ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


বিবিধ প্রসঙ্গ
 


অসংখ্য জগৎ
 

    উপরের কথাটাকে আরো একটু বিস্তৃত করা যাক। একজন লোক মরিয়া গেল, আমরা সাধারণতঃ মনে করি সেই গেল, তাহার সহিত আর কিছু গেল না। এরূপ ভ্রমে পড়িবার প্রধান কারণ এই যে, আমরা সচরাচর মনে করি যে, সেও যে জগতে আছে আমরাও সেই জগতে আছি, সেও যাহা দেখিতেছে আমরাও তাহাই দেখিতেছি। কিন্তু সেই অনুমানটাই ভ্রম নাকি, এই নিমিত্ত সমস্ত যুক্তিতে ভ্রম পৌঁছিয়াছে । সে যাহা দেখিতেছে আমরা তাহা দেখিতেছি না, সে যেখানে আছে আমরা সেখানে নাই। সে দেখিতেছে, ভাগীরথী পতিমিলনাশয়ে চঞ্চলা যুবতীর ন্যায় নৃত্য করিতেছে, গান গাহিতেছে; আমি দেখিতেছি ভাগীরথী স্নেহময়ী মাতার ন্যায় তটভূমিকে স্তন্যপান করাইতেছেন, তরঙ্গহস্তে অনবরত তাহার ললাটে অভিঘাত করিয়া কলকণ্ঠে বৈচিত্র্যহীন ঘুম পাড়াইবার গান গাহিতেছেন। উভয় জগতের উভয় জাহ্নবীর মধ্যে এত প্রভেদ। এই প্রকার , যত লোক আছে সকল লোকেরই জগৎ স্বতন্ত্র। লোক অর্থে, মনুষ্য বিশেষ এবং লোক অর্থে জগৎ বুঝায় । অর্থাৎ একজন মনুষ্য বলিলে একটি জগৎ বলা হয়। আমি কে ? না, আমি যাহা কিছু দেখিতেছি — চন্দ্র সূর্য্য পৃথিবী ইত্যাদি — সমস্ত লইয়া একজন। তুমিও তাহাই। অতএব প্রতি লোকের সঙ্গে সঙ্গে শত শত চন্দ্র সূর্য্য জন্মগ্রহণ করে ও শত শত চন্দ্র সূর্য মরিয়া যায়। অতএব দেখ, জগৎ যেমন অসংখ্য তেমনি বিচিত্র। কাহারো জগতে সূর্য্যোদয় আছে, আঁধারের অপগমন ও আলোকের আগমন আছে, কিন্তু প্রভাত নাই। সে ব্যক্তি সূর্য্যোদয়-রূপ একটা ঘটনা দেখিতে পায় বটে, কিন্তু প্রভাত দেখিতে পায় না। প্রভাত-শিশির, প্রভাত-সমীরণ, প্রভাত-মেঘমালা, প্রভাত-অরুণরাগের সামঞ্জস্য দেখিতে পায় না; সুতরাং তাহার জগতে প্রভাত ব্যতীত প্রভাতের আর সমস্তই আছে। কাহারো বা প্রভাত আছে, সন্ধ্যা নাই। বসন্ত আছে, শরৎ নাই । কাহারো জ্যোৎস্না হাসে, কাহারো জ্যোৎস্না কাঁদে । কাহারো জগতে টাকার ঝম্‌ঝম্‌ ব্যতীত সঙ্গীত নাই, মলের ঝম্‌ঝম্‌ ব্যতীত কবিতা নাই, উদরের বাহিরে সুখ নাই, ইন্দ্রিয়ের বাহিরে অস্তিত্ব নাই । এমন কত কহিব ! এ সকল ত স্পষ্ট প্রভেদ; সূক্ষ্ম প্রভেদ কত আছে, তাহার নাম কে করিবে?


