ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
আত্মীয়ের বেড়া
একলা একজন মাত্র লোক কিছুই নহে। সে ব্যক্তিই নহে! সে, সাধারণ
মনুষ্য সমাজের সম্পত্তি। শ্যামের সঙ্গেও তাহার যে সম্পর্ক, রামের সঙ্গেও তাহার সেই
সম্পর্ক। সে সরকারী। সে অমিশ্র জলজনন বাষ্পের মত। যতক্ষণ জলজনন বাষ্প অমিশ্র ভাবে
থাকে, ততক্ষণ বায়ুর সঙ্গেও তাহার যে সম্পর্ক, জলের সঙ্গেও তাহার সেই সম্পর্ক।
অবশেষে আর গুটি দুই তিন বাষ্প আসিয়া যখন তাহার সঙ্গে মেলে, তখন আমরা স্থির করিয়া
বলিতে পারি সে জল কি বায়ু। তেমনি একক আমার সহিত যখন আর গুটি দুই তিন ব্যক্তি আসিয়া
জমা হয়, তখন আমি ব্যক্তি-বিশেষ হইয়া দাঁড়াই। আমার বন্ধু বান্ধব আত্মীয়গণ আমার সীমা।
সাধারণ মনুষ্যদের হইতে আমাকে পৃথক্ করিয়া রাখা, আমাকে ব্যক্তিবিশেষ করিয়া রাখাই
তাঁহাদের কাজ। অতএব দেখা যাইতেছে আমাদের চারি দিকে কতকগুলি বিশেষ পরের আবশ্যক,
সাধারণ পর হইতে তাহারা আমাদিগকে পর করিয়া রাখে। কতকগুলি পরকে আপনার করিতে না পারিলে
আমি "আপনি" হইতে পারি না; "পর" দিয়া "আপনি" কে গড়িয়া তুলিতে হয়। নহিলে আমি মানুষ
হই, ব্যক্তি হই না। আত্মীয় বন্ধু বান্ধব -নামক কতকগুলি পর আছেন, তাঁহারা পরকে পর
করেন, আপনাকে আপনি রাখেন। আমাদের কেহই যদি আত্মীয় না থাকিত, তাহা হইলে আমাদের পরই
বা কে থাকিত? তাহা হইলে সকলেরই সঙ্গে আমার সমান সম্পর্ক থাকিত। রেখাব- নামক একটি
সুর যতক্ষণ স্বতন্ত্র থাকে ততক্ষণ সে বেহাগেরও যেমন সম্পত্তি কানেড়ারও তেমনি
সম্পত্তি ও অমন শত সহস্র রাগিণীর সঙ্গে তাহার সমান যোগ। কিন্তু যেই তার
চতুষ্পার্শ্বে আর কতকগুলি সুর আসিয়া একত্র হয় তখনি সে বিশেষ রাগিণী হইয়া দাঁড়ায় ও
অবশিষ্ট সমুদায় রাগিনীকে পর বলিয়া গণ্য করে। তেমনি আমরা যে সকলে রেখাব গান্ধার
প্রভৃতি একেকটি সুর না হইয়া বেহাগ ভৈরবী প্রভৃতি একেকটি রাগিণী হইয়াছি, তাহা কেবল
আমাদের আত্মীয় বন্ধু বান্ধবের প্রসাদে। আমরা যে একলা থাকিতে পাই, বিরলে থাকিতে
পারি, তাহার কারণ আমাদের বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়গণ আমাদিগকে চারি দিকে ঘেরিয়া
রাখিয়াছেন বলিয়া। নতুবা আমরা মুক্ত জগতে লক্ষ লোকের মধ্যে গিয়া পড়িতাম, শতসহস্রের
কোলাহলের মধ্যে আমাদিগকে বাস করিতে হইত। অতএব কতকগুলি লোক ঘনিষ্ঠ ভাবে আমাদের
কাছাকাছি না থাকিলে আমরা একলা থাকিতে পাই না, বিরলে থাকিতে পারি না। আকারহীন,
ভাষাহীন, অন্তঃপুরহীন, কুহেলিকাময় কতকগুলা অপরিস্ফুট ভাবের দল আমাদের মনের মধ্যে
যেমন ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া আনাগোনা করে, পরস্পরের কোলাহলে পরস্পরে মিশাইয়া থাকে, সমাজের
