ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
ইংরাজশাসন-বিদ্বেষী একদল লোক ক্রোধভরে বলেন— দেখ দেখি ইংরাজের
কি অন্যায় ! প্রাচীন ভারতবর্ষের বিদ্যাবুদ্ধি লইয়া তাহার সভ্যতা; ভারতবর্ষের বিষয়
পাইয়া সে ধনী; অথচ সেই ভারতবর্ষের প্রতি তাহার কি অন্যায় ব্যবহার ! আমার বক্তব্য এই
যে, তাহারা ত ঠিক উত্তরাধিকারীর মত কাজ করিতেছে। ভারতবর্ষের মুখাগ্নি করিতেছে,
ভারতবর্ষের শ্রাদ্ধ করিতেছে, আরও কি চাও ! ভূত ভারতবর্ষ যখন মাঝে মাঝে স্থানে
স্থানে উপদ্রব করিতেছিল, তখন বড় বড় কামান-গোলার পিণ্ডদান করিয়া তাহাকে একেবারে
শান্ত করিয়াছে। তাহা ছাড়া শাস্ত্রে বলে, নিজের সন্তানদের প্রতিপালন করিয়া লোকে
পিতৃঋণ হইতে মুক্ত হয়। চিত্রগুপ্তের ছোট-আদালত হইতে এ ঋণের জন্য ইংরাজের নামে বোধ
করি কোনো কালে ওয়ারেন্ট্ বাহির হইবে না। যে দেশে, যেখানে চরিবার প্রশস্ত মাঠ
পাইয়াছে Jane Cow (John Bull
এর স্ত্রীলিঙ্গ) সেইখানেই নিজের সন্তানগুলিকে
চরাইয়া ও পরের সন্তানগুলিকে গুঁতাইয়া বেড়াইতেছে। অতএব উত্তরাধিকারীর ও
পূর্ব্বপুরুষের কর্ত্তব্য-সাধনে তাহাদের কোন প্রকার শৈথিল্য লক্ষিত হইতেছে না। তবে
তোমার নালিশ কি লইয়া?
দ্রুত বুদ্ধি
অসাধারণ বুদ্ধিমান লোকদের অনেকের সহসা নির্ব্বোধ বলিয়া ভ্রম হইয়া থাকে। তাহার কারণ — বুঝিবার পদ্ধতিকে, বুঝিবার ক্রম-বিশিষ্ট সোপানগুলিকে অনেক বুঝা মনে করেন। এই উভয়কে তাঁহারা স্বতন্ত্র করিয়া দেখিতে পারেন না, একত্র করিয়া দেখেন। যাঁহাদের বুদ্ধি বিদ্যুতের মত, বজ্রবেগে যাঁহাদের মাথায় ভাব আসিয়া পড়ে, যাহাদের বুঝার সোপান দেখা যায় না,কঙ্কাল দেখা যায় না, ইঁট ও মালমস্লাগুলা দেখা যায় না, কেবল বুঝাটাই দেখা যায়, সাধারণ লোকেরা তাঁহাদের নির্বোধ মনে করে, কারণ তাহারা তাঁহাদের বুঝাকে বুঝিতে পারে না। যাদুকরেরা যাহা করে, তাহা যদি আস্তে আস্তে করে, তাহার প্রতি অঙ্গ যদি দেখাইয়া দেখাইয়া করে, তবে দর্শক বেচারীরা সমস্ত বুঝিতে পারে। নহিলে তাহাদের ভেবাচেকা লাগিয়া যায়, কিছুই আয়ত্ত করিতে পারে না ও সমস্ত ইন্দ্রজাল বলিয়া ঠাহরায়। অসাধারণ বুদ্ধির এক দোষ এই যে, সে বুঝিতে যেমন পারে বুঝাইতে তেমন পারে না। বুঝাইবে কিরূপে বল? নিজে সে একটা বিষয় এত ভাল জানে ও এত সহজে জানে যে, তাহাকেও আবার কি করিয়া সহজ করিতে হইবে ভাবিয়া পায় না। ইহারা আপনাকে অপেক্ষাকৃত নির্ব্বোধ না করিয়া ফেলিলে অন্যকে বুঝাইতে পারে না । ইহাদের বুদ্ধি একটা সিদ্ধান্তে উপস্থিত হইবামাত্র আবার তাহাকে সেখান হইতে বলপূর্বক বাহির করিয়া দিতে হয়; যে পথ দিয়া বিদ্যুৎবেগে সে সেই সিদ্ধান্তে উপস্থিত হইয়াছিল, সেই পথ দিয়া অতি ধীরে ধীরে এক পা এক পা করিয়া তাহাকে ফিরাইয়া লইয়া যাইতে হয়; সে