ভাষাংশ
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
বাল্মীকিপ্রতিভা
পঞ্চম দৃশ্য
বাল্মীকি। জীবনের কিছু হল না হায়—
হল না গো হল না, হায় হায়।
গহনে গহনে কত আর ভ্রমিব নিরাশার এ আঁধারে।
শূন্য হৃদয় আর বহিতে যে পারি না,
পারি না গো, পারি না আর।
কী লয়ে এখন ধরিব জীবন, দিবসরজনী চলিয়া যায়—
দিবসরজনী চলিয়া যায়—
কত কী করিব বলি কত উঠে বাসনা,
কী করিব জানি না গো।
সহচর ছিল যারা ত্যেজিয়া গেল তারা। ধনুর্বাণ ত্যেজেছি,
কোনো আর নাহি কাজ—
‘কী করি কী করি’ বলি হাহা করি ভ্রমি গো॥
কী করিব জানি না যে॥
ব্যাধগণের প্রবেশ
প্রথম
ব্যাধ। দেখ্ দেখ্, দুটো পাখি বসেছে গাছে।
দ্বিতীয়
ব্যাধ। আয় দেখি চুপিচুপি আয় রে কাছে।
প্রথম
ব্যাধ। আরে, ঝট্ করে এইবারে ছেড়ে দে রে বাণ।
দ্বিতীয়
ব্যাধ। রোস্, রোস্, আগে আমি করি রে সন্ধান।
বাল্মীকি। থাম্ থাম্, কী করিবি বধি পাখিটির প্রাণ।
দুটিতে রয়েছে সুখে, মনের উল্লাসে গাহিতেছে গান।
প্রথম
ব্যাধ। রাখো মিছে ও-সব কথা,
কাছে মোদের এস নাকো হেথা,
চাই নে-ও সব-শাস্তর-কথা— সময় বহে যায় যে।
বাল্মীকি। শোনো শোনো, মিছে রোষ কোরো না।
ব্যাধ। থামো থামো ঠাকুর— এই ছাড়ি বাণ॥
একটি ক্রৌঞ্চকে বধ
বাল্মীকি। মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্॥
----
কী বলিনু আমি! এ কী সুললিত বাণী রে!
কিছু না জানি কেমনে যে আমি প্রকাশিনু দেবভাষা,
এমন কথা কেমনে শিখিনু রে!
পুলকে পুরিল মনপ্রাণ, মধু বরষিল শ্রবণে,
এ কী! হৃদয়ে এ কী এ দেখি!—
ঘোর অন্ধকারমাঝে, এ কী জ্যোতি ভায়—
অবাক! করুণা এ কার॥
সরস্বতীর আবির্ভাব
বাল্মীকি। এ কী এ, এ কী এ, স্থির চপলা!
কিরণে কিরণে হল সব দিক উজলা।
কী প্রতিমা দেখি এ— জোছনা মাখিয়ে
কে রেখেছে আঁকিয়ে আ মরি কমলপুতলা॥
ব্যাধগণের প্রস্থান
বনদেবীগণের প্রবেশ
বনদেবী। নমি নমি, ভারতী, তব কমলচরণে।
পুণ্য হল বনভূমি, ধন্য হল প্রাণ।
বাল্মীকি। পূর্ণ হল বাসনা, দেবী কমলাসনা—
ধন্য হল দস্যুপতি, গলিল পাষাণ।
বনদেবী। কঠিন ধরাভূমি এ, কমলালয়া তুমি যে—
হৃদয়কমলে চরণকমল করো দান।
বাল্মীকি। তব কমলপরিমলে রাখো হৃদি ভরিয়ে—
চিরদিবস করিব তব চরণসুধাপান॥
দেবীগণের অন্তর্ধান
কালী-প্রতিমার প্রতি
শ্যামা, এবার ছেড়ে চলেছি মা!
পাষাণের মেয়ে পাষাণী, না বুঝে মা বলেছি মা!
এত দিন কী ছল করে তুই পাষাণ করে রেখেছিলি—
আজ আপন মায়ের দেখা পেয়ে নয়ন-জলে গলেছি মা!
কালো দেখে ভুলি নে আর, আলো দেখে ভুলেছে মন—
আমায় তুমি ছলেছিলে, এবার আমি তোমায় ছলেছি মা!
মায়ার মায়া কাটিয়ে এবার মায়ের কোলে চলেছি মা॥
ষষ্ঠ দৃশ্য
বাল্মীকি। কোথা লুকাইলে!
সব আশা নিভিল, দশ দিশি অন্ধকার।
সবে গেছে চলে ত্যেজিয়ে আমারে,
তুমিও কি তেয়াগিলে॥
লক্ষ্মীর আবির্ভাব
লক্ষ্মী। কেন গো আপনমনে ভ্রমিছ বনে বনে,
সলিল দু নয়নে কিসের দুখে!