জগতের জমিদারি
 

    তুমি জমি কিনিতেই ব্যস্ত, জগতের জমিদারী বাড়াইতে মন দাও না কেন? তুমি তো মস্ত ধনী, তোমার অপেক্ষা একজন কবি ধনী কেন? তোমার জগতের অপেক্ষা তাঁহার জগৎ বৃহৎ। অত বড় জমি কাহার আছে? তিনি যে চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ নক্ষত্র দখল করিয়া বসিয়া আছেন। তোমার জগতের মানচিত্রে উত্তরে আফিসের দেয়াল, দক্ষিণে আফিসের দেয়াল, পূর্ব্বেও তাহাই, পশ্চিমেও তাহাই। কবিদিগের কাছে, জ্ঞানীদিগের কাছে বিষয়কর্ম শেখ। তোমার জগৎ-জমিদারীর সীমা বাড়াইতে আরম্ভ কর। আফিসের দেয়াল অতিক্রম করিয়া দিগন্ত পর্য্যন্ত লইয়া যাও, দিগন্ত অতিক্রম করিয়া সমস্ত পৃথিবী পর্য্যন্ত বেষ্টন কর, পৃথিবী অতিক্রম করিয়া জ্যোতিষ্কমণ্ডলে যাও এবং সমস্ত জগৎ অতিক্রম করিয়া অসীমের দিকে সীমা অগ্রসর করিতে থাক। আমি ত দেখিতেছি তোমার যতই জমি বাড়িতেছে ততই জগৎ কমিতেছে। এ যেন ভয়ানক লোকসানের লাভ!
    অল্প দিন হইল আমার এক বন্ধু গল্প করিতেছিলেন, যে, তিনি স্বপ্ন দেখিয়াছেন —জগৎ নিলাম হইতেছে, চন্দ্র সূর্য্য বিকাইয়া যাইতেছে। বোধ করি যেন এমন নিলাম হইয়া থাকে। ভাবুকগণ বুঝি পূর্ব্বজন্মে চড়া দামে চন্দ্র সূর্য্য তারা বসন্ত মেঘ বাতাস কিনিয়াছিলেন, আর আমরা একটা স্থূল- উদর স্থূলদৃষ্টি ও স্থূলবুদ্ধি লইয়া নিজের ভারে এমনি অবনত হইয়া পড়িয়াছি, যে, ইহার উপরে এই সাড়ে তিন হস্তের বহির্ভূত আর কিছু চাপাইবার ক্ষমতা নাই। নিজের বোঝা যতই ভারী বোধ হইতেছে ততই আপনাকে ধনী মনে করিতেছি। ইহা দেখিতেছি না কত লোক জগতের বোঝা অবলীলাক্রমে বহন করিতেছেন।


