনী খর্ববেশিনী সাহিত্যকীর্তির টেকনিকের হাল ফ্যাশন নিয়ে
গম্ভীরভাবে আলোচনা করি, আমরাও অধুনাতনের স্পর্ধা নিয়ে পুরাতনের মানহানি করতে
অত্যন্ত খুশি হই।
এই-সব চিন্তা করেই বলেছিলুম, আমার এ বয়সে খ্যাতিকে আমি বিশ্বাস করি নে। এই
মায়ামৃগীর শিকারে বনে-বাদাড়ে ছুটে বেড়ানো যৌবনেই সাজে। কেননা, সে বয়সে মৃগ যদি বা
না’ও মেলে মৃগয়াটাই যথেষ্ট। ফুল থেকে ফল থেকে ফল হতেও পারে, না হতেও পারে, তবু আপন
স্বভাবকেই চাঞ্চল্যে সার্থক করতে হয় ফুলকে। সে অশান্ত, বাইরের দিকেই তার বর্ণগন্ধের
নিত্য উদ্যম। ফলের কাজ অন্তরে, তার স্বভাবের প্রয়োজন অপ্রগল্ভ শান্তি। শাখা থেকে
মুক্তির জন্যেই তার সাধনা — সেই মুক্তি নিজেরই আন্তরিক পরিণতির যোগে।
আমার জীবনে আজ সেই ফলেরই ঋতু এসেছে, যে ফল আশু বৃন্তচ্যুতির অপেক্ষা করে। এই ঋতুটির
সুযোগ সম্পূর্ণ গ্রহণ করতে হলে বাহিরের সঙ্গে অন্তরের শান্তি-স্থাপন চাই। সেই
শান্তি খ্যাতি-অখ্যাতির দ্বন্দ্বের মধ্যে বিধ্বস্ত হয়।
খ্যাতির কথা থাক্। ওটার অনেকখানিই অবাস্তবের বাষ্পে পরিস্ফীত। তার সংকোচন-প্রসারণ
নিয়ে যে-মানুষ অতিমাত্র ক্ষুব্ধ হতে থাকে সে অভিশপ্ত। ভাগ্যের পরম দান প্রীতি, কবির
পক্ষে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার তাই। যে-মানুষ কাজ দিয়ে থাকে খ্যাতি দিয়ে তার বেতন শোধ চলে,
আনন্দ দেওয়াই যার কাজ প্রীতি না হলে তার প্রাপ্য শোধ হয় না।
অনেক কীর্তি আছে যা মানুষকেই উপকরণ করে গড়ে তোলা, যেমন রাষ্ট্র। কর্মের বল সেখানে
জনসংখ্যায়, তাই সেখানে মানুষকে দলে টানা নিয়ে কেবলই দ্বন্দ্ব চলে। বিস্তারিত
খ্যাতির বেড়াজাল ফেলে মানুষ ধরা নিয়ে ব্যাপার। মনে কর, লয়েড জর্জ। তাঁর বুদ্ধিকে
তাঁর শক্তিকে অনেক লোকে যখন মানে তখনই তাঁর কাজ চলে। বিশ্বাস আলগা হলে বেড়াজাল গেল
ছিঁড়ে, মানুষ-উপকরণ পুরোপুরি জোটে না।
অপর পক্ষে, কবির সৃষ্টি যদি সত্য হয়ে থাকে সেই সত্যের গৌরব সেই সৃষ্টির নিজেরই
মধ্যে, দশজনের সম্মতির মধ্যে নয়। দশজনে তাকে স্বীকার করে নি এমন প্রায়ই ঘটে থাকে।
তাতে বাজারদরের ক্ষতি হয়, কিন্তু সত্য মূল্যের কমতি হয় না।
ফুল ফুটেছে, এটেই ফুলের চরম কথা। যার ভালো লাগল সেই জিতল, ফুলের জিত তার আপন
আবির্ভাবেই। সুন্দরের অন্তরে আছে একটি রসময় রহস্যময় আয়ত্তের অতীত সত্য, আমাদের
অন্তরেরই সঙ্গে তার অনির্বচনীয় সম্বন্ধ। তার সম্পর্কে আমাদের আত্মচেতনা হয় মধুর,
গভীর, উজ্জ্বল। আমাদের ভিতরের মানুষ বেড়ে ওঠে, রঙিয়ে ওঠে, রসিয়ে ওঠে। আমাদের সত্তা
যেন তার সঙ্গে রঙে রসে মিলে যায় — একেই বলে অনুরাগ।