ব্যক্তি অভ্যাসদোষে মাঝে মাঝে ছুটিয়া চলিতে চায়, অমনি তাহাকে পাক্ড়া করিয়া বলিতে হয় — "আস্তে" কেহ-বা ইচ্ছা করিলে এইরূপ নির্ব্বোধ হইতে পারে, কেহ বা পারে না। অনেকের বুদ্ধি কোনো মতেই রাশ মানে না, তাহাকে আস্তে চালাইবার সাধ্য নাই। এইরূপ লোকেদের নির্ব্বোধ লোকেরা নির্ব্বোধ মনে করে। যাহারা স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়-টানা নৌকায় যায়, তাহারা প্রতি ঝাঁকানিতে প্রতি দাঁড়ের শব্দে বুঝিতে পারে যে, নৌকা অগ্রসর হইতেছে। যাহারা পালের নৌকায় চলে,তাহারা সকল সময়ে বুঝিতে পারে না নৌকা চলিতেছে কি না।
সামাজিক লজ্জা বা অপরাধের লজ্জার কথা বলিতেছি না — আমি
যে লজ্জার কথা বলিতেছি, তাহাকে বিনয়ের লজ্জা বলা যায়। তাহাই যথার্থ লজ্জা, তাহাই
শ্রী। তাহার একটা স্বতন্ত্র নাম থাকিলেই ভাল হয় ।
সংবাদপত্রে দোকানদারেরা যেরূপে বড় বড়
অক্ষরে বিজ্ঞাপন দেয়, যে ব্যক্তি নিজেকে সমাজের চক্ষে
সেইরূপ বড় অক্ষরে বিজ্ঞাপন দেয়, সংসারের হাটে বিক্রেয়
পুতুলের মত সর্বাঙ্গে রঙ্চঙ্ মাখাইয়া দাঁড়াইয়া থাকে, "আমি"
বলিয়া দুটো অক্ষরের নামাবলী গায়ে দিয়া রাস্তার চৌমাথায় দাঁড়াইতে পারে,
সেই ব্যক্তি নির্লজ্জ। সে ব্যক্তি তাহার ক্ষুদ্র পেখমটি প্রাণপণে ছড়াইতে
থাকে, যাহাতে করিয়া জগতের আর সমস্ত দ্রব্য তাহার পেখমের আড়ালে পড়িয়া যায় ও দায়ে
পড়িয়া লোকের চক্ষু তাহার উপরে পড়ে। সে চায় — তাহার পেখমের ছায়ায় চন্দ্রগ্রহণ হয়,
সূর্যগ্রহণ হয়, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে গ্রহণ লাগে। যে লোক গায়ে কাপড় দেয় না
তাহাকে সকলে নির্লজ্জ বলিয়া থাকে, কিন্তু যে ব্যক্তি গায়ে অত্যন্ত কাপড় দেয় তাহাকে
কেন সকলে নির্লজ্জ বলে না ? যে ব্যক্তি রঙ্চঙে কাপড় পরিয়া হীরা জহরতের ভার বহন
করিয়া বেড়ায়, তাহাকে লোকে অহঙ্কারী বলে। কিন্তু তাহার মত
দীনহীনের আবার অহঙ্কার কিসের? যত লোকের চক্ষে সে পড়িতেছে তত লোকের কাছেই সে
ভিক্ষুক। সে সকলের কাছে মিনতি করিয়া বলিতেছে,"ওগো,এই দিকে! এই দিকে ! আমার দিকে
একবার চাহিয়া দেখ"। তাহার রঙ্চঙে কাপড় গলবস্ত্রের চাদরের অপেক্ষা অধিক অহঙ্কারের
সামগ্রী নহে।
আমাদের শাস্ত্রে যে বলিয়া থাকে "লজ্জাই স্ত্রীলোকের ভূষণ" সে কি
ভাসুরের সাক্ষাতে ঘোমটা দেওয়া, না, শ্বশুরের সাক্ষাতে বোবা হওয়া? "লজ্জাই
স্ত্রীলোকের ভূষণ" বলিলে বুঝায়,অধিক ভূষণ না পরাই স্ত্রীলোকের ভূষণ। অর্থাৎ
লজ্জাভূষণ গায়ে পড়িলে শরীরে অন্য ভূষণের স্থান থাকে না। দুঃখের বিষয় এই যে,
সাধারণতঃ স্ত্রীলোকের অন্য সকল ভূষণই আছে, কেবল লজ্জাভূষণটাই কম। রঙচঙ করিয়া নিজেকে
বিক্রেয় পুত্তলিকার মতো সাজাইয়া তুলিবার প্রবৃত্তি তাহাদের অত্যন্ত অধিক। লজ্জার