মধ্যে আমরা তেমনি থাকি। অবশেষে সে ভাবগুলিকে যখন বিযুক্ত করিয়া লইয়া তাহাদিগকে আকার
দিয়া, ভাষাবদ্ধ করিয়া, তাহাদের জন্য এক একটা স্বতন্ত্র অন্তঃপুর স্থাপন করিয়া দিই,
তখন তাহারা যেমন বিরলে থাকে, একক হইয়া যায়, আমরাও সংসারী হইয়া তেমনি হই।
বেশী দেখা ও কম দেখা
সাধারণের কাছে প্রেমের অন্ধ বলিয়া
একটা বদ্নাম আছে। কিন্তু অনুরাগ অন্ধ না বিরাগ অন্ধ? প্রেমের চক্ষে দেখার অর্থই
সর্বাপেক্ষা অধিক করিয়া দেখা। তবে কি বলিতে চাও, যে সর্ব্বাপেক্ষা
অধিক দেখে সে কিছুই দেখিতে পায় না? যে প্রতি কটাক্ষ দেখে, প্রতি ইঙ্গিত দেখে, প্রতি
কথা শোনে, প্রতি নীরবতা শোনে, সে মানুষ চিনিতে পারে না? যে ভাবুক কবিতা ভালবাসে সে
কবিতা বুঝিতে পারে না? যে কবি প্রকৃতিকে প্রেমের চক্ষে দেখে সে প্রকৃতিকে দেখিতে
পায় না? বিজ্ঞানবিৎ কি কেবল দূরবীক্ষণ ও অণুবীক্ষণের সাহায্যেই বিজ্ঞানের সত্য
আবিষ্কার করেন, তাঁহার কাছে যে অনুরাগবীক্ষণ আছে তাহা কি কেহ হিসাবের মধ্যে আনিবেন
না? তুমি বলিবে প্রেম যদি অন্ধ না হইবে তবে কেন সে দোষ দেখিতে পায় না? দোষ দেখিতে
পায় না যে তাহা নহে। দোষকে দোষ বলিয়া মনে করে না। তাহার কারণ সে এত অধিক দেখে যে
দোষের চারি দিক দেখিতে পায়, দোষের ইতিহাস পড়িতে পারে। একটা দোষবিশেষকে
মনুষ্যপ্রকৃতি হইতে পৃথক্ করিয়া লইয়া দেখিলে তাহাকে যতটা কালো দেখায়, তাহার
স্বস্থানে রাখিয়া তাহার আদ্যন্তমধ্য দেখিলে তাহাকে ততটা কালো দেখায় না। আমরা যাহাকে
ভালোবাসি না তাহার দোষটুকুই দেখি, আর কিছু দেখি না। দেখি না যে মনুষ্যপ্রকৃতিতে সে
দোষ সম্ভব, অবস্থাবিশেষে সে দোষ অবশ্যম্ভাবী ও সে দোষ সত্ত্বেও তাহার অন্যান্য এমন
গুণ আছে যাহাতে তাহাকে ভালোবাসা যায়।
অতএব দেখা যাইতেছে, বিরাগে আমরা যতটুকু দেখিতে পাই অনুরাগে
তাহার অপেক্ষা অনেক অধিক দেখি। অনুরাগে আমরা দোষ দেখি, আবার সেই সঙ্গে তাহা
মার্জ্জনা করিবার কারণ দেখিতে পাই। বিরাগে কেবল দোষ মাত্রই দেখি। তাহার কারণ
বিরাগের দৃষ্টি অসম্পূর্ণ, তাহার একটা মাত্র চক্ষু। আমাদের উচিত, ভালোবাসার পাত্রের
দোষ গুণ আমরা যে নজরে দেখি, অন্যদের দোষ গুণও সেই নজরে দেখি। কারণ, ভালোবাসার
পাত্রদেরই আমরা যথার্থ বুঝি। যাঁহাদের ভালোবাসা প্রশস্ত, হৃদয় উদার, বসুধৈব
কুটুম্বকং, তাঁহারা সকলকেই মার্জ্জনা করিতে পারেন। তাহার কারণ, তাঁহারাই যথার্থ
মানুষদের বুঝেন, কাহাকেও ভুল বুঝেন না। তাঁহাদের প্রেমের চক্ষু বিকশিত, এবং প্রেমের
চক্ষুতে কখনো নিমেষ পড়ে না। তাঁহারা মানুষকে মানুষ বলিয়া জানেন। শিশুর পদস্খলন হইলে
তাহাকে যেমন কোলে করিয়া উঠাইয়া লন, আত্মসংযমনে অক্ষম একটি দুর্ব্বল হৃদয় ভুপতিত
হইলে তাহাকেও তেমনি তাঁহাদের বলিষ্ঠ বাহুর সাহায্যে উঠাইতে চেষ্টা করেন। দুর্বলতাকে