কমলা দিতেছে আসি রতন রাশি রাশি,
ফুটুক তবে হাসি মলিন মুখে।
কমলা যারে চায় বলো সে কী পায়,
দুখের এ ধরায় থাকে সে সুখে।
ত্যেজিয়া কমলসনে এসেছি এ ঘোর বনে,
আমারে শুভক্ষণে হেরো গো চোখে॥
বাল্মীকি। কোথায় সে উষাময়ী প্রতিমা—
তুমি তো নহ সে দেবী কমলাসনা।
কোরো না আমারে ছলনা।
কী এনেছ ধন মান! তাহা যে চাহে না প্রাণ।
দেবী গো, চাহি না, চাহি না, মণিময় ধূলিরাশি চাহিনা—
তাহা লয়ে সুখী যারা হয় হোক, হয় হোক—
আমি, দেবী, সে সুখ চাহি না।
যাও লক্ষ্মী অলকায়, যাও লক্ষ্মী অমরায়,
এ বনে এসো না, এসো না—
এসো না এ দীনজনকুটিরে।
যে বীণা শুনেছি কানে মন প্রাণ আছে ভোর—
আর কিছু চাহি না, চাহি না॥
লক্ষ্মীর অন্তর্ধান
বাল্মীকির প্রস্থান
বনদেবীগণের প্রবেশ
বাণী বীণাপাণি, করুণাময়ী,
অন্ধজনে নয়ন দিয়ে অন্ধকারে ফেলিলে,
দরশ দিয়ে লুকালে কোথা দেবী অয়ি!
স্বপনসম মিলাবে যদি কেন গো দিলে চেতনা—
চকিতে শুধু দেখা দিয়ে চির মরমবেদনা!
তোমারে চাহি ফিরিছে হেরো কাননে কাননে ওই॥
বনদেবীগণের প্রস্থান
বাল্মীকির প্রবেশ
সরস্বতীর আবির্ভাব
বাল্মীকি। এই-যে হেরি গো দেবী আমারি!
সব কবিতাময় জগত-চরাচর, সব শোভাময় নেহারি।
ছন্দে উঠিছে চন্দ্রমা, ছন্দে কনকরবি উদিছে,
ছন্দে জগমণ্ডল চলিছে, জ্বলন্ত কবিতা তারকা সবে।
এ কবিতার মাঝারে তুমি কে গো দেবী,
আলোকে আলো আঁধারী।
আজি মলয় আকুল বনে বনে একি একি গীত গাহিছে;
ফুল কহিছে প্রাণের কাহিনী, নব রাগরাগিণী উছাসিছে।
এ আনন্দে আজ গীত গাহে মোর হৃদয় সব অবারি।
তুমিই কি দেবী ভারতী! কৃপাগুণে অন্ধ আঁখি ফুটালে,
উষা আনিলে প্রাণের আঁধারে,
প্রকৃতির রাগিণী শিখাইলে।
তুমি ধন্য গো! রব চিরকাল চরণ ধরি তোমারি॥
সরস্বতী। দীনহীন বালিকার সাজে এসেছিনু এ ঘোর বনমাঝে
গলাতে পাষাণ তোর মন—
কেন, বৎস, শোন্ তাহা শোন্!
আমি বীণাপাণি তোরে এসেছি শিখাতে গান,
তোর গানে গলে যাবে সহস্র পাষাণপ্রাণ।
যে রাগিণী শুনে তোর গলেছে কঠোর মন
সে রাগিণী তোরি কণ্ঠে বাজিবে রে অনুক্ষণ।
অধীর হইয়া সিন্ধু কাঁদিবে চরণতলে,
চারি দিকে দিকবধূ আকুল নয়নজলে।
মাথার উপরে তোর কাঁদিবে সহস্র তারা,
অশনি গলিয়া গিয়া হইবে অশ্রুর ধারা।
যে করুণ রসে আজি ডুবিল রে ও হৃদয়
শত স্রোতে তুই তাহা ঢালিবি জগৎময়।
যেথায় হিমাদ্রি আছে সেথা তোর নাম রবে,
যেথায় জাহ্নবী বহে তোর কাব্যস্রোত ববে।
সে জাহ্নবী বহিবেক অযুত হৃদয় দিয়া
শ্মশান পবিত্র করি, মরুভূমি উর্বারিয়া।
মোর পদ্মাসনতলে রহিবে আসন তোর,
নিত্য নব নব গীতে সতত রহিবি ভোর।
বসি তোর পদতলে কবি-বালকেরা যত
শুনি তোর কণ্ঠস্বর শিখিবে সঙ্গীত কত।
এই নে আমার বীণা, দিনু তোরে উপহার,
যে গান গাহিতে সাধ ধ্বনিবে ইহার তার।