কবির কাজ এই অনুরাগে মানুষের চৈতন্যকে উদ্দীপ্ত করা, ঐদাসীন্য থেকে উদ্বোধিত করা।
সেই কবিকেই মানুষ বড়ো বলে যে এমন —সকল বিষয়ে মানুষের চিত্তকে আশ্লিষ্ট করেছে যার
মধ্যে নিত্যতা আছে, মহিমা আছে, মুক্তি আছে, যা ব্যাপক এবং গভীর। কলা ও সাহিত্যের
ভাণ্ডারে দেশে দেশে কালে কালে মানুষের অনুরাগের সম্পদ রচিত ও সঞ্চিত হয়ে উঠছে। এই
বিশাল ভুবনে বিশেষ দেশের মানুষ বিশেষ কাকে ভালোবেসেছে সে তার সাহিত্য দেখলেই বুঝতে
পারি। এই ভালোবাসার দ্বারাই তো মানুষকে বিচার করা।
বীণাপাণির বীণায় তার অনেক। কোনোটা সোনার, কোনোটা তামার, কোনোটা ইস্পাতের। সংসারের
কণ্ঠে হালকা ও ভারী, আনন্দের ও প্রমোদের যতরকমের সুর আছে সবই তাঁর বীণায় বাজে। কবির
কাব্যেও সুরের অসংখ্য বৈচিত্র্য। সবই যে উদাত্ত ধ্বনির হওয়া চাই এমন কথা বলি নে।
কিন্তু সমস্তের সঙ্গে সঙ্গেই এমন কিছু থাকা চাই যার ইঙ্গিত ধ্রুবের দিকে, সেই
বৈরাগ্যের দিকে যা অনুরাগকেই বীর্যবান ও বিশুদ্ধ করে। ভর্তৃহরির কাব্যে দেখি ভোগের
মানুষ আপন সুর পেয়েছে, কিন্তু সেইসঙ্গেই কাব্যের গভীরের মধ্যে বসে আছে ত্যাগের
মানুষ আপন একতারা নিয়ে — এই দুই সুরের সমবায়েই রসের ওজন ঠিক থাকে, কাব্যেও
মানবজীবনেও। দূরকাল ও বহুজনকে যে সম্পদ দান করার দ্বারা সহিত্য স্থায়ীভাবে সার্থক
হয়, কাগজের নৌকায় বা মাটির গামলায় তো তার বোঝাই সইবে না। আধুনিক-কাল-বিলাসীরা
অবজ্ঞার সঙ্গে বলতে পারেন এ-সব কথা আধুনিক কালের বুলির সঙ্গে মিলছে না — তা যদি হয়
তা হলে সেই আধুনিক কালটারই জন্যে পরিতাপ করতে হবে। আশ্বাসের কথা এই যে, সে চিরকালই
আধুনিক থাকবে এত আয়ু তার নয়।
কবি যদি ক্লান্ত মনে এমন কথা মনে করে যে, কবিত্বের চিরকালের বিষয়গুলি আধুনিক কালে
পুরোনো হয়ে গেছে তা হলে বুঝব আধুনিক কালটাই হয়েছে বৃদ্ধ ও রসহীন। চিরপরিচিত জগতে
তার সহজ অনুরাগের রস পৌঁচচ্ছে না। তাই জগৎটাকে আপনার মধ্যে নিতে পারল না। যে কল্পনা
নিজের চারি দিকে আর রস পায় না, সে যে কোনো চেষ্টাকৃত রচনাকেই দীর্ঘকাল সরস রাখতে
পারবে এমন আশা করা বিড়ম্বনা। রসনায় যার রুচি মরেছে চিরদিনের অন্নে সে তৃপ্তি পায়
না, সেই একই কারনে কোনো একটা আজগবি অন্নেও সে চিরদিন রস পাবে এমন সম্ভাবনা নেই।
আজ সত্তর বছর বয়সে সাধারণের কাছে আমার পরিচয় একটা পরিণামে এসেছে। তাই আশা করি,
যাঁরা আমাকে জানবার কিছুমাত্র চেষ্টা করেছেন এতদিনে অন্তত তাঁরা এ কথা জেনেছেন যে,
আমি জীর্ণ জগতে জন্মগ্রহণ করি নি। আমি চোখ মেলে যা দেখলুম চোখ আমার কখনো তাতে
ক্লান্ত হল না। বিস্ময়ের অন্ত পাই নি। চরাচরকে বেষ্টন করে অনাদিকালের যে অনাহত বাণী