ভূষণ পরিতে চাও তো রঙ মোছ, শুভ্র বস্ত্র পরিধান কর, ময়ূরের মত পেখম তুলিয়া বেড়াইও
না। উষা কিছু অন্তঃপুরবাসিনী মেয়ে নয়, তাহার প্রকাশে জগৎ প্রকাশ হয়। কিন্তু সে এমনি
একটি লজ্জার বস্ত্র পরিয়া, নিরলঙ্কার শুভ্র বসন পরিয়া, জগতের সমক্ষে প্রকাশ পায় ও
তাহাতে করিয়া তাহার মুখে এমনি একটি পবিত্র বিমল প্রশান্ত শ্রী প্রকাশ পাইতে থাকে
যে, বিলাস-আবেশ-ময় প্রমোদ-উচ্ছাস উষার ভাবের সহিত কোনো মতে মিশ খায় না — মনের মধ্যে
একটা সম্ভ্রমের ভাব উদয় হয়। স্ত্রীলোকের পক্ষে লজ্জা কেবল মাত্র ভূষণ নহে, ইহা
তাহাদের বর্ম ।
দশের চোখের উপরে যে দিনরাত্রি বাস করিতে চাহে, পরের চোখের উপরেই
যাহার বাড়ি ঘর, তাহার আর নিজের ঘর বাড়ি নাই। সেই জন্যই সে রঙচঙ দিয়া পরের চোখ
কিনিতে চায়, সেখান হইতে ভ্রষ্ট হইলেই সে ব্যক্তি একেবারে নিরাশ্রয় হইয়া পড়ে। ইহারা
বাসাড়ে লোক, খামখেয়ালী ঘরওয়ালা উচ্ছেদ করিয়া দিলে ইহাদের আর দাঁড়াইবার জায়গা থাকে
না। কিন্তু ভাবুক লোকদিগের নিজের একটা ঘরবাড়ি আছে, পরের চোখ হইতে বিদায় হইয়া তাহার
সেই নিজের ঘরের মধ্যে আসিলেই সে যেন বাঁচে। ভাবুক লোকেরা যথার্থ গৃহস্থ লোক। আর
যাহারা নিজের মনের মধ্যে আশ্রয় পায় না, তাহারা কাজেই পরের চক্ষু অবলম্বন করিয়া থাকে
ও রঙচঙ মাখিয়া পরের চক্ষুর খোশামোদ করিতে থাকে। ভাবুকদিগের নিজের মনের মধ্যে কি অটল
আশ্রয় আছে ! এই জন্যই দেখা যায়, ভাবুক লোকেরা বাহিরের লোকজনের সহিত বড় একটা মিশিতে
পারেন না, কণ্ঠাগ্র ভদ্রতার আইন কানুনের সহিত কোন সম্পর্ক রাখেন না। যেখানে চল্লিশ
জন অলস ভাবে হাসিতেছে সেখানে তিনি একচল্লিশ হইয়া তাহাদের সহিত একত্রে দন্ত বিকাশ
করিতে পারেন না। দশ ব্যক্তির মধ্যে একাদশ হইবার ঐকান্তিক বাসনা তাঁহার নাই ।
নিরহঙ্কার আত্মম্ভরিতা
কেনই বা থাকিবে? তিনি নিজের কাছে নিজে সর্ব্বদাই সম্ভ্রমে নত
হইয়া থাকেন। তাঁহার নিজের সহচর নিজেই। অত বড় সহচর দশের মধ্যে কোথায় মিলিবে !
প্রতিভা যখন মুহূর্ত্ত কালের জন্য অতিথি হইয়া এক জন কবিকে বীণা করিয়া তাঁহার
তন্ত্রী হইতে সুর বাহির করিতে থাকে তখন তিনি নিজের সুর শুনিয়া নিজে মুগ্ধ হইয়া
পড়েন। বাল্মীকি তাঁহার নিজের রচিত রামকে যেমন ভক্তি করিতেন এমন কোন ভক্ত করেন না
এবং যতক্ষণ তিনি রামের চরিত্র সৃজন করিতেছিলেন ততক্ষণ তিনি নিজেই রাম হইয়াছিলেন ও
তাঁহার নিজের মহান্ ভাবে নিজেই মোহিত হইয়া গিয়াছিলেন। এইরূপে যাঁহারা নিজেকে নিজেই
ভক্তি করিতে পারেন, নিজের সাহচর্য্যে নিজে সুখ ভোগ করিতে পারেন, তাঁহাদিগকে আর দশ
জনের হস্তে আত্মসমর্পণ করিতে হয় না। এক কথায় — যাঁহারা একলা থাকেন তাঁহারা আর পরের
সহিত মিশিবার অবসর পান না। ইহাকেই বলে অহঙ্কাররবিবর্জ্জিত আত্মম্ভরিতা।