তাঁহারা দয়া করেন, ঘৃণা করেন না।
বসন্ত ও বর্ষা
এক বিরহিণী আমাদের জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইয়াছেন— বিরহের পক্ষে
বসন্ত গুরুতর কি বর্ষা গুরুতর? এ বিষয়ে তিনি অবশ্য আমাদের অপেক্ষা ঢের ভাল বুঝেন।
তবে উভয় ঋতুর অবস্থা আলোচনা করিয়া যুক্তির সাহায্যে আমরা একটা সিদ্ধান্ত খাড়া করিয়া
লইয়াছি । মহাকবি কালিদাস দেশান্তরিত যক্ষকে বর্ষাকালেই বিরহে ফেলিয়াছেন। মেঘকে দূত
করিবেন বলিয়াই যে এমন কাজ করিয়াছেন, তাহা বোধ হয় না। বসন্তকালেও দূতের অভাব নাই।
বাতাসকেও দূত করিতে পারিতেন। একটা বিশেষ কারণ থাকাই সম্ভব।
বসন্ত উদাসীন, গৃহত্যাগী। বর্ষা সংসারী, গৃহী। বসন্ত আমাদের
মনকে চারিদিকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয়, বর্ষা তাহাকে এক স্থানে ঘনীভূত করিয়া রাখে।
বসন্তে আমাদের মন অন্তঃপুর হইতে বাহির হইয়া যায়, বাতাসের উপর ভাসিতে থাকে, ফুলের
গন্ধে মাতাল হইয়া জ্যোৎস্নার মধ্যে ঘুমাইয়া পড়ে; আমাদের মন বাতাসের মত, ফুলের
গন্ধের মত, জ্যোৎস্নার মত, লঘু হইয়া চারি দিকে ছড়াইয়া পড়ে। বসন্তে বহির্জগৎ
গৃহদ্বার উদ্ঘাটন করিয়া আমাদের মনকে নিমন্ত্রণ করিয়া লইয়া যায়। বর্ষায় আমাদের মনের
চারি দিকে বৃষ্টিজলের যবনিকা টানিয়া দেয়, মাথার উপরে মেঘের চাঁদোয়া খাটাইয়া দেয়। মন
চারি দিক হইতে ফিরিয়া আসিয়া এই যবনিকার মধ্যে এই চাঁদোয়ার তলে একত্র হয়। পাখির গানে
আমাদের মন উড়াইয়া লইয়া যায়, কিন্তু বর্ষার বজ্রসঙ্গীতে আমাদের মনকে মনের মধ্যে
স্তম্ভিত করিয়া রাখে। পাখির গানের মত এ গান লঘু, তরঙ্গময়, বৈচিত্র্যময় নহে; ইহাতে
স্তব্ধ করিয়া দেয়, উচ্ছ্বসিত করিয়া তুলে না। অতএব দেখা যাইতেছে, বর্ষাকালে আমাদের
"আমি" গাঢ়তর হয়, আর বসন্তকালে সে ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে।
এখন দেখা যাক, বসন্তকালের বিরহ ও বর্ষাকালের বিরহে প্রভেদ কি।
বসন্তকালে আমরা বহির্জগৎ উপভোগ করি; উপভোগের সমস্ত উপাদান আছে, কেবল একটি পাইতেছি
না; উপভোগের একটা মহা অসম্পূর্ণতা দেখিতেছি। সেই জন্যই আর কিছুই ভাল লাগিতেছে না।
এত দিন আমার সুখ ঘুমাইয়াছিল, আমার প্রিয়তম ছিল না; আমার আর কোন সুখের উপকরণও ছিল
না। কিন্তু জ্যোৎস্না, বাতাস ও সুগন্ধে মিলিয়া ষড়যন্ত্র করিয়া আমার সুখকে জাগাইয়া
তুলিল; সে জাগিয়া দেখিল তাহার দারুণ অভাব বিদ্যমান। সে কাঁদিতে লাগিল। এই রোদনই
বসন্তের বিরহ। দুর্ভিক্ষের সময় শিশু মরিয়া গেলেও মায়ের মন অনেকটা শান্তি পায়,
কিন্তু সে বাঁচিয়া থাকিয়া ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদিতে থাকিলে তাঁহার কি কষ্ট!