অনন্তকালের অভিমুখে ধ্বনিত তাতে আমার মনপ্রাণ সাড়া দিয়েছে, মনে হয়েছে যুগে যুগে এই
বিশ্ববাণী শুনে এলুম। সৌরমণ্ডলীর প্রান্তে এই আমাদের ছোটো শ্যামলা পৃথিবীকে ঋতুর
আকাশদূতগুলি বিচিত্র রসের বর্ণসজ্জায় সাজিয়ে দিয়ে যায়, এই আদরের অনুষ্ঠানে আমার
হৃদয়ের অভিষেকবারি নিয়ে যোগ দিতে কোনোদিন আলস্য করি নি। প্রতিদিন উষাকালে অন্ধকার
রাত্রির প্রান্তে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছি এই কথাটি উপলব্ধি করবার জন্যে যে, যত্তে
রূপং কল্যাণতমং তত্ত্বে পশ্যামি। আমি সেই বিরাট সত্তাকে আমার অনুভব স্পর্শ করতে
চেয়েছি যিনি সকল সত্তার আত্মীয়সম্বন্ধের ঐক্যতত্ত্ব; যাঁর খুশিতেই নিরন্তর
অসংখ্যরূপের প্রকাশে বিচিত্রভাবে আমার প্রাণ খুশি হয়ে উঠেছে — বলে উঠছে —
কোহ্যেবান্যাৎ কঃ প্রাণ্যাৎ যদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ; যাতে কোনো প্রয়োজন নেই তাও
আনন্দের টানে টানবে, এই অত্যাশ্বর্য ব্যাপারের চরম অর্থ যাঁর মধ্যে; যিনি অন্তরে
অন্তরে মানুষকে পরিপূর্ণ করে বিদ্যমান বলেই প্রাণপণ কঠোর আত্মত্যাগকে আমরা আত্মঘাতী
পাগলের পাগলামি বলে হেসে উঠলুম না।
ঈশোপনিষদের প্রথম যে মন্ত্রে পিতৃদেব দীক্ষা পেয়েছিলেন সেই মন্ত্রটি বারবার নতুন
নতুন অর্থ নিয়ে আমার মনে আন্দোলিত হয়েছে, বারবার নিজেকে বলেছি — তেন ত্যক্তেন
ভুঞ্জীথাঃ, মা গৃধঃ। আনন্দ করো তাই নিয়ে যা তোমার কাছে সহজে এসেছে — যা রয়েছে
তোমার চার দিকে তারই মধ্যে চিরন্তন — লোভ কোরো না। কাব্যসাধনায় এই মন্ত্র মহামূল্য।
আসক্তি যাকে মাকড়সার মতো জালে জড়ায় তাকে জীর্ণ করে দেয়; তাতে গ্লানি আসে, ক্লান্তি
আনে। কেননা, আসক্তি তাকে সমগ্র থেকে উৎপাটন করে নিজের সীমার মধ্যে বাঁধে — তার পরে
তোলা ফুলের মতো অল্পক্ষণেই সে ম্লান হয়। মহৎ সাহিত্য ভোগকে লোভ থেকে উদ্ধার করে,
সৌন্দর্যকে আসক্তি থেকে, চিত্তকে উপস্থিত গরজের দণ্ডধারীদের কাছ থেকে। রাবণের ঘরে
সীতা লোভের দ্বারা বন্দী; রামের ঘরে সীতা প্রেমের দ্বারা মুক্ত, সেখানেই তাঁর সত্য
প্রকাশ। প্রেমের কাছে দেহের অপরূপ রূপ প্রকাশ পায়, লোভের কাছে তার স্থূল মাংস।
অনেক দিন থেকেই লিখে আসছি, জীবনের নানা পর্বে নানা অবস্থায়। শুরু করেছি কাঁচা বয়সে
— তখনো নিজেকে বুঝি নি। তাই আমার লেখার মধ্যে বাহুল্য এবং বর্জনীয় জিনিস ভূরি ভূরি
আছে তাতে সন্দেহ নেই। এ-সমস্ত আবর্জনা বাদ দিয়ে বাকি যা থাকে আশা করি তার মধ্যে এই
ঘোষণাটি স্পষ্ট যে, আমি ভালোবেসেছি এই জগৎকে, আমি প্রণাম করেছি মহৎকে, আমি কামনা