প্রকৃতি পুরুষ
 

    জগৎসৃষ্টির যে নিয়ম, আমাদের ভাবসৃষ্টিরও সেই নিয়ম। মনোযোগ করিয়া দেখিলে দেখা যায় আমাদের মাথার মধ্যে প্রকৃতি পুরুষ দুই জনে বাস করেন। এক জন ভাবের বীজ নিক্ষেপ করেন, আর এক জন তাহাই বহন করিয়া, পালন করিয়া, পোষণ করিয়া তাহাকে গঠিত করিয়া তুলেন। এক জন সহসা একটা সুর গাহিয়া উঠিন, আর এক জন সেই সুরটিকে গ্রহণ করিয়া, সেই সুরকে গ্রাম করিয়া, সেই সুরের ঠাটে তাঁহার রাগিণী বাঁধিতে থাকেন। এক জন সহসা একটি স্ফুলিঙ্গ মাত্র নিক্ষেপ করেন, আর এক জন সেই স্ফুলিঙ্গটিকে লইয়া ইন্ধনের মধ্যে নিবিষ্ট করিয়া তাহাতে ফুঁ দিয়া তাহাকে আগুন করিয়া তোলেন।
    এমন অনেক সময় হয়, যখন আমাদের হৃদয়ে একটি ভাবের আদিম অস্ফুট মূর্তি দেখা দেয়, মুহুর্তের মধ্যেই তাহাকে হয়ত বিসর্জন দিয়াছি, তাহাকে হয়ত বিস্মৃত হইয়াছি, আমাদের চেতনার রাজ্য হইতে হয়ত সে একেবারে নির্বাসিত হইয়া গিয়াছে — অবশেষে বহুদিন পরে এক দিন সহসা সেই বিস্মৃতি পরিত্যক্ত অস্ফুট ভাব, পূর্ণ আকার ধারণ করিয়া, সর্ব্বাঙ্গসুন্দর হইয়া আমাদের চিত্তে বিকশিত হইয়া উঠে। সেই উপেক্ষিত ভাবকে এত দিন আমাদের ভাবরাজ্যের প্রকৃতি যত্নের সহিত বহন করিতেছিলেন, পোষণ করিতেছিলেন, বুকে তুলিয়া লইয়া স্তন দান করিতেছিলেন, অথচ আমরা তাহাকে দেখিতেও পাই নাই, জানিতেও পারি নাই। তেমনি আবার এমন অনেক সময় হয় যখন আমাদের মনে হয় একটি ভাববিশেষ এই মাত্র বুঝি আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হইল, আমাদের হৃদয়রাজ্যে এই বুঝি তার প্রথম পদার্পণ, কিন্তু আসলে হয়ত আমরা ভুলিয়া গেছি, কিংবা হয়ত জানিতেও পারি নাই, কখন্ সেই ভাবের প্রথম অদৃশ্য বীজ আমাদের হৃদয়ে রোপিত হয় —কিছু কাল পরিপুষ্ট হইলে তবে আমরা তাহাকে দেখিতে পাইলাম। ভাবিয়া দেখিতে গেলে, আমরা জগৎ হইতে আরম্ভ করিয়া আমাদের নিজ-হৃদয়ের ক্ষুদ্রতম বৃত্তিটি পর্য্যন্ত, কোন পদার্থের আদি মুহুর্ত্ত জানিতে পারি না, আমাদের নিজের ভাবের আরম্ভও আমরা জানিতে পারি না — আমাদের চক্ষে যখন কোনো পদার্থের আরম্ভ প্রতিভাত হইল তাহার পূর্ব্বেও তাহার আরম্ভ হইয়াছিল। এই জন্যই বুঝি আমাদের মর্ত্ত্য- হৃদয়ের স্বভাব আলোচনা করিয়া আমাদের পুরাতন ঋষিগণ সন্দেহ-আকুল হইয়া সৃষ্টি সম্বন্ধে এইরূপ বলিয়াছিলেন —
    "অথ কো বেদ যত আবভূব । ইয়ং বিসৃষ্টিরযত আবভূব যদি বা দধে বা ন। যো অস্যাধ্যক্ষঃ পরমে ব্যোমন্‌ স অঙ্গ বেদ যদি বা ন বেদ ।"
    কে জানে কি হইতে হইল। এই সৃষ্টি কোথা হইতে হইল, কেহ ইহা সৃষ্টি করিয়াছে কি, করে নাই। যিনি ইহার অধ্যক্ষ পরম ব্যোমে আছেন তিনি ইহা জানেন, অথবা জানেন না !
    ঋষিদের সন্দেহ হইতেছে যে, যিনি ইহার সৃষ্টি করিয়াছেন তিনিও হয়ত জানেন না কোথায় এই সৃষ্টির আরম্ভ। কেননা, ক্ষুদ্র সৃষ্টিকর্তা মানবেরাও জানে না তাহাদের নিজের ভাবের আরম্ভ কোথায়, আদি কারণ কি।
    এইরূপে সংসারের কোলাহলের মধ্যে, কাজকর্মের মধ্যে, কত শত ভাব আমরা অদৃশ্য অলক্ষিত ভাবে নিঃশব্দে বহন করিয়া পোষণ করিয়া বেড়াইতেছি, আমরা তাহার অস্তিত্বও জানি না। হয়ত এই মুহুর্ত্তেই আমার হৃদয়ে এমন একটি ভাবের বীজ নিক্ষিপ্ত হইল যাহা অঙ্কুরিত বর্দ্ধিত পরিপুষ্ট হইয়া নদীতীরস্থ দৃঢ়বদ্ধমূল বৃক্ষের ন্যায় নিজের অবস্থানভূমিকে প্রখর কালস্রোতের হস্ত হইতে বহু সহস্র বৎসর রক্ষা করিবে, যাহা তাহার ঘনপল্লব শাখার অমরচ্ছায়ায় আমরা নামকে বহু সহস্র বৎসর জীবিত রাখিবে, অথচ আমি তাহার জন্মদিন লিখিয়া রাখিলাম না, তাহার জন্মমুহুর্ত্ত জানিতেও পারিলাম না, তাহার জন্মকালে শঙ্খও বাজিল না, হুলুধ্বনিও উঠিল না। আমরা যখন আহার করি তখন আমরা জানিতে পারি না, আমাদের সেই খাদ্যগুলি জীর্ণ হইয়া রক্তরূপে কত শত শিরা উপশিরায় প্রবাহিত হইতেছে। তেমনি একজন ভাবুক যখন তাঁহার শত শত ভাব মস্তকে বহন করিয়া বিহঙ্গকূজিত ফুল্লপুষ্প শ্যামশ্রী বনের মধ্যে সূর্য্যালোকে বিচরণ করিতেছেন ও স্বভাবের শোভা উপভোগ করিতেছেন, তখন তাঁহার ভাবরাজ্যের প্রকৃতিমাতা সেই সূর্যালোকে সেই বনের শোভাকে রক্তরূপে পরিণত করিয়া অলক্ষিতভাবে তাঁহার শত সহস্র ভাবের শিরা উপশিরার মধ্যে প্রবাহিত করাইয়া তাহাদিগকে পুষ্ট করিয়া তুলিতেছেন, তাহা তিনি জানিতেও পারেন না। যখন আমি একজন প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিকে দেখি তখন আমি ভাবি যে, হয়ত ইনি এই মুহুর্ত্তে ভবিষ্যৎ শতাব্দীকে মন্তকে পোষণ করিয়া বেড়াইতেছেন অথচ তিনি নিজেও তাহা জানেন না।