বর্ষাকালে বিরহিণীর সমস্ত "আমি" একত্র হয়, সমস্ত "আমি" জাগিয়া
উঠে; দেখে যে বিচ্ছিন্ন "আমি", একক "আমি" অসম্পূর্ণ। সে কাঁদিতে থাকে। সে তাহার
নিজের অসম্পূর্ণতা পূর্ণ করিবার জন্য কাহাকেও খুঁজিয়া পায় না। চারি দিকে বৃষ্টি
পড়িতেছে, অন্ধকার করিয়াছে; কাহাকেও পাইবার নাই, কিছুই দেখিবার নাই; কেবল বসিয়া
বসিয়া অন্তর্দেশের অন্ধকারবাসী একটি অসম্পূর্ণ, সঙ্গীহীন "আমি"র পানে চাহিয়া
কাঁদিতে থাকে। ইহাই বর্ষাকালের বিরহ। বসন্তকালে বিরহিণীর জগৎ অসম্পূর্ণ, বর্ষাকালে
বিরহিণীর "স্বয়ং" অসম্পূর্ণ। বর্ষাকালে আমি আত্মা চাই, বসন্তকাল আমি সুখ চাই।
সুতরাং বর্ষাকালের বিরহ গুরুতর। এ বিরহে যৌবন মদন প্রভৃতি কিছু নাই, ইহা বস্তুগত
নহে। মদনের শর বসন্তের ফুল দিয়া গঠিত, বর্ষার বৃষ্টিধারা দিয়া নহে। বসন্তকালে আমরা
নিজের উপর সমস্ত জগৎ স্থাপিত করিতে চাহি, বর্ষাকালে সমস্ত জগতের মধ্যে সম্পূর্ণ
আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহি। ঋতুসংহারে কালিদাসের কাঁচা হাত বলিয়া বোধ হয়, তথাপি
তিনি এই কাব্যে বর্ষা ও বসন্তের প্রভেদ দেখাইয়াছেন তাহাতে তাঁহাকে কালিদাস বলিয়া
চিনা যায়। বসন্তের উপসংহারে তিনি বলেন—
মলয়পবনবিদ্ধঃ
কোকিলেনাভিরম্যো সুরভিমধুনিষেকাল্লগন্ধপ্রবন্ধঃ। বিবিধমধূপযূথৈর্বেষ্ট্যমানঃ সমন্তাদ্ ভবতু তব বসন্তঃ শ্রেষ্ঠকালঃ সুখায়॥ |
|
কবি আশীর্বাদ করিতেছেন, বাহ্যসৌন্দর্য্যবিশিষ্ট বসন্তকাল তোমাকে সুখ প্রদান করুক। বর্ষায় কবি আশীর্বাদ করিতেছেন— | |
বহুগুণরমণীয়ো যোষিতাং
চিত্তহারী তরুবিটপলতানাং বান্ধবো নির্ব্বিকারঃ। জলদসময় এষ প্রাণিনাং প্রাণহেতুর্- দিশতু তব হিতানি প্রায়শো বাঞ্ছিতানি॥ |
|
বর্ষাকাল তোমাকে তোমার বাঞ্ছিত হিত অর্পণ করুক। বর্ষাকাল ত সুখের জন্য নহে, ইহা মঙ্গলের জন্য। বর্ষাকালে উপভোগের বাসনা হয় না, “স্বয়ং”-এর মধ্যে একটা অভাব অনুভব হয়, একটা অনির্দেশ্য বাঞ্ছা জন্মে। |
প্রাতঃকাল ও সন্ধ্যাকাল
উপরে বসন্ত ও বর্ষার যে প্রভেদ ব্যাখ্যা করিলাম, প্রভাত ও