করেছি মুক্তিকে — যে মুক্তি পরমপুরুষের কাছে আত্মনিবেদনে, আমি বিশ্বাস করেছি
মানুষের সত্য সেই মহামানবের মধ্যে যিনি সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্ঠঃ। আমি
আবাল্য-অভ্যস্ত ঐকান্তিক সাহিত্য-সাধনার গণ্ডিকে অতিক্রম করে একদা সেই মহামানবের
উদ্দেশে যথাসাধ্য আমার কর্মের অর্ঘ্য আমার ত্যাগের নৈবেদ্য আহরণ করেছি — তাতে
বাইরের থেকে যদি বাধা পেয়ে থাকি অন্তরের থেকে পেয়েছি প্রসাদ। আমি এসেছি এই ধরণীর
মহাতীর্থে— এখানে সর্বদেশ সর্বজাতি ও সর্বকালের ইতিহাসের মহাকেন্দ্রে আছেন নরদেবতা
— তাঁরই বেদীমূলে নিভৃতে বসে আমার অহংকার আমার ভেদবুদ্ধি ক্ষালন করবার দুঃসাধ্য
চেষ্টায় আজও প্রবৃত্ত আছি।
আমার যা-কিছু অকিঞ্চিৎকর তাকে অতিক্রম করেও আমার চরিত্রের অন্তরতম প্রকৃতি ও সাধনা
লেখায় প্রকাশ পেয়ে থাকে, আনন্দ দিয়ে থাকে, তবে তার পরিবর্তে আমি প্রীতি কামনা করি,
আর-কিছু নয়। এ কথা যেন জেনে যাই, অকৃত্রিম সৌহার্দ্য পেয়েছি সেই তাঁদের কাছে যাঁরা
আমার সমস্ত ত্রুটি সত্ত্বেও জেনেছেন সমস্ত জীবন আমি কী চেয়েছি, কী পেয়েছি, কী
দিয়েছি, আমার অপূর্ণ জীবনে অসমাপ্ত সাধনায় কী ইঙ্গিত আছে।
সাহিত্যে মানুষের অনুরাগসম্পদ সৃষ্টি করাই যদি কবির যথার্থ কাজ হয়, তবে এই দান
গ্রহণ করতে গেলে প্রীতিরই প্রয়োজন। কেননা, প্রীতিই সমগ্র করে দেখে। আজ পর্যন্ত
সাহিত্যে যাঁরা সম্মান পেয়েছেন তাঁদের রচনাকে আমরা সমগ্রভাবে দেখেই শ্রদ্ধা অনুভব
করি। তাকে টুকরো টুকরো ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছিদ্রসন্ধান বা ছিদ্রখনন করতে স্বভাবত প্রবৃত্তি
হয় না। জগতে আজ পর্যন্ত অতিবড়ো সাহিত্যিক এমন কেউ জন্মায় নি, অনুরাগবঞ্চিত পরুষ
চিত্ত নিয়ে যাঁর শ্রেষ্ঠ রচনাকেও বিদ্রূপ করা, তার কদর্থ করা, তার প্রতি অশোভন
মুখবিকৃতি করা, যে-কোনো মানুষ না পারে। প্রীতির প্রসন্নতাই সেই সহজ ভূমিকা, যার
উপরে কবির সৃষ্টি সমগ্র হয়ে সুপষ্ট হয়ে প্রকাশমান হয়।
মর্তলোকের শ্রেষ্ঠ দান এই প্রীতি আমি পেয়েছি এ কথা প্রণামের সঙ্গে বলি। পেয়েছি
পৃথিবীর অনেক বরণীয়দের হাত থেকে — তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতা নয়, আমার হৃদয় নিবেদন করে
দিয়ে গেলেম। তাঁদের দক্ষিণ হাতের স্পর্শে বিরাট মানবেরই স্পর্শ লেগেছে আমার ললাটে;
আমার যা-কিছু শ্রেষ্ঠ তা তাঁদের গ্রহনের যোগ্য হোক।
আর আমার স্বদেশের লোক যাঁরা অতিনিকটের অতিপরিচয়ের অস্পষ্টতা ভেদ করেও আমাকে
ভালোবাসতে পেরেছেন আজ এই অনুষ্টানে তাঁদেরই বহুযত্নরচিত অর্ঘ্য সজ্জিত। তাঁদের সেই
ভালোবাসা হৃদয়ের সঙ্গে গ্রহণ করি।