সন্ধ্যার সম্বন্ধেও তাহা অনেক পরিমাণে খাটে।
প্রভাতে আমি হারাইয়া যাই, সন্ধ্যাকালে আমি ব্যতীত বাকী আর
সমস্তই হারাইয়া যায়। প্রভাতে আমি শত সহস্র মনুষ্যের মধ্যে একজন; তখন জগতের যন্ত্রের
কাজ আমি সমস্তই দেখিতে পাই; বুঝিতে পারি আমিও সেই যন্ত্র-চালিত একটি জীব মাত্র; যে
মহা নিয়মে সূর্য উঠিয়াছে, ফুল ফুটিয়াছে, জনকোলাহল জাগিয়াছে, আমিও সেই নিয়মে
জাগিয়াছি, কার্য্যক্ষেত্রের দিকে ধাবিত হইতেছি; আমিও কোলাহলসমুদ্রের একটি তরঙ্গ,
চারি দিকে লক্ষ লক্ষ তরঙ্গ যে নিয়মে উঠিতেছে পড়িতেছে, আমিও সেই নিয়মে উঠিতেছি
পড়িতেছি। সন্ধ্যাকালে জগতের কল-কারখানা দেখিতে পাই না, এই জন্য নিজেকে জগতের অধীন
বলিয়া মনে হয় না; মনে হয় আমি স্বতন্ত্র, মনে হয় আমিই জগৎ।
প্রাতঃকালে জগতের আমি, সন্ধ্যাকালে আমার জগৎ। প্রাতঃকালে আমি
সৃষ্ট, সন্ধ্যাকালে আমি স্রষ্টা। প্রাতঃকালে আমা হইতে গণনা আরম্ভ হইয়া জগতে গিয়া
শেষ হয়, আর সন্ধ্যাকালে অতি দূর জগৎ হইতে গণনা আরম্ভ হইয়া আমাতে আসিয়া শেষ হয়। তখন
আমিই জগতের পরিণাম, জগতের উপসংহার, জগতের পঞ্চমাঙ্ক। জগতের শোকান্ত বা মিলনান্ত
নাটক আমাতে আসিয়াই তাহার সমস্ত উপাখ্যান কেন্দ্রীভূত করিয়াছে। আমার পরেই যেন সে
নাটকের যবনিকাপতন। প্রাতঃকালে যে ব্যক্তি নাটকের সাধারণ পাত্রগণের মধ্যে একজন ছিল,
সন্ধ্যাকালে সেই তাহার নায়ক হইয়া উঠে। প্রভাতে জগৎ অন্ধকারকে স্তব্ধতাকে ও সেই
সঙ্গে "আমি"কে পরাজিত করিয়া তাহার নিজের রাজ্য পুনরায় অধিকার করিয়া লয়। এইরূপে
প্রাতঃকালে জগৎ রাজা হয় ও সন্ধ্যাকালে আমি রাজা হই। প্রাতঃকালের আলোকে "আমি"
মিশাইয়া যাই ও সন্ধ্যাকালের অন্ধকারে জগৎ মিশাইয়া যায়। প্রাতঃকাল চারিদিক উদঘাটন
করিতে করিতে আমাদের নিকট হইতে অতি দূরে চলিয়া যায় ও সন্ধ্যাকাল চারি দিক রুদ্ধ
করিতে করিতে আমাদের অতি কাছে অসিয়া দাঁড়ায়। এক কথায়, প্রভাতে আমি জগৎ-রচনার
কর্মকারক ও সন্ধ্যাকালে আমি জগৎ-রচনার কর্ত্তাকারক। প্রভাতে "আমি"-নামক সর্বনাম
শব্দটি প্রথম পুরুষ, সন্ধ্যাবেলায় সে উত্তম পুরুষ।